১
মধ্যযুগীয় ইউরোপে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ কবরই পুনঃখননের শিকার হয়েছিল। এককালে মনে করা হতো, কবর চোরেরাই মূলত এজন্য দায়ী। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এর পেছনে কখনো কখনো জড়িত ছিল গোটা একটি জাতিই! অস্ট্রিয়ার Brunn am Gebirge সমাধিস্থলে প্রায় ৪২টির মতো কবর ছিল। সেখানে মূলত ৬ষ্ঠ শতকের জার্মানিক গোত্র ল্যাঙ্গোবার্ডের সদস্যরাই চিরনিদ্রায় শায়িত হতো।
সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণায় দেখা গেছে, সেই কবরস্থানের একটি বাদে বাকি সব কবরই পুনঃখননের শিকার হয়েছিল। কখনো কখনো কবর থেকে খুলি উধাও হয়ে যেত, কখনো আবার তাতে যোগ হতো আরেকটি খুলি! সেই সাথে কোনোকিছু দিয়ে হাড়গুলোও নাড়াচাড়া করা হতো। কেন যে এসব করা হতো সে সম্পর্কে অবশ্য পুরোপুরি নিশ্চিত নন ইতিহাসবিদগণ। তবে ধারণা করা হয়, প্রিয়জনদের স্মৃতি আকড়ে ধরে রাখতেই তারা সেসব দেহাবশেষ সেখান থেকে তুলে নিত। এজন্য সেই কবরস্থানে থাকা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কঙ্কালেরই খুলি খুঁজে পাওয়া যায় নি।
৭ম-৮ম শতকে ইংল্যান্ডের ২য় উইনাল কবরস্থানের কথা দিয়েই শেষ করা যাক। সেখানে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলো ছিল বাঁধা, খুলি ছিন্ন করা, হাড়ের সংযোগস্থলগুলো ছিল বাঁকানো এবং একজনের কঙ্কালের সাথে আরেকজনের কঙ্কালের অংশবিশেষও রাখা ছিল কোনো কোনো ক্ষেত্রে। প্রথম প্রথম মনে করা হতো, তাদের শেষকৃত্যানুষ্ঠান বুঝি অদ্ভুতভাবে করা হয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীকালে মনে করা হয়, মৃতদের আত্মারা যেন জীবিতদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্যই জীবিতরা এমনটা করেছিল।
২
মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে বিয়ের ব্যাপারটা ছিল বেশ সোজা। শুধুমাত্র পাত্র-পাত্রী রাজি থাকলেই হতো। যদি ছেলের বয়স কমপক্ষে ১৪ আর মেয়ের বয়স কমপক্ষে ১২ হতো, তাহলে তারা দুজন রাজি থাকলেই তাদের বিয়ে হয়ে যেত। সেখানে পরিবারের সম্মতির যেমন প্রয়োজন ছিল না, তেমনই দরকার পড়তো না কোনো ধর্মযাজকের উপস্থিতির।
ফলে বিয়ের মতো পবিত্র একটি সম্পর্ককে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে অনেকে। কারো সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার অর্থই ছিলো তার সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়া। একসময় সমাজের এমন অনাচারে অতিষ্ট হয়ে গির্জা থেকে ঘোষণা আসে যে, এসব পাপাচার বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে কেবলমাত্র বিয়ের লোভ দেখিয়ে তরুণীদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা থেকে বিরত থাকতেও নির্দেশ দেয়া হয় ইংল্যান্ডের তরুণ সমাজকে। আজকের দিনে যেখানে অনেক বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলা আদালত পর্যন্ত গড়ায়, সেখানে তৎকালীন ইংল্যান্ডে দুজন নারী-পুরুষের মাঝে আসলেই যে বিয়ে হয়েছে সেটা প্রমাণ করতে তারা আদালতের দ্বারস্থ হতো!
