‘ডাইনি’ শব্দটি শুনলে আমাদের অনেকের মানসপটে কাঁচা-পাকা চুল, খসখসে কণ্ঠস্বর, চামড়ায় ভাঁজ পড়ে যাওয়া এক বৃদ্ধা মহিলার ছবি ভেসে ওঠে। অধিকাংশ সময়ই সেই মহিলা একটি ঝাড়ুর উপর বসে থাকেন। দরকার পড়লেই ঝড়ের বেগে তিনি এখানে-সেখানে উড়ে বেড়ান ঝাড়ুতে করে, হাতে থাকা জাদুর দন্ড দিয়ে নিরীহ লোকজনকে দেখান ভয়। বলা চলে, বেশ ভয়াবহ আর অনিষ্টকারী চরিত্র হিসেবেই আমরা একজন ডাইনিকে মনে করে থাকি। এতক্ষণ ধরে ডাইনির যে রুপের কথা বললাম, তা অধিকাংশ সময় কার্টুন নেটওয়ার্কে টম এন্ড জেরি সহ আরো অনেক কার্টুনেই দেখা গিয়েছে। এছাড়া শৈশবে পড়া বিভিন্ন রুপকথার বইয়েও আমরা এমনভাবেই ডাইনিকে চিত্রায়িত হতে দেখেছি।
বাস্তবতা হলো, দুনিয়াতে আসলে ডাইনি বলে কোনোদিনই এমন কেউ ছিলো না। কেউই কোনোদিন ঝাড়ুতে চড়ে উড়ে উড়ে জাদু প্রয়োগ করে বেড়ায় নি। বাস্তব জগতে কল্পনার সেই ডাইনি না থাকলেও মানুষ কিন্তু নারীদের ‘ডাইনি’ অপবাদ দেয়া বাদ দেয় নি। মধ্যযুগে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিলো যে, কোনোপ্রকার প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র শত্রুতার জের ধরে কিংবা বলির পাঠা বানাতে শত শত নারীকে ডাইনি অপবাদ দেয়া হয়েছে। এরপর? এরপর লোক দেখানো বিচার নামক এক প্রহসনের মাঝে দিয়ে যেতে হতো তাদের, অধিকাংশ সময়ই যার চূড়ান্ত পরিণতি হতো আগুনে পুড়িয়ে হত্যা!
ইতিহাসের এমনই কয়েকটি ডাইনি বিচার ও পরবর্তী করুণ পরিণতি নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের এ লেখা।
আইল্যান্ডম্যাগীর আট ডাইনি
আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগেকার কথা। আয়ারল্যান্ডের গ্রাম্য একটি এলাকার নাম ছিলো আইল্যান্ডম্যাগী। সেখানেই নোয়ীহেড হাউজে স্থানীয় এক পুরোহিতের বিধবা স্ত্রী থাকতেন। ১৭১০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে তার সাথে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। বাইরে থেকে কেউ তার বাড়ির জানালায় প্রায়ই পাথর ছুঁড়ে মারতো। বাড়ির নানা জিনিস মাঝে মাঝেই হারিয়ে যেতো, কিছুদিন পরে সেগুলো আবার খুঁজেও পাওয়া যেত। কখনো কখনো বিছানার চাদর এমনভাবে গোটানো থাকতো যে, দেখে মনে হবে ওটা কোনো লাশ!
