অনেকেই হয়তো “ব্যাপারটি নারীদের সাথে বেশি ঘটে থাকে”- এমনটা বলবেন। তবে গবেষণানুসারে, নারীদের প্রতি তিনজনে একজন এবং পুরুষদের গড়ে প্রতি চারজনে একজন এই সমস্যায় ভুগে থাকেন। বলছিলাম আরাকনোফোবিয়ায় কথা। বাংলায় যার সহজ নাম মাকড়শা থেকে ভয়। আরাকনোফোবিয়ায় আক্রান্তরা মাকড়শা নামক ছোট্ট এবং অতি সাধারণ প্রাণীকে নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কে ভুগে থাকেন। যার উদাহরণ হয়তো আপনি নিজেই! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এতকিছু থাকতে আমরা মাকড়শাকে কেন ভয় পাই? এমনকি, মাকড়শা আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না জেনেও এটি দেখলেই ভয়ে সিঁটিয়ে যাই। কিন্তু কেন? আরাকনোফোবিয়া কেন হয়?
এই ‘কেন’র উত্তর জানতে হলে আমাদের জানতে হবে ফোবিয়া কী। ফোবিয়া মূলত ভয়। না, সাধারণ কোনো ভয় নয়। বেশ জাঁকিয়ে বসা ভয়। পরীক্ষায় ভালো না লিখে আসলে ফলাফল দেওয়ার সময় আপনার দুশ্চিন্তা এবং ভয় হতেই পারে। তবে ফোবিয়া ঠিক সেরকম ভয় নয়। এটি একজন মানুষের মধ্যে অনেকটা পাকাপাকিভাবে এবং অতিরিক্ত মাত্রায় বাস করে। মাকড়শার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি অনেকটা একই রকম। আশেপাশে কোনো মাকড়শা নেই, থাকলেও সেটি আপানাকে কোনোভাবেই আঘাত করতে পারবে না। সুতরাং এই ছোট্ট প্রাণীকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই। এতকিছু জানার পরেও যদি আপনাকে কেউ বলে বসে- ঐ যে মাকড়শা! আর আপনি অসম্ভব ভয় পান, তাহলে সেটা সাধারণ ভয়ের পর্যায়ে থাকে না। এই ভয়কে আমরা এত বেশি নিজেদের মধ্যে পুষে রেখেছি যে, এটি খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যতজন মানুষই কোনো ফোবিয়া বা ভীতির ভুক্তভোগী হয়ে থাকুন না কেন, সেটি শেষ পর্যন্ত ফোবিয়াই থাকে। আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, ফোবিয়া কেন হয়? প্রশ্নের উত্তর খুব একটা সহজ নয়। ঠিক কী কারণে ফোবিয়া হয়ে থাকে সেটা এখনো পর্যন্ত জানতে পারা যায়নি। তবে অতীতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা হতে পারে আপনার কোনো ব্যাপারে ভয় পাওয়ার কারণ। তবে কিছু ফোবিয়া বা ভীতি আছে যেগুলো মানুষ জন্ম থেকেই সাথে নিয়ে আসে। আর সেগুলো হচ্ছে- উচ্চতা থেকে ভয়, অন্ধকারে ভয়, চলন্ত বস্তুতে ভয় ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই ভয়গুলো কাজ করে। আর বাকি ফোবিয়া বা ভীতিগুলোকে অর্জিত ফোবিয়া বলে। যেগুলো মানুষ আগে থেকে নয়, বরং জন্ম নেওয়ার পর শেখে।
ফোবিয়া মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে। সেগুলো হল- অ্যাগ্রোফোবিয়া বা ঘরের বাইরে যাওয়ার ভয়, সোশ্যাল ফোবিয়া বা সামাজিকতায় ভয় এবং নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে ভয়। মাকড়শা নিয়ে আপনার ভয়টি শেষ রকমের ফোবিয়া বা নির্দিষ্ট কোনো ব্যাপারে ফোবিয়ার মধ্যে পড়ে। তাহলে কি আপনার সাথে মাকড়শা নিয়ে এর আগে কোনো বাজে ঘটনা ঘটেছিল? সবার সাথেই কি তা-ই হয়েছে? প্রশ্ন জাগতেই পারে আপনার মনে। তবে ব্যাপারটি এত সহজ নয়। আরাকনোফোবিয়া বা মাকড়শাকে ভয় পাওয়ার এই ব্যাপারটি মানুষের মধ্যে এখন জন্ম নেয়নি। আপনি এবং বাকি সব মানুষ যে মাকড়শাকে ভয় পায়, সেটি মোটেও নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নয়। এর পেছনে আছে আমাদের পূর্বপুরুষদের হাত। একটা সময় আমাদের প্রাচীন মানবদের কাছে না ছিল বড় হাতিয়ার, আর না ছিল কোনো উন্নত ওষুধ। আরাকনোফোবিয়ার উৎপত্তি তখন থেকে। নির্দিষ্ট এই গোত্রের প্রাণীদের কাছ থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা থাকতো তখন মানুষের। তাদেরকে প্রতিহত করার কোনো উপায় জানা ছিল না কারো। সেইসাথে আক্রমণের পর ব্যবহার করার মতো ঔষধ ছিল না তাদের কাছে। ফলে এই আক্রমণে মারা যেত অনেক মানুষ।
