চমত্কারভাবে চুল কেটে অনেকটাই বদলে ফেললেন নিজের গতানুগতিক বেশভূষা, ভাবলেন বিশেষ কাউকে চমকে দেবেন আজ। যথাসময়ে এ নতুন রূপে যদি তার সামনে গিয়ে দেখেন- আপনার এতদিনের চেনা সেই বিশেষ কেউ আপনাকে চিনলেনই না? তবে কি ইচ্ছাকৃত এ আচরণ? হতেও পারে কিংবা হয়তো মুদ্রার অপর পিঠ আপনার জন্য নিয়ে অপেক্ষা করছে অন্য কাহিনী! এবার চমকাবার পালা আপনার। সম্ভবত আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনী ‘প্রসোপ্যাগনোসিয়া’ (Prosopagnosia) রোগের ভুক্তভোগী- যে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি মানুষের চেহারা পড়তে পারে না, পারে না সেটি কল্পনায় বা মনে রাখতে। বলতে পারেন, এটি একপ্রকার দৃষ্টিহীনতা যা মানুষের অস্তিত্ব থেকে সরিয়ে নেয় মুখমণ্ডলীয় আলো। চলুন পাঠক জেনে আসি কষ্টদায়ী এই রোগটি সম্পর্কে।
প্রসোপ্যাগনোসিয়া কী?
প্রসোপ্যাগনোসিয়া একপ্রকার স্নায়বিক রোগ, যা হলে মানুষ মুখমণ্ডল শনাক্তকরণে অপারগ হয়। এই রোগটিকে মুখমণ্ডলীয় অন্ধত্বও বলা হয়। প্রসোপ্যাগনোসিয়া কথাটি এসেছে দুটি গ্রীক শব্দ থেকে যার অর্থ ‘মুখশ্রী’ এবং ‘অজ্ঞতা’। রোগের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে মানুষের লক্ষণসমূহ পরিবর্তিত হয়, যেমন- কিছু কিছু প্রসোপ্যাগনোসিয়ার রোগীর শুধুমাত্র পরিচিত মুখ চিনতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, কেউ কেউ অপরিচিত চেহারাগুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না, আবার কেউ কেউ মানুষের চেহারা এবং অন্য বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। কেউবা আয়নায় কিংবা ছবিতে নিজের চেহারাই নিজে চিনতে পারেন না। আবার এই সমস্যার সাথে সাথে অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য সমস্যা, যেমন- স্থান বা নিজের যানবাহন চিনতে অসুবিধা, মুখমণ্ডলীয় সঞ্চালন ও অভিব্যক্তি চেনার অসুবিধা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
প্রসোপ্যাগনোসিয়া কোনো স্মৃতিগত ভারসাম্যহীনতা বা স্মৃতিহারা হওয়া নয়, এটি নয় ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টিশক্তি কিংবা শেখার অপারগতাও। ধরে নেয়া হয়, প্রসোপ্যাগনোসিয়া মানব মস্তিষ্কের ডানপার্শ্বীয় ফুসিফর্ম গাইরাসের কোনো অস্বাভাবিকতা, ক্ষতিগ্রস্ততাজনিত কারণে হয়ে থাকে। ফুসিফর্ম গাইরাস হলো মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ একটি গোটানো অংশ, যা মুখমণ্ডলীয় ধারণা ও স্মৃতি নিয়ন্ত্রক স্নায়ুব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ে ভূমিকা রাখে।
স্ট্রোক, আঘাতজনিত মস্তিষ্কের জখম কিংবা কিছু কিছু স্নায়ুতান্ত্রিক রোগ থেকে প্রসোপ্যাগনোসিয়া হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি জন্ম থেকেই মানুষের শরীরে থেকে যায় কোনো প্রকার মস্তিষ্ক বিকৃতি ছাড়াই। জন্মগত প্রসোপ্যাগনোসিয়া বংশানুক্রমিকভাবে পরিবাহিত হয় এবং এতে বোঝা যায়, এটি কোনো ধরনের জেনেটিক মিউটেশন কিংবা জিনের অংশ মুছে যাবার কারণে হয়ে থাকে। আত্মমগ্নতা রোগ বা অটিজম এবং অ্যাসপার্জার্স সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে প্রায়ই কিছু কিছু প্রসোপ্যাগনোসিয়ার আলামত দেখা যায়। ধারণা করা হয়, এটি তাদের ত্রুটিপূর্ণ সামাজিক বিকাশের দরুণ হয়ে থাকে।
