সময়টা এখন স্মার্টনেসের, ট্রেন্ড অনুকরণ করে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার। নিজস্ব দর্শন বিসর্জন দিয়ে অন্যরা কী করছে বা কীভাবে ভাবছে সেটাই এখন মুখ্য বিষয়। নিজের একটি ডিএসএলআর থাকাও আজকাল স্মার্টনেসের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ভাল ছবি তুলতে পারার চেয়ে বরং ভাল কনফিগারেশনের ক্যামেরা থাকাটা অধিকতর গুরুত্ববহ। মুঠোফোনের বদৌলতে এখন ছবি তোলাটা অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে। নামজাদা কোনো রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে, সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে চেক ইন দেয়ার পাশাপাশি খাবার আর নিজেদের ছবি না তুললেই নয়। কিংবা বন্ধুদের সাথে কোথাও ঘুরতে গেলে ভ্রমণের পাশাপাশি রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তগুলোকেও বন্দী করে রাখা হয় ভবিষ্যতের জন্য। চারপাশে খেয়াল করলে দেখা যাবে, অনেকেই ছবি তুলতে পছন্দ করেন, হয়তো উদ্দেশ্য ভিন্ন থাকে। কেউ নিছক আনন্দের জন্য, কেউ লোক দেখানোর জন্য, আবার কেউ ছবি তুলবে বলেই তোলে! সমাজের পুরো চিত্রটাই কি তবে এরকম?
“প্রতিটি ছবির অবশ্যই একটি জিনিস থাকা উচিৎ- সেই তাৎক্ষণিক মুহূর্তের মানবতা।”
-রবার্ট ফ্র্যাংক
মানুষের চোখের আড়ালে কেউ কেউ রয়ে যান যারা ছবি তুলতে ভালবাসেন। এই ভালবাসাটা ক্ষণিকের মোহ না, বরং নিজের জীবনের সাথে এর অস্তিত্ব জড়ানো। তারা ছবির কবি হয়ে ওঠেন। ছবি তুলতে পারাটাই তাদের শেষ কথা না। তাদের চোখের সুগভীর পর্যবেক্ষণে প্রকৃতির অনিন্দ্যসুন্দর মুহূর্তটি বন্দী হয় ক্যামেরায়। কেউ কেউ নিজেদের জীবন বাজি রেখে এমন সব ছবি তোলেন যা দেখে নির্বাক হতে হয়। আর কারও কারও জন্য ছবি তোলাটা নিজের মুখের ভাষার মতো। ছবিই হয়ে ওঠে তাদের প্রতিবাদের ভাষা, আলোড়ন সৃষ্টি করার শক্তি আর সবশেষে নিজেকে ব্যক্ত করার সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। এদের মাঝেই একজন আছেন যিনি আমাদের বাংলাদেশের সন্তান, আর নামটা মোটেও অপরিচিত নয়- ‘জিএমবি আকাশ’।
ব্যক্তিজীবনে জিএমবি আকাশ
ঢাকা থেকে ৩০ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ শহরে তার জন্ম ১৯৭৭ সালে। স্কুলজীবনে সবসময়ই ছিলেন একজন ব্যাক বেঞ্চার। তার সবসময়ই মনে হত, অন্যান্য শিশুদের মতো তার কোনো ধরণের মেধা নেই কিন্তু তাঁর জীবনে নতুন আলোর সন্ধান দেয় আলোকচিত্র। বাবা সরকারী চাকরি করতেন। ভ্রমণের প্রতি বাবার নেশা থাকায় সন্তান হিসেবে তিনিও বাবার সাথে ঘুরেছেন বহু জায়গায়। আর এভাবেই ভ্রমণের নেশা প্রবাহিত হয় পরবর্তী প্রজন্মে। ক্লাস নাইন থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন ময়মনসিংহে এবং এরপর চলে আসেন নারায়ণগঞ্জে।
নিজের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং ছবির পৃথিবীর সাথে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তার জীবনের শুরুর দিনগুলো তার পেশাগত জীবনের সাথে কখনোই সম্পর্কিত ছিল না। শৈশবের সময়টাতে তার কোনো আলোকচিত্রী অথবা তাদের কাজের সাথে কোনো পরিচয় ছিল না এমন কি সেই সময়টাতে তার কোনো ক্যামেরাও ছিল না। তাত্ত্বিক অথবা প্রায়োগিক কোনোভাবেই তার জীবনে ছবি তোলার কোনো অংশ ছিল না। বাবার পুরোনো ক্যামেরা খুঁজে পাওয়ার পর তার জীবন মোড় নেয় অন্য দিকে। ছবি তোলার প্রতি মোহটাই তাকে নিয়ে আসে আলো-ছায়ার ভুবনে। সময়কে ফ্রেমে বন্দী করে রাখার দুর্নিবার আকর্ষণই তাকে তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে প্রেরণা দেয় এবং এই বিষয়ে তার সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞতাও হার মানে তার আগ্রহের কাছে। কী করছেন আর কেনই বা করছেন এসব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে তিনি ছুটেছেন তার ইচ্ছাকে মূল্য দিতে। আর সেজন্যই যখন যেখানে যা কিছুই তার মনযোগ কেড়েছে, তারই ছবি তিনি তুলেছেন দারুণ আগ্রহে।
