Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টার্ডিগ্রেড উপাখ্যান: প্রতিকূলতার চরম সীমায় বাসকারী এক জীবের গল্প

পৃথিবীর সমস্ত পানি শুকিয়ে গেছে! বৈশ্বায়িক উষ্ণায়নের খপ্পরে পড়ে বিলিয়ন বিলিয়ন কিউসেক পানি শুকিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে। চারিদিকে ধুঁকে ধুঁকে মরছে সকল জীব। পথে-ঘাটে যেদিকে দু’চোখ যায়, শুধু চোখে পড়ে মৃত প্রাণীদের গলিত লাশ।

পানিহীনতায় বেঁচে নেই বৃক্ষরাজিও। সারি সারি বৃক্ষশোভিত বন-জঙ্গল সব পানির অভাবে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে আছে। মাটিচাপা পড়ার আগেই সবুজ পাতার মনোরম ঐকতান বদলে গেছে কঠিন নিস্তব্ধতায়। বাদ পড়লো না মানুষরাও। আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ মানবসমাজ লড়াই করলো একদম শেষ পর্যন্ত। যে অভিশাপের শুরুটা হয়েছিল তাদের হাত ধরে, তা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় বাতলাতে পারলো না কেউই। তারাও হেরে গেলেন। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একে একে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে।

সর্বশেষ জীবিত ব্যক্তির শেষ নিঃশ্বাসটুকু বের হবার সাথে সাথেই পৃথিবী থেকে মুছে গেল প্রাণের স্বাক্ষর।

আসলেই কি তাই? পানির অপর নাম তো জীবন। পানি ছাড়া কি আর কোনো প্রাণ বেঁচে থাকতে পারে? আমাদের সাধারণ জ্ঞানের পরিসর অনুযায়ী এই প্রশ্নের উত্তরটা “না” ছিল অনেকদিন ধরেই। কিন্তু আমাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণ করতে পৃথিবীর বুকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিল এক ‘সুপারম্যান’ জীব।

জ্বী! পানি ছাড়াও বাঁচা যায়। আর এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারা বিস্ময়কর জীবের নাম ‘টার্ডিগ্রেড’, যাকে আদর করে জীববিজ্ঞানিরা ডাকেন ‘জলের ভালুক’ নামে।

টার্ডিগ্রেডের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

বিস্ময়কর প্রাণী টার্ডিগ্রেডকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের শেষ নেই। বিস্ময়করভাবে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সাবলীলভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারার ক্ষমতা এদেরকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। টার্ডিগ্রেডকে নিয়ে কিছু বলার আগে চলুন এর সাথে একটু পরিচিত হওয়া যাক

উৎপত্তি

টার্ডিগ্রেডের যাত্রা শুরু হয় আজ থেকে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে প্রাক-ক্যাম্ব্রিয়ান যুগে। অর্থাৎ এদের যাত্রা শুরু হয় ডায়নোসর আবির্ভাবেরও অনেক আগে থেকেই। ইতিহাসের পাঁচটি গণ বিলুপ্তির সবগুলোই টিকে থাকতে পেরেছে এরা, যেখানে ডায়নোসরের মতো দানবীয় প্রাণীর পক্ষে একটি গণ বিলুপ্তিও টিকে থাকা সম্ভব হয়নি!

আবিষ্কার

১৭৭৩ সালে টার্ডিগ্রেডের প্রথম দেখা পান জার্মান বিজ্ঞানী জোহান অগাস্ট গুজ। তিনি অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানির নমুনায় সর্বপ্রথম এদের দেখা পান। অতি ক্ষুদ্র আকারের ভালুকের মতো দেখতে এই জীবের নাম রাখা হয় টার্ডিগ্রেড, যা জার্মান শব্দ ‘টার্ডিগ্রাডা’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে ‘ছোট পদক্ষেপ’। এদের চলাফেরার ধরণ অত্যন্ত ধীর বলেই এরূপ নামকরণ করা হয়।

