ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং শরীরের সার্বিক খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী। আর তাই খাবার তালিকাটি বাছাই করতে হয় গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে-শুনে!
বাদাম
যেকোনো ধরনের বাদাম যে কতটা স্বাস্থ্যসম্মত তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না! যেকোনো ধরনের বাদামেই বেশ ভালো পরিমাণ স্বাস্থ্যকর ফ্যাট থাকে। এই সব ফ্যাট ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তবে ঠিক কী পরিমাণ আপনার খাওয়া উচিৎ তা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নেয়া ভালো।
টিপস
সব বাদামের মধ্যে কাজুবাদাম সবচাইতে স্বাস্থ্যসম্মত।
মাছ
মাছ সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত প্রোটিনের উৎসগুলোর মধ্যে একটি। স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপনের জন্য শরীরে প্রোটিন চাহিদা পূরণ করা অনিবার্য। বাদাম ও বীচির মতো মাছেও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড (স্বাস্থ্যসম্মত ফ্যাট)। এছাড়াও মাছ শরীরে যেকোনো ধরনের রোগবালাই হওয়ার সম্ভাবনা কমায়।
টিপস
ভাজা মাছের চাইতে গ্রিল করা মাছ অধিক স্বাস্থ্যসম্মত।
মটরশুঁটি, শিম, বরবটি
ফাইবার! ফাইবার! ফাইবার! ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের খাবারের মেন্যুতে ফাইবার থাকা খুব জরুরী। আর মটরশুঁটি, শিম, বরবটি জাতীয় খাবার হচ্ছে ফাইবারের সবচাইতে ভালো উৎস। এই সবজিগুলো প্রতিদিন না খেতে পারলেও সপ্তাহে অন্তত একবার অবশ্যই খাওয়ার চেষ্টা করবেন। এটি রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে। তবে কী পরিমাণ খাবেন সে সম্পর্কে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে অবশ্যই ভুলবেন না। কারণ এতে যথেষ্ট পরিমাণ কার্বোহাইড্রেটও থাকে। এছাড়াও এই সবজিগুলোতে উচ্চ মাত্রার প্রোটিন থাকে।
ব্রক্লি
ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য যদি বিশেষ কোনো সবজি থাকে তবে তা হলো ব্রক্লি। এতে রয়েছে বিশেষ একটি যৌগ যা প্রাকৃতিকভাবে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করে এবং ব্লাড সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়াও ব্রক্লি হৃদরোগজনিত সমস্যা থেকে রক্ষা করে। এ থেকে শরীরে প্রতিদিনের ভিটামিন-সি এর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
টক দই
প্রতিদিন অন্তত এক পরিবেশন টক দই খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়। এছাড়াও এক গবেষণায় দেখা যায়, নিয়মিত টক দই খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুললে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা ১৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। আর টক দইয়ে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণও কম থাকে। এছাড়াও টক দই হজম শক্তি বাড়ায়।
চা
চা হলো এমন একধরনের শক্তিবর্ধক ও ক্লান্তি দূরকারী পানীয় যাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা নিয়মিত লাল চা ও গ্রিন টি পান করার পরামর্শ দেন। তবে অবশ্যই এই দুই ধরনের চা চিনি ছাড়া হতে হবে।
তিসি
ডায়াবেটিস এর সমস্যাটি প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় যৌগগুলোর মধ্যে তিনটিই তিসিতে রয়েছে। সেগুলো হলো স্বাস্থ্যসম্মত ফ্যাট, ফাইবার ও প্রোটিন। পুষ্টিগুণে ভরপুর থাকা সত্ত্বেও তিসি স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ভালো তা খুব কম লোকই জানেন। স্বাদ ততটা ভালো না হওয়ার কারণে শুধু তিসি খেতে ভালো না-ও লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে ওটস্ বা বেকড্ কোন আইটেমের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী এই তিসি।
আপেল
আপেল খেতে পছন্দ করেন না এরকম মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। আর প্রতিদিন একটি আপেল খেলে যে অসুখবিসুখ শরীরে বাসা বাঁধতে পারে না সে বিষয়টিও মোটামুটি সবাই-ই জানেন। আপেল হৃদরোগজনিত সমস্যা ও কোলেস্টেরলের উচ্চ মাত্রার ঝুঁকি কমায় এবং রক্তে গ্লুকোজের সঠিক পরিমাণ বজায় রাখে। পুরো পৃথিবীতে মোট কত রকমের আপেলের উৎপাদন হয় তা জানা আছে কী? ৭,৫০০ এর চেয়েও অধিক রকমের!
