২০১৫ এর শেষ দিকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলো যে, “আপনার চোখে কে সেরা প্লেয়ার বর্তমানে?” রোনালদোর উত্তর ছিল, “আমি। আপনাদের চোখে অন্য কেউ হতেই পারে, তবে আমার মাথায় কেবল আমিই সেরা!” প্রতিপক্ষ বাদ দেই, খোদ নিজের দলের সমর্থকরাও এর সাথে একমত ছিল না। তখন রোনালদো তাঁর স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে সময় পার করছেন। বয়স ৩০ এর ঘরে, যে সময়টাকে স্ট্রাইকারের জন্য শেষের শুরু ধরা হয়, সাথে চলছে গোলখরা। কিছুদিন আগেই মালাগার সাথে এক ম্যাচে এত এত সহজ সুযোগ মিস করেন, যে কারণে এক বিখ্যাত স্প্যানিশ পত্রিকা লিখে দেয়, “The End”।
রিয়াল হোঁচটের পর হোঁচট খাচ্ছে, ওদিকে সদ্য ট্রেবল জয়ী বার্সা তাঁর অদম্যতা লীগে ধরে রেখে ছুটছে, মেসি তাঁর ফর্মের তুঙ্গে। খবরের কাগজ খুললেই কে হবে রিয়ালে রোনালদোর রিপ্লেসমেন্ট তা নিয়ে গুঞ্জন। হ্যাজার্ড না ডিবালা- এসব নিয়ে খবর। অনেক সমর্থক আর অধিকাংশ মিডিয়া ধরে নেয় যে তাঁর সময় শেষ। তখন জিদান কোচ হয়ে এলেন। রোমার সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শেষ ষোলতে অসাধারণ খেলে কোয়ার্টারে তোলেন রিয়ালকে। উলফসবারগের সাথে ২-০ তে তাদের মাঠে হেরে আসে রিয়াল। সেমিতে উঠতে হলে ঘরের মাঠে কমপক্ষে ৩-০ তে জিততে হতো। রোনালদোর হ্যাটট্রিকে ঘরের মাঠে ৩-০ তে জিতেই সেমি ফাইনালে উঠে রিয়াল। এবার শুরু হলো রোনালদো বন্দনা ঐ পারফর্মেন্সের জন্য। ঐ দুঃস্বপ্নের সিজনে প্রথম আশার সুবাস ছড়িয়েছিল এই হোম পারফর্মেন্সই। ফাইনালে এটলেটিকোকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিতল রিয়াল। খালি হাতে ফেরা, নাকি দুঃস্বপ্নের সিজনেও ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্ব- এমন সমীকরণে দাঁড়িয়ে ডিসিসিভ পেনাল্টিতে গোল করেন রোনালদো।
এরপর শুরু হলো ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপ। রোনালদোর জাতীয় দল পর্তুগাল কোনো ফেভারিট টিম না। প্রথম দুই ম্যাচ ড্র করে এলো পর্তুগাল, বাদ পড়ার দ্বারপ্রান্তে। রোনালদো নিষ্প্রভ। আবার রব উঠে গেল জাতীয় দলে রোনালদো ফ্লুক, ফ্লপ এসব। বাঁচা-মরার ম্যাচে হাঙ্গেরির সাথে দুই গোল এক এসিস্টে দলকে শেষ ষোলোতে তোলেন। এরপর সেমিতে গোল করে নিয়ে যান ফাইনালে। ফাইনালে এক-তৃতীয়াংশ পার হবার আগেই ইনজুরির কারণে উঠে যেতে হয়।
