খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রায় পুরোটা সময় সহ দীর্ঘ দেড়শো বছর ধরে রোম ছিল এট্রুসকানদের অধীনে। রোমের উত্থানের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এর রয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ। প্রথমে ছিলেন বিখ্যাত সাত রাজা, এরপর আসে প্রজাতন্ত্র এবং সবশেষে সাম্রাজ্য। বিখ্যাত এই সাত রাজা হলেন-
১. প্রথম রাজা, রোমুলাস, যিনি সিনেটের প্রবর্তন করেন।
২. নুমা পম্পিলিয়াস, যিনি যাজক-তন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা।
৩. টুলাস হস্টিলিয়াস, যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি বাড়িয়ে তোলেন রোমের প্রভাব।
৪. অ্যানকাস মারসিয়াস, যুদ্ধ ঘোষণার পদ্ধতির প্রবর্তক।
৫. টারকুইনিয়াস প্রিসকাস, রোমের প্রথম এট্রুসকান রাজা।
৬. সারভিয়াস টুলিয়াস, তার নির্দেশে রোমে সর্বপ্রথম আদমশুমারি হয়।
৭. টারকুইনিয়াস সুপারবাস, সর্বশেষ রোমান রাজা।
এখানে একটা কথা উল্লেখ্য- যদিও এই সাতজনকে ‘রাজা’ বলা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রথম পাঁচজন ছিলেন জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত নেতা। এরা সর্বেসর্বা ছিলেন না, সিনেটের কাছে তাদের জবাবদিহিতা করতে হতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সাত রাজার সময়ের অধিকাংশ ইতিহাস হারিয়ে যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯০ সালে গলদের আক্রমণের কারণে।
রোমুলাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫৩ – খ্রিষ্টপূর্ব ৭১৬)
রোমুলাস সর্বপ্রথম রোমান রাজা এবং রোম নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত। এমনকি ‘রোম’ নামটাও এসেছে তারই নাম থেকে। তিনি এবং তার যমজ ভাই, রেমাস, রোম নগরীর পত্তন করেন। কিন্তু কে হবে এই নগরের শাসক? এই দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন তারা। কীভাবে মারা গেলেন রেমাস, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও- রোমুলাসের হাতে উঠে আসে শাসন ক্ষমতা।
রোম নির্মাণের পর, নিজের মাতৃভূমি, অ্যালবা লংগায় ফিরে আসেন রোমুলাস। উদ্দেশ্য ছিল নতুন নগরীর জন্য অধিবাসী সংগ্রহ করা। সক্ষমও হলেন তিনি, কিন্তু একটা সমস্যা দেখা গেল- তার নতুন শহরের অধিবাসীদের অধিকাংশই পুরুষ! এই পুরুষদের জন্য স্ত্রীর ব্যবস্থা করতে রোমুলাস তার প্রতিবেশী, স্যাবিনদের আক্রমণ করলেন। এই ঘটনা আজও ইতিহাসে ‘দ্য রেপ অব দ্য স্যাবিন ওমেন’ নামে লিখিত আছে। যুদ্ধের একপর্যায়ে এসে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো স্যাবিন এবং রোমের মাঝে। যার ফলে স্যাবিন রাজা, টাটিয়াস, রোমুলাসের সঙ্গে দ্বৈত-রাজা হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে লাগলেন।