রসুন
জ্বি, রসুন; তা-ই বলে একটু ভিন্ন ধাঁচের কিছু খেতে গিয়ে গারলিক ব্রেড খেলেও কিন্তু চলবে না! গবেষণা থেকে জানা যায় যে, রসুন কোলেস্টেরল ও উচ্চ রক্তচাপ কম করতে সাহায্য করে। এছাড়াও পাকস্থলীর ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমাতেও রসুন বেশ কার্যকরী।
পালং শাক
পালং শাক যে পুষ্টিগুণের সম্ভার তা নতুন করে আর বলার কিছু নেই। তবে বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য পালং শাক অত্যন্ত উপকারী। সবুজ শাকসবজি ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য একপ্রকার অনুমোদিত খাবারই বলা চলে। আর এই পালং শাক হলো সব রকমের সবুজ শাকসবজির মধ্যে ডায়াবেটিকের সবচাইতে ফলদায়ক হাতিয়ার।
ডার্ক চকলেট
এই আইটেমটি দেখে নিশ্চয়ই চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তবে বিষয়টি সত্যি যে, ডায়াবেটিক রোগী হওয়া সত্ত্বেও আপনি চকলেটের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন। তবে অবশ্যই তা ডার্ক চকলেট হতে হবে! মনে রাখবেন যে, চকলেট যতটা ডার্ক বা গাঢ় রঙের হবে, তাতে চিনির পরিমাণ তত কম থাকবে। এই ডার্ক চকলেটে যে শুধু অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি থাকে তা-ই নয়, বরং এটি ইনসুলিনের প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। এছাড়াও ডার্ক চকলেট প্রাকৃতিকভাবে ক্ষুধা নিবারণ করতে এবং শরীরে ক্যালরির চাহিদা কমাতে খুব কার্যকরী।
দারুচিনি
দারুচিনির সবচাইতে ভালো একটি গুণ হলো যে, মিষ্টি কিছু তৈরি করার সময়ে এটি চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও দারুচিনি আপনার ক্ষুধা দমন করতেও সাহায্য করবে। গবেষণা থেকে জানা যায়, দারুচিনি ব্লাড সুগারের মাত্রা কমাতেও বেশ উপকারী।
টিপস
মিষ্টি আইটেম ছাড়াও চায়ে দারুচিনি মিশিয়ে খেলে ডায়াবেটিক রোগীরা উপকার পেতে পারেন।
ওটস্
ওটস্ হয়তবা মন্থর কার্বোহাইড্রেট। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি শরীরে কার্বোহাইড্রেটকে চিনিতে রূপান্তরিত করতে মন্থর গতিতে কাজ করে থাকে। এছাড়াও এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। সকালের নাস্তায় ওটস্ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যসম্মত রেসিপি তৈরি করে খেতে পারেন।
অলিভ অয়েল
সাধারণত আমরা খাবারে সয়াবিন বা সরিষার তেল ব্যবহার করে থাকি। তবে অলিভ অয়েলও স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভালো। অলিভ অয়েলে রয়েছে স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের উৎসগুলোর মধ্যে একটি। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অলিভ অয়েলকে একটি আদর্শ খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা দীর্ঘায়ু ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
মিষ্টি আলু
সাদা আলু বা সচরাচর যে আলু আমরা খেয়ে থাকি তা ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য খুব বেশি একটা ভালো নয়। কিন্তু মিষ্টি আলুতে রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ, যা স্বাস্থ্যের জন্যও বেশ উপকারী। এছাড়াও এটি ইনসুলিন প্রতিরোধ করে, কোলেস্টেরল কমায় এবং ব্লাড সুগারের উচ্চ মাত্রা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
টিপস
সেদ্ধ বা রান্নার চাইতে বেকড্ মিষ্টি আলুতে পুষ্টিগুণ বেশি বজায় থাকে।
ডিম
ডিমের রয়েছে অনেক স্বাস্থ্যগুণ। এছাড়াও ডিম খেলে পেট অনেকক্ষণ ভরা থাকে এবং ক্ষুধাও কম লাগে। নিয়মিত ডিম খেলে হৃদরোগ সহ নানা ধরনের রোগের সম্ভাবনাও কমে। ডিম জ্বালাপোড়ার সমস্যা কমায় ও ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগে আক্রান্তরা যদি প্রতিদিন দুটো করে ডিম খায় তাহলে কোলেস্টেরল ও ব্লাড সুগারের মাত্রার উন্নতি হয়। এছাড়াও ডিম চোখের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ডিমের সাদা অংশের চাইতে কুসুমেই পুষ্টিগুণ বেশি থাকে।
মনে রাখবেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে অনেক রকম অসুখবিসুখ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এমন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করুন যা ব্লাড সুগার, ইনসুলিন ও জ্বালাপোড়া কমায়।
ফিচার ইমেজ: Tires & Parts