বিজ্ঞানী জোহান অগাস্ট গুজ; সূত্র: Bildindex der Kunst und Architektur

এর থেকে তিন বছর পরে ইতালীয় বিজ্ঞানী লাজারো স্পালাঞ্জানি প্রথমবারের মতো এদের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেন। প্রথম প্রথম অবিশ্বাস্য ঠেকলেও স্পালাঞ্জানির মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানীর কথা কেউ ফেলতে পারেননি। এরপর থেকেই নাদুস নুদুস গড়নের এই জীবকে নিয়ে শুরু হয় গবেষণা, মিলতে থাকে রোমাঞ্চকর সব তথ্য।

আকার-আকৃতি

এদের আকৃতি কিছুটা মোটাসোটা ধরনের শুঁয়োপোকার মতো। তবে খালি চোখে এদের দেখা যায় না। এরা লম্বায় প্রায় ০.০৫ মি.মি. থেকে ১.২ মি.মি. পর্যন্ত হয়ে থাকে।

বাসস্থান

এরা কোথায় বাস করে এ প্রশ্ন করার চেয়ে এরা কোথায় বাস করে না এ প্রশ্ন করা বেশি যুক্তিসংগত। কোথায় নেই টার্ডিগ্রেডরা? হিমালয় পর্বত থেকে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীর খাত- সবখানেই এদের অস্তিত্ব বিদ্যমান। এমনকি অ্যান্টার্কটিকার বরফের মাঝেও বেঁচে থাকতে সক্ষম এরা।

খাদ্য

এরা তরল খাবার গ্রহণ করে জীবনধারণ করে। সাধারণত বিভিন্ন শৈবাল, মস এবং লাইকেন থেকে এরা তরল পদার্থ শোষণ করে থাকে। এদের কিছু প্রজাতি আবার মাংসাশী জীব। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদের মাঝে ‘ক্যানিবলিজম’ বা স্বগোত্রভোজী প্রজাতির সংখ্যাও কম নয়। সুযোগ পেলেই এক টার্ডিগ্রেড ঘাড় মটকে দিতে পারে আরেক টার্ডিগ্রেডের!

বংশবিস্তার

এরা ডিম পেড়ে বংশবিস্তার করে থাকে। স্ত্রী টার্ডিগ্রেডের দায়িত্ব ডিম পাড়া এবং পুরুষদের দায়িত্ব সেই ডিমে নিষেক ঘটানো। একটি স্ত্রী সদস্য প্রায় ৩০টি করে ডিম পেড়ে থাকে।

এরা সাঁতার কাটতে পারে। এদের মুখের ভেতর ধারালো দাঁতের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, যা খাদ্যগ্রহণে সহায়তা করে। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে টার্ডিগ্রেড অন্যান্য আর দশটা প্রাণীর মতোই সাধারণ জীবনযাপন করে। অন্যান্য প্রাণীর সাধারণ বৈশিষ্ট্যের সাথে তাদের তেমন একটা তফাৎ চোখে পড়ার মতো নয়।

কিন্তু, ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’ বলে বাংলায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। প্রতিকূল পরিবেশে যখন অন্যান্য প্রাণীদের আত্মরক্ষা করা দায় হয়ে পড়ে, ঠিক তখনই টার্ডিগ্রেড বিস্ময়করভাবে খাপ খাইয়ে নিয়ে বংশবিস্তার করতে থাকে স্বাভাবিকভাবে।

প্রতিকূলতায় অদম্য টার্ডিগ্রেড

বিজ্ঞানের ভাষায় প্রতিকূল পরিবেশ হচ্ছে এমন কোনো পরিবেশ যেখানে কোনো নির্দিষ্ট প্রাণীর জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সর্বোচ্চ সীমার চেয়ে অধিক অথবা সর্বনিম্ন মাত্রার চেয়ে কম থাকে। সেক্ষেত্রে যেটা আমাদের জন্য প্রতিকূল, তা টার্ডিগ্রেডদের ক্ষেত্রে প্রতিকূল না-ও হতে পারে। তবে প্রতিকূল পরিবেশ দ্বারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের জন্য প্রতিকূল সব ধরনের পরিবেশকে বোঝানো হয়।

লাজারো স্পালাঞ্জানি সর্বপ্রথম টার্ডিগ্রেডের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার কথা জানান দেয়ার পর থেকে বিজ্ঞানীরা একে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতে উঠেন। কিছুদিন পর থেকেই বিভিন্ন দিক থেকে আসতে থাকে বিস্ময়কর সব তথ্য।