যদি দুজন নারী-পুরুষ কোনো সাক্ষী না রেখে একে অপরকে বিয়ে করতো, তাহলে তাদের বিয়ের সপক্ষে বক্তব্য তেমন জোরালো ভিত্তি পেত না। এজন্য এরপর থেকে নিয়ম করা হয় যে, বিয়ের সময় অন্তত একজন ধর্মযাজককে উপস্থিত থাকতেই হবে।
৩
প্রাচীন পৃথিবীতে কোনো দম্পতির সন্তান না হলে সকল দোষ গিয়ে পড়তো স্ত্রীর ঘাড়ে। ইংল্যান্ডও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। তবে ১৩ শতকের বইগুলো ঘাঁটালে দেখা যায়, তৎকালে সন্তানহীনতার জন্য পুরুষদেরও দায়ী মনে করা শুরু হয়েছিল এবং এ সমস্যা নিরসনের জন্য কী করা যায় তা নিয়েও আলাপচারিতা হতো।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে প্রকৃতপক্ষে কে সন্তান জন্মদানে অক্ষম তা বুঝতে অদ্ভুত উপায়ের দ্বারস্থ হতেন তৎকালীন চিকিৎসকেরা। এজন্য তাদের দুজনকেই তুষপূর্ণ একটি পাত্রে মূত্রত্যাগ করতে হতো। এরপর সেই পাত্রটি ৯ দিন বন্ধ করে রেখে দেখা হতো তাতে কোনো পোকা জন্মায় কিনা। সমস্যা যারই থাকুক না কেন, এটা থেকে পরিত্রাণের জন্য অনুসৃত পন্থা কিন্তু কম বিস্ময়কর ছিলো না। এজন্য শূকরের অণ্ডকোষ শুকিয়ে চূর্ণ করে এরপর সেটা ওয়াইনের সাথে মিশিয়ে পরপর ৩ দিন পান করতে হতো!
৪
মধ্যযুগের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডে কোনো ব্যক্তি যদি ৫০ বছর বয়সে পদার্পন করতো, তাহলেই তাকে বৃদ্ধ বলে ভাবা শুরু হতো। এককালে মনে করা হতো, সেই সময়ের বৃদ্ধরা বুঝি তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের কারণে সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকতো। কিন্তু পরবর্তী সময়ের গবেষণায় জানা যায় যে, এমন ধারণা একেবারেই ঠিক ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন ইংল্যান্ডে অবসর নেয়ার ধারণাটাই প্রচলিত ছিল না। একজন মানুষ, হোক না তিনি বয়স্ক, কাজের মাধ্যমেই সমাজে তার টিকে থাকা নিশ্চিত করতে হতো। যোদ্ধা, শ্রমিক, গির্জার পুরোহিত কিংবা নেতা- সাধারণত এমন সব পেশার সাথেই জড়িত থাকতে দেখা যেত তাদের।
৫
একটা সময় পৃথিবীব্যাপী রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো রাজ্যের পরিধি বিস্তারের লক্ষ্যে। সেই সময় আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। আজকের দিনে এক দেশ অবশ্য অন্য দেশে হামলা চালায় আরো সুচতুর কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে। সে কথা নাহয় অন্য কোনো দিন আলোচনার জন্যই তোলা থাকুক।
মধ্যযুগে ইউরোপের মানুষজনের মৃত্যুর পেছনে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল নিয়মিত লেগে থাকা সেসব যুদ্ধ-বিগ্রহ। সেই সাথে এখনকার মতো নানা ধরনের বিবাদ এবং দুর্ঘটনাতেও তাদের মৃত্যু ঘটতো। ২০১৫ সালে গবেষকগণ ওয়ারউইকশায়ার, লন্ডন ও বেডফোর্ডশায়ারের বেশ কয়েকজন মধ্যযুগীয় করোনারের মৃত্যু সংক্রান্ত রিপোর্ট যাচাই-বাছাই করা শুরু করেন। সেখান থেকে তারা সেই সময়কার মৃত্যুর নানা ধরনের কারণ খুঁজে পান, যা ছিল আসলেই চমকে দেয়ার মতো।
শূকরের হাতে মৃত্যুর ঘটনা মধ্যযুগীয় ইউরোপে মাঝে মাঝেই ঘটতো। ১৩২২ সালের একটি ঘটনার কথাই ধরা যাক। সেই বছর জোহানা ডি ইরলন্ড নামের দু’মাস বয়সী এক বাচ্চা মেয়ে তার মাথায় শূকরীর কামড়ে মারা যায়। ১৩৯৪ সালে আরেকজন লোকও শূকরের আক্রমণে মারা গিয়েছিল। এছাড়া গরুর গুঁতা খেয়েও মৃত্যুর কথা শোনা যায়। তৎকালে পানিতে ডুবে মৃত্যু ছিল বেশ সাধারণ একটি ঘটনা। মানুষজন ডোবা, নদী ও কুয়ার পানিতে ডুবে অনেক মৃত্যুবরণ করতো।
