ড্রোন শব্দটি আজকের সমাজে অনেক বেশি আলোচিত একটি বিষয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সব যন্ত্রপাতি, যা একটা সময় আমাদের কাছে ছিল শুধু কল্পনা। ছোটবেলায় কত ভেবেছি, আমার যদি একটা রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার থাকতো, তাহলে কী মজাই না হতো! বর্তমানে এসব খেলনা দুধ-ভাত। কম্পিউটার আর মোবাইলের যুগে বাচ্চারাও আজকাল এসব খেলনার প্রতি খুব একটা বেশি ঝোঁকে না। তবে রিমোট কন্ট্রোল নিয়ন্ত্রিত এই খেলনাই কিন্তু ড্রোন ভাবনার প্রথম উপাত্ত। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিজ্ঞানী ড্রোনের পর্যায়ক্রমিক উন্নতি সাধন করে আসছেন। দিনকে দিন ড্রোনগুলো শক্তিশালী থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
শুরুর দিকে গোয়ান্দা বাহিনীর কাজে সাহায্য করার কথা ভাবা হলেও দিন দিন এর অপপ্রয়োগ বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন ক্ষমতাধর দেশ পর্যন্ত এখন ড্রোন হামলার ভয়ে আতঙ্কিত। আর এসব ড্রোন ঠেকানোর জন্য দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থা আর প্রতিরক্ষা বাহিনী নিত্য নতুন কৌশল আয়ত্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে নিরলস।
খুব সম্প্রতি অবৈধ ড্রোন ঠেকানোর জন্য নেদারল্যান্ড এক অভিনব উপায় বের করেছে। তাদের কৌশল অনুসারে এবার ড্রোন ঠেকাবে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন ধারালো নখের শিকারী ঈগল। মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, কি করে সম্ভব এটি? চলুন দেখা যাক কী করে এমন আশ্চর্য উপায় বাস্তবায়ন করবে নেদারল্যান্ডের প্রতিরক্ষা বাহিনী।
এশিয়ার অনেক দেশেই সেই প্রাচীনকাল থেকে ঈগল পাখি দিয়ে শিকার করার প্রচলন ছিল। সেই একই কৌশলের ব্যবহার দেখা গেল নেদারল্যান্ড পুলিশ বাহিনীর কাছ থেকে। আকাশ থেকে উড়ন্ত অবৈধ ড্রোন নামাতে শিকারি ঈগল পাখি ব্যবহারের পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। প্রাচীন ঐতিহ্যকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে ব্যবহারের জন্য নেদারল্যান্ড গড়ে তুলেছে এক অভিনব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঈগল বাহিনী। আর নেদারল্যান্ডের পুলিশ বাহিনীর সাথে একযোগে কাজ করছে পাখি প্রশিক্ষণ নিরাপত্তা সংস্থা।
আকাশে উড্ডয়নরত অবৈধ ড্রোনকে ছোঁ মেরে মাটিতে নামিয়ে আনবে এ ঈগল বাহিনী। এরই মধ্যে নতুন এ বাহিনীর এক সদস্যের তৎপরতা প্রদর্শন করেছে ডাচ পুলিশ। হান্টার নামের দু’বছর বয়সী মার্কিন ঈগল আকাশ থেকে সফলভাবে নামিয়ে এনেছে অবৈধ এক ড্রোন। ডাচ পুলিশ জানিয়েছে, এভাবেই উচ্চ প্রযুক্তি থেকে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে ব্যবহার হবে প্রাচীন পদ্ধতি।
পাখিরা কিন্তু অনেক আগে থেকেই খুব বুদ্ধিমান। সেই প্রাচীন যুগে যেমন পায়রার পায়ে চিঠি গুঁজে ভাবের আদান-প্রদান হতো। তেমনি আজও ঈগলের চোখের শিকারি মনোভাবকে কাজে লাগিয়েছে ‘গার্ড ফ্রম এবাভ’ নামের এক কোম্পানি। তাদের দাবি, পৃথিবীতে প্রথম কোম্পানি হিসেবে তারাই শত্রুপক্ষের ড্রোন ধ্বংসের কাজে প্রাণীদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছে।
