জাদুকরের জাদুর ছোঁয়াতে কম বেশি আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হই। জাদুর বিভিন্ন কলাকৌশল জানা সত্ত্বেও আমরা মুগ্ধ নয়নে জাদুকরের দিকে তাকিয়ে থেকেছি কত সময়। একজন দক্ষ জাদুশিল্পী খুব সহজেই তার দর্শকদের সুনিপুণ কথার মাধ্যমে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে রাখতে পারেন পুরোটা সময়। এমনি এক ফরাসি ম্যাজিশিয়ান রবেয়ার উদ্যাঁ (Robert Houdin, ১৮০৫-১৮৭১)। তিনি তার জাদু দিয়ে সারা পৃথিবীতে শুধু খ্যাতিই অর্জন করেন নি, জাদু নিয়ে তার নানান কীর্তি এ শিল্পে তাকে দিয়েছে অমরত্ব।
১৮০৫ সালের ৭ই ডিসেম্বর ফ্রান্সে তার জন্ম। জাদুবিদ্যার বিভিন্ন কলাকৌশলে তিনি ছিলেন সেই সময়ের পথিকৃৎ। তার জাদুবিদ্যার কথা আজও বই পুস্তকে ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়।
১৮৫৬ সালের দিকে ফরাসিদের দখলে থাকা উত্তর আফ্রিকার আলজিরিয়ায় শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খলা। কিছু আরব-ধর্মযাজকের নানারকম জাদু দেখে আলজিরিয়ানরা খুব সহজেই তাদের বশ্যতা স্বীকার করে। আরব ধর্মযাজকদের কথামতো আলজিরিয়ানরা ফরাসি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। তখনকার সেসব আরব আরব ধর্মযাজকদের প্রতি তারা এতই মোহিত ছিল যে আলজিরিয়ান জনগোষ্ঠী ভাবতে লাগল এই ধর্মযাজকদের জাদুর বলেই তারা ফরাসিদের পিছু হটাতে বাধ্য করবে।
বলাই বাহুল্য ফরাসি সরকার আলজিরিয়ানদের এমনতর বিদ্রোহের মুখে হকচকিয়ে গেল। প্রাথমিক সঙ্কট নিরসনে সামরিক বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কথা চিন্তা করলেও পরবর্তীতে খুব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তখনকার সরকার ভিন্ন উপায় খুঁজে নিলেন। তলব করা হল ফরাসি জাদু-গৌরব রবেয়ার উদ্যাঁকে।
জাদুর ভেলকি জাদুতেই নিপাতের লক্ষে ফরাসি সরকারের এমন চিন্তা। পুরো ইউরোপ জুড়ে তখন উদ্যাঁর জাদুর প্রচুর খ্যাতি। জাদু দেখিয়ে দেশ সেবা করার এমন সুযোগ উদ্যাঁ ছাড়তে পারলেন না। সদলবলে আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ারসে পৌঁছলেন। শুরু হলো তার জাদু দেখানো। বিভিন্ন শহরে জাদু দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন।
তার রোমাঞ্চকর জাদুর খবর পুরো আলজিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে লোক ভিড় জমাতে লাগল উদ্যাঁর জাদু দেখার জন্য। প্রাথমিকভাবে উদ্যাঁকে ততটা তোয়াক্কা না করলেও ধীরে ধীরে উদ্যাঁর জাদু সবাইকে অবাক করতে লাগল। অনেকে আবার ভীত হয়ে পড়ল।
আলজিরিয়ায় যে খেলাগুলো দেখিয়ে রবেয়ার উদ্যাঁ তাক লাগিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল কাউকে অদৃশ্য করে দেয়া। একজন আরব দর্শককে মঞ্চের উপর ডেকে বেতের একটা বড় ঝুড়ি দিয়ে তাকে চাপা দেয়া হত। তারপর উদ্যাঁ জাদুকাঠি দিয়ে কিছু কেরামতি দেখিয়ে ঝুড়িটা তুলতেই জলজ্যান্ত মানুষটি পুরো উধাও। এই রকম অদ্ভুত কাণ্ড দেখে ভয়ে অনেকেই চিৎকার করতে করতে হল থেকে পালিয়ে যেত। এই ফরাসি জাদুকর তাদেরকেও এভাবে জাদু করে হাওয়া করে দিবে বলে সবাই ভীষণ ভয় পেতে লাগল।
এই ধরনের আরেকটি চমৎকার খেলা পিস্তলের গুলি আটকানো। উদ্যাঁ একটি প্লেটে অনেক পিস্তলের টোটা রেখে আরব দর্শকদের তা ভালভাবে পরীক্ষা করতে বলতেন। টোটাগুলো নেড়েচেড়ে দেখে দর্শকরা খুশি। এবার সেই প্লেট থেকে একটি টোটা নিয়ে জাদুকর পিস্তলে ভরে একজনকে দিতেন। উদ্যাঁ কিছুটা পিছে সরে গিয়ে লোকটির মুখোমুখি দাঁড়াতেন। লোকটিকে জাদুকরের দিকে নির্ভয়ে গুলি ছুঁড়তে বলতেন।
