সবসময় র্যাপার হিসেবে ভবিষ্যতের পথিকৃৎ হয়ে থাকবেন যারা তেমনই একজন হলেন টুপ্যাক শাকুর। ১৯৯৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন টুপ্যাক শাকুর। হত্যা করা হয় তাকে। কিন্তু কীভাবে এবং কেন এত কম বয়সে মারা যেতে হল অসম্ভব প্রতিভাবান এই শিল্পীকে? রহস্য উদঘাটিত হয়নি বটে, তবে চেষ্টা খুব একটা কম করা হয়নি। চলুন, আজ সেই রহস্যের সাথে পরিচিত হয়ে নেওয়া যাক।
১৯৭১ সালের ১৬ই জুন সাবেক ব্ল্যাক প্যান্থার কর্মী আফেনি শাকুরের ঘরে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। টুপ্যাক বা ২(টু)প্যাক হিসেবেই পরিচিত হয়ে ওঠে এই সন্তান। চেষ্টা ছিল র্যাপার হিসেবে কাজ করার। সেই চেষ্টা বিফলে যায়নি। নিউ ইয়র্কের হারলেম থেকে আসা এই র্যাপার খুব সহজেই কেড়ে নেয় সবার মনোযোগ। নিজের ‘অল আইজ অন মি’ এবং বাকি কাজগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বেশি বিক্রিত কাজে পরিণত হয়। ৭৫ মিলিয়ন রেকর্ড বিক্রি করার মাধ্যমে একের পর এক, নিয়মিতভাবে সেরা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে থাকেন এই গায়ক। কাজ করেন নতুন সব মানুষের সাথে। সেই সাথে বিভিন্ন ঝামেলার সাথেও নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
নটোরিয়াস বি.আই.জি বা বিগি স্মলস নামে একজন র্যাপারের সাথে শখ্যতা গড়ে ওঠে টুপ্যাকের। র্যাপার হিসেবে ভালো ছিলেন বিগি স্মলসও। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যায় ১৯৯৪ সালে। সেই বছর নিউ ইয়র্ক স্টুডিওর সামনে টুপ্যাকের উপরে হামলা হয়। তাকে গুলি করা হয় এবং সেই সাথে চলে ছিনতাইয়ের চেষ্টাও। এই পুরো ব্যাপারটির জন্য বিগি স্মলসের দিকে আঙ্গুল তাক করেন টুপ্যাক। বিগি তখন একই স্থানে একটু পাশেই রেকর্ড করছিলেন। বিগির সাথে লেবেলসের প্রতিষ্ঠাতা পি ডিডিকেও অভিযুক্ত করেন টুপ্যাক। তবে এই দুজনের কেউই হামলা কিংবা গুলি করার দায় স্বীকার করেননি। পরবর্তীতে মারা যান টুপ্যাক। আর তার ছয় মাস পর মারা যান বিগিও। গুলি করে খুন করা হয় তাকে। এই হত্যাকান্ড এবং হত্যাকারী সম্পর্কেও জানা যায়নি আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে। তবে টুপ্যাকের মৃত্যুর পেছনে বিগির হাত ছিল বলে মনে করেন অনেকে। তবে এটি কেবল একমাত্র কিছু নয়। এই ঘটনাটির সাথে জড়িয়ে আছে এমন আরো অনেক আন্দাজ, মনে করার মতো ব্যাপার, যেগুলোর কোনো প্রমাণ নেই।
টুপ্যাকের মৃত্যু
১৯৯৬ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর; ক্লাব ৬৬২ এর দিকে বিএমডব্লিউ গাড়িতে চড়ে যাচ্ছিলেন টুপ্যাক। আর সেসময় তাকে গুলি করা হয়। গাড়ি চালাচ্ছিলেন স্যুজ নাইট। সামনের আসনেই বসেছিলেন টুপ্যাক। খুনী সাদা রঙয়ের ক্যাডিলাকে চড়ে টুপ্যাকের গাড়ির কাছে চলে আসে। ঘড়িতে তখন ঠিক ১১ টা বেজে ১৫ মিনিট। মোট চারবার গুলি করা হয় টুপ্যাককে। বুক, বাহু এবং উরুতে গুলি লাগে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার ছয়দিন পর মারা যান এই তারকা। এই ঘটনার কয়েক ঘন্টা আগে এমজিএম গ্র্যান্ড ক্যাসিনোতে মাইক টাইসন এবং ব্রুস সেলডনের মুষ্টিযুদ্ধ দেখে ফেরার পথে লবিতে মারামারির ঘটনা ঘটে টুপ্যাকের অরল্যান্ডো ‘বেবি লেন’ অ্যান্ডারসনের সাথে। প্রথম ঘুষিটা অবশ্য গিয়েছিল লস অ্যাঞ্জেলসের দল দ্য ব্লাডসের সমর্থক টুপ্যাকের পক্ষ থেকেই। পরবর্তীতে টুপ্যাকের মৃত্যুর সাথে এই মারারমারির কোনো যোগাযোগ আছে কী? সেটা নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। অ্যান্ডারসনের জন্য ব্যাপারটি নতুন কিছু ছিল না। এর আগেও টুপ্যাকের সাথে জড়িত মানুষ এবং টুপ্যাকের সম্পদ ও অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে ক্ষত করতে চেয়েছে সে। ফলে কে টুপ্যাককে মেরেছে সেটার সুরাহা করা সম্ভব হয়নি।
টুপ্যাক এবং ‘অল আইজ অন মি’
২০১৭ সালের ৩০শে জুন; টুপ্যাকের মৃত্যুর বিশতম বছর উপলক্ষ্যে তার জীবন নিয়ে বায়োপিক ‘অল আইজ অন মি’ নির্মাণ করা হয় এই বছরে। একেবারে নিতান্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে কীভাবে খ্যাতি ও সম্পদ পরিপূর্ণ একটি অবস্থানে এত অল্প বয়সে এসেছিলেন টুপ্যাক তা নিয়ে তৈরি হয় এটি, যার নামকরণ করা হয় শিল্পীর সেরা অ্যালবামের নামে। টাকা, গ্যাং আর লোভী প্রযোজকদের দেখানো হয়েছে এই বায়োপিকে। তবে টুপ্যাকের জীবনে কোমল কোনো অংশও যে ছিল সেটাও ফুটিয়ে তোলা হয় এতে। টুপ্যাক কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন। নারীদের জন্য কবিতা রচনা করেছিলেন তিনি। তার এই অজানা দিকগুলোকেও আনা হয় অল আইজ অন মি বায়োপিকে।
টুপ্যাক- জীবিত নাকি মৃত?