এরপর বিশ্ব দেখেছিলো অন্য এক রোনালদোকে। ডাগ আউটে দাঁড়িয়ে কোচের মতো ডিরেকশন দিয়ে যাচ্ছেন শেষ বাঁশি বাজার আগ পর্যন্ত। এডারের দেয়া গোলে তাদের ইতিহাসের প্রথমবারের মতো ইউরো জিতে পর্তুগাল। তো ডাগ আউটে লাফালাফির মধ্যে কি এমন ছিল? ছিল ট্রফি জেতার অদম্য ইচ্ছা, স্পৃহা, নিজেদের ইতিহাসকে নতুন করে লেখার আকাঙ্ক্ষা। ফাইনালে জয়সূচক গোল করা এডার ফাইনালের পর বলেছিলেন, “আমাকে নামানোর আগে রন আমার কানে কানে বলেছিলো আমি জানি তুমি গোল করে ম্যাচ জেতাতে পারো। যাও, নিজের সেরাটা দাও।” শেষ ষোলোর ম্যাচটা যখন পেনাল্টি শ্যুট আউটে যায়, তখন দলের এক প্লেয়ার জোয়াও মোটিনহো পেনাল্টি নিতে চাচ্ছিলেন না, খানিকটা আত্মবিশ্বাসের অভাবে। ইউরোর পরে প্রকাশিত এক ভিডিওতে লিপ রিডারের মাধ্যমে দেখানো হয় যে, তখন রোনালদো তাকে বলেন, জাস্ট দিক ঠিক করে তাঁর বেস্ট শটটা নিতে, বাকি যা হওয়ার হবে। পুরো ইউরো জুড়ে এমন অনেক কাহিনী শোনা যায় মেন্টর বা মোটিভেটরের ভূমিকায় নামা রোনালদোকে নিয়ে। সমালোচনায় জর্জর এক সিজন শেষ করলেন ক্লাবে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ আর জাতীয় দলের হয়ে ইউরো জিতে।
২০১৬-১৭ সিজনটা শুরু করেন ইনজুরি থেকে ফিরে খানিক দেরিতে। শুরুটাও হলো স্লো। রিয়াল জিততে থাকলেও তাঁর কিছু সমস্যা থেকেই যাচ্ছিল। আসলে রিয়াল যখন স্ট্রাগল করে তখন সবচেয়ে বেশী সমালোচনা হয় এই রোনালদোকে নিয়েই। বেলের ইনজুরি, বেঞ্জেমার অফ ফর্ম- সব মিলিয়ে রিয়াল এটাকের তথৈবচ অবস্থার কারণে চিরাচরিত নিয়মে আবারো ‘রোনালদো শেষ’ এই রব উঠে গেল। এই স্ট্রাগলিং রোনালদোই এটলেটিকোর মাঠে গিয়ে হ্যাটট্রিক করে হারিয়ে আসল এটলেটিকোকে। এবার আসা যাক সিজনের ব্যস্ত ও সবচেয়ে গুরুত্ববহ সময়ে। বায়ার্নের সাথে কোয়ার্টার ফাইনালে রিয়াল দুই লেগ মিলিয়ে ৬-৫ গোলে জেতে, যার ৫ টি গোলই রোনালদোর। সেমিতে এটলেটিকোকে ৪-২ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে উঠলো যেখানে তিনটি গোলই রোনালদোর। ফাইনালে টাফেস্ট ডিফেন্স জুভেন্টাসের সাথে ম্যাচ। এবার দিলেন ২ গোল, দ্বিতীয় গোলটি বলা চলে রিয়ালের ফাইনাল জয়টা নিশ্চিত করে দেয়।
এবার লীগের শেষার্ধে রিয়ালের বেশ কয়েকটি টাফ ম্যাচ বাকি ছিলো। বেশ এগিয়ে থাকা রিয়াল হঠাৎ বার্সার কাছে হেরে বসে, যেটা পুরো সমীকরণকে জটিল করে দেয়। রিয়ালের যেকোনো সময় পা হড়কানোই বার্সাকে এনে দেবে টানা তৃতীয় লীগ শিরোপা। ঠিক এরপর শুরু হলো সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ধারাবাহিকতম রোনালদো শো। ভ্যালেন্সিয়ার সাথে ১ গোল, সেভিয়ার সাথে ২ গোল, সেল্টার সাথে টাফ অ্যাওয়েতে দুই গোল আর লীগ নির্ণায়ক শেষ ম্যাচে মালাগার মাঠে সব শঙ্কা উড়িয়ে প্রথম মিনিটেই গোল। এমন ধারাবাহিক গোল অনেকেই করেন, তবে এটার মাহাত্ম্য কি? প্রত্যেকটা ম্যাচ ছিল রিয়ালের বাঁচা-মরার ম্যাচ, পা হড়কালেই লীগের অপেক্ষা আরো এক বছর বাড়ত। আর একটা ব্যাপার ছিল টাইমিং। প্রত্যেকটা গোল এমন সময়ে দেয়া যখন ম্যাচের ভাগ্য পেন্ডুলামের মতো ঝুলছিল। রিয়ালের এবার ডাবল জয়ের পেছনে অবশ্যই দলীয় প্রচেষ্টাই আসল ছিল, তবে এককভাবে বললে দুটো কম্পিটিশনের শেষের দিকের আসল সময়ে সবচেয়ে ডিসিসিভ পাঞ্চগুলো রোনালদোরই দেয়া।