দর্শকটি জাদুকরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার পর দেখা যেতো টোটা জাদুকরের বুকে না লেগে দাঁতের ফাকে আটকে আছে। উদ্যাঁ তখন ব্যঙ্গ করে বলে উঠতেন, “গায়ে গুলি চালিয়েও রক্ত বের করতে পারলে না। এবার দেখ আমি এই পিস্তল দিয়ে অদৃশ্য শত্রুর রক্ত বের করব।” এই বলে জাদুকর দেয়ালের গায়ে গুলি ছুঁড়তেন। আর দেয়ালের গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হত। এ দৃশ্য দেখে সবাই হতভম্ব। দর্শকদের অনেকেই দৌড়ে গিয়ে দেখত যে সত্যিকার রক্ত কিনা! এই কাণ্ড দেখে সকলের মধ্যে এক ধরনের চাপা গুঞ্জন আর ভয়ের সঞ্চার হতে লাগল।
বলাই বাহুল্য এই জাদুতে উদ্যাঁ খুব সুচারু বুদ্ধির প্রয়োগ করেছিলেন যার কারণে আরব লোকগুলো সহজেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিল যে তারা যা দেখছে তা সবকিছুই সত্যি। ধীরে ধীরে জাদুকরের প্রতি তাদের বিশ্বাস আরও বেশি বেড়ে যেতে থাকে এবং উদ্যাঁকে তারা আরও বেশি ভয় পেতে শুরু করল।
আলজিরিয়ার দুর্ধর্ষ আরবদের কাবু করার জন্য উদ্যাঁর দেখানো সবচেয়ে আলোচিত এবং চমকদার খেলা ছিল ‘হালকা এবং ভারী বাক্সের খেলা’। স্টেজের উপর একটি ছোট বাক্স রেখে উদ্যাঁ একটি শিশুকে বাক্সটি তুলতে বলতেন। ছেলেটি সহজেই বাক্সটি তুলে জায়গামত রেখে দেয়।
এরপর উদ্যাঁ শক্তিশালী এক জোয়ানকে বাক্সটি তুলতে বলেন। লোকটি খুব তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বাক্সটি তুলে রাখে। এরপর এরপরই শুরু হয় উদ্যাঁর ম্যাজিক। এবার উদ্যাঁ সেই লোকটিকে লক্ষ্য করে বলে উঠতেন, “আমি তোমার সব শক্তি কেড়ে নিলাম। তোমার শক্তি এখন শিশুটির চাইতেও অনেক কম, তুমি এখন অনেক দুর্বল, এবার তুমি বাক্সটি তুলে দেখাও।”
লোকটি প্রথমে অবহেলা করে বাক্সটি তুলতে গিয়ে দেখলো বাক্সটি তোলা যাচ্ছে না। এরপর সে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকল। কিন্তু বাক্সটিকে এর জায়গা থেকে এক বিন্দুও সে নাড়াতে পারল না। উল্টো বৈদ্যুতিক শক খেয়ে স্টেজের একপাশে গিয়ে আছড়ে পড়ে কাঁপতে লাগল। এরপর উদ্যাঁ বাচ্চাটিকে বাক্সটি তুলতে বললে বাচ্চাটি খুব সহজেই তা তুলে দেখাল। ব্যাপারটি দেখে ঐ লোকটিই শুধু অবাক হল না, উপস্থিত সবাই ভয় পেয়ে গেল। উদ্যাঁ তখন লোকটিকে ভরসা দিয়ে বললেন যে “ভয় পেয়ো না, আমি তোমার সকল শক্তি আবার তোমার কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছি। এবার তুমি খুব সহজেই বাক্সটি তুলতে পারবে।” যেমন বলা তেমন কাজ। লোকটির এরপর বাক্সটি তুলতে কোন প্রকার বেগ পেতে হল না।
এই জাদুকরী খেলাটিতে উদ্যাঁ বৈদ্যুতিক চুম্বকশক্তি ব্যবহার করেছিলেন যা তখন আরবদের কাছে অজানা ছিল। বৈদ্যুতিক তরঙ্গের ব্যবহার করে খুব সহজেই এই জাদুটি দেখানো হয়েছিল যা উদ্যাঁর এক অসামান্য সৃষ্টি। পুরো খেলাটি এমন সুচারুরূপে দেখানো হয়েছিল যে উপস্থিত কারও মধ্যে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগেনি।
পুরো ব্যাপারটিই তাদের মাঝে এমনি ভুতুড়ে প্রভাব ফেলে যে সকলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এসব ঘটনা দেখে আরবদের মধ্যে আর কোন সন্দেহ রইল না যে, ফরাসি জাদুকরের কাছে তাদের আলজিরিয়ান জাদুকররা নেহাতই শিশু। আলজিরিয়ান ধর্মযাজকরা ভয়ে ও বিস্ময়ে রবেয়ার উদ্যাঁ তথা পুরো ফরাসিদের কাছেই আত্মসমর্পণ করে। শুধুমাত্র জাদুকে পুঁজি করে একটি দেশের বিদ্রোহ দমন করার ঘটনা ইতিহাসে বিরল।
ফরাসি সরকারের কাছে রবেয়ার উদ্যাঁ ছিলেন শান্তির দ্যূত। তার এই ধরনের নজিরবিহীন ঘটনার জন্য একটি রক্তক্ষয়ী আন্দোলন থেকে ফরাসি নাগরিক এবং আলজিরিয়ার অধিবাসী উভয়েই রক্ষা পায়। বিরল এই ঘটনার জন্য উদ্যাঁকে তাই সর্বদা স্মরণ করা হয়ে থাকে। রবেয়ার উদ্যাঁ সেই সময়কালে যে সকল জাদু দেখিয়েছিলেন তার অধিকাংশ ছিল তার নিজের সৃষ্টি। তার নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং জ্ঞান প্রয়োগ করে উদ্যাঁ চমৎকার সব জাদুর সৃষ্টি করেন। রবেয়ার উদ্যাঁকে তাই আধুনিক জাদুবিদ্যার জনকও বলা হয়ে থাকে।