রাজনীতি এমন একটি পেশা, যেখানে দম ফেলার ফুসরত মেলা ভার। অনেক দেশেই রাজনীতিবিদদেরকে সপ্তাহের সাতদিনই কর্মব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। তবে সাড়ে ৭ লক্ষ মানুষের দেশ ভুটানের রাজনীতিবিদদের অবস্থা অতটাও খারাপ নয়। সপ্তাহান্তে তারাও ছুটি পান বটে, এবং সেই দিনগুলো নিজেদের মতো করে কাটাবার সুযোগও পান।
কিন্তু আমরা যে মানুষটার ব্যাপারে কথা বলতে চলেছি, তিনি কোনো পাতি রাজনীতিবিদ নন। তিনি লোটে শেরিং, স্বয়ং দেশটির প্রধানমন্ত্রী। তাই অন্য কারো সাথে তাকে তুলনা করাটা নিতান্তই বোকামি। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অবশ্যই তাকে সবসময়ই দেশের কল্যাণ সাধনের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে কি না, সে ব্যাপারেও খোঁজখবর নিতে হয়। সব মিলিয়ে তাকে সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে তো বটেই, এমনকি ছুটির দিনগুলোতেও চরম মানসিক উদ্বেগের মধ্যে কাটাতে হয়।
সুতরাং, তিনি যদি ছুটির দিনগুলোতে খানিকটা সময়ের জন্য আরাম-আয়েশ করে কাটাতে চান, তাতে কারোই কিছু বলার থাকবে না। অথচ অদ্ভুত বিষয় হলো, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি তা করেন না। সারা সপ্তাহ দেশের জন্য দিন-রাত একাকার করে খেটে চলেন তো বটেই, এমনকি সপ্তাহান্তেও কোনো বিশ্রাম নেন না। ফিরে যান তার পূর্বের পেশা তথা ডাক্তারিতে। সাদামাটা কোনো চিকিৎসা নয়, এমনকি তিনি রোগীদের অস্ত্রোপচার পর্যন্তও করেন সেসব দিনে!
“ছুটির দিনে কেউ গলফ খেলতে পছন্দ করে, কেউ আবার তীরন্দাজি করে। কিন্তু আমি পছন্দ করি অসুস্থ রোগীর অস্ত্রোপচার করতে। এর মাধ্যমেই আমি আমার সারা সপ্তাহের উদ্বেগ কাটাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি এ কাজই করে যাব। প্রতিদিন এখানে (হাসপাতালে) আসতে না পারাটাকে আমি খুব মিস করি। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে আমি যখন গাড়ি চালিয়ে কাজে যাই, আমার বারবার মনে হতে থাকে, যদি আমি গাড়িটা ঘুরিয়ে হাসপাতালের দিকে যেতে পারতাম!”
হ্যাঁ, ডাক্তারি পেশার প্রতি ঠিক এতটাই দুর্নিবার ভালোবাসা শেরিংয়ের। কারণ, রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আগে তিনি ছিলেন নিজ দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ডাক্তারদের একজন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর দেশ সামলানোর চাপে নিজের প্রকৃত পেশায় আর নিয়মিত থাকতে পারেননি তিনি।
২০০৮ সালে ভুটানে পরম রাজতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটে, এবং দেশটি একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, ২০১৩ সালে দেশটির দ্বিতীয় নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন শেরিং। কিন্তু সে দফায় ব্যর্থ হতে হয়েছিল তাকে। কিন্তু ২০১৮ সালের নভেম্বরে দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সাফল্যের দেখা পান তিনি। এ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হয় তার রাজনৈতিক দল ড্রাক নামরূপ শকবা, এবং তিনি পান লাভ করেন প্রধানমন্ত্রিত্ব।
এই মুহূর্তে নিজের মূল দায়িত্ব সরকার পরিচালনা হলেও, সপ্তাহান্তে হাসপাতালে ছুটে আসাকেও সমান জরুরি বলে মনে করেন শেরিং। তার ভাষ্যমতে,
“হাসপাতালে আমি রোগীদের পরীক্ষা করি ও তাদের চিকিৎসা দিই। আর সরকারের অংশ হিসেবে আমি বিভিন্ন পলিসির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করি, এবং সেগুলোকে আরো ভালো করে তোলার চেষ্টা করি।”
এগুলো শুনে আপনাদের কাছে ভুটানকে এক ইউটোপিয়ান রাষ্ট্র বলেই মনে হতে পারে, নইলে কি আর সেখানকার প্রধানমন্ত্রীও ছুটির দিনে রোগীদের সেবা দেয়ার কাজে নেমে পড়েন! এবং মজার ব্যাপার হলো, বাস্তবেও কিন্তু ভুটান এশিয়ার সবচেয়ে সুখী দেশ। অন্যান্য দেশ যেমন জিডিপির মাধ্যমে দেশের মোট উৎপাদনের খোঁজ করে, ঠিক একই কায়দায় ভুটানে খোঁজা হয় গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস বা স্থূল জাতীয় সুখ।
অবশ্য এসবের পরও দেশটি প্রতিবেশী দেশগুলোর মতোই বেশ কিছু সমস্যায় জর্জরিত। যেমন: দেশটিতে বেকারত্বের হার ক্রমশ বাড়ছে। জাতীয় পর্যায়ে অপরাধের হারও বেড়েছে ৯৫ শতাংশ। এছাড়া স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যাও ক্রমবর্ধমান। এর মধ্যে রয়েছে ডায়াবেটিস, স্থূলতা ইত্যাদি। তাই তো, একজন সাবেক ডাক্তার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও বারবার নিজের পুরনো পেশায় ফিরে আসেন শেরিং।