১৮৪২ সালের দিকে বিজ্ঞানী দঁইয়েরে তার জার্নালে টার্ডিগ্রেডের তাপমাত্রা সহনশীলতার কথা তুলে ধরেন। তিনি ১২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় টার্ডিগ্রেডের একটি প্রজাতির নমুনা পর্যবেক্ষণ করে কয়েক মিনিটের জন্য বেঁচে থাকার প্রমাণ পান।

টার্ডিগ্রেডের ত্রিমাত্রিক ছবি; সূত্র: Diane Nelson

১২৫ ডিগ্রির কথা শুনেই চোখ কপালে তুলবেন না! কারণ পরবর্তীকালে টার্ডিগ্রেডের আরো কয়েকটি প্রজাতির উপর পরীক্ষা করে দেখা গেল যে এরা ১৫১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়ও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রায় বেঁচে থাকা প্রাণীদের মধ্যে প্রায় বেশিরভাগ প্রাণীই কক্ষ তাপমাত্রা এবং নিম্ন তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে না।

কিন্তু ‘অদম্য’ তকমা লাগানো টার্ডিগ্রেড -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে! ধরুন, আপনি কৌতূহলবশত তাপমাত্রা খানিকটা কমিয়ে -১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নামিয়ে আনলেন। তারপরও টার্ডিগ্রেড বেশ স্বাভাবিকভাবেই বেঁচে থাকতে পারবে সেখানে। এবার ধরুন, তাপমাত্রা একটু বেশিই কমিয়ে -২৭২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নামিয়ে আনলেন। এবার কী হবে? এখানেও প্রায় ১৫ মিনিটের মতো বেঁচে থাকতে সক্ষম টার্ডিগ্রেড! জানিয়ে রাখা ভালো যে, -২৭২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা কেলভিন স্কেলে ‘শূন্য’ এর চেয়ে মাত্র এক ইউনিট বেশি, যেটিকে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হিসেবে ধরা হয়।

বিস্মিত বিজ্ঞানীরা এবার নতুন পরীক্ষায় মেতে উঠলেন। তাপমাত্রার পর শুরু হলো চাপের পরীক্ষা। এক্ষেত্রেও জয়ী হলো টার্ডিগ্রেড পৃথিবীর গভীরতম স্থান হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ায়া ট্রেঞ্চ (১০,৯৯৪ মিটার)। সেখানে সর্বমোট চাপ প্রায় ১০০ মেগাপ্যাসকেল। এতো উচ্চ চাপে যেকোনো জীবের প্রোটিন ও ডিএনএ ভেঙে নষ্ট হয়ে যায়।

পৃথিবীর গভীরতম স্থান মারিয়ানা ট্রেঞ্চ; সূত্র: mirrordaily.com

অলৌকিকভাবে টার্ডিগ্রেড এত উচ্চ চাপেও অক্ষত থেকে অবাক করে দিয়েছে বিশ্বকে। ১০০ মেগাপ্যাসকেলের চেয়েও ৬ গুণ বেশি চাপে অক্ষত থাকবে এর ডিএনএ, এমনটাই প্রমাণ করেছেন বিজ্ঞানীরা! এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সকল জীবের সহনক্ষমতার তালিকা তৈরি করলে কোনো প্রাণী এর ধারে কাছে থাকবে না।

এরপরেই বিজ্ঞানীরা পানিবিহীন অবস্থায় টার্ডিগ্রেডকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। অনেক বিজ্ঞানীই ধরে নিয়েছিলেন এবার পরাস্ত হবে টার্ডিগ্রেড। উচ্চ তাপ, উচ্চ চাপে বাঁচতে পারা অনেক জীব থাকলেও পানি ছাড়া জীবের অস্তিত্ব কল্পনা করা বৃথা। কারণ পানিশূন্যতার কারণে প্রাণীর আবরণ ছিদ্র হয়ে যায়। যার ফলে তার বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না। রটিফার নামক কিছু ক্ষুদ্র প্রাণী এর আগে পানি ছাড়া কয়েক মাস বেঁচে থাকতে পেরে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল বিজ্ঞানীদের। কিন্তু টার্ডিগ্রেড মাসের হিসেবকে টেনে বছরে নিয়ে গেল। সেটা ১-২ বছর নয়, পুরো ১২০ বছর!

