জীবনে এমন দিন সবারই আসে। ঘুম থেকে উঠেই মনে হয়, আজ দিনটা বোধহয় আমার নয়। সারাদিন পদে পদে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের শিকার হয়ে দিনশেষে আপনাকে মুখ ফুটে বলতেই হয়, ‘নাহ, এই দিন আমার নয়!’
খেলোয়াড়দের জীবনে এমন দিন তো বারবার আসে, বিশেষ করে বোলারদের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আজকালকার বোলারদের। সময়টাই যখন টি-টোয়েন্টির দাপটের, ব্যাটসম্যানদের মন এবং মননে ঐ একটি চিন্তাই বসবাস করে, ‘১৫৬ গ্রামের চর্মগোলকটা পিটিয়ে সীমানাছাড়া করতে হবে।’ আজকের ক্রিকেটে তাই বোলারদের মার খেতে দেখলে প্রশ্নটা তাই তেমন জোরেশোরে ওঠে না। বরং, অধিনায়কের শেষ ভরসা, জীবনের চরম সত্য সেই অমর উক্তিতেই মানুষ আস্থা খোঁজে, “Just a bad day in the office”।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই বাজে দিনগুলো এতটাই মাত্রা ছাড়িয়ে যায় যে, বাজে দিন বলেও আর পার পাওয়া হয়ে ওঠে না। ব্যাটসম্যানরা বোলারকে পিটিয়ে এমনই ছাতু বানান, আর বোলার এমনই দাতা হাতেম তাঈ হয়ে ওঠেন যে, ‘সবচেয়ে খরুচে বোলিংয়ের তালিকায়’ যোগ হয় আরেকটি নতুন পাতা।
কান পাতলেই যখন শোনা যাচ্ছে বিশ্বকাপের দামামা, আমরা আজ তাই উল্টাচ্ছি ‘বিশ্বকাপের ম্যাচে সবচেয়ে বাজে পাঁচ বোলিং ফিগারের’ পাতাটি।
৫. ডোয়াইন লেভেরক (১০-০-৯৬-১)
ভদ্রলোকের নাম শুনেই আপনার মনে চলে এলেন রবিন উথাপ্পা, এক ঝটকায় মন চলে গেলো ২০০৭ বিশ্বকাপে। ভুল বললাম কী!
বিশ্বকাপে বারমুডার খেলার কথা উঠলে এই ১২৭ কেজির ভদ্রলোকের নাম আসবেই। এই দশাসই শরীর নিয়ে কীভাবে নিজের ডানে ঝাঁপিয়ে পড়ে উনি রবিন উথাপ্পার ঐ ক্যাচ নিয়েছিলেন, তা আজও কৌতূহল জাগায়! ক্যাচের চেয়ে উদযাপনের আতিশায্য দিয়েই অবশ্য এসেছিলেন আলোচনায়।
তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে, লজ্জার রেকর্ডটা আড়ালে পড়ে গিয়েছে। ক্যাচ নিয়ে ইনিংসের শুরুতেই রবিন উথাপ্পাকে ফেরালেও এর শোধ তুলেছিলেন বাকিরা, লেভেরকের বলেই মূলত। সেদিন দশ ওভার বল করে উইকেট পেয়েছিলেন যুবরাজ সিংয়ের, সেটাও শেষ ওভারের চতুর্থ বলে। তার আগ অব্দি রান দিয়েছিলেন ৯১। ঝড়টা যুবরাজ সিংই বেশি তুলেছিলেন, মুখোমুখি হওয়া ১৭ বলে নিয়েছিলেন ৪২ রান।
শেষ পর্যন্ত লেভেরক থেমেছিলেন ৮ ছয় আর ২ চারের মার খেয়ে, ৯৬ রানে। মার খেয়েছিলেন বারমুডার বাকি বোলাররাও। মালাচি জোনস ৭ ওভারেই দিয়েছিলেন ৭৪ রান। বারমুডার বোলারদের বেধড়ক পিটিয়ে ভারত থেমেছিলো ৪১৩ রানে। এই ম্যাচের ফল অজানা ছিলো না কোনোকালেই। প্রথম ইনিংসের পর তো আরও না!
২৫৭ রানে বারমুডার বিশাল হার কিংবা বীরেন্দর শেবাগের আরও একটি ঝড়ো সেঞ্চুরি ছাপিয়ে এই ম্যাচের শিরোনাম তো একটিই, ‘লেভেরকের ম্যাচ!’
