বিজ্ঞান আর ধর্ম একে অন্যের পরিপূরক। তবে এদের মধ্যে বেহুদা সংঘাতে প্রাণ দিতে হয়েছে অনেক বিজ্ঞানীকেই। ধর্ম-বিজ্ঞান বিবাদ ছাড়াও আকস্মিক হামলা বা নিজের খামখেয়ালিপনায়ও জীবন হারান অনেক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। যারা বেঁচে থাকলে হয়তো পৃথিবী এগিয়ে যেতো কয়েক যুগ। চলুন দেখে আসা যাক, এমন সাত বিজ্ঞানী যারা পৃথিবীকে অনেক কিছু দেওয়ার আগেই দুর্ভাগ্যক্রমে পরপারে পাড়ি জমান।
আর্কিমিডিস
তৎকালীন সমসাময়িকে তার মতো প্রতিভাবান কেউ ছিলোনা। একাধারে গণিতবিদ, পদার্থবিদ, জ্যোতিষবিজ্ঞানী, আবিষ্কারক, অস্ত্র পরিকল্পক ছিলেন এই গুণী গ্রিক বিজ্ঞানী। ক্ল্যাসিকাল সময়ের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে স্বনামধন্য আর্কিমিডিস।
তিনি বাস করতেন গ্রিক নগরী সিরাকিউসে। তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর প্রতিভা কাজে লাগিয়ে উন্নতমানের অস্ত্র দিয়ে রোমের আক্রমণ থেকে নগরীকে সুরক্ষিত রেখেছিলো সিরাকিউসের প্রতিনিধিরা। তবে অন্তঃমহলের বিশ্বাসঘাতকতায় রোমের সৈন্যরা সিরাকিউস দখল করতে সমর্থ হন। তবে রোমান সম্রাট মার্কাস ক্লদিয়াস মার্সেলাস সৈন্যদের বলেছিলেন কেউ যাতে আর্কিমিডিসের কোনো ক্ষতি না করে। তৎকালীন সময়ে সিরাকিউসের প্লুটার্ক নামের এক বাসিন্দা তার বইয়ে আর্কিমিডিসের মৃত্যু কাহিনী তুলে ধরেন। তার ভাষ্যমতে, রোমান সৈনিক যখন আর্কিমিডিসকে মার্সেলাসের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসেন, তখন তিনি একটি জ্যামিতিক চিত্র নিয়ে মগ্ন ছিলেন। তাকে বিরক্ত না করতে বলায় সৈন্যটি রেগে গিয়ে তরবারি দিয়ে আর্কিমিডিসকে খুন করে। আরেকটি তথ্যমতে, তাকে মার্সেলাসের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি নিজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রোমান সৈনিক সেগুলোকে অস্ত্র ভেবে তাকে খুন করে বসেন। তার মৃত্যুর খবরে যারপরনাই অনেক রেগে যান মার্সেলাস। তিনি চেয়েছিলেন আর্কিমিডিসের মতো প্রতিভাবানকে বাঁচিয়ে রাখতে। মার্সেলাস আর্কিমিডিসকে আখ্যায়িত করেছেন ‘জ্যামিতির ব্রিয়ারিউস’ নামে। এক সাধারণ সৈন্যের খামখেয়ালীপনায় ৭৫ বয়সে প্রাণ হারান এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী।
হেনরি মোসলে
পিরিয়ডিক টেবিলের ভিত্তি আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন এই ব্রিটিশ বিজ্ঞানী। রাদারফোর্ডের ল্যাবরেটরিতে কাজ করা এই বিজ্ঞানী এটমিক ব্যাটারি আবিষ্কারের জন্যও সুপরিচিত।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভলান্টিয়ার হিসেবে ব্রিটিশ আর্মিতে নাম দেন হেনরি মোসলে। তার পরিবার তাকে মিনতি করলেও দায়িত্ব রক্ষার জন্য তিনি যুদ্ধে যোগদান করেন। সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট মোসলে মাত্র সাতাশ বছর বয়সে যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ হারান। ১৯১৬ সালে তুরস্কের গালিপোলির যুদ্ধের ময়দানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই গুণী রসায়নবিদ। ১৯১৬ সালে পদার্থ কিংবা রসায়নে নোবেল দেওয়ার প্রচলন ছিলোনা। ধারণা করা হয়, পুরষ্কার থাকলে তিনি যে কোনো একটি বিষয়ে নোবেল পাওয়ার যোগ্য দাবিদার ছিলেন। মাত্র সাতাশ বছরেই তিনি বিজ্ঞান ক্ষেত্রে রেখে গেছেন অপরিসীম অবদান।
হাইপেশিয়া
