চীনের মহা প্রাচীর বা, গ্রেট ওয়াল অব চায়না!! মানুষের সৃষ্ট এই বিস্ময়কর সৃষ্টির কথা শুনেনি এমন মানুষ এ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া দায়। চায়নায় যাকে ডাকা হয় ছাং ছং বা, দীর্ঘ প্রাচীর নামে। দীর্ঘ এ প্রাচীরের সারির প্রায় পুরোটাই মাটি ও পাথর দিয়ে নির্মিত। পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি হল চীনের এই মহা প্রাচীর। আক্রমণকারীদের দূরে রাখা এবং সামরিক অনুপ্রবেশ ঠেকানোই ছিল এ বিশাল প্রাচীর নির্মাণের উদ্দেশ্য। এই দেয়াল নির্মাণ করার প্রকল্পটি পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুল এক প্রকল্প হিসেবে ধরা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামরিক অবকাঠামোও এটি। এটিই মানুষের হাতে তৈরি সবচেয়ে বড় স্থাপত্য। উচ্চতায় প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার উঁচু এই প্রাচীরটি। আর লম্বায় প্রায় ৬৫৩২ কি.মি.! আজ আমরা পৃথিবীর এই সবচেয়ে দীর্ঘতম প্রাচীরটির ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা, অবকাঠামো ইত্যাদি সম্বন্ধে কিছুটা জানার চেষ্টা করব।
নির্মাণের ইতিহাস
চীনের ঐতিহাসিক উত্তরাঞ্চলের বর্ডারে চায়না রাজ্য এবং রাজত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে এই প্রাচীরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি বর্ডারের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকের রেখা বরাবর নির্মিত। ইউরেশিয়ান প্রান্ত থেকে যাযাবর গোষ্ঠীগুলোর যথেচ্ছ আক্রমণ ঠেকাতেই তখন এ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। চীনের প্রাচীর আসলে বেশ কিছু দুর্গের সমষ্টি। চীনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় একে প্রায়শই ঐতিহাসিকরা ১০,০০০ মাইল দীর্ঘ দেয়াল বলে অভিহিত করে থাকতেন। ঐতিহাসিক ‘সিমা কিয়ানে’র বর্নণাতেও এমনটাই দেখা যায়। যদিও এ ১০,০০০ সংখ্যাটি এর প্রকৃত দৈর্ঘ্য না বুঝিয়ে অনেক দীর্ঘ এই বিষয়টির দিকেই ইঙ্গিত করেই ব্যবহার করা হত।
খ্রীষ্টের জন্মের ৫ থেকে ৮শ বছর আগে থেকেই চাইনিজরা দেয়াল নির্মাণের কলা কৌশল ভালোভাবেই রপ্ত করে নিয়েছিল। এই সময়ের মাঝে চীনের কিন, ঝাও, কিউ, ইয়ান এবং ঝংসান রাজ্য তাদের নিজেদের নিজেদের বর্ডার রক্ষার্থে বিশাল বিস্তৃত দুর্গ নির্মাণ করে ফেলে। ছোট ছোট আক্রমণ ঠেকানোর মত ব্যবস্থা এসব দুর্গে ছিল।
কিন রাজ্যের রাজা ঝেং ২২১ খ্রীষ্ট পূর্বে তার শেষ শত্রুদেরও পরাজিত করে পুরো চায়নায় প্রথম ‘কিন’ বংশের রাজত্ব স্থাপন করেন। তিনি কেন্দ্রীয় শাসন জোড়দার করতে বিভিন্ন রাজ্যের আগের নির্মিত দেয়ালগুলো, যেগুলো সেই রাজ্যকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে রেখেছিল সেই দেয়ালগুলো ভাঙ্গার নির্দেশনা দিলেন। তবে উত্তর দিক থেকে জিয়াংনু গোষ্ঠির মানুষদের আক্রমণ থামানো যাচ্ছিল না। তাই তিনি এ আক্রমণের হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষার জন্য অবশিষ্ট দুর্গগুলোকে সংযুক্ত করে নতুন দেয়াল নির্মাণের নির্দেশ দেন। এ দেয়াল নির্মাণের কাঁচামাল জোগাড় করা তখন বেশ কষ্টসাধ্য এক কাজ ছিল। তাই স্থানীয় যেসব কাঁচামাল পাওয়া যেত তাই দিয়েই কাজ চালানো হত। পরবর্তিতে হান, সুই সহ আরো অনেক রাজবংশ এই দেয়ালের সংস্কার, পুনর্নির্মাণ এবং বিস্তার ঘটায়। এ সবই করা হয়েছিল উত্তর দিক থেকে আসা যাযাবর বা, শত্রুদের আক্রমণ ঠেকাতে।
১৪শ শতাব্দীতে এসে মিং সাম্রাজ্যের অধীনে চীনের মহা প্রাচীর যেনো নব জীবন লাভ করল। মূলত টুমুর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তারা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। তারা এক প্রকার বাধ্য হয়ে উত্তরের বর্ডারে আবার দেয়াল স্থাপনের কাজ শুরু করল। এবারের দেয়ালগুলোও বেশ শক্ত ছিল। এর কারণ ছিল যে, তারা আগের মত স্থানীয় মাটি দিয়ে তৈরি না করে এবার দেয়ালগুলো তৈরি করল পাথর এবং ইট দিয়ে। দেয়ালের উপড় প্রায় ২৫,০০০ টি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হল। কিন্তু এতেও মঙ্গোলদের আক্রমণ থামনো গেল না। তারা নিয়মিত আক্রমণ চালাতে থাকল। এর ফলে নিয়মিত দেয়ালগুলোর বেশ ক্ষতি সাধন হতে লাগল আর মিংদের এর সংস্কারের পেছনে আবার প্রচুর অর্থ ও শ্রম খরচ করতে হতে লাগল।
