হঠাৎ করে বেজে উঠল মেইলের নটিফিকেশনের ঘন্টা। মেইল খুলে দেখলেন সেখানে বিশাল অক্ষরে লেখা, আপনার জন্য শুধুমাত্র আজকের জন্য একটি বিশেষ অফার দিয়ে সেই মেইলটি। অনেকের মনে হয়ত এই প্রশ্নটি আসবে না, তা-ও একটা বিষয়ে একটু খেয়াল করুন নাহয়। কেন এই মেইলটি আপনাকে পাঠানো হল বা ওই কোম্পানির কাছে আপনার মেইল আইডি থাকবে, কী করেছেন আপনি? কি, উত্তর খুঁজে পেলেন না? আপনার অজান্তেই আপনি কোনো এক ওয়েবসাইটে প্রবেশের সময় আপনার তথ্য প্রদান করে বসছেন, অনেক সময় তা খেয়ালই করেন না। এসব সাধারণত হয়ে থাকে ওয়েবসাইট বা এপ্লিকেশন ব্যবহারের সময় আপনার বেখেয়ালিপনা এবং ডিজাইনারদের চাতুর্যপূর্ণ নকশার কারণে। এভাবে সুকৌশলে মানুষকে তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও এরকম ফাঁদে ফেলে তাদের তথ্য নিয়ে নেয়াটাই হল ডার্ক প্যাটার্ন।
ডার্ক প্যাটার্ন
জাদুকরের অভিনয়ের সময় যেমন আপনি তার ছল ধরতে পারেন না, ঠিক তেমনি বিভিন্ন ইন্টারফেস নকশা করার সময় অনেক ডিজাইনার অ্যাপ বা ওয়েবসাইট এমনভাবে তৈরি করেন যেন তারা আপনাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করে যা সাধারণত আপনি করতে চাইবেন না। এরকম নকশাকেই বলা হয় ডার্ক প্যাটার্ন। ইন্টারনেট ব্যবহারের সময় আপনি একটি পেইজে আসা প্রতিটি শব্দ ভাল করে পড়ে দেখেন না। একনজর দেখেন, আন্দাজ করে নেন অনেকটুকুই। প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার এই বেখেয়ালিপনার উপরে ভর করে আপনার এবং কিছু ক্ষেত্রে আপনার আশপাশের মানুষজনের মূল্যবান তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা এমনভাবে নকশা করে যাতে একটি জিনিস মনে হলেও আপনার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নেয় অন্য কিছুর।
আপনি আপনার পিসিতে সফটওয়ার ইন্সটল করার সময় অনুমতি চেয়ে এরকম একটি স্ক্রিন প্রায়শ দেখা যায়। একবার একটু খেয়াল করে শেষের লাইনটা একটু দেখুন তো। কি, অবাক হচ্ছেন? মেসেঞ্জার আপনাকে এই পেইজের মাধ্যমে অন্য একটি সফটওয়ার ইন্সটল করার অনুমতি চেয়ে নিচ্ছে। শেষে আবার এই ধাপ এড়ানোর ব্যবস্থাও করে রেখেছে, তবে অনেকেই না দেখেই ‘Accept’ বাটনের দিকে মাউস বাড়াতেই পারেন।
বিভিন্ন ধরনের ডার্ক প্যাটার্ন
হ্যারি ব্রিগনাল নামক একজন গবেষক প্রায় ছয় বছর তথ্য সংগ্রহ করেন এবং এসব ফাঁকিকে বেশ কিছু ভাগে বিভক্ত করেন। এই লেখনীতে অল্প কিছু তুলে ধরা হল
Bait and Switch (টোপ ফেলে বেশ পালটে ফেলা)
এক্ষেত্রে একজন ব্যবহারকারী একটি কাজের উদ্দেশ্যে তার যাত্রা শুরু করেন, কিন্তু নিজের অজান্তে কখন যে ভিন্ন পথে এগিয়ে বসেন বুঝতেও পারেন না। এই পদ্ধতির সবচেয়ে প্রচলিত উদাহরণ ছিল মাইক্রোসফট যখন তাদের উইন্ডোজ ব্যবহারকারীদের উইন্ডোজ ১০ এ আপগ্রেড করার বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছিল।