প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, রোনালদো ফুরিয়ে গেছেন। এটা কেন? ২০০৪ ইউরোতেই আপামর লোকজন প্রথম রোনালদোকে দেখেন, এরপর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। সেই রোনালদো বলতেই মানুষ বোঝে দারুণ স্পিডি, ড্রিবলার, দারুণ শ্যুট নেয়া এক প্লেয়ারকে। এমনকি রিয়ালেও প্রথম দুই তিন সিজন এমনই ছিলো রোনালদো। কিন্তু একজন ফরোয়ার্ড যখন ৩০ এর ঘরে পৌছায় তখন তাঁর স্পিড কমে যেতে থাকে, ড্রিবলিং এ পড়তি ভাব চলে আসে। সবাই তো আর রোবেন না যে বয়সের সাথে সাথে ড্রিবল বাড়বে! সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রোনালদো প্রায় সেন্টারের কাছাকাছিই খেলছেন বেশী, প্রায় স্ট্রাইকারের মতোই। ফলে যেদিন গোল পান সেদিন ওকে, আর দুই ম্যাচ গোল খরা গেলেই ‘রোনালদো শেষ’ ধুয়ো উঠে যায়। এটা সত্য রোনালদোর আগের অনেক স্কিলই এখন আর তাঁর পায়ে নেই, তারপরেও কিভাবে এখনো ৩২ বছর বয়সেও বিশ্বসেরা খেতাবের জন্য লড়েন?
যদি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনালের ৩য় গোলটি খেয়াল করেন, তবে দেখবেন লুকা মদ্রিচ যখন বল নিয়ে রাইট উইং দিয়ে ঢুকে ক্রস করছেন, তখনও দুই ডিফেন্ডারের বেশ দূরে রোনালদো। গ্রাউন্ড ক্রসটা বুফনের হাতে যাবারই কথা। প্রায় অকস্মাৎ ক্ষিপ্র গতিতে দুই ডিফেন্ডারের মাঝখান দিয়ে এসে গোল দিয়ে দেয় সে।
ড্রিবলিং বা স্কিল চোখের জন্য তৃপ্তিদায়ক হতে পারে, তবে ফুটবলে একটা স্ট্রাইকারের জন্য পজিশনিং, ইন্সটিংক্ট এসবও সমান গুরুত্ববহ। ৩২ বছর বয়সে যখন শরীরের লিমিটেশনকে পাশ কাটিয়ে পজিশনিং, ইন্সটিংক্ট এসবের উপর ভর করে গোলস্কোরিংকে ঠিকই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
আপনি যদি রোনালদোর ক্যারিয়ারের দিকে নির্মোহ ভাবে তাকান, এটা অনুপ্রেরণার উপাখ্যান বৈ আর কিছু না। বারবার শুনতে হয়েছে যে তাঁর সময় শেষ, রিয়ালে ট্রফি খরা আর মেসির অতিমানবিক পারফর্মেন্সে তাকে টানা চারবার ব্যালন ডি অর মঞ্চে দ্বিতীয় হয়েই থাকতে হয়েছে। এরপর টানা দুটো (এবারেরও সবচেয়ে সম্ভাবনাময়) ব্যালন ডি অর জিতেছেন। যখনই সন্দেহ বা শেষ রব উঠেছে, তখনই প্রবল দর্পে প্রত্যাবর্তন করেছেন। যখন তাকে বিশ্বাস করার লোক ক্রমেই কমে আসছিল, তখন নিজেকে বিশ্বাস করতে ভোলেননি। একজন প্লেয়ার বাদেও তাঁর ক্যারিয়ারটাকে দেখা যায় একজন মানুষ হিসেবে যিনি সীমাবদ্ধতাকে প্রতিনিয়ত পার করার চেষ্টা করেছেন, সফল হয়েছেন; ব্যর্থ হয়েছেন, সকল অবিশ্বাসকে ভেঙে আবার সদর্পে ফিরেছেন। তারই একটা কথা দিয়ে পুরো সব ব্যাখ্যা করা যায়, “Your love makes me stronger, but your hate makes me unstoppable.”