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যাদের এই মুখশ্রীর অন্ধত্বের কারণ মূলত স্ট্রোক কিংবা মস্তিষ্কজনিত আঘাত তাদেরকে পুনঃপুনঃ প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে নানান সূত্র ব্যবহার করে মানুষকে শনাক্ত করতে শেখানো সম্ভব।
প্রসোপ্যাগনোসিয়া রোগীর সামাজিক জীবন
প্রসোপ্যাগনোসিয়া শুধু মুখমণ্ডলীয় পরিচিতির অজ্ঞতাই নয়, নয় শুধু ব্যক্তিগত গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ সমস্যাও। প্রসোপ্যাগনোসিয়া থেকে সাংঘাতিক সামাজিক সমস্যা হতে পারে। প্রসোপ্যাগনোসিয়ার দরুণ নিজের পরিবার-পরিজন, আপনজন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব এমনকি নিজেকেও চিনতে সমস্যা হওয়ায় এটি জীবনকে অনেক কঠিন করে তোলে। এ রোগাক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ প্রায়ই মানুষ চেনার জন্য বিকল্প পন্থা অবলম্বন করেন। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই আসলের মতো অতটা কার্যকরী নয়।
প্রসোপ্যাগনোসিয়া রোগীর সোশ্যাল এংজাইটি ডিসঅর্ডার (সামাজিক ক্ষেত্রে সর্বদা উদ্বিগ্ন থাকার প্রবণতা) দেখা দিতে পারে। এ রোগীর কর্মক্ষেত্রে এবং নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। প্রসোপ্যাগনোসিয়া রোগীর জীবনে নেমে আসে ডিপ্রেশন বা হতাশার কালো ছায়া।
প্রসোপ্যাগনোসিয়ার ইতিহাস
প্রসোপ্যাগনোসিয়ার নিবন্ধনের শেকড় বেশ পুরনোই বলা চলে, তবে ১৯৪৭ সালে দুজন মানুষের ওপর করা বোডামারের রিপোর্টে তিনি এই রোগের লক্ষণসমূহের গভীর বর্ণনা দেন এবং এটি যে Agnosia থেকে পৃথক, সেটি উল্লেখ করেন। তিনিই এর নাম দেন ‘প্রসোপ্যাগনোসিয়া’ এবং তার হাত ধরেই শব্দটির আগমন। গ্রীক প্রসোপন (Prosopon) তথা মুখশ্রী এবং পরিচিতি বিভ্রাট বা চেনার অজ্ঞতা (Agonosia) থেকেই এই শব্দটি উদ্ভাবন করেন তিনি। সে সময়ের পর থেকে শতাধিক এ সংক্রান্ত ঘটনা ও ফলাফলযুক্ত নথিপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
বর্তমানে জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ব্র্যাড পিট দাবি করেন, তিনিও প্রসোপ্যাগনোসিয়ার শিকার। এই রোগের দরুণ তার মানুষ চেনা বা মনে রাখতে কষ্ট হবার পাশাপাশি অন্যান্য নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
প্রসোপ্যাগনোসিয়ার লক্ষণসমূহ
মানুষের চেহারা চিনতে অনেক সময়েই অনেকেরই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং এই প্রবণতা তাদের মধ্যেই বেশি দেখা যায় যাদের মানুষের নাম মনে রাখতে সমস্যা হয়। কিন্তু প্রসোপ্যাগনোসিয়া এসব দৈনন্দিন সাধারণ সমস্যাগুলোর থেকে আলাদা। প্রসোপ্যাগনোসিয়ার রোগীদের (Prosopagnosics) প্রায়ই এমন মানুষকেও চিনতে সমস্যা হয়, যাদের সাথে ইতোপূর্বেও অসংখ্যবার দেখা হয়েছে। রোগের লক্ষণ তীব্রতর হয়ে গেলে প্রসোপ্যাগনোসিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিরা হৃদ্যতাপূর্ণ সময় কাটানো মানুষ এমনকি তাদের জীবনসঙ্গী ও সন্তানদেরও চিনতে ব্যর্থ হন।
