১৯৬৯-৭০ সালের দিকের ঘটনা। চীন ও সোভিয়েত সীমান্তে প্রায়ই তখন সংঘাত লেগেই রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট তখন বেশ চরমে উঠেছে। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে চীনের উসুরি নদীর জেনবাও দ্বীপে দুই দেশের মধ্যে এক মারাত্মক সংঘর্ষ বাঁধে। স্থানীয়রা একে ‘জেনবাও দ্বীপের সংঘর্ষ’ নামেও অভিহিত করে থাকে। ফলে দু’দেশের মধ্যে এক বড় ধরনের যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়।
দিনের পর দিন দু’দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ বাড়তে থাকে। দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক এতটাই খারাপ পর্যায়ে চলে যায় যে, চীন ধারণা করতে থাকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেকোনো সময় চীনে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করতে পারে। তখন চীনের বেইজিং শহরের তলদেশে সামরিক প্রতিরক্ষার জন্যে অনেকগুলো সুড়ঙ্গের সমন্বয়ে নির্মিত হয় একটি বোমাবিরোধী আশ্রয়কেন্দ্র। একে ভূগর্ভস্থ মহাপ্রাচীরও বলা হয়ে থাকে। আর ভূগর্ভস্থ শহরটির স্থানীয় নাম ‘ডিজিয়া চেং’।
বেইজিং বা পিকিং হল চীনের রাজধানী। ১৯৬৯ সালে এই শহরটি সোভিয়েত ইউনিয়নের রোষের কারণ হয়ে উঠতে পারে ভেবে পুরো চীন তখন তটস্থ। স্বাভাবিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তখন যুদ্ধাস্ত্রে শক্তিশালী দেশ। পারমাণবিক ও বায়োক্যামিকেল অস্ত্রেও তখন দেশটি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। জাপানে ঘটে যাওয়া পারমাণবিক হত্যাযজ্ঞের বিভীষিকাময় চিত্র তখনও মানুষের মন থেকে হারিয়ে যায়নি। বেইজিংয়ে যদি পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়, তাহলে যে শহরটি কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, তা আর কারও বোঝার বাকি নেই। আর তার সাথে জড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার মানুষের জীবনও।
সোভিয়েতের আগ্রাসন ঠেকানোর জন্যে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং মাটির নিচে কোনোভাবে কিছু করা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনায় বসেন। দেশের সকল দক্ষ প্রকৌশলী এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দিন-রাত পরিশ্রমের ফলে ভূগর্ভস্থ একটি বাসযোগ্য স্থানের পরিকল্পনা করা হয়। রীতিমতো একটি শহরের আদলে পুরো ভবনের পরিকল্পনা করা হয়। এটি মূলত ভবন নয়, মাটির নিচে অনেকগুলো সুড়ঙ্গের যাতায়াত পথ যেখানে বিভিন্ন ফটকে ছিল দৈনন্দিন জীবন যাত্রার বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা। নকশায় তুলে ধরা হয়, সুড়ঙ্গের বিভিন্ন স্থানে রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল, স্কুল, মার্কেট সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা ও ব্যবহারের সুব্যবস্থার দিকগুলো। সাথে ছিল বয়স্কদের জন্য বিনোদন ব্যবস্থা, ছোটদের খেলাধুলার জায়গা, চুল কাটার স্থান, কাপড় ধোয়ার যন্ত্রপাতি, রান্নার ব্যবস্থা এমন আরও অনেক কিছু।
নকশার মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল পানির অপর্যাপ্ততা এবং বায়ু সঞ্চালনে বাধা। পানির অভাব পূরণ করতে বিভিন্ন স্থানে পানির কূপ খননের কথা চিন্তা করা হয়। কূপ খননের জন্যে প্রায় ৭০টির উপর জায়গা নির্বাচন করা হয়। আর সুড়ঙ্গের ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস থেকে রক্ষা করতে প্রায় ২,৩০০ পর্যায়ে বায়ুচলাচলের ব্যবস্থা করা হয়।
অবশেষে সুড়ঙ্গের কাজ শুরু করার জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তোড়জোড় শুরু করা হয়। কিন্তু প্রাথমিক বাধা আসে শ্রমিক ও অর্থের বিষয়ে। সুড়ঙ্গের কাজ শেষ করতে প্রচুর অর্থ ও লোকবলের প্রয়োজন ছিল। তখন শহরের মানুষদের বোঝানো হতে লাগল যে, তাদের জীবনের প্রয়োজনেই এই সুড়ঙ্গ নির্মাণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই তাদের সকলের সহযোগিতায় কেবল এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব। তখন স্কুল-কলেজের ছাত্র সহ স্থানীয়রা বিনা পারিশ্রমিকে নিয়মিত কাজ করতে সম্মত হয়। প্রায় তিন লাখের উপর লোকের নিরলস চেষ্টার ফসল হিসেবে তৈরি হয় সুরঙ্গগুলো। তাদের ছিল না কোনো ভারী যন্ত্রপাতি, ছিল না কোনো আধুনিক সুযোগ সুবিধা। বিভিন্ন পুরনো স্থানের ভগ্নাবশেষ দিয়ে ধীরে ধীরে তৈরি করা হয় ভেতরকার সাজ।
