নেপোলিয়নের শাসনামলে ফ্রান্সের এক দুর্ধর্ষ গুপ্তচরের নাম হল কার্ল সালমিস্তার। এই সালমিস্তারের গল্পগুলো বলার মত। যেমন ছিল তার তীক্ষ্ন বুদ্ধি, তেমনি ছিল ব্যক্তিত্ব আর অভিনয় করার প্রচন্ড দক্ষতা। Force-2 মুভিটা দেখছিলাম, গুপ্তচরদের সাথে কীরকম আচরণ করা হয় তাদের মৃত্যুর পর, সেটা নিয়েই নির্মিত। তখুনি মাথায় এলো, কার্ল সালমিস্তারের ব্যাপারেও মানুষের জানা উচিত। বিজেতা হিসেবে নেপোলিয়নের যে সুনামটুকু, তার সাথে যে সালমিস্তার নামক ছোটখাটো মানুষটির নাম জড়িয়ে আছে সেটা খুব কম মানুষেরই জানা আছে।
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ডান হাত ছিল এই সালমিস্তার। এই সালমিস্তার তার জীবনে সমস্ত মানুষকে ঠকিয়েছে, শুধু ঠকায়নি তার প্রভু নেপোলিয়নকে।
১৭৭০ সালে ফরাসী সীমান্তে জন্ম হয় সালমিস্তারের। স্কুলে থাকাকালীন সময়েই হয়ে উঠে দক্ষ চোরা-চালানী। উনিশ-বিশ বছর বয়সের পূর্বেই বেআইনী আমদানি-রপ্তানি তে হাত পাকিয়ে ফেলেছে।
যে সময়ের কথা বলছি, নেপোলিয়ন সবেমাত্র ফ্রান্সের দখল নিয়েছে, পুরো ইউরোপ দখলের উন্মত্ততা তাকে ছেঁয়ে আছে। ছোটখাটো এক সৈনিক থেকে ফ্রান্সের কর্ণধার। সারা ইউরোপ দখল করার স্বপ্ন চোখে নিয়ে দপদপিয়ে বেড়াচ্ছিল সে সময়ে। তা দেখে, নেপোলিয়নের প্রতি সালমিস্তারের মনে ছিল অনেক ভক্তি।
একদিন হঠাৎ করেই সালমিস্তারের কাছে সুযোগ এসে গেল, নেপোলিয়নের জন্য কিছু করার। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঠেকাতে, তিনি চাইছিলেন চরম একটা উদাহরণ তৈরি করে দিতে, যেন আর কেউ কখনো ষড়যন্ত্রের সাহস না করে। নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীতে স্যাভারি নামক এক সেনাপতি ছিল। স্যাভারি বেশ ভালমতোই সালমিস্তারকে চিনতো। স্যাভারির হঠাৎই মনে হল, সালমিস্তার নেপোলিয়নের কাজটি করে দিতে পারবে, সেই দক্ষতা সালমিস্তারের রয়েছে। স্যাভারি তাই নেপোলিয়নের প্রস্তাব নিয়ে সালমিস্তারের কানে তুললো।
সালমিস্তার সেই সুযোগ লুফে নিল বলা চলে। এই কাজের জন্য নিয়োগ পেল সালমিস্তার। বুঁড়বো বংশীয় ডিউকরা সে সময়ে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পায়তারা করছিল। সালমিস্তার ভাবলো কোনো এক ডিউককে যদি সীমান্ত পার করে নিয়ে আসা যায়, তাহলেই তাকে ধরিয়ে দেয়া যাবে নেপোলিয়নের কাছে।
বলির পাঠা হওয়ার জন্য যেন, ডিউক এনঘিন তৈরি হয়েই ছিলেন। তিনি সেই সময়ে অবস্থান করছিলেন জার্মানীর বডেন শহরে। আসছে সপ্তাহে স্ট্রাসবুর্গের এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর মেয়ের সাথে বিয়ে, বাগদান সম্পন্ন হয়েই আছে।
সালমিস্তার প্রথমেই মিথ্যা এক অজুহাতে সেই মেয়েকে এনে বন্দী করে রাখলেন ফরাসী সীমান্তে। তারপর ডিউককে লিখলেন মস্ত এক চিঠি। বাগদত্তার হাতের লেখা এমন ভাবে নকল করলেন যে, আর বোঝার উপায় রইলো না, এটা সালমিস্তারের লেখা ছিল। চিঠির মূল কথাগুলো ছিল এমন, “আমাকে এরা বন্দী করে রেখেছে, কী কারণে সেটা বলছে না। তুমি আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে না গেলে উপায় নেই বাঁচার”।