প্রসোপ্যাগনোসিয়ার দৃশ্যমান লক্ষণগুলোর একটি হলো মুখমণ্ডলীয় ব্যতিরেকে অন্যান্য শারীরিক তথ্যাদির ওপর নির্ভর করে মানুষ চিনে নেয়া। এসব তথ্য হতে পারে চুল, চলাফেরার ধরন, পোশাক-আশাক, কণ্ঠস্বর এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য। এমনকি এ রোগে আক্রান্তরা কোনো পরিচিত ব্যক্তির মুখশ্রী কল্পনা পর্যন্ত করতে পারে না। পাশাপাশি প্রসোপ্যাগনোসিয়ার রোগীদের একটি খুবই প্রচলিত অভিযোগ হলো তাদের টেলিভিশনে প্রচারিত নাটক বা সিনেমার ঘটনাপ্রবাহ ও কাহিনী বুঝতে সমস্যা হয়, কেননা রোগের দরুন তারা কাহিনীর চরিত্রগুলোকে সঠিকভাবে চিনতে না পারায় কীভাবে কী হচ্ছে তা ঠাওর করে উঠতে পারেন না।
মুখমণ্ডলীয় এই অন্ধত্ব নির্ণয় করার জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এবং এই পরীক্ষালব্ধ ফলাফল স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের সাথে তুলনা করে জানা যায় পরীক্ষিত ব্যক্তির প্রসোপ্যাগনোসিয়া রোগ হয়েছে কিনা।
প্রসোপ্যাগনোসিয়ার কারণ
কিছুদিন আগে পর্যন্তও ভাবা হতো খুব কম মানুষই প্রসোপ্যাগনোসিয়ার ভুক্তভোগী। তবে সংখ্যাটা নেহায়েতই অল্প নয়। পূর্বে স্নায়বিক হানিজনিত কারণে (সাধারণত স্ট্রোক কিংবা মাথার আঘাত) যাদের এ রোগ হয়েছে, তাদের ওপরই পর্যবেক্ষণ চালানো হয়েছে এবং এর মধ্যে গুটিকতক ঘটনা বিংশ শতকে লিখিত আকারে লিপিবদ্ধও হয়েছে। কিন্তু ইদানীং এটি পরিষ্কারভাবে জানা গেছে যে, কোনো ধরনের স্নায়ুতান্ত্রিক হানি ব্যতীতও প্রসোপ্যাগনোসিয়া হতে পারে। এই ধরনের ক্ষেত্রে জন্মগতভাবে কিংবা ক্রমবর্ধমান আকারে এই সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। তাই স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞান ঠিকভাবে কাজ করলেও এমন মানুষের মধ্যে চেহারা চেনার প্রক্রিয়ায় অসফল হবার ঘটনা দেখা যায়। যাদের এই সমস্যা ক্রমান্বয়ে তৈরি হতে থাকে তাদের ক্ষেত্রে প্রায়ই জন্মগতভাবে কিংবা জীবনের সিংহভাগ জুড়েই এই সমস্যার উপস্থিতি দেখা যায়।
আধুনিক তথ্যমতে, খুব সম্ভবত এই রোগের পেছনে জিনগত প্রভাব বিদ্যমান এবং অনেক রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাদের অন্তত একজন নিকটাত্মীয় এই রোগে আক্রান্ত। কারণের ওপর ভিত্তি করেই প্রসোপ্যাগনোসিয়া নিম্নলিখিত ভাগে বিভক্ত:
অর্জিত প্রসোপ্যাগনোসিয়া (Acquired Prosopagnosia)
এই ধরনের প্রসোপ্যাগনোসিয়ার রোগীদের শুরুতে স্বাভাবিক চেহারা চেনার ক্ষমতা থাকলেও তা পরবর্তীতে নষ্ট হয়ে যায়। দেখা যায় যে, এযাবৎকালে প্রকাশিত নথিপত্রের তথ্যানুসারে দু’ভাবে এ ধরনের প্রসোপ্যাগনোসিয়ার কথা জানা হয়ে থাকে:
১) এ ধরনের রোগাক্রান্তদের পূর্বে চেহারা চেনার স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল কিন্তু পরে সেটি আর না থাকায় তারা খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারেন তাদের এ সমস্যাটি হয়েছে।
২) এ সকল ব্যক্তিবর্গের মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তাই এরা চিকিৎসকের চিকিত্সাধীন থাকাকালেই চিকিৎসক তাদের এই রোগ ধরে ফেলতে পারেন।