সমাজের প্রান্তিক মানুষরা সবসময়ই হয়েছেন তার ছবির বিষয়বস্তু, কারণ তাদের চেহারার গভীর হতাশা, সংগ্রাম করার নিষ্ঠা এবং কষ্টের জীবন তার কাছে আগ্রহের বিষয় ছিল। দিনের পর দিন তিনি সময় কাটিয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সাথে এবং তাদের লোকালয়েই। দীর্ঘদিন তাদের সাথে থেকে তাদের জীবনকে তাদের মতো করেই অনুভব করার চেষ্টা করেছেন, পৌঁছাতে চেয়েছেন তাদের মনের কাছাকাছি এবং হতে চেয়েছন তাদের আপন কেউ। কারণ সবাই ছবি তুললেও তিনি বরাবরই চেয়েছেন ছবির পিছনের গল্গগুলো তুলে আনতে। প্রতিটি ভ্রমণই তাকে সাহায্য করেছে মানবতাকে আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে।
ছবির সাথে সংসার
ছবি তোলার প্রতি তার আবেগ জন্ম নেয় ১৯৯৬ সালের দিকে। ঢাকায় তিন বছর তিনি ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন ও পাঠশালা থেকে আলোকচিত্র সাংবাদিকতায় ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জন করেন। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ এই পৃথিবীতে আলোকচিত্রও এখন যথেষ্ট গতিশীল। তাই তিনি মনে করেন, শিল্পের এই অঙ্গনে টিকে থাকতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবশ্যই দরকার আছে। তবে এই সৃজনশীল ভুবনে নিজের স্থান করে নেয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি জিনিস হচ্ছে প্রচণ্ড উৎসাহ এবং নিবেদিতপ্রাণ ভালবাসা।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তাকে যথেষ্ট সাহায্য করলেও তিনি বিশ্বাস করেন, সবচেয়ে কার্যকরী শিক্ষা পেয়েছেন তিনি অন্যান্য আলোকচিত্রীদের সাথে থেকে এবং তাদের কাজ দেখে। ছবি তোলার নেশাই তাকে উৎসাহ দিয়েছে প্রত্যহ নতুন জায়গায় যেতে, নতুন মানুষদের সাথে মিশতে। অসংখ্য আলোকচিত্রীর কাজ দেখে তিনি নিজেকে করেছেন সমৃদ্ধ এবং একইসাথে চিত্রকর্ম, গান ও চলচ্চিত্র থেকেও তিনি অনেক কিছু শিখেছেন।
ছবি তোলার প্রতি ভালোলাগাই তাকে প্রতিনিয়ত তাগিদ দিয়েছে আপামর জনসাধারণের সাথে মেশার। প্রতিটি জায়গায় গিয়ে তিনি নতুন করে মানবতাকে আবিষ্কার করেছেন। একজন আলোকচিত্রী হতে পেরে তিনি নিজেকে আশীর্বাদপুষ্ট মনে করেন। ছবির মাধ্যমে নির্বাক, অসহায়, নিপীড়িত মানুষের কথাগুলো বলার মাধ্যমে, পরিচয়হীন মানুষগুলোকে সমাজে আরও একটু ভালভাবে জায়গা করে দেওয়া এবং স্পষ্টভাবে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার মাধ্যমে তিনি মূলত নিজের জীবনেই অর্থবহতা যোগ করেন। আর এভাবে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যটা আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে তার কাছে।
ছবি তোলার প্রেরণা
জিএমবি আকাশের কাছে ফটোজার্নালিজম একটি বিশাল দায়িত্বের জায়গা এবং অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ। তার মতে, একজন আলোকচিত্র সাংবাদিককে হতে হবে সৎ, পরিশ্রমী, সময়নিষ্ঠ এবং প্রতিটি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
