গত কয়েক দশকে বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। নির্বাচনী প্রচার, প্রসারে এসেছে চোখে লাগার মতো বৈচিত্র্য, যেখানে ইন্টারনেট বেশ বড় একটি ভূমিকা পালন করেছে। সোশ্যাল মিডিয়া; বিশেষ করে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব সহ আরো কয়েকটি গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী সোশ্যাল সাইটের কল্যাণে গত কয়েক বছরে এই পরিবর্তনের পরিমাণ এত বেড়েছে যে, সমালোচকরা এ নিয়ে পূর্ণ দৈর্ঘ্য আলোচনায় বসতে বাধ্য হচ্ছেন। একসময়ের সোশ্যাল মিডিয়া বিমুখ রাজনৈতিক দলগুলোও ঝাঁপিয়ে পড়ছে ইন্টারনেটের কল্যাণে এগিয়ে যাওয়া এসব মিডিয়ার সুবিধা ভোগ করতে।
বর্তমানে প্রায় প্রত্যেক রাজনৈতিক দল, প্রার্থীর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যেখান থেকে নিয়মিত নিজেদের এবং দলীয় মতামত, কর্মকাণ্ডগুলো প্রচার করা হয়। লক্ষ লক্ষ সমর্থক, বিরোধী দলীয় পক্ষের ভোটারদের সাথে সরাসরি কৌশল বিনিময়, বিভিন্ন মতামত আদান-প্রদানে এই ডিজিটাল মাধ্যমগুলোর ব্যবহার পদ্ধতি এত বেশি সহজ আর কার্যকর যে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো থেকে শুরু করে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে নিয়মিত হচ্ছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনে বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান, নির্বাচনী প্রচার বাজেটের প্রায় ৫০ শতাংশ টাকা ইন্টারনেট ভিত্তিক মাধ্যমগুলোতে ব্যয় করেছে।
চলুন দেখা যাক, সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় প্রভাব বিস্তার করছে!
১) সরাসরি ভোটারদের সাথে যোগাযোগ
ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবের মতো মিডিয়াগুলো রাজনীতিবিদদের সরাসরি ভোটারদের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে টাকার বিনিময়ে প্রচারের প্রথাগত পদ্ধতিগুলো থেকে বের হয়ে বর্তমানে নামমাত্র খরচে প্রায় প্রত্যেকের কাছে প্রার্থীরা পৌঁছে যেতে পারছেন।
২০১৬ সালের আমেরিকার নির্বাচনে এই প্রচার পদ্ধতিটি বেশ চোখে লাগার মতো ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল বেশ ভালোভাবেই টুইটারের ১৭ মিলিয়ন ফলোয়ার, ফেইসবুক পেইজের ১৬ মিলিয়ন লাইক এবং ৪ মিলিয়ন ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার নিয়ে নিজেদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছে। প্রত্যেকটি টুইট, পোস্ট এবং ক্যাম্পেইন আপডেটগুলোতে সমর্থক এবং বিরোধীরা নিজেদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছে। মতামতগুলোতে চোখ বুলিয়ে খুব সহজেই অনুমান করার সম্ভব হয়েছে, ভোটাররা কী চায়! এমনকি, সোশ্যাল মিডিয়া প্যানেলে কর্মরত লোকজন সমালোচকদের সরাসরি সবরকমের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে। যার ফলে খুব সহজেই প্রার্থী আর ভোটারের মধ্যে একটা মজবুত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যা কেবল মিডিয়া বা মাঠ পর্যায়ে সমাবেশের মাধ্যমে সম্ভব ছিল না।
২০১৬ সালের নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব সম্পর্কে শক্ত ধারণা পেতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় ডিজিটাল মিডিয়া পরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকা ব্র্যাড পার্সকলের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের ক্ষুদ্রাংশ উল্লেখ করা যেতে পারে। নির্বাচনে জয়লাভের পরে তিনি বলেছিলেন, “ফেইসবুক এবং টুইটার আমাদের জয়ী হতে সাহায্য করেছে।”
