অব্যবহৃত এয়ারফিল্ড, পরিত্যক্ত রানওয়ে, জঙ্গলে ঘেরা বৈরি পরিবেশ! আর তারই মধ্যে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে চলেছে প্রশিক্ষণ, অঙ্কুরোদগম হয়েছে এক সশস্ত্র বাহিনীর। এ কাহিনী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর গোড়াপত্তনের এবং অদম্য সাহস ও সাহসিকতার। কঠিন প্রশিক্ষণের পর ঝুঁকি নিয়ে উড়াল দেয়ার গল্প, সাহসিকতার সাথে বিপদমুখে ঝাঁপিয়ে পড়ার উপাখ্যান আর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সূচনালগ্ন কেন্দ্রীভূত একটি বিন্দুতে- ইউনিট কিলো ফ্লাইট।
কিলো ফ্লাইটের জগতে বিশদভাবে প্রবেশ করার পূর্বে এর পটভূমি থেকে ঘুরে আসা যাক। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অনেক বাঙালি অফিসার, ক্যাডেট ও সেনা পালিয়ে চলে আসেন। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তারা নানা স্থল অপারেশনে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের পরিচয় দেন। প্রায় পাঁচশ বিমানসেনা ও ৩৫ জন বিমানবাহিনীর অফিসার পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের নিজস্ব বিমান বাহিনী হোক এই লক্ষ্য নিয়ে কিছু বাঙালি বিমান বাহিনীর অফিসার, পাইলট, বাংলাদেশ ফোর্সেস বা বিডিএফ, ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং ভারত সরকারের মধ্যে আলোচনা হয়ে আসছিল। অতঃপর ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আসে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি। ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এ ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটিতে অত্যন্ত গোপনভাবে গোড়াপত্তন হয় ক্ষুদ্র বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর, গোপনীয়তা রক্ষার্থে যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘কিলো ফ্লাইট’।
স্বাধীন বিমানবাহিনী গঠনের জন্য তৎকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পুরনো দুটি বিমান ও একটি হেলিকপ্টার দেয়া হয়। এর মধ্যে একটি বিমান ছিল যোধপুরের মহারাজার দেয়া আমেরিকায় প্রস্তুতকৃত ডিসি-৩ ডাকোটা এবং অন্যটি কানাডায় তৈরি ডিএইচথ্রি অটার বিমান। হেলিকপ্টারটি ছিল ফ্রান্সে তৈরি এলুয়েট থ্রি মডেলের। সদ্যজাত এই বিমানবাহিনীর লক্ষ্য ছিল মূলত এই আকাশযানগুলো নিয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর রাত্রে আক্রমণ করার অপারগতাকে কাজে লাগিয়ে আকাশপথে আচমকা হামলা চালিয়ে পালিয়ে আসা। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ক্ষয়ক্ষতি সাধন করাও ছিলো এর উদ্দেশ্য।
মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন (তার নামের অক্ষর ‘কে’ থেকেই কিলো ফ্লাইটের নামকরণ করা হয়েছে)। বিভিন্ন সেক্টর থেকে ৫৮ জন বিমানসেনাকে কিলো ফ্লাইটের জন্য নিয়ে আসা হয়। এদের মধ্যে কিছু পিআইএ এবং প্ল্যান্ট প্রোটেকশন পাইলটও ছিলেন। কিলো ফ্লাইট দলে ছিলেন ১০-১২ জন পাইলট (যাদের ৩ জন পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে এবং ৬ জন পিআইএ-সহ অন্যস্থান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন) ও কিছু টেকনিশিয়ান। পালিয়ে আসা ৯ জন পাইলট হলেন- স্কোয়াড্রন লিডার (পরবর্তীতে এয়ার ভাইস মার্শাল ও চিফ অফ এয়ার স্টাফ) সুলতান মাহমুদ, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ, ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার, ক্যাপ্টেন খালেক, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন বদরুল আলম এবং ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন। বিমান ও হেলিকপ্টারের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র যেমন- মেশিনগান, রকেট, পড এবং জ্বালানী ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়েছিল।