অনেকেই হয়তো জেনে অবাক হবেন, শেরিংয়ের সাথে বাংলাদেশেরও খুব গভীর একটি যোগাযোগ রয়েছে। কেননা, তিনি ডাক্তারি পড়েছেন বাংলাদেশেরই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। ১৯৯১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের এই চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হয়ে আসেন তিনি। অন্যান্য সহপাঠী, এবং ভুটানের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দর্জির সাথে তার নিবাস ছিল ময়মনসিংহ জেলা শহরের বাঘমারা কলেজ হোস্টেলের ২০ নম্বর রুমে।
১৯৯৯ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ ৮ বছর ময়মনসিংহেই কাটান শেরিং। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে জেনারেল সার্জারি নিয়ে শেরিং এফসিপিএস করেছিলেনও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতেই। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি কিছুদিন তিনি হাতে-কলমে কাজ করেন ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে।
২০০২ সালে নিজ দেশে ফিরে যান শেরিং। সেখানে কিছুদিন ডাক্তারির চাকরি করেন তিনি। এরপর প্রাক্তন রুমমেট টান্ডি দর্জির প্রতিষ্ঠিত দলে যোগদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে আগমন ঘটে তার।
তবে রাজনীতিবিদ পরিচয়ের বাইরেও, ডাক্তার হিসেবেই ভুটানের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে যায় শেরিংয়ের নাম। সার্জন হিসেবে দারুণ নামডাক হয় তার। একটা সময় তিনি এতটাই খ্যাতি অর্জন করেন যে, দৈনিক গড়ে ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা তাকে অস্ত্রোপচারে ব্যস্ত থাকতে হয়। কখনো কখনো সপ্তাহান্তে ছুটির দিনগুলোতেও হাসপাতালে রোগীর সেবায় ব্যস্ত থাকেন তিনি। আর কোনো কারণে যদি মঙ্গারে নিজের বাড়ি ফিরে যান, আর সেই সময়ে কোনো রোগী তার কাছে হাজির হয়, তাহলে সেই রোগীকে নিজের বাড়িতেই থাকার বন্দোবস্ত করে দেন তিনি।
ডাক্তার হিসেবে এমন কর্মব্যস্ততার পরও, নিয়মিত ভুটান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস (বিবিএস) টিভি চ্যানেলে চিকিৎসা বিষয়ক অনুষ্ঠানে হাজির হতে শুরু করেন তিনি। সেখানে তিনি মানুষদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিতে থাকেন, এবং অন-এয়ার কলের মাধ্যমেও অনেককে পরামর্শ দেন। এতে করে তার জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়।
২০১৫ সালে নেপালে যখন ৭.৮ মাত্রার এক ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে, তখন ৩৭ সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল টিমের অংশ হিসেবে সেখানে চিকিৎসা দিতে যান শেরিংও। তিনি ছিলেন দলটির টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর এবং চিফ সার্জন।
মাদার তেরেসার বিশাল বড় ভক্ত শেরিং এ বছরের এপ্রিলেই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আসেন এক বিশেষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। সেখানে তিনি নিজের সহপাঠী, ছাত্র ও শিক্ষকদের উদ্দেশে বাংলায় এক অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তব্য রাখেন। এ সময় তিনি নিজের শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন স্মৃতিচারণা করেন।
“শিক্ষক পরের দিন যে বিষয়টি পড়াবেন, সেটি আমি আগের রাতেই একবার চোখ বুলিয়ে নিতাম। পরদিন ক্লাসে গেলে স্যার ডেমো দিতেন। এবং এরপর বন্ধুদের নিয়ে আবারো সেটি নিয়ে আলোচনা করতাম। ফলে বিষয়টি দু-তিনবার পড়া হয়ে যেত। এ থেকে শিক্ষাটা হলো: আমরা যদি শিখতে চাই, সেটা পড়িয়ে নয়, আলোচনা করতে হবে। শেখার সেরা উপায় হলো আলোচনা করা।”
এছাড়া তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে উপস্থিত নবীন শিক্ষার্থীদেরকে আরো একটি বিশেষ উপদেশ দেন, যা তাদের ভবিষ্যৎ ডাক্তারি জীবনের পথ চলায় খুবই উপকারী হতে পারে। তিনি বলেন,
“যদি রোগী দেখতে চাই, তবে ভালো করেই দেখতে হবে। হুট করে প্রেসক্রিপশন দিলে ডায়াগনোসিস মিস হতে পারে এবং আমরা আমাদের কাজ হালকাভাবে নিলে আরেকজনের জীবনের ক্ষতি হতে পারে। রোগীর সাথেই আমাদেরকে সকাল-সন্ধ্যা, রাত-দিন ওঠাবসা করতে হয়। তবু আমরা মানিয়ে নিই, কারণ এটাই আমাদের কাজ।”
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/