একদিন সেই বৃদ্ধা হঠাৎ করে দাবি করে বসেন অশরীরী এক আত্মা এসে তাকে সতর্ক করে গেছে, খুব শীঘ্রই মৃত্যু হবে তার। সত্যি সত্যিই এই হুমকির পর আর বেশিদিন বেঁচে থাকেন নি সেই মহিলা। ১৭১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি। জানা যায়, সেদিন নাকি পিঠে কেউ ছুরি দিয়ে কোপালে যেমন যন্ত্রণা হয়, তেমনই ব্যথা অনুভূত হয়েছিলো তার।
বৃদ্ধার এমন মৃত্যুতে নড়েচড়ে বসলো এলাকাবাসী। সবাই দাবী করতে থাকলো- নিশ্চয়ই ডাকিনীবিদ্যার প্রভাবে অমন অদ্ভুত সব কাজকারবার ঘটে চলেছে। ব্যাপারগুলো আরো বিচিত্র হয়ে ধরা দিতে থাকলো যখন মেরি ডানবার নামে এক কিশোরী সেই বৃদ্ধার একটি এপ্রন খুঁজে পায়। লোকমুখে শোনা যায়, তখন মেরিকে ঘিরেও নানা অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিলো।
লোকে বলতো, মেরির উপর কোনো অশরীরী আত্মা ভর করেছে! প্রায় একমাস নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করে একদিন হঠাৎ করে মেরি সেই এলাকার আটজন মহিলার নাম বলে, যাদেরকে সে ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো। তার দাবি ছিলো, গত এক মাসে এই মহিলাদের ছবি প্রায় সময়ই তার মানসপটে ভেসে উঠেছে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, মেরি নামের একটি কিশোরী আটজনের নাম বললো, আর স্থানীয় গির্জার যাজকেরাও সেটা সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করে নিয়েছিলো। তার কথা কতটুকু যৌক্তিক, সে কি মানসিকভাবে সুস্থ কিনা- এসব কোনোকিছুই বিবেচনায় আনে নি তারা। সেই আট নারী নিজেদের বারবার নির্দোষ দাবি করা সত্ত্বেও কোনো লাভ হয় নি। বিচারক রায় দিয়েছিলেন এই আট নারীকে নোংরা বন্দীশালায় পুরো একটি বছর আটকে রাখতে হবে।
শেষপর্যন্ত কিছু না করেও তাই শুধুমাত্র এক কিশোরীর উদ্ভট দাবির জন্য নিরপরাধ আট নারীকে ডাইনি অপবাদ নিয়ে পুরো এক বছরই কারাবাস করতে হয়েছিলো।
স্কটল্যান্ডের ডাইনি নিধন
সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্কটল্যান্ডের জনগণ তাদের ইতিহাসে অন্যতম এক ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাক্ষী হয়। এর শুরুটা হয়েছিলো এডিনবার্গের কাছাকাছি কিছু ছোট এলাকা থেকে। মাত্র নয় মাসের মাঝে সেখানকার প্রায় দু’শ নারী-পুরুষকে জাদুবিদ্যার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে আটক করা হয়। এরপর দাবানলের মতো পুরো দেশজুড়ে জাদুবিদ্যার সাথে জড়িতদের ধরপাকড়ের এ মহোৎসব (!) শুরু হয়ে গেলো।
ইতিহাস বলে, এ ঘটনার ব্যপ্তিকাল ছিলো ১৬৬১-৬২ সাল। তখন ’৬২ সাল শেষ হওয়ার আগে এমন প্রায় ৬৬০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিলো। তাদের ঠিক কতজনের যে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিলো সেটা ঠিক নিশ্চিত না। ৬৫ জনের কথা যেমন জানা যায়, তেমনি ৪৫০ জনের কথাও জানা যায়।
ইতিহাসবিদগণ স্কটল্যান্ডে এভাবে হঠাৎ করে জাদুবিদ্যার সাথে জড়িতদের উপর জনতার আক্রোশের কারণ হিসেবে মূলত সেখান থেকে ইংরেজ শাসনের বিদায়কে চিহ্নিত করে থাকেন। ইংরেজ বিচারকরা জাদুকর-জাদুকরীদের বিচার করতে চাইতেন না। তাদের বিদায়ের পর তাই স্কটল্যান্ডের জনগণের সামনে আর কোনো বাধা রইলো না। স্থানীয় গির্জার লোকজনও এতে ইন্ধন জুগিয়েছিলো এ প্রত্যাশায় যে, এতে জনগণের উপর তাদের প্রভাব বিস্তারের পথ সুগম হবে।