গোপন ও ক্ষুদ্রভাবে শুরু হওয়া কিলো ফ্লাইটের যাত্রাপথ কিন্তু মসৃণ ছিলো না। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত ডিমাপুরের বিমানঘাঁটিটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিত্যক্ত। এটি ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা, সাপ-খোপে ভরা এবং অমসৃণ রানওয়েযুক্ত স্থান। ভারত সরকারের দেয়া বিমান ও হেলিকপ্টারও ছিল সেকেলে ও ত্রুটিযুক্ত। এর মধ্যেই এই বৈরি পরিবেশে শুরু হয়ে যায় পরিকল্পনামাফিক কাজ। ডাকোটাটিকে ৫০০ পাউন্ড বোমা পরিবহনের উপযোগী করে তোলা হয় (যদিও পরবর্তীতে কারিগরিগত কারণে এটাকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গকে পরিবহনের কাজে লাগানো হয়)। হেলিকপ্টারটিতে বাড়তি সুরক্ষার জন্য এর মেঝেতে এক ইঞ্চি পুরু স্টিলের পাত ঝালাই করে লাগানো হয়। এছাড়াও এতে থ্রি-নট-থ্রি ব্রাউনিং মেশিনগান এবং ১৪ টি রকেট ছোঁড়ার পাইলন বসানো হয়েছিল। অতিরিক্ত ভারের জন্য এটি বেশ নড়বড়েভাবে উড়ত। মেরামতের পর এটি নভেম্বরে এর প্রথম যাত্রা সম্পন্ন করে। ঘণ্টায় ৮০ মাইল গতির অটার বিমানটির প্রতিটি ডানার নিচে ৭টি করে রকেট ছিল এবং এর ২৫ পাউন্ড বোমা বর্ষণের ক্ষমতা ছিল। পেছনের দরজা খুলে লাগানো হয়েছিলো মেশিনগান, মেঝের পাটাতন খুলে ২৫ পাউন্ডের ১০টি বোমা বসানো হয়েছিলো। উল্লেখ্য যে, বোমাগুলো স্বয়ংক্রিয় ছিল না, হাত দিয়ে পিন খুলে নিক্ষেপ করতে হতো।
অতঃপর শুরু হয় কঠোর মাত্রার প্রশিক্ষণ। ভারতীয় বিমানবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা দিনরাত প্রয়াস করে প্রশিক্ষণ দিয়ে যান। এদের মধ্যে গ্রুপ ক্যাপ্টেন চন্দন সিং, স্কোয়াড্রন লিডার ঘোষাল, স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সি.এম. সিংলা উল্লেখযোগ্য। সেই সাথে প্রচণ্ড বাধা অতিক্রম করে অসীম সাহসিকতার সাথে নানা প্রতিবন্ধকতার সাথে পাল্লা দিয়ে প্রশিক্ষণে নিজেদের অর্পিত করেন বাঙালি বীর সন্তানেরা।
ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনের মতে, দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের জঙ্গলঘেরা ঐ এলাকায় বিমান চালানো ছিল বিপদসংকুল। তিনি বলেন, “আমরা ২০০-২৫০ মিটারের চেয়ে বেশি উঁচুতে উড়তে পারতাম না এবং যে কোনো সময় পাহাড়ে বিধ্বস্ত হবার ঝুঁকি ছিল। কিন্তু আমরা ঐ আকাশযানগুলো নিয়ে খুব কম সময়ের মধ্যেই প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছিলাম।” কমোডোর এ. কে. খন্দকারের মতে, “বিমানঘাঁটিটি ঘন জঙ্গলে ঘেরা ছিল। পাহাড়ের উপরে ফেলা প্যারাস্যুটকে নিশানা বানিয়ে আমরা বোমা-রকেট ফেলা ও আক্রমণ করার প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলাম। বর্ষাকালে জঙ্গলবেষ্টিত ও সাপের প্রাচুর্যমণ্ডিত এলাকায় কোনো দিকনির্দেশনার ব্যবস্থা ব্যতিরেকে এসব কিছুই অনেক কঠিন ছিল। কতটা কঠিন ছিল তা একজন পাইলট ছাড়া কারো বোঝার কথা নয়।”