প্রখ্যাত রোমান ইতিহাসবিদ, টাইটাস লিভিয়াসের মতে, ৩৭ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন রোমুলাস। তারপর আচমকা জন্ম নেওয়া প্রবল এক ঝড়ের ঘূর্ণির মাঝে হারিয়ে যান তিনি। অবশ্য তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে তিনি অন্য সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরেছেন। তার মতে, রোমুলাসকে সিনেটররা খুন করে থাকতে পারে। কোনো কোনো বিশ্বাস মতে দেবতা মার্স নিজে এসে তার পুত্রকে (রোমুলাস এবং রেমাসকে যুদ্ধদেবতা মার্সের সন্তান হিসেবে বিবেচনা করতো তারা) স্বর্গে নিয়ে যান। সে সময়কার রোমানরা শেষোক্ত এই তত্ত্ব বিশ্বাস করত। স্বর্গীয় দেবতাদের ধারণা প্রবল ছিল তাদের মাঝে।
রোমুলাসের মৃত্যুর পর, রোমান রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন নুমা পম্পিলিয়াস, যিনি ছিলেন জাতিতে স্যাবিন।
নুমা পম্পিলিয়াস (খ্রিষ্টপূর্ব ৭১৫ – খ্রিষ্টপূর্ব ৬৭৩)
৭১৫ খ্রিষ্টপূর্বে রাজা হিসেবে নির্বাচিত হন নুমা পম্পিলিয়াস, তার রাজত্বকাল স্থায়ী হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬৭৩ সন পর্যন্ত। যুদ্ধপ্রিয় রোমুলাসের চাইতে অনেকটাই আলাদা ছিলেন তিনি। তার অধীনে, ৪২ কি ৪৩ বছর শান্তিতেই দিন কাটায় রোমান নাগরিকরা। সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় অঙ্গনে প্রশংসনীয় উন্নতি সাধন করেন তিনি।
রোমের প্রথম রাজা, রোমুলাস, দৃশ্যপট থেকে সরে যাবার পর, স্যাবিন এবং রোমানদের মাঝে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। কে পরবর্তী রাজা হবে- এই প্রশ্নে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে যায় তারা। অবশেষে সিনেট সিদ্ধান্ত নেয়, রোমান এবং স্যাবিন, উভয় জাতিই একজন-একজন করে রাজা নির্বাচন করবে। তবে রোমানরা করবে স্যাবিনদের ভেতর থেকে, আর স্যাবিনরা রোমানদের ভেতর থেকে। প্রথমে বেছে নেবার পালা আসে রোমানদের, এবং তারা বেছে নেয় নুমা পম্পিলিয়াসকে। এদিকে স্যাবিনরা আর বাছাবাছির ঝামেলায় না গিয়ে, নুমাকেই তাদের রাজা হিসেবে মেনে নেয়। অতঃপর স্যাবিন এবং রোমানদের নিয়ে গঠিত একটা দল রওনা দেয় নুমাকে এই সুখবর জানাবার জন্য।
রাজবংশের সঙ্গে আগে থেকেই তার সম্পর্ক ছিল। রাজা রোমুলাসের সঙ্গে রাজকার্য পালন করা টাটিয়াস ছিলেন তার শ্বশুর। কিন্তু স্ত্রীকে হারাবার পর, নুমা সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তিনি এমনকি রোমেও বাস করতেন না, বাস করতেন কাছের একটা শহর কিউরেস-এ।
রোম থেকে সুখবর নিয়ে আসা দলটা নির্বাচনের কথা জানালে তিনি সরাসরি মানা করে দেন। কিন্তু পরবর্তীতে তারা বাবা এবং স্থানীয় এক ব্যক্তি মারসিয়াসের কথা শুনে মত পাল্টান। কেননা তিনি বুঝতে পারেন, যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে রোমুলাসের অধীনে যেমন যুদ্ধ-প্রেমী ছিল, তেমনই রয়ে যাবে রোমানরা। এখন তাদের দরকার শান্তি-প্রেমী একজন রাজা। তারপরও ওদের স্বভাবে যদি পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে অন্তত স্যাবিন এবং কিউরেস তো নিরাপদে থাকতে পারবে।