২০১৬ সালের দিকে অনেক উইন্ডোজ ব্যবহারকারীর কাছে উপরের এই বিজ্ঞপ্তি তুলে ধরে। একসময় তারা তাদের ‘x’ বাটনের অর্থ পালটে দিল। সাধারণত এই বাটন দিয়ে বন্ধ করুন বা পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিব এরকম বুঝানো হলেও মাইক্রোসফট এই বিজ্ঞপ্তিতে তার অর্থ পালটে করে দেয়, ‘হ্যাঁ, আমি আপগ্রেড করতে রাজি আছি’। বলা চলে অনেকটা জোর করে ব্যবহারকারীদের উইন্ডোজ ১০ এ আপগ্রেড করতে বাধ্য করতে চায় মাইক্রোসফট।
লজ্জায় ফেলে কাজ আদায়
কিছু কিছু জায়গায় বিজ্ঞাপন এমনভাবে সাজানো হয় যেন আপনি সেটিতে রাজি না হয়ে কত বড় ভুল কাজই না করছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটা করা হয় কোনো নিউজলেটারে সাইনআপ করার জন্য নয়ত এডব্লকার ব্যবহার না করার জন্য।
ছদ্মবেশী বিজ্ঞাপন
কিছু বিজ্ঞাপন এমনভাবে সাজানো হয় যে দেখে মনে হয় তা সে ওয়েবসাইটেরই অংশ। ভুলে সে বিজ্ঞাপনে ক্লিক করে বসলেই নিয়ে যাবে অন্য একটি ওয়েবসাইটে। ধরে নেয়া যাক, আপনি একটি গান ডাউনলোড করবেন, সে হিসেবে খুঁজে আপনি নিচের এই ওয়েবসাইটে এসে পৌঁছালেন। বড় বড় করে দুটি বিজ্ঞাপন দিয়ে রাখা হয়েছে এবং নিচে আসল লিংক।
বন্ধু স্প্যাম
এই ব্যবস্থায় আপনার কাছ থেকে এই বলে অনুমতি নেয়া হয় যে আপনার তথ্য আপনার উপকারে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু তারা আপনার পক্ষ থেকে আপনার পরিচিত মানুষজনকে মেইল পাঠিয়ে এক বিরক্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে।
এর সবচেয়ে প্রচলিত উদাহরণ ছিল লিংকডিনের সাইন-আপ এর সময়। তারা আপনার কাছ থেকে আপনার অনুমতি চায় যাতে আপনার ক্যারিয়ারের জন্য শক্তিশালি নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারে। কিন্তু তারা আপনার পরিচিত মানুষজনকে আপনার নাম করে মেইল পাঠিয়ে দেয়। ২০১৫ সালে লিংকডিনের এরকম কাজে বিরক্ত হয়ে ক্যালিফোর্নিয়া শহরে একটি মামলা করা হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে লিংকডিন কোম্পানিকে দিতে হয়েছিল প্রায় ১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতিপূরণ।
লুকানো খরচ
কিছু কিছু ওয়েবসাইটে আপনাকে প্রথমদিকে খরচ দেখানো হয় একরকম, কিন্তু শেষে গিয়ে দেখা যায় ডেলিভারি চার্জ, শুল্ক ইত্যাদির নাম করে অতিরিক্ত কিছু টাকা দাবি করে বসে।
প্রোফ্লাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফুল বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান। প্রথমে আপনি যখন ফুলের অর্ডার করতে যাবেন তখন শুধুমাত্র ফুলের দাম দেখাবে আপনাকে।
কিন্তু কয়েকটি ধাপ পার করে অর্ডার করতে যাবেন দেখা যাবে আপনার খরচের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে তারা কিছু চার্জ যুক্ত করেছে। ৫-৬ ধাপ পার করে অনেকে নতুন কোনো ওয়েবসাইট খোঁজার থেকে এই অতিরিক্ত টাকা দেয়া উত্তম বলে মনে করেন এবং টাকা দিয়ে দেন।
ভ্রান্ত পথ
এরকম ডিজাইনে আপনার মনোযোগ বিভ্রান্ত করে এমন কিছু করিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয় যেটিতে সাধারণত আপনি রাজি হবেন না। কোনো সফটওয়্যার ইন্সটল করার সময় অন্য কিছু ইন্সটল করিয়ে নেয়া হয়। একটি স্ক্রিন আসে যেখানে আপনার কাছে অনুমতি চাওয়া হয়। খেয়াল না করলে ইন্সটল হয়ে পড়ে বিজ্ঞাপনের সেই সফটওয়্যার বা অনেক সময় ম্যালওয়্যার।