১৯৪৮ সালে প্রায় ১২০ বছর আগের শুকিয়ে যাওয়া মসের নমুনায় পানি প্রয়োগের ফলে পুনরায় বেঁচে উঠেছে টার্ডিগ্রেড। পরবর্তীতে আরো কিছু নমুনায় পরীক্ষার পরে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, টার্ডিগ্রেড তার দেহে পানির পরিমাণ ৮৫% থেকে নেমে ৩% হওয়ার পরও বেঁচে থাকতে পারে! সামান্য প্রাণী টার্ডিগ্রেড তখন প্রাণীজগতের ‘সুপারম্যান’ বনে গেল।

স্ক্যানিং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে পানিশূন্যতায় নির্জীব হয়ে পড়া টার্ডিগ্রেডের ছবি; সূত্র: viraljio.com

আধুনিক কালে বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় রশ্মির মাধ্যমে পরীক্ষা করা হলো টার্ডিগ্রেডকে। টার্ডিগ্রেড তখনো ভেঙে পড়েনি। কারণ অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় ১,০০০ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়তা প্রতিহত করতে পারে এরা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, অদম্য টার্ডিগ্রেডের স্বাভাবিক আয়ু মাত্র কয়েক মাস! কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে এরা বিশেষ উপায়ে টিকে থাকতে পারে কয়েক শতক পর্যন্ত।

মহাকাশচারী টার্ডিগ্রেড

বিকিরণে টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতার কারণে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা টার্ডিগ্রেডকে মহাকাশে পাঠাবেন। নাসার উদ্যোগে ২০০৭ সালে কয়েক প্রজাতির টার্ডিগ্রেডকে পানিশূন্য অবস্থায় FOTON-M3 মিশনের একটি কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে প্রেরণ করা হয়। ১০ দিনব্যাপী মহাশূন্যের বিভিন্ন শক্তিশালী মহাজাগতিক তরঙ্গের বিকিরণের মুখোমুখি হওয়ার পর পুনরায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয় উপগ্রহটিকে।

FOTON-M3 মিশনের সদস্যবৃন্দ। তারাই প্রথম টার্ডিগ্রেডকে মহাকাশে প্রেরণ করেন; সূত্র: mlib.cnr.it

এরপর পুনরায় পানি সংযোগ করে শুরু হয় অপেক্ষার পালা। তবে অপেক্ষার পালা ৩০ মিনিটের বেশি লম্বা হতে দেয়নি টার্ডিগ্রেড। ফের স্বাভাবিক প্রাণীর মতো বেঁচে উঠলো তারা। এমনকি বংশবিস্তার করতেও সক্ষম হলো।

এরপর ২০১১ সালে STS-134 মিশনে পুনরায় পাঠানো হয় এদের। এবারও বেঁচে থাকতে সক্ষম হলো টার্ডিগ্রেড। নড়ে চড়ে বসলেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। যদি এদের এই বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানো যায়, তাহলে বিজ্ঞানের অগ্রগতি প্রায় হাজার বছর এগিয়ে যাবে। টার্ডিগ্রেডের অদম্যতা যেন হাতছানি দিচ্ছে অপার সম্ভাবনার দিকে।

ক্রিপ্টোবায়োসিসঃ টার্ডিগ্রেডের অদম্যতার রহস্য

পানিশূন্য পরিবেশে টার্ডিগ্রেডের বেঁচে থাকার সক্ষমতা বিস্মিত করেছে সকল স্তরের বিজ্ঞানীদের। এরপর থেকেই এর রহস্য উন্মোচনে পুরোদমে রাত-দিন গবেষণায় মত্ত আছেন বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানীরা। কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের কাছে ধরা পড়ে টার্ডিগ্রেডের অদম্যতার রহস্য; যার ভানুমতিতে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকতে পারে এরা। আর সেই রহস্যময় গুণের নাম ক্রিপ্টোবায়োসিস