জন্মগত (Congenital Prosopagnosia)
জন্ম থেকেই থাকা এই প্রসোপ্যাগনোসিয়ার ক্ষেত্রে কোনোরূপ মস্তিষ্ক বিকৃতি বা হানি দেখা যায় না। স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী মানুষ কোনোপ্রকার মস্তিষ্কহানি ব্যতিরেকেই জন্ম থেকে এই রোগটি দেখা যায়। জীনগত কারণে বংশানুক্রমিকভাবে এ রোগ হয়ে থাকে। অনেক সময় একে বর্ধনকালীন প্রসোপ্যাগনোসিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বর্ধনকালীন/ক্রমবিকাশমান প্রসোপ্যাগনোসিয়া (Developmental Prosopagnosia)
এক্ষেত্রে স্বাভাবিক মুখমণ্ডল চেনার ক্ষমতা তৈরি হবার আগেই প্রসোপ্যাগনোসিয়ার সূত্রপাত হয়ে থাকে। তবে কিছুক্ষেত্রে এটি জন্মগত প্রসোপ্যাগনোসিয়ার চেয়ে আলাদা। অর্থাৎ ক্রমবিকাশমান প্রসোপ্যাগনোসিয়া হতে পারে জন্মগত কিংবা হতে পারে শিশুর বিকাশকালীন আঘাতজনিত কারণে (যেহেতু প্রাপ্তবয়স্কদের স্তরের মুখমণ্ডল চেনার ক্ষমতা মানুষ তার কৈশোরেই পেয়ে থাকে)।
এই ধরনের প্রসোপ্যাগনোসিয়ার কারণ জীনগত, ভ্রূণীয় অবস্থায় কিংবা হঠাত্ মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ততা এবং শিশুবয়সে ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্ক কিংবা শৈশবে থাকা তীব্রমাত্রার দৃষ্টিজনিত সমস্যা বলে জানা গিয়েছে। তবে এসকল কারণকে আলাদা আকারে বিভক্ত করা প্রয়োজন, কেননা এগুলোর প্রতিটিই প্রসোপ্যাগনোসিয়ার কারণ হলেও ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে ক্ষতিগ্রস্ততার পরিমাণ ও স্থান ভিন্ন ভিন্ন হবে। কাজেই এর ওপর ভিত্তি করে এই প্রসোপ্যাগনোসিয়াকে যথাক্রমে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে: জিনগত প্রসোপ্যাগনোসিয়া (Genetic prosopagnosia), অভিজ্ঞতাপূর্ব প্রসোপ্যাগনোসিয়া (Pre-experiential prosopagnosia), এবং অভিজ্ঞতাপরবর্তী (Post-experiential prosopagnosia)।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রসোপ্যাগনোসিয়ার সঠিক কারণ নিরূপণ করা সম্ভবপর হয় না। তবে এগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় আক্রান্তরা এ রোগের পারিবারিক ইতিহাস কিংবা এটি সৃষ্টির আড়ালে নিহিত কোনো আঘাত বা দুর্ঘটনার কথা সম্পর্কে অবহিত থাকেন। ক্রমবর্ধমান প্রসোপ্যাগনোসিয়ার রোগীরা প্রায়ই বুঝতে পারেন না তাদের চেহারা এবং এমনকি মানুষও চিনে নিতে সমস্যা হয়। যেহেতু তারা আগে কখনোই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় চেহারা শনাক্তকরণে অক্ষম ছিলেন না, তাই স্বভাবতই এটিও বুঝতে পারেন না যে তাদের এই অক্ষমতাটি রয়েছে। পাশাপাশি এটি তাদের জন্য বুঝতে পারাটাও বেশ কষ্টকর, কেননা স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে কাউকে চেনার পেছনে চেহারার কী ভূমিকা সে ব্যাপারে কাউকে কথা বলতে সচরাচর শোনা যায় না। এ কারণেই পুরোপুরি প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে অনেকে ধরতেই পারেন না তারা মুখমণ্ডলীয় অন্ধত্বের কালো থাবার শিকার।
কতজন মানুষ প্রসোপ্যাগনোসিয়ার শিকার?