১৮৬০ সালে শেষ হওয়া ২য় অপিয়াম যুদ্ধের পর চায়নার বর্ডার বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এর ফলেই ব্যবসায়ী এবং দর্শনার্থীরা এই মহা প্রাচীর সম্বন্ধে ভালভাবে প্রথম জানতে পারে। এর আগে পর্যন্ত সারা বিশ্বে এর তেমন কোন পরিচিতি ছিল না। ধীরে ধীরে চীনের এই মহা প্রাচীর দর্শনার্থীদের আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে যায়। বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দিতে এসে এই প্রাচীর খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং একে ঘিরে নানা রকম মিথ বা, জনশ্রুতি তৈরি হতে থাকে। চীনের এই প্রাচীরকে চাঁদ এমনকি মঙ্গল গ্রহ থেকেও দেখা যায় এমন একটি মিথ্যা জনশ্রুতি এখনো বেশ প্রচলিত রয়েছে।
২০০৯ সালে এই প্রাচীরের লুকিয়ে থাকা ১৮ কিলোমিটার অংশ নতুন করে আবিষ্কার করা হয়। এই অংশটি পাহাড় এবং খানা খন্দের আড়ালে চাপা পরে গিয়েছিল। এই অংশ খুঁজে বের করতে ‘ইনফ্রারেড রেঞ্জ ফাইন্ডার’ এবং জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছিল। গত বছরের মার্চ এবং এপ্রিলে আরো ১০ কি.মি. এরও বেশি দীর্ঘ দেয়ালের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যায়। এগুলোকেও চীনের মহা প্রাচীরের অংশ হিসেবেই ধারণা করা হচ্ছে।
প্রাচীরটির বৈশিষ্ট্য
প্রথম দিকে দেয়ালটি মাটি, কাঠ এবং পাথরের ব্যবহারেই তৈরি করা হত। মিং সাম্রাজ্যের সময়ে চুন, ইট আর পাথরের ব্যবহার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এই প্রাচীর থেকে সীমান্ত রক্ষীরা সীমান্ত পাহাড়া দিত। সীমান্ত রক্ষীরা ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ হয়ে এই সীমান্ত পাহাড়া দিত। ফলে এক দলের সাথে অন্য দলের যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়াও ভয়ঙ্কর আক্রমণের ক্ষেত্রে আরো শক্তিশালী বাহিনীকে ডাকা বা, সতর্ক করারও সুব্যবস্থা ছিল এতে। পাহাড়ের চূড়ায় বা, অনেক উঁচুতে সিগন্যাল টাওয়ারগুলো অবস্থিত ছিল। ফলে এসব টাওয়ার থেকে কোন সতর্কতা বা, বিপদ সংকেত দেয়া হলে তা খুব সহজেই বোঝা যেত।
প্রাচীরটির বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে প্রাচীরটির অনেক অংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। যদিও বেইজিঙ্গের উত্তর দিকে এবং পর্যটন কেন্দ্রের আশেপাশে সংরক্ষিত রয়েছে। এসবের কিছু অংশ আবার অনেক বেশি রকমের সংস্কারও করা হয়েছে। ২০১৪ সালে লাইয়াওনিং এবং হেবেই প্রদেশের বর্ডারের কাছের দেয়ালগুলো কনক্রিট দিয়ে নতুন করে সংস্কার করা হয়। চীন সরকারের এই সংস্কার উদ্যোগ তখন বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছিল। ২০১২ সালের ‘স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশান অভ কালচারাল হেরিটেজ’ কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যমতে মিং সাম্রাজ্যের সময় তৈরি হওয়া ২২% প্রাচীরই বা, প্রায় ২,০০০ কি.মি. প্রাচীরই সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে গেছে। পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি এই চীনের মহা প্রাচীরের যে অংশ গানসু প্রদেশে অবস্থিত তার ৬০ কি.মি. এরও দীর্ঘ অংশ সামনের ২০ বছরের মাঝেই ধ্বংশ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আজ কালের আবর্তে শুধু চীনের নয় গোটা বিশ্বের গৌরব চীনের এই প্রাচীর আজ অনেকটাই ধ্বংসের মুখোমুখি। পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এর প্রতি চীন সরকার যেমন যত্নবান হয়েছেন তেমনি উল্টোদিকে এই ব্যাপক পরিচিতির ফলে একে প্রতি নিয়ত সামলাতে হচ্ছে লাখ লাখ পর্যটকদের চাপ। তবে চীন সরকার যদি এর সংস্কারের প্রতি আরো মনোযোগী হয়ে ওঠে তাহলে হয়ত আরো বহুদিন এই মনুষ্য সৃষ্ট বিশ্ব ঐতিহ্যকে এই পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।