হাইপেশিয়াকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘ইউনিভার্সাল জিনিয়াস’ হিসেবে। জ্যোতিষশাস্ত্র, গণিত, বিজ্ঞান সব শাখায় বিচরণ ছিলো এই সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়ানো মহিলার। তার বাবা ছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক থিওন। বাবার দেখানো পথে হেঁটে তিনিও অর্জন করেন সম্মান আর ভালবাসা। হাইপেশিয়ার জীবন জুড়ে আছে আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি আর জাদুঘর। এই লাইব্রেরির সখ্যতা ছিলো টলেমি, আর্কিমিডিস, প্লুটোর দর্শনের সাথে।
তবে সেইসময়ে আলেকজান্দ্রিয়ার ধর্মবিরোধ কাল হয়ে আসে হাইপেশিয়ার জীবনে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে হাইপেশিয়ার অবাধ বিচরণ আর খ্রিস্টধর্মের অযৌক্তিক দিকগুলো বিজ্ঞানের মাধ্যমে তুলে ধরায় চার্চের রোষানলে পড়েন তিনি। খ্রিস্টপূর্ব ৪১৫ এর কোনো এক বিকালে ঘোড়ার গাড়ি থেকে টেনে নামায় কিছু গোঁড়া ধর্মান্ধ মানুষ। পিটার নামের এক লোকের নেতৃত্বে রাস্তায় সবার সামনে বিবস্ত্র করা হয় হাইপেশিয়াকে। শামুকের খোলস দিয়ে তার শরীরের মাংস খুবলে নেওয়া হয়। শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আলাদা করার পর পুড়িয়ে ফেলা হয় এই সম্মানীয় ব্যাক্তিত্বকে। এইভাবে চার্চের ক্ষোভের স্বীকার হয়ে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে প্রাণ হারান তিনি। হাইপেশিয়াকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে চাঁদের একটি গিরিখাতের নামকরণ করা হয়েছে তার নামানুসারে।
এভারিস্টে গ্যালিয়োঁ
ফ্রেঞ্চ এই প্রতিভাবান গণিতবিদের জীবন কাহিনী সিনেমাকেও হার মানাতে বাধ্য। প্রচণ্ড প্রতিভাবান থাকা সত্ত্বেও খামখেয়ালী ঘরানার ছিলেন এই গণিতবিদ। ১৪ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে অংক নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়ে থাকতেন তিনি। এর ফাঁকে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতেও। যার জন্য ছয় মাসের জেলও খেটেছিলেন তিনি।
৩০ মে, ১৮৩২ সালে এক ডুয়েল বন্দুকযুদ্ধে আহত হন, ঠিক পরেরদিনই মারা যান তিনি। মৃত্যুর মাত্র পাঁচদিন আগে গ্যালিয়োঁ তার বন্ধু অগাস্টোর কাছে একটি চিঠি লিখেন। সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে নিজের প্রিয়তমাকে পাওয়ার জন্য তাকে বন্দুকযুদ্ধে যেতে হচ্ছে। তবে বন্দুকযুদ্ধে নিজের হার সম্পর্কে অনেকটাই সুনিশ্চিত ছিলেন, যার দরুন নিজের আবিষ্কারগুলো লেখা শুরু করেন তিনি। সেসব কিছু পাঠিয়ে দেন তার বন্ধুর নিকট। ৩১ মে, ১৮৩২ সালে গ্যালিয়োঁর মৃত্যু হলেও তার আবিষ্কারগুলো বুঝতে সময় লেগেছে একশ বছরেরও বেশি। ১৯৫২ সালে জার্মান গণিতবিদ হার্মেন উইয়েল প্রথম পাঠোদ্ধার করেন তার পাঠানো চিঠিগুলোর। গণিতের জগতের গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপ থিওরির আবিষ্কারক এই ফ্রেঞ্চ গণিতবিদ।
মাত্র বিশ বছর বয়সে নিজের খামখেয়ালিতে প্রাণ না হারালে হয়তো গণিতকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারতেন এভারিস্টো গ্যালিয়োঁ।
মিগুয়েল সারভেটাস
বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব,মেডিসিন, আইন বিষয়ে অসম্ভব পারদর্শী এই বিজ্ঞানীর জন্ম মধ্যযুগে, ১৫১১ সালে। মেডিসিন আর এনাটমি খাতে তার গুরুত্ব অপরিসীম। তিনিই প্রথম হৃৎপিণ্ড আর ফুসফুসের মধ্যে রক্ত সঞ্চালনের সঠিক ব্যাখ্যা দেন।