ক্রিপ্টোবায়োসিসের অর্থ হচ্ছে ‘গুপ্ত প্রাণ’। আসলেই তাই! পানিশূন্যতার ইঙ্গিত পেলেই টার্ডিগ্রেড তার প্রাণকে লুকিয়ে রাখে এবং একদম নির্জীব অবস্থায় পার করে দিতে পারে বছরের পর বছর। বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানের ফলাফল থেকে জানা যায়, ক্রিপ্টোবায়োসিস অবস্থায় এদের দেহের বিপাক ক্রিয়ার হার কমে ০.০১% পর্যন্ত নেমে আসে।

ক্রিপ্টোবায়োসিস পর্যায়ে সুপ্তাবস্থায় এক টার্ডিগ্রেড; সূত্র: biologicalexceptions.blogspot.com

পুনরায় পানি প্রয়োগের পর একদম স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করা শুরু করে দেয় এরা। দেখে মনে হয়, যেন ছুটির সকালের লম্বা ঘুম সেরে উঠলো মাত্র!

গবেষণার অগ্রগতি

ক্রিপ্টোবায়োসিসের আবিষ্কারেই থেমে যাননি বিজ্ঞানীরা। অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী এই জীবের মাঝে আরো রহস্য লুকিয়ে আছে বলে বিশ্বাস করেন সবাই। তাই সময়ের সাথে সাথে উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুনভাবে বিভিন্ন দিক থেকে একে নিয়ে নানা পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ফলে শুধু পানিশূন্যতার রহস্যই শেষ নয়, বের হয়ে আসে বাকি প্রশ্নের উত্তরগুলোও।

প্রথমেই ক্রিপ্টোবায়োসিসের জন্য দায়ী জিনগুলো চিহ্নিত করেন থমাস বুথবি। তার মতে IDP বা Intrinsically Disordered Proteins নামক কিছু প্রোটিন নির্দেশকারী জিন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রোটিন জগতে IDP বাকিদের থেকে একটু আলাদা। কারণ অন্যান্য প্রোটিনের নিজস্ব আকৃতি থাকলেও এদের কোনো নির্দিষ্ট আকৃতি নেই। এরা ক্ষণে ক্ষণে নিজের আকৃতি বদলাতে থাকে।

কম্পিউটার দ্বারা ডিজাইনকৃত টার্ডিগ্রেডের চলাচলের ছবি; সূত্র: bbc.com

বিজ্ঞানীরা টার্ডিগ্রেডের IDP-গুলো বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়াতে প্রয়োগ করেন এবং বিস্ময়করভাবে ব্যাক্টেরিয়াগুলো পানিশূন্যতার মাঝে টিকে থাকার সক্ষমতায় অভাবনীয় ফলাফল প্রদর্শন করে। এরপর চলে আসি উচ্চ তাপমাত্রা এবং অস্বাভাবিক চাপে এদের টিকে থাকার কারণ ব্যাখ্যায়। থমাস বুথবির মতে টার্ডিগ্রেডের দেহে ডিএনএ মেরামত করা এনজাইমের কার্যক্ষমতা যেকোনো জীবের থেকে হাজার গুণ বেশি কার্যক্ষম। যখন তাপমাত্রা এবং চাপে এদের ডিএনএ এবং প্রোটিন ভেঙে যেতে থাকে, তখন সেই এনজাইমগুলো দক্ষতার সাথে দ্রুত মেরামত করে ফেলে ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ-কে। মেরামতকৃত ডিএনএগুলো টিকে থাকে দীর্ঘসময় ধরে।

পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ জয় করা টার্ডিগ্রেডের গবেষণায় পিছিয়ে নেই মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাও। নাসার মহাজাগতিক বিকিরণ গবেষণাগারের প্রধান পিটার গিডার মতে, মহাকাশ যাত্রায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিকিরণের জন্য দায়ী Reactive Oxygen Species। যখন মহাকাশচারী টার্ডিগ্রেড এই বিকিরণের সম্মুখীন হয়, তখন এরা অস্বাভাবিক হারে Anti-oxidant উৎপাদন করতে সক্ষম হয়, যা বিস্ময়করভাবে বিকিরণ রশ্মিকে প্রশমিত করে। এই আবিষ্কার যতো না আমাদের বিস্মিত করে, তার থেকে বেশি মনে প্রশ্ন জাগায়।বিজ্ঞানীদের কাছেও ব্যাপারটা খটকা লেগেছিল। মহাকাশে টিকে থাকার মতো অলৌকিক সক্ষমতা কখন এবং কীভাবে টার্ডিগ্রেডের মাঝে উদ্ভূত হয়েছিল, এর উত্তর জানেন না কেউই।

