গত ২ জুন রাতে বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচশেষে পাকিস্তানের পিটিভির নিয়মিত ক্রিকেট শো ‘গেম অন হ্যায়’ পোস্ট ম্যাচ আলোচনা ছিল বাংলাদেশের জন্য নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। ইউটিউবের কল্যাণে শো দেখতে পেয়েছে দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। ঠিক ভাইরাল না হলেও এই শো’র কিছু অংশ সবার নজর কেড়েছে।
সেদিন আলোচক প্যানেলে ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক কোচ মহসিন খান, দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অলরাউন্ডার ল্যান্স ক্লুজনার, পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক রশিদ লতিফ ও ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’খ্যাত শোয়েব আখতার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয় নিয়ে আলোচনার শুরুতে তিন আলোচক তাদের মন্তব্য জানিয়েছেন। উপস্থাপক শোয়েব আখতারকে কথা বলার সুযোগ দিলেন তিনজনের পর। মাইকটা পেয়েই শোয়েব বলে উঠলেন,
‘অনেক মানুষ ভাবতে পারে, এটা আপসেট। এটা আপসেট নয় স্যার, ভালো দলটাই ম্যাচটা জিতেছে। যেখানে ওইদিনের গড়পড়তা দলটাই হেরেছে। আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি, দক্ষিণ আফ্রিকা গড়পড়তা দলের মতোই খেলেছে।’
ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়ের পর দুই ধরনের বক্তব্য উঠে আসছে। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ২১ রানের দাপুটে জয়ে বিশ্বকাপ শুরু করেছে বাংলাদেশ। এই জয়ের পর বেশিরভাগ সাবেক ক্রিকেটার, বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞরা ভূঁয়সী প্রশংসা করেছেন বাংলাদেশের। শোয়েব আখতারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটার রবীন উথাপ্পা বলেছেন, বাংলাদেশ এখন এশিয়ার দ্বিতীয় সেরা দল। আবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি তাদের শিরোনামে উল্লেখ করেছিল, বাংলাদেশের আপসেটের শিকার হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
আদৌ কি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়টা আপসেট ছিল? বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ দলের সঙ্গে ‘আপসেট’ শব্দটা কতটা মানানসই? আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, তথা ওয়ানডেতে (১৯৯৭ সালে ওয়ানডে স্ট্যাটাস প্রাপ্তি থেকে) বাংলাদেশের বিচরণ প্রায় ২৩ বছর। গত এক দশকে বাংলাদেশ বারবার প্রমাণ করেছে, ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটের মাঝে ওয়ানডেই তাদের সবচেয়ে পছন্দের ফরম্যাট, যেখানে টাইগারদের সাফল্য ঈর্ষণীয় পর্যায়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। গত ১০ বছরে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের যত কীর্তি, তার ফিরিস্তি টানলেই অগ্রগতির লক্ষণটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
আপসেটের অধ্যায় ও উন্নতির ধারা
‘আপসেট’ যুগটা পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ, এ কথা এখন দৃঢ়কণ্ঠে বলা যায়। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানকে ৬২ রানে, ২০০৭ সালে ভারতকে ৫ উইকেটে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৬৭ রানে, ২০১১ সালে ইংল্যান্ডকে ২ উইকেটে, ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে ১৫ রানে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এ জয়গুলোকে ক্রিকেটবিশ্ব ‘আপসেট’ মর্যাদাই দিয়েছিল। তাতে বড় কোনো অনুযোগও ছিল না বাংলাদেশের।