প্রশিক্ষণ যখন প্রায় শেষের দিকে তখন চন্দন সিং, সুলতান আহমেদসহ বাকিদেরকে একটি প্রতীক ঠিক করতে বলেন যা অস্ত্রসজ্জিত হেলিকপ্টারে আঁকা হবে। আলোচনার পর ঠিক হয় হেলিকপ্টারের ভার্টিকাল স্ট্যাবিলাইজারের উপর গোলাকার লাল চাকতির ওপর বসানো থাকবে সবুজরঙা বাংলাদেশের মানচিত্র। হেলিকপ্টারটির সিরিয়াল নম্বর আইএএফ ৩৬৪ থেকে পাল্টে ইবিআর (ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস) করা হয়। প্রশিক্ষণকালে একবার সকালে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম একাই অটার বিমান নিয়ে গিয়েছিলেন। জ্বালানী স্থায়িত্বকাল এর অনেক পরেও তিনি যখন ফিরলেন না তখন ক্যাম্পে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। সূর্যাস্তের কিছু পরে তিনি ফিরে আসলে জানা যায়, তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে সোজা কলকাতা চলে গিয়েছিলেন! সেখানে জ্বালানী নিয়ে তারপর ঘাঁটিতে ফিরেছিলেন তিনি। এসবের পাশাপাশি চলেছিল নাইট ফায়ারিং বা রাতের অন্ধকারে নিশানা চিহ্নিত করে আক্রমণ চালানোর কলাকৌশল রপ্ত করার প্রশিক্ষণ। নভেম্বরের শেষের দিকে দিনে ও রাত্রে আক্রমণ চালানোর জন্য কিলো ফ্লাইট ইউনিট তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ কিলো ফ্লাইটের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম এবং ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন হেলিকপ্টারটি চালানোর দায়িত্বে ছিলেন। ক্যাপ্টেন আব্দুল খালেক , ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার ও ক্যাপ্টেন আব্দুল মুকিত ডাকোটা বিমানটি এবং ফ্লাইট লেফটেল্যান্ট শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমেদ অটার বিমানটি চালাবার দায়িত্ব পেয়েছিলেন।
৬৬ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল কিলো ফ্লাইট। প্রথম আক্রমণের দিন প্রথমে ২৮ নভেম্বর ধার্য হলেও পরে সেটা ৬ দিন পিছিয়ে ডিসেম্বরের দুই তারিখ ধার্য করা হয়। পাইলট শামসুল আলম ও কো-পাইলট আকরাম আহমেদের আওতাধীন অটার বিমানটি ত্রিপুরার মণিপুরের কৈলাসশহরে নিয়ে গিয়ে চট্টগ্রামে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নেয়া চলতে থাকে। অপরপক্ষে, সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলমের হেলিকপ্টারটির তেলিয়ামুরা থেকে রওয়ানা হয়ে নারায়ণগঞ্জে হামলা করবে বলে ঠিক হয়। চট্টগ্রাম এলাকায় ২২০২৫’ উত্তর দ্রাঘিমারেখাকে আকাশ ও নৌপথে হামলার আওতার বিভাজন রেখা হিসেবে ধরা হয়।
অতঃপর ৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারি ও নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল তেল ডিপোতে আক্রমণ চালানো হয়। ৩ ডিসেম্বর রাত্রের শুরুতে পর্যাপ্ত জ্বালানী ও রকেট নিয়ে সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলমের হেলিকপ্টারটি রওয়ানা দেবার জন্য তৈরি হয়। আকাশে উড্ডয়নকালে নেভিগেশন লাইট চালু রাখার কারণে কপ্টারটি বেশি পরিমাণে দৃশ্যমান হওয়ায় সি.এম. সিংলা হ্যান্ডসেট মারফত তাদের সাথে যোগাযোগ করে সেটি বন্ধ করান। অতঃপর আওয়াজজনিত কারণে বিমানটির অস্তিত্ব টের পাওয়া গেলেও রাতের অন্ধকারে সেটি চোখে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। এরপর সেটি যেতে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের জ্বালানী তেল সংরক্ষণকারী ট্যাঙ্কের দিকে। তেলিয়ামুরা থেকে ইলিয়টগঞ্জ হয়ে ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক ধরে উড়ে তারা ডেমরা পৌঁছান। অতঃপর দক্ষিণে মোড় নিয়ে সোজা গোদনাইল যান। বলা বাহুল্য, তাদের আচমকা হামলা সেখানে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল এবং তেমন কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন না হয়েই তারা তেলের ট্যাঙ্কারের ক্ষতিসাধনে সক্ষম হন।