একসময় অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার এসব কাজকর্মে অতিষ্ট হয়ে ওঠে। জাদুবিদ্যার সাথে জড়িত থাকার দোষে আটককৃত বেশ কয়েকজনকে নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তি দেয়া হয়। ওদিকে যারা এভাবে জাদুকর-জাদুকরীদের ধরছিলো, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবার তাদের গ্রেফতার করা শুরু করে। তখনই বোধোদয় হয় এর সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের। এরপর তারা মানে মানে সেসব কাজকারবার থেকে সরে আসেন।
ট্রায়ারের ডাইনি হত্যাযজ্ঞ
এ ঘটনাটি ঘটেছিলো জার্মানির ট্রায়ার অঞ্চলে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিককার সময়ে। খারাপ আবহাওয়ার প্রভাবে সেখানে বেশ কয়েক বছর যাবত ফসলের ফলন ঠিকমতো হচ্ছিলো না। কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনতা কারণ খুঁজতে গিয়ে দাবি করে বসলো, তাদের এলাকায় নিশ্চয়ই ডাইনি আছে যাদের জাদুর প্রভাবেই তাদের এমন দুর্দশা।
ব্যস, স্থানীয় গির্জার লোকজনও বোধহয় এমনটাই চাচ্ছিলো। তারা সাথে সাথেই জনতার দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করে ডাইনি নিধনকার্যে নেমে পড়লো।
১৫৮২-৯৪ পর্যন্ত প্রায় এক যুগ ধরে চলে হত্যাকান্ড। এসবের নেতৃত্বে ছিলেন বিশপ পিটার বিন্সফেল্ড। বিন্সফেল্ড আবার প্রিন্স-বিশপ জোহান ভন শোনেনবার্গের ছত্রচ্ছায়াতে থেকেই এসব করে যাচ্ছিলেন। বৃদ্ধা মহিলাদের পাশাপাশি ধনী পরিবারের যেসব সদস্য তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতো, তাদেরকেও ছাড় দিতো না বিন্সফেল্ডের দল। সবাইকেই জাদুকর আখ্যা দিয়ে তাদের শাস্তি দিতো তারা। ট্রায়ারের ডেপুটি গভর্নর দিয়েত্রিচ ফ্লেড বিন্সফেল্ডের দলের এহেন কাজকর্মে লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এতে হীতে বিপরীত হয়ে যায়। বিন্সফেল্ডের দল লোকটিকে পিটিয়ে তার মুখ থেকে এ কথা বের করে যে, সে-ও একজন জাদুকর। এরপর তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।
প্রায় এক যুগ ধরে চলা এ হত্যাকান্ডে পকেট ভারী হয়েছিলো বিন্সফেল্ডের মতো কিছু অমানুষের। আনুমানিক ৩৬৮ জন মানুষ মারা গিয়েছিলো সে সময়।
নর্দাম্পটনের ডাইনি বিচার
স্কটল্যান্ড আর ট্রায়ারের মতো একই ঘটনা ঘটেছিলো নর্দাম্পটনেও। এবার সমাজের ধনীক শ্রেণী লেগেছিলো সাধারণ নারীদের পেছনে। ঘটনার সূত্রপাত এলিজাবেথ বেলচার নামক এক ধনী নারীর হাত ধরে। জোয়ান ব্রাউনী নাম্নী অপর এক সাধারণ পরিবারের নারীকে তিনি সহ্যই করতে পারতেন না। তাই একদিন তিনি অভিযোগ আনেন জোয়ান তাকে অভিশাপ দিয়েছে। কিছুদিন পর কোনো কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন এলিজাবেথ। ব্যস, এই তো চাচ্ছিলেন তিনি। সাথে সাথেই আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি, জাদুবিদ্যা প্রয়োগের অভিযোগ আনেন জোয়ানের বিরুদ্ধে।
এলিজাবেথের সাথে যোগ দেন তার ভাই উইলিয়াম অ্যাভেরিও। তিনিও দাবি করেন, অভিশাপ তোলার ব্যাপারে অনুরোধ করতে তিনি জোয়ানদের বাড়িতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এক অদৃশ্য শক্তি তাকে সেটা করতে দেয় নি। ব্যাপারটি যে ডাহা মিথ্যা কথা তা তো সহজেই বোঝা যাচ্ছে। এই অভিযোগের জের ধরে আদালতে ধরে আনা হয় জোয়ান, তার বৃদ্ধা মা অ্যাগনেস এবং অন্য আরো চারজনকে। বিচারে জাদুবিদ্যা চর্চার অভিযোগ এনে তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দেয়া হয়। শোনা যায়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে নারীদের বন্দীশালায় প্রবেশের অনুমতি ছিলো উইলিয়ামের। সেখানে বৃদ্ধা অ্যাগনেসকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে আসতেন তিনি। কারণ তখন বিশ্বাস করা হতো কোনো ডাইনির রক্ত ঝরালে তার দেয়া অভিশাপ কেটে যাবে!