মূল্যের তুলনায় বাধা
একই রকমের অনেক পণ্য থাকলে আপনি সাধারণত তার দাম যাচাই করে আপনার জন্য দাম এবং মানে ভাল হবে সেটা ক্রয় করবেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে বিক্রেতারা আপনার এই কাজ করে তুলে তুলনামূলক কঠিন। তারা তাদের মূল্য তালিকা এমনভাবে আপনার সামনে তুলে ধরে যাতে আপনি সহজে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারেন।
এখানে আপনি কেজি হিসেবে খরচ কম হবে নাকি খুচরা হিসেবে সেটা বুঝে উঠা কঠিন একটা সিদ্ধান্ত।
Privacy Zuckering (প্রাইভেসি জাকারিং)
আপনার তথ্য সুকৌশলে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এই পদ্ধতিতে। নামকরণ করা হয়েছে ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গের নামে।
কিছু বছর আগে Whatsapp এর এক আপডেটে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে তারা ব্যবহারকারীদের কিছু তথ্য (মূলত ফোন নাম্বার) ফেসবুককে প্রদান করবে। এর জন্য আপনার কাছ থেকে অনুমতিও চাওয়া হয়। নিচের ছবি দ্রষ্টব্য। প্রথম দেখায় মনে হবে রাজি না হয়ে উপায় নেই।
নিচের দিকের তীরে চাপ দিলে আরেকটি অপশন আসবে যেখানে আপনি চাইলে আপনি আপনার তথ্য ফেসবুকে পাঠানো থেকে বিরত থাকতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই জিনিসটি খেয়াল করেননি।
Roach Motel (রোচ মোটেল)
এই মডেলে ব্যবহারকারী খুব সহজে কোনো একটি পরিস্থিতিতে সহজে উপনীত হতে পারে, তবে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে প্রচুর কষ্ট করতে হয়। যেমন ধরুন, আপনি নিউ ইয়র্ক টাইমসে যদি সাবস্ক্রিপশন বন্ধ করতে চান তাহলে আপনাকে তাদের কাজের সময়ে ফোন দিতে হবে।
বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন
অনেক সময় তাড়াহুড়ার মধ্যে দেখা হয় না আপনি কোথায় নিজের তথ্য দিয়ে বসছেন। এমনই একটি নকশার নমুনা হলো এই পদ্ধতি। আপনাকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে এবং সাথে সাথে অন্য একটি জিনিসের অনুমতি নিয়ে বসবে। কোন একটি জায়গায় আপনি সাইন-আপ করার সময় বেশ কিছু অনুমতি দেয়া প্রয়োজন পড়ে। এরকম একটি উদাহরণ দেখা যায় currys.co.uk এর ওয়েবসাইটে।
প্রথম চেকবক্সে মেইল না পাঠানোর কথা বলা হলেও অন্যদিক থেকে তথ্য পাঠানোর ব্যাপারে রাজি করানো হয় ব্যবহারকারীর কাছ থেকে।
এসব নকশা ভুল করে বানানো বা ব্যবহারকারীদের বাজে অভিজ্ঞতা প্রদানের উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়নি। করা হয়েছে ব্যবহারকারীদের তথ্য অসাধু উপায়ে ব্যবহারের জন্য, যা এককথায় প্রতারণামূলক এবং অনৈতিক। ব্যবহারকারীরা এসব ওয়েবসাইটে ভুল করে একবার যেতে পারেন, কিন্তু সতর্ক হয়ে গেলে তারা অন্য উপায় অবশ্যই খুঁজবেন। যেমন ধরুন, ফেসবুক কেলেঙ্কারির পরে অনেক মানুষই ফেসবুক ত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছেন।
ফিচার ইমেজ: 4usky.com