আজকের মতো তখনকার দিনেও বিবাদে জড়িয়ে খুনোখুনি বেশ সাধারণ একটি ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল। সেই সাথে গাছ কিংবা কোনো ভবনের উপর থেকে পড়ে যাওয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে মৃত্যুও ঘটতো।
৬
তৎকালীন লন্ডনের অবস্থা ছিল বেশ ভয়াবহ। জায়গাটিকে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ স্থান বলেও মনে করতো অনেকে। প্রত্নতত্ত্ববিদ্গণ ১০৫০-১৫৫০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে লন্ডনের ৬টি কবরস্থান থেকে সমাজের সকল শ্রেণীর অন্তর্গত ৩৯৯ জন মানুষের মাথার খুলি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। দেখা গিয়েছে, এদের মাঝে শতকরা ৭ ভাগই কোনো না কোনো বড় ধরনের আঘাতের শিকার হয়েছিল। সেখানে সমাজের খেটে খাওয়া শ্রেণীর ২৬-৩৫ বছর বয়সী পুরুষদের সংখ্যাই ছিল বেশি। সেই সাথে এই শ্রেণীর মানুষেরাই যে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হতো, সেটাও বেরিয়ে এসেছিল এ গবেষণার ফলাফল হিসেবে।
এখানেও তৎকালীন করোনারদের রিপোর্টগুলো বেশ কাজে এসেছিল। দেখা গিয়েছে, ছুটির দিন রবিবার সন্ধ্যাতে অপঘাতে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটতো। কারণ সেদিন সন্ধ্যায় সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরা পানশালাগুলোতে ভিড় জমাতো। সেখানেই মাতাল হয়ে বিবাদে লিপ্ত হবার পর কখনো কখনো খুনোখুনির মধ্য দিয়ে সেই বিবাদের মীমাংসা হতো।
৭
মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় বিড়ালগুলোকে বেশ দুর্ভাগাই বলতে হবে। কারণ তাদের লোম নিয়ে ব্যবসা পৌঁছে গিয়েছিল স্পেন পর্যন্ত। ঘরোয়া এবং বুনো- উভয় ধরনের বেড়ালই এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো।
আজ থেকে প্রায় ১,০০০ বছর আগে ইউরোপে বসবাস করতো এল বোর্ডেলেট কৃষক সম্প্রদায়। তারা মাটিতে গর্ত করে মূলত তাদের ফসল জমা করে রাখতো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তাদের এমন কিছু গর্তও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, যেখানে ছিল আনুমানিক ৯০০ বিড়ালের হাড়গোড়। সবগুলো হাড় একই গর্তে পাওয়া গিয়েছিল। বিড়ালগুলো ৯-২০ মাস বয়সী ছিল। বিড়ালের লোম দিয়ে কোট বানানোর পাশাপাশি বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানেও প্রাণীগুলোকে বলি দেয়ার রীতি চালু ছিল বলে মনে করেন গবেষকগণ।
৮
আজকের দিনে ডোরাকাটা ডিজাইনের পোশাক পরে কেউ ঘর থেকে বেরোলে তাকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। এতকিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়? কিন্তু মধ্যযুগীয় ইউরোপে ব্যাপারটা ঠিক এমন ছিল না। তৎকালে ডোরাকাটা ডিজাইনের পোশাক পরে ঘর থেকে বের হওয়া আর ওপারের টিকিট জোগাড় করা ছিল একই কথা। ১৩১০ সালে শুধুমাত্র এ ডিজাইনের পোশাক ব্যবহারের কারণে প্রাণটি খোয়াতে হয়েছিল ফরাসি এক মুচির।
তখনকার সমাজে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে, ডোরাকাটা ডিজাইনের জামা-কাপড় পরবে কেবলমাত্র পতিতা, জল্লাদ, কুষ্ঠরোগী, প্রচলিত মতের বিরুদ্ধাচারী এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্লাউনরা। এমনকি অক্ষম, জারজ সন্তান, ইহুদি ও আফ্রিকানদেরও এ পোশাক দেয়া হতো।
তারা মনে করতো, ডোরাকাটা ডিজাইনের জামা-কাপড়ের সাথে বুঝি শয়তানের কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কিন্তু কীভাবে যে এ ধারণা তাদের মাঝে এসেছিল সেই সম্পর্কে ইতিহাসবিদগণ পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেন নি। শেষপর্যন্ত ১৮ শতকের দিকে এসে এ কুসংস্কার থেকে মুক্তি লাভ করে ইউরোপীয় সমাজ ব্যবস্থা।
ফিচার ইমেজ: All About History