অর্জিত প্রসোপ্যাগনোসিয়ার চেয়ে ক্রমবিকাশমান প্রসোপ্যাগনোসিয়ার হারই বেশি। বিগত কিছু বছরে গণমাধ্যমগুলো এই রোগ সম্পর্কে বেশ আলোকপাত করেছে এবং বিশ্বজুড়ে প্রায় হাজারখানেক মানুষ যারা নিজেদের প্রসোপ্যাগনোসিয়ার রোগী হিসেবে দাবি করেন, তারা গবেষকদের শরণাপন্ন হয়েছেন।
জার্মানিতে ছাত্রছাত্রীদের ওপর চালানো এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ক্রমবিকাশমান প্রসোপ্যাগনোসিয়ার হার এ রোগের অন্য প্রকারের চেয়ে শতকরা প্রায় ২-২.৫ ভাগ বেশি। এছাড়াও প্রাপ্তবয়স্কদের একটি বড় দল এবং বৃহদাকারে অনেক প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ওপর চালানো পরীক্ষা থেকেও প্রায় একইরকম ফলাফল পাওয়া যায়। যদিও এই সকল পরীক্ষণলব্ধ ফলাফল অনেকটা সেই পরীক্ষায় ব্যবহৃত নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও সূচকের ওপর নির্ভরশীল, তবুও এ ফলাফল আমাদের জানায়- প্রতি ৫০ জনে একজনের এ ধরনের রোগ রয়েছে।
এই পরিমাপ ও তথ্য সঠিক হলে বর্তমানে শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যেই প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ প্রসোপ্যাগনোসিয়ার ক্রমবিকাশমান প্রকরণে আক্রান্ত। যদি এই তথ্য বাস্তবতার চেয়ে অতিরিক্ত বেশি পরিমাণও হয়, তবুও বলতে হয় এক্ষেত্রে শতকরা মাত্র এক ভাগ আধিপত্যের অর্থই হলো প্রায় ৬ লক্ষ লোকের এই সমস্যাটি রয়েছে।
প্রসোপ্যাগনোসিয়া এবং অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার
এটি সত্য যে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার থাকা অসংখ্য মানুষের মধ্যে চেহারা চেনার অসুবিধাসংক্রান্ত সমস্যা দেখা যায়। এমনকি অন্যান্য শৈশবকালে শুরু হওয়া ক্রমবিকাশমান রোগ, যেমন- উইলিয়ামস সিনড্রোম এবং টার্নার্স সিনড্রোমের ক্ষেত্রেও চেহারা শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় অসুবিধা দেখা গিয়েছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই প্রসোপ্যাগনোসিয়ার রোগীদের তাদের মুখমণ্ডল চেনায় সমস্যা হবার কারণে প্রচুর সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু তবুও তার মানে সবসময় এই নয় যে এসকল ব্যক্তিরই ক্রমবর্ধমান স্নায়ুতান্ত্রিক জটিলতা বা রোগ রয়েছে।
অপরপক্ষে, এমনও নজির পাওয়া গিয়েছে প্রকৃতপক্ষে রোগীর প্রসোপ্যাগনোসিয়া থাকলেও ভুলক্রমে তার রোগকে উচ্চমাত্রার অটিজম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে উল্লেখ্য যে, ক্রমবিকাশমান প্রসোপ্যাগনোসিয়ার অনেক লক্ষণই অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের অনেক রোগ নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্যের সাথে মেলে না। তাই এ থেকে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় যে এ দুটো রোগ পরস্পর আলাদা।
কীভাবে নির্ণয় করা হয় প্রসোপ্যাগনোসিয়া?