১৯৬৯ সালে শুরু হয়ে প্রায় দশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে সুড়ঙ্গগুলোর কাজ শেষ হয়। শহরের মূল কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় ৮৫ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই সুড়ঙ্গগুলোর অবস্থান। শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান এবং সরকারি মহলের সাথে সুড়ঙ্গগুলির আন্তঃযোগাযোগ আছে বলে ধারণা করা হয়। মূল নকশা থেকে জানা যায় যে, মোট নব্বইটির মতো সুড়ঙ্গে ঢোকার পথ রয়েছে। এই সুড়ঙ্গের ব্যাপারে চীনা সরকার সবসময় এক ধরনের সতর্কতা এবং গোপনীয়তা বজায় রেখেছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে, কখনো এই সুড়ঙ্গের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনকিছু ঘোষণা করা হয়নি।
তবে যে উদ্দেশ্যে এই সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্যে কখনো এই সুড়ঙ্গ ব্যবহার করতে হয়নি। সুড়ঙ্গের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর থেকে স্থানীয়রা বিভিন্নভাবে এর ব্যবহার নিশ্চিত করে আসছে। সুড়ঙ্গগুলোর বিভিন্ন মুখ সরাসরি প্রধান সড়কের সাথে যুক্ত রয়েছে। তাই সেসব মুখে রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে কেনাকাটার জন্যে বাজার, এমনকি থিয়েটার পর্যন্ত রয়েছে। তবে বেশিরভাগ সুড়ঙ্গের মুখই বন্ধ হয়ে গেছে বা সেখানে ঢোকার বা হাঁটার মতো অবস্থা নেই।
কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে সুড়ঙ্গগুলো কখনো পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করা হয়নি। স্থানীয়রা বিভিন্নভাবে সুড়ঙ্গগুলো ব্যবহার করে চলেছে। শহরজুড়ে রয়েছে হাজারো শ্রমিক, আছে কলেজে পড়া ছাত্ররাও। বাসস্থানহীন এমন অনেকেই রাতের আঁধারে আশ্রয় নেয় এই সুড়ঙ্গগুলোতে। যেসকল সুড়ঙ্গ মোটামুটি থাকার মতো, সেগুলোতে রাতের বেলা তিল-ঠাঁই জায়গা মেলা ভার।
ধীরে ধীরে চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে সম্পর্কের উন্নতি ঘটতে থাকে। সকল সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯১ সালে চীন-সোভিয়েত সীমান্ত চুক্তি সাধিত হয়। সেই থেকে বাইরের দেশের মানুষ ধীরে ধীরে এই সুড়ঙ্গ সম্পর্কে জানতে শুরু করে।
২০০০ সালের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে দর্শনার্থীদের জন্যে খুলে দেওয়া হয় সুড়ঙ্গটি। সরকার নির্ধারিত একটি ফি দিয়ে তবেই সুড়ঙ্গপথে প্রবেশ করা যেত। তবে পুরো সুড়ঙ্গ দেখার সুযোগ কখনো দর্শনার্থীদের হয়নি, একটি নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি থাকত কেবল। মূল রাস্তা থেকে একটি ছোট দোকানের প্রবেশ মুখের দরজার মতো স্থান দিয়ে ভেতরে ঢুকতে হত। রাস্তা থেকে প্রায় ৮-১৮ মিটার নিচের দিকে সুড়ঙ্গটির যাত্রাপথ। ভেতরের দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার এবং স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। তবে সুড়ঙ্গে চলার পথে বিভিন্ন কোটর পাওয়া যায়, যেখানে ‘টয়লেট’, ‘বার্বার হাউস’, ‘কুকিং’ এমন সব লেখা বোর্ড পাওয়া যায়। অনেকে একে আবার ভুতুড়ে সুরঙ্গও বলে থাকেন। সুড়ঙ্গের ভেতরে একটি সচল রেশম কারখানা রয়েছে, যা থেকে আজও বেশ উন্নতমানের রেশম পাওয়া যায়। মূলত যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর জীবনধারণের জন্যে বেঁচে থাকার নিমিত্তে এই রেশম কারখানা নির্মাণ করার পরিকল্পনা করা হয়।
তবে সময়ের বিবর্তনে সুড়ঙ্গের অনেক জায়গা বিপদজনক হয়ে পড়ে এবং অনেক প্রবেশদ্বার পুরোপুরি অকেজো ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সুড়ঙ্গের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পুনরায় সংস্কার করার উদ্দেশ্যে এবং বাড়তি সতর্কতার জন্যেই ২০০৮ সালে এটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকে আজও এটি বিদেশী পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি।
সময়ে সময়ে চীনের অনেক কর্মকাণ্ড পৃথিবীর মানুষকে হতবাক করেছে। পৃথিবীর বুকে দেশটি অনেকবারই প্রমাণ করেছে যে, অসম্ভব বলে কোনো শব্দ যেন তাদের জানা নেই। বেইজিং শহরের এই মাটির নিচের সুড়ঙ্গগুলো যেন সেই কথাই আরেকটিবার প্রমাণ করে।