সেখান থেকেই মাকড়শা গোত্রের যেকোনো প্রাণীর প্রতি আমাদের স্বভাবজাত ভয়ের জন্ম। বর্তমানে আমার কিংবা আপনার সাথে মাকড়শা সংক্রান্ত কোনো ঘটনা ঘটুক কিংবা না ঘটুক, ভয় পাওয়াটা তাই হয়ে পড়ে স্বাভাবক একটি ব্যাপার। মাকড়শা সম্পর্কে তো জানা হল। কিন্তু মাকড়শা কেবল তার গোত্রের একমাত্র প্রাণী নয়। আরো অনেকে আছে তার সাথে। প্রাচীনকালে কেবল মাকড়শা নয়, বরং এই গোত্রের সব প্রাণীকেই ভয় পেত মানুষ। আরাকনিড একটি প্রাণীগোষ্ঠী। এই গোত্রের মধ্যে আছে মাকড়শা, বিছেসহ আরো অনেক প্রাণী, যাদের শরীর দেখতে অনেকটা একইরকম। আর এদের মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে আরাকনোফোবিয়া হয়ে থাকে। ১৯৯১ সালে লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটির গ্রাহাম ডেভি এই সংক্রান্ত একটি পরীক্ষা চালান। এতে তার সাথে অংশ নেয় ১১৮ জন শিক্ষার্থী। আর সেখান থেকে পরীক্ষায় জানা যায় যে, প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ মাকড়শা এবং আরাকনিড গোত্রের প্রাণীদেরকে ভয় পায়। আর এদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী।
তবে প্রশ্ন থাকে যে, মানুষ কি কেবল এই একটি কারণেই মাকড়শাকে ভয় পায়? একদম নয়। মানুষের মাকড়শার প্রতি এই ভয় জন্ম নেওয়ার পেছনে আছে তার পরিবারের প্রভাব। পরীক্ষায় জানা যায় যে, যেসব ব্যক্তি মাকড়শাকে প্রচন্ড পরিমাণে ভয় পান তাদের পরিবারেও কারো না কারো ঠিক একই সমস্যা ছিল। তবে কারো উপরে এই সংক্রান্ত ব্যাপারে জিনগত কোনো ব্যাপার বেশি প্রভাব রাখে নাকি পরিবেশগত, সেটি খুব একটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় না। আশ্চর্যজনকভাবে, মাকড়শাকে ভয় পাওয়ার দিকে সবচাইতে এগিয়ে থাকে শিশুরা। বিভিন্ন শিশুকে এই সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তাদের ভয়ের কারণ হিসেবে গাড়ি, নিঃশ্বাস না নিতে পারা ইত্যাদি ব্যাপারগুলো উল্লেখ করেছে তারা। কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই একটি সাধারণ এবং সবচাইতে এগিয়ে থাকা ভয় প্রাধান্য পেয়েছে। আর সেটি হলো মাকড়শাকে ভয়। মাকড়শাকে ভয় পাওয়া বা আরাকনোফোবিয়ার সাথে যে আমাদের প্রাচীন মানবদের সম্পর্ক আছে, তা তো আগেই উল্লেখ করেছি। তবে এই ব্যাপারে আরো বেশি পরিষ্কার ধারণা পেতে ডেভির গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি গবেষণা চালানো হয় জানার চেষ্টা করা হয় যে পরিবেশ নাকি জিন- কোনটা প্রভাব রাখে এই ক্ষেত্রে?
২০০৩ সালে জন হেত্তেমা ভার্জিনিয়া ইন্সটিটিউট ফর সাইকায়াট্রিক এন্ড বিহেভিওরাল জেনেটিক্স থেকে তার সহকর্মীদের নিয়ে শুরু করেন এই গবেষণা। এই গবেষণায় তারা ব্যবহার করেন জমজদের উপরে। এই জমজ শিশুদেরকে সম্পূর্ণ দু’ভাবে বড় করা হয়। পরিবেশ আলাদা দেওয়া হয় এবং এটা নিশ্চিত করা হয় যে তাদের মধ্যে একজন মাকড়শা দেখেনি আর মাকড়শার সাথে তার কোনোরকম বাজে কোনো অভিজ্ঞতাও হয়নি। পরীক্ষা চলতে থাকে। খানিকটা বড় হওয়ার পর তাদের দুজনকেই মাকড়শার ছবি দেখানো হয়। আর ফলাফল? মাকড়শা দেখুক কিংবা না দেখুন, মাকড়শার সাথে বাজে অভিজ্ঞতা থাকুক বা না থাকুক- এরা দুজনেই ভয় পেয়ে যায় মাকড়শার ছবি দেখে। আর সেখান থেকে সিদ্ধান্তে আসেন গবেষকেরা যে, আরাকনোফোবিয়া কোনো পরিবেশগত সমস্যা নয়। পরিবেশের উপরে কিংবা নিজের অভিজ্ঞতার উপরে ভিত্তি করে এই ভয়কে ধারণ করতে হয় না মানুষের। মাকড়শাকে ভয় পাওয়ার এই ফোবিয়া জন্ম থেকে নিজের সাথে নিয়ে আসা এবং শেখা- এই দুটোর মাঝখানে পড়ে যায়। তাহলে, কী ভাবছেন? আপনারও আছে নাকি আরাকনোফোবিয়া?
ফিচার ইমেজ: YouTube