রাজা হিসেবে দায়িত্ব নেবার পর, প্রথমেই নুমা তার দেহরক্ষীদেরকে বাদ দিয়ে দেন। এরপর রোমুলাসের অর্জিত ভূমিগুলো বণ্টন করে দেন গরীব অধিবাসীদের মাঝে, এই আশায় যে এতে হয়তো রোমানরা কৃষিকাজ করে থিতু হবে। নিজে এসব খামার পরিদর্শন করেন তিনি, পুরষ্কার এবং তিরস্কারের ব্যবস্থাও রাখেন।
কিন্তু এতকিছুর পরও, জাতিগত একটা দ্বন্দ্ব ছিলই। মানুষ নিজেদের পরিচয় দিত রোমান বা স্যাবিন বলে, কখনো রোমের নাগরিক বলে নয়। তাই নাগরিকদের নুমা তাদের পেশার ভিত্তিতে নানা দলে ভাগ করে দেন।
রোমুলাসের সময়, বছরে ৩৬০ দিন ধরা হতো; তবে কোন মাসে কতদিন, তাতে ছিলে মারাত্মক অসামঞ্জস্য। নুমা ৩৬৫ দিনে সৌর-বছর এবং ৩৫৪ দিনে চন্দ্র-বছর হয় বলে স্থির করলেন। এই এগারো দিনের পার্থক্যকে দ্বিগুণ করে জন্ম দিলেন বাইশ দিনের একটা মাস। তখন বছরের প্রথম মাস ছিল ফেব্রুয়ারি, দ্বিতীয় মাস মার্চ। নুমা নতুন এই মাসটিকে ফেব্রুয়ারি এবং মার্চের মাঝখানে স্থাপন করলেন। তারপর প্রথম মাসের নাম পাল্টে রাখলেন জানুয়ারি, এবং দিনপঞ্জিতে মাসটিকে যোগ করে দিলেন।
৮০ বছর বয়সে মারা যান নুমা। তার একমাত্র কন্যা, পম্পিলিয়ার গর্ভে জন্ম নেয় অ্যানকাস মারসিয়াস। তিনি পরবর্তী রোমের চতুর্থ রাজা হন।
টুলাস হস্টিলিয়াস (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৭৩ – খ্রিষ্টপূর্ব ৬৪১)
নুমা পম্পিলিয়াস মারা গেলে, রাজা হন টুলাস হস্টিলিয়াস। রোমুলাসের শাসনামলে যুদ্ধ সংগঠিত হয় রোমান এবং স্যাবিনদের মাঝে। সেই যুদ্ধে এক স্যাবিন যোদ্ধা আচমকা দল ছেড়ে ছুটতে শুরু করেন রোমানদের অভিমুখে। তার জবাব দেবার জন্য এক রোমান যুবকও দলছুট হয়ে দৌড় শুরু করেন। এই রোমান যুবকের নাম ছিল হস্টাস হস্টিলিয়াস, তিনি ছিলেন টুলাস হস্টিলিয়াসের দাদা। যদিও স্যাবিন যোদ্ধাকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হন হস্টাস, তবুও তাকে বরণ করে নেওয়া হয় বীরত্বের প্রতীক রূপে।
নুমা পম্পিলিয়াসকে যদি শান্তি-প্রেমী বলা হয়, তাহলে টুলাসকে বলতে হবে যুদ্ধ-প্রেমী। তবে তার ব্যাপারে খুব কমই জানা যায়। তিনি রোমের অধিবাসীর সংখ্যা দ্বিগুণ করে তোলেন এবং অ্যালবা লংগাকে রোমের অধীনস্থে আনেন। এছাড়াও তিনি নির্মাণ করেন কিউরিয়া হস্টিলিয়া, যা রোমানদের সিনেট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
টুলাসকে রোমুলাসের চাইতেও বেশি যুদ্ধপ্রবণ বলে ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছেন। তিনি অ্যালবা লংগা, ফিদেনি এবং ভিয়েনটাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। অবশ্য অ্যালবানদের সঙ্গে টুলাস প্রথমে বন্ধু-সুলভ আচরণ প্রদর্শন করেন, কিন্তু পরবর্তীতে তাদের নেতা বিদ্রোহ করে বসলে শক্ত-হাতে তা দমন করেন। এরপর অ্যালবানদের বাধ্য করে রোমে এসে বাস করতে।
যুদ্ধের প্রতি আগ্রহী হলেও, ধর্মের দিকে খুব একটা মনোযোগ ছিল না টুলাসের। একদা রোম প্লেগে আক্রান্ত হলে, ব্যাপারটাকে রোমানরা ধরে নেয় স্বর্গীয় শাস্তি হিসেবে। তারপরও টুলাস সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করেননি। যখন তিনি নিজে আক্রান্ত হন এতে তখন টনক নড়ে তার। অসুস্থ রাজা তখনকার দিনের প্রচলিত চিকিৎসা, অর্থাৎ ধর্মীয় আচারসমূহ পালন করতে শুরু করেন। তবে লোককাহিনী অনুসারে, আগেকার অশ্রদ্ধায় বীতশ্রদ্ধ জুপিটার তার উপর ছুঁড়ে দেন বজ্র। বত্রিশ বছর রাজত্ব করার পর মারা যায় টুলাস।