খ্রিষ্ট ধর্মের ট্রিনিটি ও ব্যাপ্টিজম নিয়ে অভিযোগ তুললে ক্যাথলিক চার্চের চোখের বিষে পরিণত হন এই স্প্যানিশ বিজ্ঞানী। জেসাস একইসাথে পুত্র, পিতা ও ঈশ্বর, ক্যাথলিক চার্চের এই বিশ্বাসই পরিচিত ট্রিনিটি নামে। ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলায় প্রথমে তাকে জেলে নেওয়া হয়। কোর্টের ট্রায়ালে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো স্বীকার করে নেন তিনি। অবশেষে তার মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৫৫৩ সালে ২৭ অক্টোবর সারভেটাসকে খুঁটির সাথে বেঁধে জীবন্ত পোড়ানো হয়। আগুন জ্বালানোর জন্য তারই লেখা বইগুলো ব্যবহৃত হয়। মৃত্যুকালীন সময়েও তিনি ট্রিনিটিকে অবিশ্বাস করে বলেছেন ‘Jesus, Son of the Eternal God, have mercy on me.’ নিজের বিশ্বাসের উপর অটল থেকে মাত্র ৪২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
জিওর্দানো ব্রুনো
কোপার্নিকাসের দেওয়া তত্ত্বে বিশ্বাসী এই বিজ্ঞানীও প্রাণ হারান ক্যাথলিক চার্চের বিদ্বেষের কারণে। কসমোলজি নিয়ে গবেষণা করা ব্রুনোই সোলার সিস্টেমের আধুনিক তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনিই প্রথম বলেন মহাবিশ্বের কোনো কেন্দ্র নেই এবং মহাবিশ্বের আকার অসীম। চার্চের প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে কথা বলায় প্রথমে তাকে জেলে যেতে হয়। ট্রায়ালের আগে সাত বছর কারাগারে ছিলেন এই ইতালিয়ান বিজ্ঞানী। ট্রায়ালেও নিজের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন তিনি। ২০ জানুয়ারি, ১৬০০ সালে তাকে হেরেটিক উপাধি দিয়ে পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট মৃত্যুদেশ জারি করেন। আদেশ জারির ২৭ দিনের মাথায় রোমান মার্কেটের সামনে নগ্ন করে তাকে পোড়ানো হয়। তার ছাই হওয়া শরীর টাইবার নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। এভাবে বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে মাত্র ৫১ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান জিওর্দানো ব্রুনো।
অ্যান্টনিও ল্যাভয়শিয়েঁ
রসায়ন জগতের অন্যতম পুরোধা হচ্ছেন এই ফরাসি বিজ্ঞানী। ‘ফাদার অফ কেমিস্ট্রি’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয় এই কৃতি বিজ্ঞানীকে। বাতাসে গ্যাসের অনুপাত তিনিই প্রথম নির্ণয় করেছেন। এছাড়া পিরিয়ডিক টেবিলেও রয়েছে তার অসামান্য অবদান। সোশাল রিফর্মার হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন ল্যাভয়শিয়েঁ।
তিনি ছিলেন ফ্রান্সের অভিজাতদের মধ্যে একজন। তৎকালীন সময়ে ফ্রান্সের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ছিলেন এই বিজ্ঞানী। তার অর্থ আসতো একটি প্রাইভেট ট্যাক্স কোম্পানির মাধ্যমে। ইতিমধ্যে বিশাল অর্থবিত্তের কারণে মারাট নামে একজন শত্রুও হয় ল্যাভয়শিয়েঁর। ফ্রেঞ্চ অভ্যুত্থানের সময়কালে মারাট প্রভাবশালী হয়ে উঠে। অবশেষে অভ্যুত্থানের শেষদিকে কোম্পানির নাম করে মারাট তিনিসহ আরও সাতাশ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। ১৭৯৪ সালের ৮ই মে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ল্যাভয়শিয়েঁকে। ৫১ বছর বয়সে শিরশ্ছেদে প্রাণ হারান এই রসায়নবিদ।
আকস্মিকতায় প্রাণ না হারালে এরাই হয়তো বিজ্ঞানের শাখাগুলোকে দিতে পারতো আরও মূল্যবান কিছু। অনেক ক্ষেত্রে চার্চ ক্ষমাও চেয়েছে এই মৃত্যুগুলোর জন্য। এই মহান বিজ্ঞানীদের অকাল প্রয়াণে মানবজাতিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণের সাথে সাথে আমৃত্যু আফসোসও করে যেতে হবে।