ডিউক চিঠি পড়ে একটুও সন্দেহ করলেন না। উদ্ধার করার উদ্দেশ্য একাই রওনা হয়ে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন, অর্থলালসাকে উপজীব্য করেই এই অপহরণ করা হয়েছিল। কিন্তু বুঝতে পারেননি হিসেবে যে সামান্য ভুল ছিল। ফরাসী সীমান্তে প্রবেশের আগেই তাকে গ্রেপ্তার করে হাজির করা হল নেপোলিয়নের সামনে। ষড়যন্ত্রকারীদের কীভাবে খুঁজে বের করা হবে, সেই উদাহরণ তৈরি করলেন নেপোলিয়ন। শাস্তিস্বরূপ রায় দিলেন ফাঁসির।
আর সালমিস্তারের দক্ষতায় নেপোলিয়ন হলেন মুগ্ধ, এরপর থেকে গোপন বৈঠকগুলোয় ডাক পড়তে লাগলো সালমিস্তারের।
একে একে কাজের ভার দিতে শুরু করলেন সালমিস্তারের উপর। আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড; গুপ্তচরবৃত্তিতে সবগুলোতেই সফল হল সালমিস্তার। নেপোলিয়ন তখন অনেকটাই ভরসা করে বসে আছেন সালমিস্তারের উপর। এবার দিলেন সবথেকে বিপজ্জনক কাজের ভার, অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীর সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে আনা চাই।
সুন্দর এক গল্প সাজালো সালমিস্তার। অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল ম্যাক এর কাছে গিয়ে বলল, নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে ফ্রান্স থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অনেক গালিগালাজও করতে ছাড়লো না নেপোলিয়নকে। ম্যাক এ সমস্ত শুনে অনেক মজা পেল। ম্যাকের মতে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী অনেক শক্তিশালী। সহজে ধরাশায়ী করা যাবে না।
সালমিস্তার যেন ম্যাকের মুখের কথা কেড়ে নিল। বলল, যতটা আপনারা মনে করেন ততটা শক্তিশালী বাহিনী তার নেই। সাথে এও যোগ করল যে, ফ্রান্সের বহু লোক নেপোলিয়নের থেকে মুক্তির জন্য যেকোন সময়ে অস্ট্রিয়ার পক্ষে যোগদান করতে ইচ্ছুক।
অস্ট্রিয়ানরা আগে একবার নেপোলিয়নের কাছে হেরেছে। সুতরাং তাদের মনে নেপোলিয়নের প্রতি একটা ভয় কাজ করছিল, কখন না জানি আক্রমণ করে বসে লোকটা। সালমিস্তারের কথাবার্তায় মার্শাল ম্যাকের মনে হল, বহুদিনের লালিত স্বপ্ন এবার বুঝি সত্যি হয়।
ম্যাক সালমিস্তারকে নিয়োগ দিল অস্ট্রিয়ার পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য। সে চাইছিল, সালমিস্তার ফ্রান্সে ফিরে গিয়ে সকল খবরাখবর সংগ্রহ করে আনুক, কিন্তু পাছে আবার ধরা পড়ে যায় নেপোলিয়নের হাতে। তাই ম্যাক সাহেবের রায় হল, সালমিস্তার যেন, তার পরিচিত মানুষজনকে চিঠি লিখে খবর আনায়।
ধীরে ধীরে ফ্রান্সের খবর সরবরাহ শুরু করল সালমিস্তার, সবই ছিল বানোয়াট, নেপোলিয়ন এসমস্ত কথাই জানতো। নেপোলিয়নের আদেশে পৃথকভাবে ছাপানো খবরের কাগজ যেতো সালমিস্তারের নামে। তাতে থাকতো নেপোলিয়নের বিরোধীদলের কার্যকলাপের মিথ্যা গল্প। ম্যাকের মন থেকে ধীরে ধীরে নেপোলিয়নের ভয় উবে যেতে শুরু করেছিল সেই সময়টায়।