অপারেশন সম্পন্ন করে ফেরার সময় তারা সহজেই নির্দিষ্ট হেলিপ্যাড চিহ্নিত করে নিরাপদে অবতরণ করেন। অন্যদিকে কো-পাইলট ও গানারসহ অটার বিমানটি নিয়ে শামসুল আলম চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হন। তারা পাকিস্তানি রাডারগুলোকে ফাঁকি দেয়ার জন্য অনেক নিচু দিয়ে ওড়েন। শামসুল আলম জানান, এই তেল ডিপোটিতে হামলা চালানো হয়েছিল পাকিস্তানি মিলিটারির তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে। তিনি বলেন, “পরিকল্পিত সুবিধাজনক স্থানের মধ্যে এটি একটি ছিল এবং আক্রমণের বেশ আগেই আমরা এটিকে নির্দিষ্ট করেছিলাম।” শামসুল আলম জানান, “ডিসেম্বরের ৩ তারিখ একটি ট্যাঙ্কারে বোমা ফেলা হয়। খুব দ্রুতই অন্য ট্যাঙ্কারগুলোতেও আগুন ধরে যায়। অপারেশনটি সফল হয়েছিল।”
শামসুল আলম চট্টগ্রাম বন্দরেও দুটি জাহাজে হামলা করেন এবং তেল ডিপো ও জাহাজ মিলিয়ে মোট ২৪টি রকেট ছোঁড়েন। তার মতে বিমানে কোনো নেভিগেশন সিস্টেম না থাকায় তাকে পৃষ্ঠের অবস্থা বুঝে, দিক ঠিক রেখে ও সময় গুনে গুনে নিশানায় হামলা চালাতে হচ্ছিল। তিনি বলেন, “নিচে থেকে মেশিনগান চালানো শুরু হয়েছিল, আমরা ভাগ্যবান যে পালাতে পেরেছিলাম।” তার মতে, “এই আক্রমণ পাকিস্তানি সেনাদের মনোবলে চির ধরাতে সক্ষম হয়েছিল। এর পরে তারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ তাদের কল্পনাতীতভাবে এই মধ্যরাত্রে চালানো হয়েছিল আক্রমণ।” নেভিগেশন লাইট ছাড়া রানওয়ে খুঁজে বের করে নাগাল্যান্ডের কুড়িগ্রামে অবতরণও ছিল দুরূহ কাজ। এরপর নিরাপদে ফিরলে মিশনের পর্যবেক্ষক আইএএফ অফিসার তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন।
৪ ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় এবং তখন কিলো ফ্লাইট লোকবল ও অস্ত্রশস্ত্রে বেশ ভালোভাবে সংগঠিত হচ্ছিলো। ৩ তারিখের অপারেশনের পর থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাথে যৌথভাবে অনেক অপারেশনে অংশ নেয়। ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তারের ভাষায়, “৪ ডিসেম্বর এর আক্রমণে ৮০টিরও বেশি বিমান অংশ নেয়। আমরা এত নিচু দিয়ে উড়ছিলাম যে সহজেই মেশিনগানের গুলির শিকার হতে পারতাম। আমি যে বিমানটি চালাচ্ছিলাম তার দুই পাখায় মোট ১৪টি রকেট ছিল। আমি তার সবগুলোই শুত্রুর ওপর ফেলেছিলাম।”
বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নিজস্ব দ্বিতীয় বিমান হামলাটি করে ৬ ডিসেম্বর সিলেটের মৌলভীবাজারের সেনা ছাউনিতে। এ আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, কো-পাইলট হিসেবে ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন। এদিকে ডিমাপুর থেকে ঘাঁটি সরিয়ে শমসেরনগর নেয়া হয় এবং পরবর্তীতে যুদ্ধ শেষ হবার আগে তা আগরতলায় স্থানান্তর করা হয়। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট ও ভৈরবসহ মোট ১২টি অপারেশনে কিলো ফ্লাইট বীরত্বের সাক্ষর রাখে। ৫-১১ ডিসেম্বরের মধ্যে জামালপুর, মেঘনা নদী ও নরসিংদীর অপারেশনেও কিলোফ্লাইট অংশ নেয়।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে কিলো ফ্লাইটের সবাই গুরুত্বপূর্ণ সামরিক খেতাব পান। সুলতান মাহমুদ – বীর উত্তম, শামসুল আলম- বীর উত্তম, বদরুল আলম- বীর উত্তম, শাহাবুদ্দিন- বীর উত্তম, আকরাম আহমেদ- বীর উত্তম, শরফুদ্দিন আহমেদ- বীর উত্তম, আব্দুল খালেক- বীর প্রতীক, আলমগীর সাত্তার- বীর প্রতীক, আব্দুল মুকিত- বীর প্রতীক।
কিলো ফ্লাইট বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম ফ্লাইং ইউনিট যা জন্মের ৬৬ দিনের মাথায় কার্যকরী হয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি সশস্ত্রবাহিনীর ইতিহাসে তাই কিলোফ্লাইট এক ভাস্বর নাম।