কোম্পানিটির এ ধরনের অভিনব চিন্তাধারা মনে ধরে যায় নেদারল্যান্ড প্রশাসনের। নেদারল্যান্ড পুলিশের মতে, অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের বেশ ভাল অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। ড্রোন নিধনে নেদারল্যান্ড পুলিশ জাম্পিং ড্রোন ব্যবহার করা, জাল দিয়ে ধরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া, আকাশে গুলি করে ধ্বংস করে দেওয়ায় বেশ অভিজ্ঞ। কিন্তু এর সঙ্গে যদি প্রযুক্তিবিহীন প্রাকৃতিক ঈগল ব্যবহার করা যায়, তাহলে এটি হবে নেদারল্যান্ড পুলিশের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা।
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে বেড়ে চলেছে সন্ত্রাসী হামলার দৌরাত্ম্য। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে ড্রোন হামলার হুমকি। ২০১৪ সালে ফ্রান্সের নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশনের কাছ থেকে অজ্ঞাতনামা ড্রোন উদ্ধার করা হয়। একই বছরে ইংল্যান্ডের সাবমেরিন আওতাভুক্ত এলাকায় ড্রোন পাঠানোর জন্য একজনকে জরিমানা করা হয়। ২০১৫ সালে এক স্টেডিয়ামে ড্রোন উড়ানোর জন্য একজনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে ইংল্যান্ড। গত এপ্রিল মাসে নেদারল্যান্ডের আমাস্টারডাম বিমানবন্দর থেকে সিফোলে নামে একটি অজ্ঞাতনামা ড্রোন উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পরই নিরাপত্তা বিষয়ে আরো জোরালো পদক্ষেপ নিতে বলা হয় দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। ফলে এন্ট্রি ড্রোন কর্মসূচী দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর সেই আন্দোলনের এক নতুন পদক্ষেপ ঈগলের ব্যবহার যা হয়তো উন্নত দেশগুলোকে কিছুটা স্বস্তি দিতে সাহায্য করবে।
‘গার্ড ফ্রম এবাভ’ সংস্থাটি ২০১৪ সাল থেকে এন্টি ড্রোনের উপর কাজ করে যাচ্ছে। অবৈধ ড্রোন ধ্বংস করার কাজে তারা প্রযুক্তির উপর নির্ভর না করে পুরোপুরি প্রাকৃতিক উপায়কে বেছে নিয়েছে। আর ড্রোন আটকানোর জন্য তারা বেছে নিয়েছে শক্তিশালী বুদ্ধিসম্পন্ন শিকারি পাখি ঈগলকে। এসব ঈগলকে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করা হয় ড্রোন নিধনের জন্য।
সাধারণত ঈগলের বাচ্চাকে ছোট অবস্থা থেকেই প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। ড্রোনের গায়ে খাবার রেখে বাচ্চা ঈগলগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাচ্চাগুলো ড্রোনের গায়ে ঠুকরে ঠুকরে খাবার খেতে থাকে। ছোটবেলা থেকেই ড্রোনের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা জন্মানোর চেষ্টা করা হয়। ধীরে ধীরে ঈগলগুলো বড় হতে থাকে একটি সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। ঈগলগুলো আকারের দিক দিয়ে বেশ বড়সড়ো। যেকোনো ছোটখাট ড্রোনকে খুব সহজেই মাটতে ভূপাতিত করতে পারতে এই ঈগল।