২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়েই কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল লাল-সবুজের দল। কিন্তু ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডেতে মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে টাইগারদের উল্লম্ফন ছিল নজরকাড়া। গর্বিত হওয়ার অনেক সাফল্যগাঁথা সঙ্গী হয়েছে বাংলাদেশের। বিশ্বকাপের পরপরই দেশের মাটিতে পরপর তিনটি সিরিজে পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে ভূপাতিত করেছে বাংলাদেশ। শক্তিশালী তিন দলকে সিরিজ হারানোর মাধ্যমেই ওয়ানডেতে প্রতিষ্ঠিত শক্তি হওয়ার বার্তাটা দিয়েছে মাশরাফি বাহিনী। তারপর ২০১৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সেমিফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ।
গত বছর ক্যারিবিয়ান সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২-১ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। দেশের বাইরে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের সামর্থ্যও দেখিয়েছে। সর্বশেষ গত মে মাসে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। নিজেদের ইতিহাসে এবারই প্রথম বহুজাতিক সিরিজে শিরোপা জয়ের ইতিহাস গড়ল মাশরাফির দল। ডাবলিনে বৃষ্টিবিঘ্নিত ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উড়িয়ে দিয়ে দুর্দান্ত জয়ে ট্রফির স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। টানা ছয় ফাইনাল হারের ব্যথাও মোচন হয়েছে কিছুটা।
এর বাইরেও এই ফরম্যাটে নিজেদের উন্নতি, অগ্রগতি, সামর্থ্য বারবারই তুলে ধরেছে বাংলাদেশ। এশিয়া কাপ মূলত ‘উপমহাদেশের বিশ্বকাপ’ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই টুর্নামেন্টের শেষ চার আসরের তিনটিতেই ফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। ২০১২ সালে প্রথমবার ফাইনালে উঠে পাকিস্তানের কাছে হেরে যায় মুশফিকুর রহিমের দল। ২০১৬ সালে টি-২০ টুর্নামেন্টের টুর্নামেন্টেও ভারত হারিয়েছিল বাংলাদেশকে। ২০১৮ সালে দুবাইয়ের মরুর বুকে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানদের পেছনে ফেলে ট্রফির মঞ্চে আসে টাইগাররা। এ যাত্রাও ভাগ্য বিড়ম্বিত হয় মাশরাফিদের। সাকিব-তামিমকে ছাড়াই দুরন্ত লড়াই করা বাংলাদেশ ফাইনালে ভারতের কাছে পরাজিত। এতগুলো ফাইনাল হারলেও নিজেদের শক্তির স্বরূপটা কিন্তু ঠিকই তুলে ধরেছিল টাইগাররা।
এশিয়ার দ্বিতীয় সেরা দল বাংলাদেশ: রবীন উথাপ্পা
প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়টাকে সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটার রবীন উথাপ্পা। ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভারতবধের ম্যাচে খেলেছিলেন তিনি। গত ২ জুন ম্যাচশেষে ক্রিকেট বিষয়ক ওয়েবসাইট ক্রিকবাজের বিশ্লেষণে এসে ভারতের হয়ে ৪৬টি ওয়ানডে ও ১৩ টি-২০ খেলা উথাপ্পা বলেন,
‘এশিয়ার সব দলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমার মনে হয় ভারতের পর বাংলাদেশই এশিয়ার দ্বিতীয় সেরা দল। তারা সেই সম্মান পাওয়ার যোগ্য। তাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়কে এখন আর ওভাবে ঐতিহাসিক জয় বলা ঠিক নয়। তারা এখন বেশ শক্তিশালী দল।’
বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রার পেছনে সিনিয়রদের অবদান দেখছেন উথাপ্পা। ক্যারিয়ারের চতুর্থ বিশ্বকাপ খেলছেন অধিনায়ক মাশরাফি, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমরা। তৃতীয় বিশ্বকাপ খেলছেন মাহমুদউল্লাহ ও রুবেল হোসেন। দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ খেলছেন সৌম্য সরকার ও সাব্বির রহমান। তরুণ তুর্কি মুস্তাফিজুর রহমান ও মেহেদী হাসান মিরাজরাও হয়ে উঠেছেন দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তাছাড়া গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক ভালো ক্রিকেট খেলছে বাংলাদেশ। সবকিছু মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপে তাদের মতো অভিজ্ঞ দল কমই আছে বলে মনে করেন উথাপ্পা। তিনি বলেছেন,
‘গত ১৬-১৭ মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে ভালো ক্রিকেট খেলছে তারা। তাদের দলের বেশ কয়েক ক্রিকেটারের পূর্বেও বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এটাও তাদের সাফল্যের অন্যতম কারণ। দুর্দান্ত শুরুটা ধরে রাখা হবে তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। আমি কোনো পক্ষপাতিত্ব করে বলছি না, আসলেই বাংলাদেশ এবারের আসরে শক্তিশালী এক প্রতিপক্ষ হিসেবেই এসেছে।’
