গত ১৪ মার্চ ৭৬ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। তবে সম্প্রতি তার মৃত্যু হলেও বেশ কদিন আগে থেকেই তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ত্বত্ত। কেউ কেউ আছে যারা মনে করে স্টিফেন হকিং আসলে ৩৩ বছর আগেই মারা গেছেন।
তাদের মতে হকিংয়ের বই আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম প্রকাশিত হওয়ার ৩ বছর পূর্বে ১৯৮৫ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। কোনো এক গোপন উদ্দেশ্যে সমাজের উঁচু শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও বিজ্ঞানীরা তার স্থলে তারই মতো কোনো এক ব্যক্তিকে বসিয়ে দিয়েছেন। সে ব্যক্তিই স্টিফেন হকিং নামে পরিচিত। যারা তার মৃত্যু আগেই হয়েছে বলে দাবী করছিলেন তারা সেই ব্যক্তিকে ‘পাপেট প্রফেসর’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
সন্দেহবাদীদের ধারণা
সন্দেহবাদীরা ৫টি কারণ দেখিয়ে বলেন, তারা তাদের ধারণাকে পুরোপুরি সমর্থন করেন। এই ৫টি কারণের মাঝে হকিংয়ের বাহ্যিক রূপ থেকে শুরু করে তার বৈজ্ঞানিক থিওরির জটিলতাও স্থান পেয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক এ ৩৩ বছর আগেই মৃত্যুবরণের ধারণার পেছনে তারা কি কি কারণ দেখিয়েছেন।
- তার বাহ্যিক রূপ: সন্দেহবাদীদের মতে হকিংকে ২০১৭ সালের তুলনায় ১৯৮২ সালে বেশি বয়স্ক দেখাতো। মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত ব্যক্তিকে কয়েক বছরের মাথায়ই অনেক বৃদ্ধ দেখানোর কথা। তাছাড়া তার কান ও দাঁতের পরিবর্তন নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা। তাদের মতে, আগের তুলনায় তার কান আরো ছোট দেখাতো। এমনকি দাঁতের গঠনও সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে দাবী করেন তারা। বড় ধরনের কোনো ডেন্টাল সার্জারি ব্যতীত এটি সম্ভব নয়। মাইলস ম্যাথিস তার ওয়েবসাইটে হকিংয়ের আগের ছবি ও সাম্প্রতিক কিছু ছবির মাঝে তুলনা করে জানান সাম্প্রতিক ছবিতে তাকে আগের ছবির তুলনায় কম বয়স্ক দেখায়।
- তার অবস্থা: হকিং যে রোগে আক্রান্ত ছিলেন সে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রোগ নির্ণয়ের পরে গড়ে ৪-৫ বছর। তার রোগ নির্ণয় করা হয় ১৯৬৩ সালে। অর্থাৎ এরপরেও তিনি প্রায় ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন। এতোদিন বেঁচে থাকার এই ব্যাপারটিকেই তারা সন্দেহজনক বলে ধারণা করেছেন।
- বিয়ের ছবি: হকিংয়ের প্রথম বিয়েতে স্ত্রীর সাথে তোলা ছবি সন্দেহবাদীদের কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও তার দ্বিতীয় বিয়ের ছবি নিয়ে তারা সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় বিয়েতে স্ত্রীর সাথে তোলা হকিংয়ের এক এক একটি ছবিকে তারা এক এক রকম বলে মন্তব্য করেছেন। তারা মনে করেন প্রথম ছবিটি আসল হকিং এবং দ্বিতীয় ছবিটি পরবর্তীতে নকল হকিং এর সাথে তোলা।
- ভয়েস-সিন্থেসাইজিং যন্ত্র: এ যন্ত্রটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সন্দেহবাদীরা। তাদের মতে শুধুমাত্র গালের মাংসপেশির নড়াচড়ার মাধ্যমে শব্দ শনাক্ত করে এবং সেগুলোকে কণ্ঠস্বরে রূপান্তরিত করে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। যে স্বরটি শোনা যেত তা আসলে নাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কম্পিউটারে তথ্য দানের ফল!