অ্যানকাস মারসিয়াস (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৪২ – খ্রিষ্টপূর্ব ৬১৬)
তিনি রোমের চতুর্থ রাজা। তার নানা, নুমা পম্পিলিয়াস ছিলেন রোমের দ্বিতীয় রাজা। লোককাহিনী অনুসারে, তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি টাইবার নদীর উপর সেতু স্থাপন করেন। কাঠের এই সেতুর নাম ছিল পনস সাবলিসিয়াস। টাইবারের মুখে প্রতিষ্ঠিত অস্টিয়া নামক বন্দরনগরীর গোড়াপত্তনের কৃতিত্বও দেওয়া হয় তাকে।
নুমা পম্পিলিয়াস ছিলেন শান্তি-প্রেমী রাজা। তাই তার নাতিও তেমনটাই হবেন- অন্তত সেটাই ছিল বাসিন্দাদের ধারণা। এই ধারণা থেকে রোমের জমিতে আক্রমণ করে ল্যাটিনরা। পরবর্তীতে যখন রোমানরা ক্ষতিপূরণ দাবি করে, তখন অপমান করে দূতকে ফেরত পাঠায় তারা। ফলশ্রুতিতে অ্যানকাস যুদ্ধ ঘোষণা করেন তাদের বিরুদ্ধে। ৬০ বছর বয়সে, রাজত্বের ২৪-তম বছরে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান তিনি।
টারকুইনিয়াস প্রিসকাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৬১৬ – খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭৯)
রোমের পঞ্চম রাজা, টারকুইনিয়াস প্রিসকাস ছিলেন জাতিতে এট্রুসকান। রোমের ইতিহাসের প্রথম এট্রুসকান রাজা তিনি। তবে এর কৃতিত্ব যতটা তার, ততটাই তার স্ত্রী, টানাকুইল-এর।
টানাকুইল ছিলেন সম্ভ্রান্ত এক এট্রুসকান পরিবারের সন্তান। তবে তার ধনী স্বামী, লুকুমোকে নিয়ে ছিলেন অসন্তুষ্ট। লুকুমো মায়ের দিক দিয়ে এট্রুসকান হলেও, তার পিতা ছিলেন ডেমারাটাস নামের এক গ্রিক করিন্থিয়ান। তাই সামাজিকভাবে অনেকটা অচ্ছুৎই ছিলেন তারা। হতাশ টানাকুইলের প্ররোচনায় তারা রওনা দেন নতুন নগরী, রোমের উদ্দেশ্যে। যেখানে মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হয় কর্মে এবং সফলতায়। বংশে নয়। অন্তত তখন পর্যন্ত।
টানাকুইল ছিলেন ভবিষ্যতদ্রষ্টা। লুকুমো রোমের ভেতরে প্রবেশ করা মাত্র একটা ঈগল এসে তার মাথার টুপি উড়িয়ে নিয়ে যায়। ব্যাপারটাকে টানাকুইল দেখেন শুভলক্ষণ হিসেবে। বুঝতে পারেন যে দেবতারা তার স্বামীকে রাজা হিসেবে পছন্দ করেছেন।
রোমে থিতু হবার পর, লুকুমো নতুন নাম ধারণ করেন- লুসিয়াস টারকুইনিয়াস প্রিসকাস। তার আচরণ এবং সম্পদ নজর কাড়ে নগরীর সম্ভ্রান্ত পরিবারদের। এদের মাঝে ছিলেন রাজা অ্যানকাসও। এমনকী নিজ সন্তানদের অভিভাবক হিসেবে তিনি মনোনীত করেন টারকুইনিয়াসকে।
২৪ বছর রাজত্ব করেন অ্যানকাস, মৃত্যুর সময় তার সন্তানরা সবাই প্রায় বড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অ্যানকার মারা যাবার পর, টারকুইনিয়াস তাদের পাঠিয়ে দেন শিকারে এবং সেই সুযোগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন রাজা হিসেবে!
রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য টারকুইনিয়াস নতুন করে তৈরি করেন একশো সিনেটরকে। তারপর ল্যাটিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামেন। ল্যাটিন শহর অ্যাপিওল দখল করে সেই আনন্দে পত্তন করেন রোমান গেমস-এর।
এরপর, আচমকা একদিন স্যাবিনরা আক্রমণ করে বসে রোমকে। প্রথম যুদ্ধে কোন নিষ্পত্তি না হলেও, পরবর্তী যুদ্ধে রথের সংখ্যা বাড়িয়ে স্যাবিনদের পরাজিত করেন টারকুইনিয়াস। যুদ্ধের আগেই তিনি রোম ঘিরে পাথুরে দেয়াল খাড়া করছিলেন।
স্বামীর হয়ে আরেকবার ভবিষ্যদ্বাণী করেন টানাকুইল। তাদের এক দাস ছিল, নাম তার সারভিয়াস টুলিয়াস। একবার ঘুমোবার সময় আগুন ধরে যায় ছেলেটার মাথার চারপাশে। কিন্তু আগুন না নিভিয়ে টানাকুইল নির্দেশ দেন চুপচাপ দেখার। যখন ঘুম ভেঙে যায় ছেলেটির, তখন কীভাবে কীভাবে যেন নিভেও যায় আগুন। টানাকুইল তখন স্বামীকে জানান যে এই ছেলে, সারভিয়াস টুলিয়াস একসময় তাদের বংশের হাল ধরবে। এরপর নিজেদের সন্তানের মত করেই বড় করে তোলেন সারভিয়াসকে, সময় এলে নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়েও দেন।
অ্যানকাসের ছেলেরা ক্ষেপে যায় এতে। তারা বুঝতে পারে যে টারকুইনিয়াস যদি সারভিয়াসকে প্রতিষ্ঠা করার আগেই মারা যান, তাহলে সিংহাসন পুনরুদ্ধারের একটা সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে। তাই তারা এক গোলযোগের সুযোগে হত্যা করে টারকুইনিয়াসকে।
কিন্তু টানাকুইলও হাল ছাড়ার পাত্র নন। জনসম্মুখে এসে তিনি জানালেন, টারকুইনিয়াস মারা যাননি। তবে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। তাই আপাতত শাসনকার্য চালাবেন সারভিয়াস, অবশ্যই টারকুইনিয়াসের পরামর্শ অনুসারে।
কাজে এল পরিকল্পনা। তবে সত্য একদিন না একদিন তো প্রকাশ পাবেই। কিন্তু ততদিনে সিংহাসনে শক্তপোক্ত ভাবে বসে পড়েছেন সারভিয়াস।
সারভিয়াস টুলিয়াস (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭৯ – খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৫)
রোমে প্রথম আদমশুমারি হয় সারভিয়াস টুলিয়াসের অধীনে। উদ্দেশ্য ছিল সিনেটে কোনো একটি বিশেষ এলাকা থেকে কতজন প্রতিনিধি থাকবে তা নির্ধারিত করা। রোমের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন তিনি। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ টিম কর্নেল সারভিয়াসকে কখনো কখনো ‘রোমের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা’ বলেও অভিহিত করেন।
সেনাবাহিনীর নানা ধরনের সংস্কার করেন সারভিয়াস। সৈন্যদেরকে তিনি ভাগ করেন ‘সেঞ্চুরি’তে। রোমান লিজিয়োন-এ যে সেঞ্চুরির উপস্থিতি দেখা যায়, তা এখান থেকেই এসেছে। এই সেঞ্চুরিকে তিনি আবার ভাগ করেন দুই ভাগে, যাতে করে অর্ধেক সৈন্য যুদ্ধে গেলেও বাকি অর্ধেক পেছনে থেকে নগরীকে সুরক্ষা দান করতে পারে।
রোমের নাগরিকদেরকে মোট ৩৫টি দলে ভাগ করেন তিনি, অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে। নতুন নাগরিকদের এই দলগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়াও রোম নগরীর আকার বৃদ্ধি করেন তিনি, নির্মাণ করেন সারভিয়ান দেয়াল। এই দেয়ালের মাধ্যমে রোমের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয় প্যালাটাইন, কুইরিনাল, কোয়েলিয়ান এবং অ্যাভেনটাইন পাহাড়ের। অ্যাভেনটাইনে ডায়ানার মন্দির নির্মাণের কৃতিত্বও তাকে দেওয়া হয়।
