ধরুন, হঠাৎ একদিন আপনি এক কোটি টাকার লটারি জিতলেন। কেমন লাগবে তখন? খুশিতে ফেটে পড়বেন? ভাববেন, জীবনে তো আর কোনো সমস্যাই থাকলো না। এখন থেকে কেবল সুখ আর সুখ।
কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন এই সুখানুভূতি ঠিক কতদিন থাকবে? কিংবা উলটো একটা দৃশ্যপট চিন্তা করুন। আপনার এক বন্ধু পানিতে ডুবে মারা গেল। সংবাদটা শুনে আপনি খুবই শোকাহত হলেন। ভাবলেন, দুনিয়া থেকে ভালো মানুষগুলোই আগে চলে যায়। মন্দ মানুষগুলো রয়ে যায়। বন্ধুর মৃত্যুর শোকে আপনি নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। অফিস যাওয়া, বিয়ে, জন্মদিন, সিনামা দেখা ইত্যাদি সব রকম পার্থিব ক্রিয়াকলাপ আপনার কাছে অসহ্য আর অর্থহীন মনে হতে লাগলো। এখন ভাবুন, এই দুঃখের অনুভূতি আপনার ঠিক কতদিন থাকবে?
এসব নিয়ে আপনি ভেবেছেন কিনা জানি না। তবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ ড্যান গিলবার্ট কিন্তু ভেবেছেন। তার মূল প্রশ্ন ছিল, আমরা আমাদের আবেগ অনুভূতির পূর্বাভাস দিতে পারি কিনা। কোটি টাকার লটারি জয় আমাদেরকে বাকি জীবনের জন্য সুখিতম মানুষে পরিণত করবে কিনা। ব্যাপারটা হাতে-কলমে যাচাই করার জন্য তিনি একদল লটারি জয়ী মানুষের উপর গবেষণা করেছেন।
তিনি দেখেছেন, লটারি জয় যে সুখটা নিয়ে আসে, কয়েক মাসের মধ্যেই সেটা ফিকে হয়ে যায়। মোটা অংকের চেকখানা পাবার কিছুদিনের মধ্যেই আপনি আগে যে মানুষটা ছিলেন, সেই মানুষটায় ফিরে যাবেন। গড়পড়তা সুখি মানুষ হলে সেই গড়পড়তা সুখেই ফিরে যাবেন। অত্যাধিক সুখি মানুষে পরিণত হবেন না। অসুখী হলে লটারির টাকা সেই অসুখকে কিছুদিনের জন্য ধামাচাপা দেবে। কিন্তু কিছুদিন পরই আবার যেই কে সেই।
আমার এক বন্ধু। ঢাকায় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। অনেক টাকা বেতন। সাথে বছর শেষে বোনাস। বিলাসী জীবনযাপন করার পরেও বহু টাকা বেঁচে যায়। সেই টাকা দিয়ে সে ঢাকার বাইরে কিছু জমিজমা কিনে একটা বাংলোবাড়ি করে। ঢাকায় থাকতে তার আর ভালো লাগছে না। এই শহরের মানুষ, বাতাস সবকিছুতেই বিষিয়ে উঠেছে। কাজেই, এক শুভদিনে সে ঢাকার পাট চুকিয়ে সেই বাংলোবাড়িতে গিয়ে উঠে। বাড়ির সামনে চমৎকার সাবেকি ধাঁচের উঠোন। উঠোনের পাশে দেশি গাছগাছড়ার বাগান। বাগানের পর একটা সুইমিং পুল। তার ইচ্ছে ছিল পুকুর কাটানোর। আজকাল নাকি কেউ পুকুর কাটায় না। তাই সুইমিং পুলই সই।
প্রথম কয়েক মাস ভালোই যাচ্ছিল। সকাল সন্ধ্যা ঢাকা আপ-ডাউন করে শুধু অফিসের কাজে। সন্ধ্যেয় বাড়ি এসে নিজেকে সময় দেয়। নিরিবিলি ও প্রকৃতির কাছাকাছি- এই ব্যাপারগুলো সে খুবই উপভোগ করে। আমার এই বন্ধুটি ছিল তখন পৃথিবীর সুখিতম মানুষ। সদ্য বিবাহিত দম্পতিরাও এতো সুখে থাকে না।
দিন যায়। তার এই সুখও একদিন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। মাস ছয় পর সে আগের চেয়েও অসুখী আর খিটখিটে মানুষে পরিণত হয়। হলোটা কী? এই বাংলোবাড়ি তো ছিল তার স্বপ্ন। এর জন্য তার এত ওভারটাইম করা, এতো ত্যাগ। আসলে বাংলোবাড়িটি তাকে যে পরিমাণ সুখ দিতে পারতো, তা দিয়ে দিয়েছে। বাংলোবাড়ির উপযোগ তার কাছে শেষ হয়ে গেছে। যে কারণে আজকাল সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে সেই বাংলোবাড়ি আর এক রুমের মেসবাড়ির মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না।
তার উপর আগে থাকতো অফিসের একদম কাছেই। এখন দুই ঘণ্টা দুই ঘণ্টা চার ঘণ্টা চলে যায় আসা যাওয়া করতে করতে। এই যন্ত্রণা আর ভালো লাগে না। যা ছিল একদিন স্বপ্ন, তা-ই যখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে, তখন দেখা গেল সেটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