টুপ্যাক মারা গিয়েছেন। অন্তত এখনো পর্যন্ত পড়লে সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে অনেকেই এখনো ভেবে থাকেন টুপ্যাক আসলে মরেননি। তিনি বেঁচে আছেন। ২০১২ সালে গায়িকা রিহানার সাথে টুপ্যাকের একটি ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই তখন টুপ্যাক জীবিত নাকি মৃত সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। অনেকে অবশ্য ছবিটিকে কেবল ফটোশপের কারসাজি বলে চালিয়ে দেয়। এছাড়াও গুজব আছে যে, টুপ্যাক নিজের মৃত্যু সম্পর্কে মিথ্যে কথা বলে কিউবাতে বাস করছেন এখনো। বিশেষ করে, টুপ্যাকের কেস নিয়ে কাজ করা সাবেক পুলিশ অফিসার ডেভিড মায়ার্স যখন বলেন যে টুপ্যাক নিজের মিথ্যে মৃত্যুর জন্য তাকে ১.২ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিলেন, তখন প্রশ্নগুলো মাথাচড়া দিয়ে ওঠে বটে!
অনেকে আবার টুপ্যাকের মৃত্যুর পেছনে সিআইএর হাত আছে বলে দাবি করেন। ১৯৯৩ সালে টুপ্যাকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আসে। এতে করে ৪ বছরের বেশি সাজা দেওয়া হয় তাকে। এই ঘটনার সাথে টুপ্যাকের হারিয়ে যাওয়া বা মৃত্যুর সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন অনেকে। তবে কারণ যেটাই হোক না কেন, এখনো অব্দি টুপ্যাকের মৃত্যুর জন্য কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। আর সেটাই হয়ে দাড়িয়েছে আইনশৃঙ্খলা কর্মীদের অন্যতম বড় ব্যর্থতা। মৃত্যুর কিছুদিন পর পর্যন্ত পাশে একজন মানুষের আগ্নেয়াস্ত্র খুঁজে পাওয়া যায় বলে জানা যায় কাগজ থেকে। কিন্তু সেই সময় এই ব্যাপারে তেমন কোনো অনুসন্ধান করা হয়নি। পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া বন্দুক এবং টুপ্যাকের মৃত্যু হয়েছে যে গুলির মাধ্যমে- দুটোর মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অনেকে প্রায় নিশ্চিত যে এই বন্দুক এবং টুপ্যাকের হত্যাকারীর সাথে সম্পর্ক আছে। এই বন্দুকের ক্রেতাকে খুঁজতে গিয়ে ক্রিপ গ্যাঙয়ের সদস্য অব্দি পৌঁছে যায় পুলিশ। তবে ব্যাপারটা থেমে থাকে এই পর্যন্তই। ব্যাপারটি নিয়ে এর বেশি দূর এগোতে চায়নি কেউই।
টুপ্যাকের মা আফেনি শাকুর ২০১৬ সালে ৬৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছেলের হত্যাকারীকে দেখে যেতে চেয়েছিলেন তিনি, তার শাস্তি চেয়েছিলেন। তবে আইন সেটা করতে সক্ষম হয়নি। শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা, সবসময় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে কাজ করেছে পুলিশ। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। টুপ্যাক বেঁচে আছেন কিংবা মারা গিয়েছেন সেটা নিয়েই গুজব ছড়িয়েছে, মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু সত্যিকারের হত্যাকারী পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি পুলিশ। কিংবা পারলেও সেটা প্রকাশ করার মতো সাহস দেখাতে পারেনি। ইতিহাসে বিখ্যাত এক র্যাপারের মৃত্যু এভাবেই থেকে গেছে অমীমাংসিত।
ফিচার ইমেজ: Capital FM Kenya