ইতিহাসবিদ লিভির মতানুসারে, সারভিয়াস টুলিয়াসের ছিল দুই মেয়ে- টুলিয়া দ্য এলডার এবং টুলিয়া দ্য ইয়ঙ্গার। তাদেরকে তিনি বিয়ে দেন তার পূর্বের রাজা, টারকুইনিয়াসের দুই সন্তান, লুসিয়াস টারকুইনিয়াস এবং অ্যারানস টারকুইনিয়াস-এর সঙ্গে। ছোট টুলিয়া এবং লুসিয়াস টারকুইনিয়াস প্রিসকাস মিলে ষড়যন্ত্র করেন সারভিয়াসকে সরিয়ে দেবার।
স্ত্রীর প্ররোচনায় একদল অস্ত্রধারীকে নিয়ে সিনেটে যান টারকুইনিয়াস, সেখানে তিনি সারভিয়াসকে দাসের পুত্র দাস বলে অভিহিত করে তার সমালোচনা করেন। উল্লেখ করেন যে রোমের রাজা নির্বাচনের পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত হননি সারভিয়াস। এছাড়াও তাকে নারীর আঁচলে আশ্রয় লাভের মাধ্যমে সিংহাসন লাভ, ধনীদেরকে বাদ দিয়ে গরিবদেরকে অধিক সুবিধা প্রদান, আদমশুমারি ইত্যাদি তুলে ধরেও সমালোচনা করেন।
এসব জানতে পারেন সারভিয়াস টুলিয়াস, তাই দ্রুত ছুটে যান নিজের পক্ষে কথা বলার জন্য। কিন্তু সেই সুযোগ আর তিনি পাননি। তার আগেই সিনেটের সামনের রাস্তায় তাকে হত্যা করে টারকুইনিয়াসের সৈন্যরা। এর পর পরই রথ চালিয়ে পিতার মৃতদেহকে বিকৃত করেন টুলিয়া। লিভির মতে, টারকুনিয়াস তার শ্বশুরের লাশের সৎকার হতে না দেয়ার কারণেই পরবর্তী সুপারবাস বা অহংকারী উপাধি পান।
টারকুইনিয়াস সুপারবাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৪ – খ্রিষ্টপূর্ব ৫০৯)
রোমের সপ্তম এবং সর্বশেষ রাজা, লুসিয়াস টারকুইনিয়াস সুপারবাস, তথা অহংকারী টারকুইন ক্ষমতা লাভ করেন বিশ্বাসঘাতকতা এবং হত্যার মাধ্যমে। রাজত্বের প্রথম দিকে তিনি মন দেন রাজত্ব বিস্তারে; একে-একে এট্রুসকান, ভলচি এবং ল্যাটিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তার বিজয় সেই এলাকায় রোমকে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। টারকুইনিয়াস বাধ্য করেন রোমান নাগরিকদের কায়িক শ্রমে, এবং নির্মাণ করেন ম্যাক্সিমা ড্রেনেজ সিস্টেম যা আজও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের পথিকৃৎ বলে ধরা হয়।
তবে খুব বেশিদিন রাজত্ব করতে পারেননি তিনি। অচিরেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়; যার প্রধান ছিল তারই ভাতিজা, লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাস এবং টারকুইনিয়াস কোলাটিনাস। শেষ পর্যন্ত সুপারবাস এবং তার পরিবার (এমনকী কোলাটিনাসসহ) নির্বাসন লাভ করেন রোম থেকে। এরপরও বেশ কয়েকবার তিনি চেষ্টা করেন রাজত্ব পুনরুদ্ধারের, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হন। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯৫ সনে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
রোমে এট্রুসকান রাজতন্ত্রের পরিসমাপ্তি ঘটে এর মাধ্যমে। রাজতন্ত্রের পরিবর্তে রোমে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্র।