জীবনের আরো অনেক ক্ষেত্রেই এই চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটে। আপনি একটা প্রমোশন পেলেন, আপনার খুব ভালো লাগলো, এতোদনের পরিশ্রম, নেটওয়ার্কিং সফল হলো। মাস তিনেক পর আপনি যে অসুখী, সব কিছু নিয়ে অভিযোগ করা মানুষ ছিলেন, সেই মানুষে আবার ফিরে গেলেন। আপনি নতুন মডেলের গাড়ি কিনলেন। সেই একই অবস্থা। এই ঘটনাকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘হেডোনিক ট্রেডমিল’। আমরা পরিশ্রম করি, বেশি বেশি টাকা রোজগার করি। সেই টাকা দিয়ে নতুন নতুন সুন্দর সুন্দর জিনিস কিনি। তাও আমরা সুখ পাই না। আমরা ট্রেডমিলে দৌড়াই বটে, কিন্তু যে জন্যে দৌড়াই, সেটাই পাই না।
নিজের জীবনের একটা উদাহরণ দিতে পারি। আমেরিকার অধিকাংশ শহরে গাড়ি ছাড়া চলা খুব মুশকিল। নিউয়র্কের মতো দু-একটা শহর ছাড়া অন্য শহরগুলোতে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই। আমি যেখানে থাকি, মায়ামিতেও তাই। বাসগুলো সঠিক সময়ে আসে না। দূরে কোথাও যেতে হলে দু-তিনটা বাস পাল্টিয়ে যেতে হয়। উবার একটা অপশন বটে। তবে উবার ড্রাইভারদের একটা বড় অংশ ইংরেজি বোঝে না। ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশে তাদের বোঝাতে হয়, আমি সাদা রঙা শার্ট পরা। কিংবা লালরঙা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়ানো। মোদ্দাকথা, নিজের গাড়ি না থাকার হুজ্জত অনেক এখানে।
তখন ভাবতাম, গাড়ি কিনলে বুঝি সব সমস্যার সামাধান হয়ে যাবে। একদিন একটা পুরনো দেখে গাড়ি কিনলামও। কিছুদিন মনের ভেতর একটা আত্নপ্রসাদ অনুভব করলাম। যাক, এখন আর অন্যের কাছে রাইড চাইতে হবে না। নিজের একটা স্বাধীনতা এলো। কিছুদিনের মধ্যেই সেই স্বাধীনতার সাথে সাথী এলো দায়িত্ব আর দুশ্চিন্তা। গাড়ির স্টিয়ারিং ঠিকমত ঘোরে না। ব্রেক কষলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ একটা শব্দ করে। গাড়ি ঠিকঠাক করাতে বেরিয়ে গেল একগাদা টাকা। সাথে তেলের খরচ তো আছেই। বুঝলাম, আমি নিজেও খুব আলাদা কেউ নই। আর দশজনের মতই হেডোনিক ট্রেডমিলে আটকা পড়া মানুষ।
পজিটিভ ইফেক্টের কথা তো হলো, মুদ্রার অপর পিঠটা দেখি এবার। ধরা যাক, আপনার বড়সড় একটা অসুখ হলো। ডায়াবেটিক কিংবা স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি। এর মানে কি এই যে বাকি জীবন আপনার খুব দুঃখে কাটবে? কখনো প্রেমে ব্যর্থ হয়েছেন? ছ্যাঁকা খাবার পর এমনটা কি মনে হয়নি যে আপনার প্রাক্তনকে ছাড়া আপনি বাঁচবেন না? আপনার জীবনে হাসি, আনন্দ আর কখনোই ফিরে আসবে না? সেই আপনিই কি তিন-চার মাসের মধ্যেই নতুন কারো সাথে প্রেমে পড়েননি? সত্যি করে বলুন তো।
আসলে আমরা আমাদের আবেগের গভীরতা আর তীব্রতা দুটোকেই অনেক বেশি করে আঁচ করি। আবেগ অনুভূতি সংক্রান্ত পূর্বাভাষগুলো এজন্য খুব কমই সঠিক হয়। সবকিছু ভুল প্রমাণ করে আমরা কিছুদিনের মধ্যেই আবার যেই কে সেই হয়ে যাই। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। এতে লজ্জিত হবার কিছু নেই।
হেডোনিক ট্রেডমিল আসলে আমাদের কী শিক্ষা দেয়? এই শিক্ষাই দেয় যে, বস্তুগত সাফল্য আমাদের দীর্ঘস্থায়ী সুখ দিতে পারে না। গাড়ি, বাড়ি, প্রমোশন আমাদের সামান্য সময়ের জন্য ডোপামিন, সেরোটোনিনের নিঃসরণ দেয় শুধু। এটুকুই। দীর্ঘস্থায়ী সুখের জন্য আমাদের অন্য রাস্তা দেখতে হবে। নিজের ভালো লাগার কাজটুকু করতে হবে। তাতে যদি আয়-উন্নতি একটু কম হয়, তাও ভালো। পরিবার আর বন্ধুবান্ধবদের সময় দিতে হবে। এই রুদ্ধশ্বাস পৃথিবীতে হেডোনিক ট্রেডমিল থেকে বের হবার উপায় আপাতত এগুলোই।
মূল: Hedonic Treadmill, The art of thinking clearly, Rolf Dobelli
ফিচার ইমেজ- VideoBlocks