২) বিনামূল্যে বিজ্ঞাপন
একটা সময় ছিল, যখন টেলিভিশন, রেডিও এবং প্রিন্ট মিডিয়াই ছিল নির্বাচনী প্রচারণা মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে প্রচারের অভিপ্রায়ে এসব মাধ্যমগুলোর সময় কেনার জন্য ব্যয় করতে হতো মোটা অংকের টাকা। কিন্তু বর্তমানে খুব সহজেই ইউটিউব, ফেইসবুক, টুইটারের মাধ্যমে এসব প্রচারণা চালানো যায়। আর যেহেতু ইন্টারনেট ভিত্তিক মিডিয়াগুলোতে যেকোনো সময় প্রায় সবরকমের উপায়ে প্রচারণা চালানো সুযোগ রয়েছে, সেহেতু ক্যাবল বা প্রিন্ট মিডিয়ার মতো নির্ধারিত সময় এবং বাধ্যবাধকতাগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। ফলে নির্বাচনী প্রচার ব্যবস্থা দিন দিন পুরোপুরি সোশ্যাল মিডিয়ামুখী হয়ে যাচ্ছে।
২০০৮ সালের আমেরিকার ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনী প্রচারণা ব্যবস্থাপক হিসেবে খ্যাত জোসেফ পাউল ট্রিপি, সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক বিনামূল্যে বিজ্ঞাপন প্রচারের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “দলীয় প্রচারণার ভিডিওগুলো প্রায় ১৪.৫ মিলিয়ন বার ইউটিউবে দেখা হয়েছে। ভিডিওগুলো সম্প্রচারের জন্য কোনো টেলিভিশনে এই সময়টা ক্রয় করতে প্রয়োজন হতো প্রায় ৪৭ মিলিয়ন ডলার।”
৩) ভাইরাল মার্কেটিং
ফেসবুকের শেয়ার এবং টুইটারের রি-টুইট ফিচারগুলো বর্তমানে যেকোনো জিনিসকে খুব সহজেই ভাইরাল করে দিতে পারে। নির্বাচনী প্রচারণায়ও এদের ভূমিকা চোখে লাগার মতো। নির্দিষ্ট কোনো দলের সম্ভাব্য ভোটাররা তাদের নেতা-নেত্রীদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া ভাষণের ভিডিও সহ বিভিন্ন সংবাদ খুব সহজেই নিজেদের প্রোফাইলে শেয়ার এবং রি-টুইট করার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারে। তাছাড়া কোনো একটি নির্বাচনী ইভেন্টে লোক জড়ো করার জন্য পূর্বের মতো আর বিলবোর্ড বিজ্ঞাপন কিংবা পোস্টার ছাপানোর প্রয়োজন হয় না। দলীয় ইভেন্টগুলোতে লোক জড়ো করার অভিপ্রায়ে খুব সহজেই নির্দিষ্ট কোনো দলের ফেসবুক ইভেন্টগুলোকে সমমনস্ক লোকদের কাছে শেয়ার করে ছড়িয়ে দিতে পারে।
৪) ফিল্টারিং
বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো গ্রাহকদের সবরকমের তথ্যের ব্যাপারেই ওয়াকিবহাল। ফেসবুক, টুইটারের মতো কোম্পানিগুলো নিজেদের সাইটে এমন সব অ্যালগরিদম ব্যবহার করে যেগুলো গ্রাহকদের পছন্দ, অপছন্দ, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে খুব সহজেই ধারণা করে নিতে পারে। আর এই সুবিধাটিই তারা বিজ্ঞাপন ব্যবসায় কাজে লাগায়। ব্যবহারকারীর বয়স, সামাজিক, ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান চিহ্নিত করে কোনো একটি নির্দিষ্ট দলে ভাগ করে ফেলে এবং সে অনুযায়ী তাদের পছন্দসই দলের ব্যাপারে পছন্দসই বিজ্ঞাপন উপস্থাপন করে। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষ যদি নির্দিষ্ট কোনো দলের নির্বাচনী প্রচারের জন্য বেতনভুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে ঐ দলটির ব্যাপারে ইতিবাচক হিসেবে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, এমন সব তথ্য বিরোধী মনোভাবের গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেয়, যেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই অধিকাংশ ভোটারকে দল পরিবর্তনে উৎসাহিত করে।