টার্ডিগ্রেডরা কি এলিয়েন? সূত্র: ssaft.com

জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং সম্ভাবনার নতুন আলো

যেকোনো প্রাণীর আদ্যোপান্ত সম্পর্কে জানার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে এর জিনোম সিকোয়েন্স করা। সম্প্রতি টার্ডিগ্রেডেরও জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে।

২০১৫ সালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা টার্ডিগ্রেডের একটি প্রজাতির জিনোম সিকোয়েন্স করেন। এর ফলে অনেক রোমাঞ্চকর তথ্য বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু তথ্য তুলে ধরা হলোঃ

  • টার্ডিগ্রেডের জিনগুলোর মধ্যে প্রায় ১.২% জিন তাদের নিজস্ব জিন নয়। বিবর্তনের মাধ্যমে অন্যান্য প্রাণী থেকে বিভিন্ন সময়ে তারা এসব জিন পেয়েছে।
  • ডিএনএ নষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী বিভিন্ন সাধারণ জিন এদের মাঝে অনুপস্থিত।
  • টার্ডিগ্রেডের মাঝে Dsup (Damage suppressor Protein) নামক একটি বিশেষ প্রোটিন বিদ্যমান, যা বিভিন্ন উচ্চ বিকিরণ (বিশেষত এক্স-রে বিকিরণ) থেকে নিজের ডিএনএ-কে রক্ষা করে থাকে। অন্যান্য কোনো প্রাণীর মাঝে এর অস্তিত্ব এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই প্রোটিনের কারণে এরা মহাকাশে বিভিন্ন বিকিরণ প্রশমিত করতে পেরেছিল।
  • Dsup প্রোটিন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে মানুষের দেহে স্থানান্তর করা সম্ভব। ফলে মানুষ বিভিন্ন বিকিরণ উপেক্ষা করে বেঁচে থাকতে পারবে।

জাপানি বিজ্ঞানী তাকিকাজো কুনিদা তার গবেষণাগারে মানুষের কোষে Dsup প্রোটিন স্থানান্তর করেন। এর ফলে সেই কোষের বিকিরণ প্রশমণ ক্ষমতা ৪০% বৃদ্ধি পায়।

মসের দেহের সাথে লেগে থাকা টার্ডিগ্রেড। সূত্র: gizmodo.com

এই অভূতপূর্ব সাফল্য মূহুর্তের মধ্যে বিজ্ঞান মহলে সাড়া ফেলে দেয়। অন্যান্য গবেষকরাও এগিয়ে আসেন। তারা IDP সহ বিভিন্ন প্রোটিন নিয়ে কাজ করছেন। তবে ইচ্ছা করলেই মানুষের দেহে এসব জিন স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। কারণ মানুষের দেহে এসব প্রোটিন স্থানান্তর করতে হলে আরো অনেক ধাপ পার হতে হবে। সাথে সাথে এর বিভিন্ন ক্ষতিকারক প্রভাবের কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। বের করতে হবে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সমাধান।

সৃষ্টিকর্তার বিস্ময়কর সৃষ্টি টার্ডিগ্রেড। বিজ্ঞানীদের ধারণা, টার্ডিগ্রেডের মাঝে বিবর্তনের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে। অন্যদিকে মহাকাশে মানুষের সীমাবদ্ধতার বৃত্ত থেকে মুক্তিলাভের পাথেয় হতে পারে এই টার্ডিগ্রেড। বিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রমের কারণে এখন টার্ডিগ্রেডকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অসম্ভবকে সম্ভব করার এক নতুন সম্ভাবনা।

গবেষণা এখনো চলছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা এদের সম্পর্কে আরো রোমাঞ্চকর তথ্য জানতে পারবো, যার মাধ্যমে দেখা দিবে নতুন কোনো সম্ভাবনার। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সময়ই আমাদের সবকিছু জানিয়ে দিবে।

ফিচার ইমেজ: bbc.com

Related Articles