ম্যাককালামের ‘কোটা’ পূরণ করেছে বাংলাদেশ
বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে ক্রিকেট দুনিয়ার অনেক সাবেক ক্রিকেটারই তাদের মতামত দিয়েছেন, জানাচ্ছেন। দলগুলোকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীও করছেন। যেমনটা নিউ জিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালামের বিশ্বকাপের ভবিষ্যদ্বাণীতে বাংলাদেশের ঘরে বরাদ্দ ছিল মাত্র একটি জয়! আবার সেই জয়টাও নাকি শুধু বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।
বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ম্যাককালামের কোটা পূরণ করে ফেলেছে বাংলাদেশ। মজার বিষয়, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেই কোটা ধরে ফেলেছে টাইগাররা। ম্যাককালামের অনুমিত শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচ সামনে পড়েই আছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয় ম্যাককালামকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। তবে জয়ের পর টাইগারদের অভিনন্দন জানিয়েছেন সাবেক এই কিউই অধিনায়ক। এক টুইটে তিনি লিখেছেন,
‘দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাল বাংলাদেশের ক্রিকেট দল। আমার প্রত্যাশা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা জিতবে, কিন্তু বাংলাদেশ দারুণ খেলেছে। আমার ভবিষ্যদ্বাণীকে এভাবে ভুল প্রমাণ করায় ধন্যবাদ জানাই।’
তারপরও নিজের বিশ্বাসে অনড় আছেন ম্যাককালাম। এমন জয়ের পরও নাকি বাংলাদেশ খুব সুখ স্মৃতি নিয়ে বিশ্বকাপ শেষ করতে পারবে না। ম্যাককালাম লিখেছেন,
‘মনে হয় শেষ পর্যন্ত গড়পড়তা একটি অবস্থানে থাকবে। আমার সব কথা তো আর সত্যি হবে না।’
আপসেটের প্রশ্নে মাশরাফির জবাব
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচশেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফির সংবাদ সম্মেলন ততক্ষণে বেশ কিছুটা সময় পার করে ফেলেছে। তখনই এক বিদেশি সাংবাদিকের প্রশ্নে ‘আপসেট’ শব্দটি শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল মাশরাফির। সাথে সাথেই পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বলেছেন,
‘আপনি কি বোঝাতে চাইছেন, এটা আপসেট ছিল?’
নিজের প্রশ্নের আরও বৃহত্তর দিক তুলে ধরে ওই সাংবাদিক বলেছেন,
‘না, না, না, সেটা বোঝাতে চাইছি না। বলতে চাইছি, অতীতে আপনাদের এসব জয়কে আপসেট বলত অনেকে, এখন ধারণা বদলাবে?
এবার খুলল মাশরাফির দৃঢ়কন্ঠ। প্রতিনিয়ত উন্নতির ধারায় এগিয়ে যেতে চায় বাংলাদেশ। তিনি বলেছেন,
‘অবশ্যই, শতভাগ উচিত (ধারনা বদলানো)। তবে ধারনা নির্ভর করে যার যার ওপর। কে কী ভাবছে, সেটা তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। আমরা নিজেদের কাজে মন দিচ্ছি, আমরা যেন সেরাটা দিতে পারি। আমরা জানতাম, বিশ্বকাপে কাজটা কঠিন হবে। তাই নিজেদের পরিকল্পনায় মন দিয়েছি। লোকে যা বলবে, বলতে থাকুক। তাদের যদি আমাদের ভালো না লাগে, অনেক কথাই বলবে। আমাদের সেটা ভাবার প্রয়োজন নেই। নিজেদের কাজ করতে হবে। আমি নিশ্চিত, আমাদের ক্রিকেটের খুব বড় ভক্ত তেমন কেউ নেই। তাতে আমাদের কিছু করারও নেই। আমরা কেবল আমাদের খেলায় মন দিচ্ছি।’
অনেকদিন ধরেই ওয়ানডে র্যাংকিংয়ের সাতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। ক্রিকেট বিশ্বে বড় দল বলতে যাদেরকে বোঝানো হয়, ধারাবাহিকভাবেই এসব দলগুলোকে হারাচ্ছে বাংলাদেশ। ওয়ানডেতে প্রতিষ্ঠিত শক্তি হওয়ার, বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে বড় কিছু অর্জনের সব রসদই আছে বাংলাদেশ শিবিরে। বাকি বিশ্বের এই বার্তা গ্রহণে বিলম্ব হলেও কিছু করার নেই। এটুকু এখন নির্জলা সত্য, আপসেটের পথটুকু পাড়ি দিয়ে এসেছে বাংলাদেশ।