‘গার্ড ফ্রম এবাভ কোম্পানি’র এক প্রতিনিধির মতে ঈগল প্রশিক্ষণের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে এই ঈগলের ব্যবহার যে একেবারে ত্রুটিমুক্ত তা কিন্তু নয়। কারণ ড্রোনের রয়েছে ধারালো পাখা। এই পাখার আঘাতে ঈগলগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। কিন্তু ঈগলগুলো রক্ষার্থে তাদের পায়ের নখে পড়ানো হচ্ছে মোটা মোজা। এতে করে ব্লেডের ধারে তাদের কোনো প্রকার ক্ষতি হবে না বলে আশা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে ড্রোনে থাকা বোমা বিস্ফোরিত হয়ে ঈগলের মৃত্যু ঠেকাতে তাদের গলায় লাগানো হবে বিস্ফোরক অকেজো করার যন্ত্র।
নেদারল্যান্ডের নিরাপত্তা বিষয়ক পরামর্শক সজার্ড হোজেনডোর্ন ঈগল ব্যবহারের পদ্ধতি প্রথম আলোচনায় নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, “এই দুর্দান্ত আইডিয়া অনেক কাজ দেবে আমাদের।” ভালকেনবুর্গ নৌবহিনীর এই আলোচনা অনুষ্ঠানে সজার্ড হোজেনডোর্ন বলেন, ‘প্রসিদ্ধ ঈগল পালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেই আমরা এসব ঈগল কিনেছি।” সজার্ড হোজেনডোর্ন আরও বলেন, “২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন নিউ ইয়র্কে হামলা হয়, ওই সপ্তাহে আমি সেখানে ছিলাম। তারপর থেকেই নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন ও নতুন পদ্ধতি ব্যবহারের ইচ্ছাপোষণ করি। একটি হামলার ঘটনা মানুষের জীবনে অনেক বড় প্রভাব ফেলে। আমি সেদিনের ঘটনা দেখার পর নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু করার সুযোগ খুঁজছিলাম। আমার মনে হয়ে ঈগলের ব্যবহার খুব কার্যকরী উপায় যা দিয়ে পৃথিবীকে কিছুটা হলেও নিরাপত্তা দেওয়া যাবে।”
সম্প্রতি ফরাসি বিমান বাহিনীও ড্রোন দিয়ে সন্ত্রাসী হামলা ঠেকাতে গড়ে তুলছে ঈগল বাহিনী। এ লক্ষ্যে এক ঝাঁক ঈগলকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে ফরাসি দৈনিক লা এক্সপ্রেস।
বাস্তিল দিবস, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনসহ আন্তর্জাতিক বড় সম্মেলন বা গুরুত্বপূর্ণ দিবসে ড্রোন দিয়ে সন্ত্রাসী হামলা ঠেকাতে ঈগল বাহিনীকে ব্যবহার করা হবে। অনেক সময়ই ড্রোনকে গুলি করে নামানো সম্ভব নয়। বিশেষ করে জনবহুল এলাকায় এ ধরণের পদক্ষেপ বাড়তি ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। তাই ফরাসি বাহিনীর এ সব পরিস্থিতিতে ঈগল বাহিনীকে ব্যবহার করাকেই সর্বোত্তম ভাবছে।
ড্রোন বর্তমান সময়ে সারা বিশ্বে হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী হামলার সন্দেহে সকল উন্নয়নশীল দেশ সর্বদা তটস্থ। এমতাবস্থায় ড্রোন প্রতিরোধ করা যেন অত্যাবশ্যকীয় প্রতিটি দেশের জন্য। ড্রোন আটকানোর জন্য প্রচলিত অনেক উপায় রয়েছে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে। এর সাথে যদি স্বল্প খরচের এই ঈগল ব্যবহার করা যায়, তাহলে প্রাকৃতিক উপায়ে ড্রোনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে একটি নজিরবিহীন পদক্ষেপ।
তথ্যসূত্র
১। theguardian.com/world/2016/sep/12/eagles-v-drones
২। fortune.com/2017/02/22/drones-eagles-france/
৩। washingtonpost.com/news/worldviews