যদি চেহারা শনাক্তকরণজনিত কোনো সমস্যা দেখা দেয় তবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তারা মুখমণ্ডল শনাক্তকরণ পরীক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য আরো পরীক্ষা করে থাকেন। এর মধ্যে হতে পারে:
- আগে দেখেননি এমন চেহারা একবার দেখিয়ে মনে রাখতে বলা এবং পরবর্তীতে সেগুলো শনাক্ত করতে বলা।
- বিখ্যাত ব্যক্তিদের চেহারা চেনার পরীক্ষা।
- পাশাপাশি বা পরপর দেখানো অসংখ্য চেহারার মধ্যে মিল ও অমিল খুঁজে বের করা।
- এক গুচ্ছ চেহারার ছবির মাঝে বয়স, লিঙ্গ এবং আবেগীয় অভিব্যক্তির তুলনা ও যাচাইকরণ।
যদি মনে করেন আপনার মানুষের চেহারা চেনার ক্ষমতা লক্ষণীয় মাত্রায় কমে যাচ্ছে, আপনার যথাসম্ভব শীঘ্র একজন স্নায়ুচিকিত্সকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। হুট করে মুখমণ্ডল শনাক্ত করার ক্ষমতা কমে যাওয়া অবশ্যই তত্ক্ষণাত্ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার মতো বিষয়।
আপনার শিশুটি প্রসোপ্যাগনোসিয়ায় ভুগছে না তো?
শিশুদের মধ্যে প্রসোপ্যাগনোসিয়ার উপস্থিতি নির্ণয় বেশ কঠিন হলেও নিম্নলিখিত কিছু কিছু লক্ষণ এটির সম্ভাব্যতা নির্দেশ করে:
- হঠাৎ দেখা হলে আপনার শিশু যদি বারবার পরিচিত মুখগুলো চিনতে ব্যর্থ হয়।
- তাদের মধ্যে জনসমক্ষে বা লোকসমাগমে খুব বেশি কাছে ঘেঁষে থাকার প্রবণতা কাজ করে।
- স্কুল ছুটির পর তাদের নিতে গেলে, তারা আপনার তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ার অপেক্ষা করে কিংবা আপনি মনে করে অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট চলে যায়।
- স্কুলে তারা একঘরে হয়ে থাকে এবং তাদের বন্ধু তৈরি করতেও সমস্যা হয়। কিন্তু এমনও হতে পারে বাইরে সমস্যা হলেও বাড়িতে তারা বেশ আত্মবিশ্বাসী ব্যবহার করে কেননা বাড়ির সকলেই আপনজন বিধায় কাউকে চেনা না চেনার আশঙ্কাটি সেখানে থাকে না।
- চলচ্চিত্র কিংবা টেলিভিশন অনুষ্ঠানসমূহকে পুরোপুরি বুঝতে বা অনুসরণ করতে সমস্যা দেখা দেয়া।
প্রসোপ্যাগনোসিয়ার চিকিৎসা
বাস্তবিক অর্থে, এই রোগের এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকরী চিকিত্সা নেই। তবে কিছু নাতিদীর্ঘকালীন ঔষধ গ্রহণ এবং মানুষ চেনার প্রশিক্ষণ দেবার মাধ্যমে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। তবে গবেষকগণ এখনো প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন প্রসোপ্যাগনোসিয়ার অন্তর্নিহিত কারণ জানতে ও এর প্রতিকার খুঁজে বের করতে।
প্রসোপ্যাগনোসিয়া রোগীর প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন চলাকালে তার মস্তিষ্ক বিকৃতিকালীন বয়স, মস্তিষ্কে আঘাতের মাত্রা ও ধরণ এবং চিকিত্সায় ব্যয় হওয়া সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই তথ্যগুলোর উপরই এসকল প্রক্রিয়ার সাফল্যের হার নির্ভর করে। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে এই রোগাক্রান্ত অনেক ব্যক্তিই বিকল্প পন্থা যেমন- কণ্ঠস্বর, হাঁটার ধরণ, সাজ-পোশাক দেখে মানুষকে চিনে নেন। কিন্তু এসব পন্থা অতটা কার্যকরী হয় না, বিশেষ করে হঠাত্ কোনো অচিন্তনীয় কোনো স্থানে পরিচিত মানুষের দেখা পেলে কিংবা কোনো পরিচিত ব্যক্তি তার সাজ-পোশাকের ধাঁচ পাল্টে ফেললে তাকে চিনতে ব্যর্থ হন এ রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা।
প্রসোপ্যাগনোসিয়া এমন এক অভিশাপ, যা দৈনন্দিন জীবনকে কঠিনরূপে হাজির করার পাশাপাশি এক তীব্র সমস্যার সম্মুখীন করে মানুষকে। এর যথার্থ চিকিৎসা ও নিরাময়ের পথ উদ্ভাবনের জন্য পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের দিকে আশাময় দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকবে বিশ্ববাসী।
ফিচার ছবিসূত্র: xlsemanal.com