- তত্ত্বের জটিলতা: তাদের আরেকটি অভিযোগটি হলো হকিংয়ের দেয়া বিভিন্ন তত্ত্ব ও মতামতের জটিলতা। তাদের মতে তিনি যে তত্ত্ব ও মতামত দিয়েছেন সেগুলো প্রমাণ করা বেশ জটিল যা প্রকৃতপক্ষে হওয়ার কথা নয়।
তাদের ধারণা যদি সত্যিও হয়; তবে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন স্টিফেন হকিংয়ের স্থলে একজন পাপেট প্রফেসরকে রাখা হবে? ডেইলি মেইলের প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্দেহবাদীদের মতে, মানবজাতি আর মাত্র ১০০ বছর টিকে থাকবে কিংবা এলিয়েনের অস্তিত্ব আছে ইত্যাদি তত্ত্ব দিয়ে মানুষের মনে ভীতি সঞ্চার করাই ছিল পাপেট প্রফেসর রাখার উদ্দেশ্য। তাদের মতে গত ১০ বছরে তিনি ট্রাম্প, স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা, ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে অবস্থান ইত্যাদি বিষয় নিয়ে হঠাৎ করেই খুব রাজনৈতিক হয়ে গেছেন, যা বেশ সন্দেহজনক।
পাল্টা যুক্তি
সন্দেহবাদীদের দাবীর জবাব অবশ্যই আছে। খেয়াল করলে দেখা যাবে সন্দেহবাদীদের দাবীগুলো অনেকটাই হাস্যকর। কিন্তু তারপরেও যেহেতু সেগুলো দাবী তাই সেসব দাবীর জবাবে কিছু যুক্তি দেখানো যায়।
- ইন্টারনেটে প্রাপ্ত হকিংয়ের ছবিগুলো থেকে সুবিধামতো ছবি নিয়ে তার ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। আগের ছবিতে তার চুলের রঙ ছিলো গাঢ় বাদামী এবং সাম্প্রতিককালের ছবিতে চুলের রঙ ধূসর হয়েছে বলে তারা দুজন ভিন্ন ব্যক্তি এই যুক্তিটি বেশ হাস্যকর।
- মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত রোগীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা গড়ে ৪-৫ বছর হলেও এরকম অনেক রোগীই আছে যারা এর চেয়েও বেশি সময় বেঁচেছেন। বেশিরভাগ রোগীর মৃত্যুর কারণ হয় শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা অথবা অপুষ্টিজনিত কারণে। এই দুই সমস্যা না থাকলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা আসলে বেশি।
- হকিংয়ের দ্বিতীয় বিয়ের ছবি নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে তাও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। দুই ছবিতে তার বিয়ের পোশাক দুই রকম, আলোর তারতম্যের কারণে কিছুটা ভিন্ন দেখাতে পারে। এরপরও একজন নকল হকিং ৩৩ বছর ধরে আসল হকিং এর মতো অবশ ও বেঁকে হয়ে যাওয়া হাতের অভিনয় করে যাবেন এটি বিশ্বাস করাও কষ্টকর। তাছাড়া এমনও হতে পারে, তারা আসলে দুই রকম পোশাক পরেই ছবি তুলেছিলেন।
- শুধুমাত্র গালের মাংসপেশির সাহায্যে যন্ত্র পরিচালনার ব্যাপারটিকে তারা সন্দেহজনক বলে মনে করেছেন। হকিংয়ের কম্পিউটারের কার্সর তার কি-বোর্ডের প্রতিটি সারির প্রতিটি বর্ণ স্ক্যান করতো। আর কিছু লিখার জন্য তাকে পুরো একটি শব্দ লিখতেও হতো না। কয়েকটি বর্ণ লিখলে বেশ কিছু শব্দ অভিভাবন চলে আসতো। তাছাড়া ইনটেল যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে তা এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। ফলে যেকোনো বিজ্ঞানী এর কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পারে।
একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার যুগে যন্ত্রের মাধ্যমে যোগাযোগের ব্যাপারটি এখন খুব বেশি বিস্ময়কর মনে হওয়ার কথা নয়। স্টিফেন হকিং যদি আসলেই ৩৩ বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করে থাকেন এবং একজন ‘পাপেট প্রফেসর’কে এতোদিন তার স্থলাভিষিক্ত করে পরিচালনা করা করা হয়, তবে প্রশ্ন থেকে যায় তবে এখন তার মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত করা হচ্ছে কেন? একটু চিন্তা করলেই এ ষড়যন্ত্রতত্ত্বের দুর্বলতাগুলো চোখে পড়ে। নিজেদের সুবিধামতো পক্ষপাতদুষ্টভাবে এর যুক্তিগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে।
ফিচার ইমেজ: Team Roar