৫) ফান্ড রাইজিং
পশ্চিমা বিশ্বের রাজনীতিতে নির্বাচনী প্রচারণায় সরাসরি সাধারণ সমর্থকদের কাছ থেকে ফান্ড রাইজিংয়ের ধারণাটা বেশ পুরনো। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এখানেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। অনলাইন ভিত্তিক ক্রাউড-ফান্ডিং পদ্ধতি ব্যবহার করে খুব সহজেই যে কেউ যেকোনো পরিমাণের অর্থ যেকোনো সংগঠন বা ব্যক্তিকে প্রদান করতে পারে। আর এই পদ্ধতিটি বর্তমানে নির্বাচনী ফান্ড রাইজিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে। আর সোশ্যাল মিডিয়া সাধারণ ভোটারদের কাছে পুরো ব্যাপারটাকে সহজবোধ্য করে তুলে ধরছে। নির্দিষ্ট দলের সমর্থকেরাও শেয়ার, রি-টুইট করে একই চিন্তা-চেতনার ব্যবহারকারীদের কাছে ফান্ড রাইজিং সংক্রান্ত ইভেন্টগুলোও পৌঁছে দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ২০০৮ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনী ফান্ড রাইজিংয়ের দিকে ইঙ্গিত করা যেতে পারে। বারাক ওবামা তার পুনঃনির্বাচনী প্রচারণায় অনলাইনে মাধ্যমে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেন।
হাফিংটন পোস্টের প্রধান সম্পাদক আরিয়ানা হাফিংটন ২০০৮ সালে বারাক ওবামার নির্বাচনী জয়ে ইন্টারনেটের ভূমিকা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “ইন্টারনেট না হলে বারাক ওবামা নির্বাচিত হতো না। ইন্টারনেট না থাকলে তিনি মনোনীতই হতে পারতেন না!”
৬) যাচাইকরণ
প্রত্যেকটি ক্যাম্পেইনের জন্য নিরেট পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়। আর পরিকল্পনার মূল অংশেই পূর্বের চাইতে পরবর্তী ক্যাম্পেইনে ভালো করা অভিপ্রায় থাকে। কিন্তু আপনি জানবেন কীভাবে পূর্বের ক্যাম্পেইন কেমন হয়েছিল? একসময় এ নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হলেও, বর্তমানে অনলাইন ভিত্তিক যাচাইকরণ ভোট গ্রহণের মাধ্যমে খুব সহজেই এ বিষয়ে আন্দাজ করা যায়। আর এসব ভোটিংয়ে অংশগ্রহণকারীর অধিকাংশরাই ফেসবুক এবং টুইটারের কল্যাণে জড়ো হয়।
৭) বিতর্ক, প্রতিক্রিয়া এবং অন্যান্য
যেহেতু সোশ্যাল মিডিয়া সর্ব সাধারণের কাছে উন্মুক্ত এবং খুব সহজেই যে কেউ যেকোনো পোস্টে মন্তব্য করতে পারে, সেহেতু কোনো রাজনৈতিক নেতার কোনো মন্তব্য হঠাৎ করেই কিছু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতিপন্ন হয়, আবার অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায়, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া এবং বিতর্কের সৃষ্টি করে। এর ফলে দুটো জিনিস হতে পারে। প্রথমত, যদি ঐ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হওয়ার ফলে সম্ভাব্য ভোটারদের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসে, তাহলে ঐ নেতা বারবার একই ধরনের বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে আরো মজবুত করে নেয়। আর দ্বিতীয়ত, যদি বক্তব্যটি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে খুব সহজেই এটি বিরোধী দলের টার্গেটে পরিণত হয়, যা ঐ প্রার্থীর জন্য ধ্বংসাত্মক হিসেবে দেখা দিতে পারে।
ফিচার ছবি- onlyhdpic.com