এক সময় অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীতে উচ্চপদস্থ এবং অনেক সম্মানিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন সালমিস্তার। অনেক ধনী হয়ে উঠলো সালমিস্তার। নেপোলিয়ন সংবাদ পাঠাল যে, তিনি এবার অস্ট্রিয়া আক্রমণের জন্য প্রস্তুত। সময় বুঝে, ফিল্ড মার্শালকে লেলিয়ে দিলেন পুরো সেনাবাহিনী নিয়ে ফ্রান্সকে আক্রমণ করতে, সেই ছিল সময়। ম্যাকের মন ছিল অনেক ফুরফুরে, তিনি অবশেষে ফ্রান্স জয় করতে যাচ্ছেন, বাছাইকৃত ত্রিশ হাজার সৈন্য পাঠাল, ফ্রান্স জয় করে নেপোলিয়নকে পাকড়াও করে আনতে। সৈন্যদল কিছুদূর এগোতেই, ফরাসীদের শত শত কামান গর্জে উঠল, আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল।
দুর্দান্ত এই লড়াই চলল তিনদিন পর্যন্ত। টানা তিনদিন লড়াই শেষে, সৈন্যদের শরীর যেন আর চলছে না। একে একে ঢলে পড়ল মৃত্যুর কবলে। শেষপর্যন্ত মার্শাল আত্মসমর্পণ করতেই বাধ্য হল। কোনরকমে ফিরে এল ভিয়েনাতে। সালমিস্তার আগে থেকেই প্রস্তুত। অস্ট্রিয়ার সম্রাটকে বেশ ভাল মতোই বুঝাল যে, মার্শাল ম্যাকের জন্যই এই পরাজয়। ম্যাকের উপর বিচার শুরু হল, যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। এইদিকে নেপোলিয়নের বাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল ভিয়েনার দিকে।
আবারো সালমিস্তারের ফাঁদে পড়লো অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনী। আর নেপোলিয়ন তো প্রথম থেকেই প্রস্তুত ছিল। অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনী আক্রমণ শুরু করা মাত্রই, তাদের হারিয়ে দিয়ে দখল করে নিল পুরো অস্ট্রিয়া। এই ছিল সেই বিখ্যাত অস্টারলিটজ যুদ্ধ।
নেপোলিয়ন ভিয়েনা তে প্রবেশ করার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সালমিস্তার অস্ট্রিয়ানদের মনে এই বিশ্বাস অটুট রেখেছিল যে, সে তাদের বন্ধু এবং তাদের জন্যই সংগ্রাম করে যাবে আজীবন।
নেপোলিয়নের জন্য সালমিস্তার কী যে করেনি তার খোঁজ পাওয়া যায় না। অস্ট্রিয়ার বিপুল সেনাবাহিনীকে ঠেলে দিয়েছে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে। নেপোলিয়নও বরাবরই তার কার্যদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে সালমিস্তারকে পুরষ্কৃত করেছেন। কিন্তু তাও শেষ পর্যন্ত সালমিস্তারের একটি অনুরোধ তিনি রক্ষা করেননি। সালমিস্তার নেপোলিয়নের কাছে চেয়েছিল ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ সম্মানসূচক উপাধি। নেপোলিয়ন যদিও সালমিস্তারের সকল মনোবাসনা পূর্ণ করায় দৃঢ়কল্প ছিলেন, কিন্তু একজন গুপ্তচরকে শ্রেষ্ঠ সম্মানের ভূষণে ভূষিত করার পক্ষপাতী ছিলেন না।
গুপ্তচরবৃত্তির গল্প শেষ, French Secret Service এর পরিচালক নির্বাচিত হয়েছিল যদিও, সালমিস্তারের শেষ জীবন কেটেছে, তামাক ব্যবসায়ী হিসেবে। ইংরেজরা নেপোলিয়নকে পরাজিত করে সেইন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়, আর সালমিস্তারের হয় কয়েক মাসের জেল। জেল থেকে এসেই শুরু করে তামাকের ব্যবসা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওটাই ছিল সালমিস্তারের কাজ।