ভাল কামোনিকার দুর্ভাগা জনগণ
ইতালির ভাল কামোনিকার জনগণ বোধহয় নিজেরাও জানতো না যে তাদেরকে জাদুবিদ্যার চর্চাকারী, খারেজী ইত্যাদি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়। কিছুটা দূরবর্তী, পাহাড়-পর্বতে ঘেরা এ অঞ্চলের জনগণের অজ্ঞতা নিয়ে গির্জারও খুব একটা মাথাব্যথা ছিলো না। তারা ছিলো ভেনিসের অধীন একটি এলাকা।
সমস্যাটা বাধে ১৪৫৫ সালে। সেই বছর বাহির থেকে ধর্ম-বিচারসভার একজন বিচারক গিয়েছিলেন ভাল কামোনিকা পরিদর্শনে। সেখানকার অধিবাসীদের জীবনযাপনের রীতিনীতি দেখে মাথা গরম হয়ে যায় তার। সাথে সাথেই তিনি এই লিখে অভিযোগ জানান যে, এই এলাকার লোকেরা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে সরে গেছে, শিশুদেরকে তারা উৎসর্গ করে এবং শয়তানের আরাধনা করে।
শিশুবলি দেয়ার এ দাবি যে কতটা সঠিক তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ভাল কামোনিকার জনগণের ভাগ্যে দুর্ভাগ্য নেমে আসে পরবর্তীতে। ১৫০৫-১০ এবং ১৫১৮-২১ সময়কালে তাদেরকে শায়েস্তা করতে লোক পাঠানো হয়। সেই লোকেরা স্থানীয় জনগণকে উদ্ভট সব প্রশ্ন করতো, অমানবিক নির্যাতন করে তাদেরকে জাদুকর-জাদুকরী হিসেবে আখ্যা দিতো। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে পুড়িয়ে মারা হতো। এভাবে প্রায় একশজনের মতো মানুষকে মারা হয়েছিলো তখন।
ওদিকে ভাল কামোনিকার জনগণের উপর যে এভাবে নির্যাতনের স্টিম রোলার চলছে তা জানতো না ভেনিস কর্তৃপক্ষ। জানতে পেরে তার যেন আকাশ থেকে পড়লো। কারণ সেই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে এমন অভিযোগের কথা তারা চিন্তাই করতে পারে নি। ভাল কামোনিকার জনগণ সহজ-সরল, কিছুটা অনগ্রসর; কিন্তু তাই বলে তারা শয়তানের আরাধনা করে এমনটা কোনোভাবেই বলা যাবে না। সাথে সাথেই তারা ভাল কামোনিকার ধর্ম-বিচারসভার প্রধান বিচারককে অব্যাহতি দেয় এবং এ হত্যাকান্ডের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। এমনকি তারা এটাও ঘোষণা দেয় যে, নির্মম এ হত্যাকান্ডে যারা মারা গিয়েছে তারা সবাই শহীদ হয়েছে!