তিনি বিশ্বাস করেন, আলোকচিত্র এই সমাজে যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তার তোলা ছবিগুলো তার নিজের ভাষা, যে ভাষায় তিনি বলতে চান সমাজের কোন বিষয়গুলো সংশোধিত হওয়া দরকার অথবা কোন বিষয়গুলোকে সাধুবাদ জানানো উচিৎ। সমাজের অবহেলিত মানুষের মুখের ভাষা, আর্থিক কষ্ট বা দৈন্যতার কাছে হেরে যাওয়া, বারবার হোঁচট খেয়ে আবারও নতুন উদ্যমে নিজেকে গড়ে তোলা- এসবের মাঝে যে তীব্র জীবনবোধ বা বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা কাজ করে, সেটাই তাকে আজও উৎসাহ দেয় ছবি তোলার।
বাংলাদেশে একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার হিসেবে টিকে থাকাটা মোটেও সহজ কিছু না। প্রযুক্তির কল্যাণে এএফপি, রয়টার্স, এপি এবং ইপিএ এর মতো গণমাধ্যমগুলো বলতে গেলে বাজারের সিংহভাগ দখল করে রেখেছে। কারণ এগুলো যথেষ্ট গতিশীল এবং শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। সর্বত্রই তাদের কর্মী রয়েছে। তাই এরকম অবস্থায় একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার হিসেবে নিজের কাজ কোথাও প্রকাশ করা এক অর্থে কঠিনই হয়ে পড়ে। তবে তিনি অন্তঃপ্রাণভাবে বিশ্বাস করেন, কেউ যদি তার কাজের প্রতি সৎ থাকে, তাহলে শেষপর্যন্ত কাজও তার প্রতি সৎ থাকে এবং সাফল্য ধরা দেয়।
শুধুই কি নিজের জন্য এত সব আয়োজন?
ছবি তোলার প্রতি নেশা তাকে এনে দিয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি; নাম, যশ সহ হয়েছে অনেক কিছুই। বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন, খ্যাতি পেয়েছেন, ভূষিত হয়েছেন অসংখ্য পুরষ্কারে। বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট থেকে আর্থিকভাবেও লাভবান হয়েছেন। তবে তো প্রশ্ন এসেই যায়, যে মানুষের ছবি তুলে তিনি এত পরিচিতি পেয়েছেন, যাদের সাথে এত সখ্যতা, যারা তার ছবি তোলার বিষয়, দিনশেষে তাদের প্রাপ্তি কী? চলুন দেখা আসা যাক বাস্তবতা!
নিজের প্রাপ্তিগুলো নিয়ে ফিরে এসে আবার সেই মানুষগুলোর মাঝেই বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। জীবনকে আরেকটু সুন্দর করে সাজাতে সাহায্য করেছেন। পঞ্চাশটির মতো পরিবারের হাতে তিনি তুলে দিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা, তাদেরকে করে তুলেছেন স্বাবলম্বী। বৈভবের মাঝে তিনি চাইলেই গা ভাসাতে পারতেন, অথচ কী সাধারণভাবেই না তিনি ফিরে এসেছেন তার গল্গগুলোর চরিত্রদের কাছে! ছবির মাধ্যমে তিনি শেষ অবধি এটাই বলতে চেয়েছেন, “আমার তোলা ছবির মাঝে আমি মানুষ এবং তাদের প্রাণচাঞ্চল্য খুঁজে পাই।” জনসাধারণের হয়ে কথা বলতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অনেকটাই একা হয়ে গেলেও তিনি দৃঢ়চিত্তে নিজের প্রতিই উচ্চারণ করেছেন হেলেন কেলারের সেই বিখ্যাত উক্তি-
“I am only one, but still I am one. I cannot do everything, but still I can do something; and because I cannot do everything, I will not refuse to do something that I can do.”
জীবনের জয়গান
জীবনে ছবি তোলাকে ভালবাসতে গিয়ে অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। তবুও নিজের জায়গায় অটল থেকেছেন। বিশ্বকে বদলে দেওয়ার চিন্তা হয়তো ছিল না তার শুরুতেই, কিন্তু কালক্রমে পুরো পৃথিবী তার কাজের দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে আর অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করে জীবনকে। কারণ তিনি তো সেই কারিগর, যিনি শিক্ষা দেন শুধু কথা নয়, কাজ দিয়ে মানুষের কাছাকাছি গেলে তবেই অনুভব করা যায় জীবনকে।
ফিচার ইমেজ- gmb-akash.com