৪. অশন্থা ডি মেল (১০-০-৯৭-১)
ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন ডেসমন্ড হেইন্স। ১০৫ রানের ইনিংস খেলতে বল খেলেছিলেন ১২৪টি। ভিভ রিচার্ডস তার চেয়ে বেশি খেলেছিলেন মাত্র এক বলই, তবে তার ইনিংস থেমেছিলো ১৮১ রানে। আর তার উইকেটটি দখল করেছিলেন ডি মেল।
তার আগপর্যন্ত যা হয়েছে, তাতে ডি মেল এই ম্যাচের স্মৃতি ভুলে যেতে পারলেই বাঁচেন। সেই সাদা পোশাকি ওয়ানডে ক্রিকেটেও যে ইকোনমি রেট দশ ছুঁইছুঁই হতে পারে, সেটা ক্রিকেট দেখেছিলো ঐ ১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবরের সেই ম্যাচেই। ভিভ রিচার্ডসের ক্যারিয়ার হাইলাইটসের শিকার হয়ে ডি মেল দশ ওভারে রান দিয়েছিলেন ৯৭।
ডি মেলের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের গতি যেন নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো এতেই। এই ম্যাচের পরে খেলেছিলেন আর মাত্র দুটি ওয়ানডেতেই।
দুই সেঞ্চুরির সাহায্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সে ম্যাচে করেছিলো তৎকালীন বিশ্বকাপ সর্বোচ্চ ৩৬০ রানে। ভয়ংকর ওই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলিংয়ের বিপক্ষে শ্রীলংকা এই রান করে কী করে!
খবরদার, অশন্থা ডি মেলকে এই তথ্য মনে করিয়ে দেবেন না যেন!
৩. দৌলত জাদরান (১০-১-১০১-২)
আফগান-রূপকথার গল্পে ২০১৫ সালে যোগ হয়েছিলো নতুন অধ্যায়, প্রথম বিশ্বকাপ। ডিভিশন-ফাইভ ক্রিকেট খেলার দশ বছরের মাঝে বিশ্বকাপ খেলা, রূপকথাই তো!
সেই রূপকথার গল্পে বাস্তবতার পাঠ শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া। বিশ্ব দেখেছিলো আরও একটি চার’শ ছাড়ানো স্কোর।
বাস্তবতার সবচেয়ে ভালো পাঠ পেয়েছিলেন দৌলত জাদরান। ওভারপ্রতি ১০.১০ রান খরচায় ম্যাচে রান দিয়েছিলেন ১০১।
অথচ শুরুটা করেছিলেন স্বপ্নের মতো। প্রথম ওভারে চার রান দিলেও দ্বিতীয় ওভার করেছিলেন মেইডেন। সাথে তুলে নিয়েছিলেন অ্যারন ফিঞ্চের উইকেট। প্রথম চার ওভার পর্যন্ত তো ঠিকঠাকই যাচ্ছিলো। তাল কাটলো পঞ্চম ওভারে, ওয়ার্নারের হাতে ২ চার খেয়ে ১৩ রান দেয়ার মাধ্যমে। তবে আসল ঝড়টা টের পেয়েছিলেন ইনিংসের ৩০তম আর ব্যক্তিগত ষষ্ঠ ওভারে, চার-ছয়ের বন্যা বইয়ে ওয়ার্নার আর স্মিথ মিলে তুলে নিয়েছিলেন ২৩ রান। শেষ চার ওভারে আরও ৫১ রান দিয়ে পৌঁছেছিলেন শত রানের কোটায়। আফসোস, এ সেঞ্চুরিতে কোনো গৌরব নেই।
দৌলত জাদরানের কীর্তিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছেন, নয়তো বাকিরাও কম যাননি সেদিন। শাপুর জাদরানের ইকোনমি রেট ছিলো ৮.৯০, মোহাম্মদ নবী থেমেছিলেন ৮৪ রান দিয়ে। অস্ট্রেলিয়া থেমেছিলো ৪১৭ রানে।
এই ম্যাচের ফলাফল তো আপনি ম্যাচ শুরুর আগে থেকেই জানতেন!
২. জেসন হোল্ডার (১০-২-১০৪-১)
‘Morning shows the day’- প্রবাদে জেসন হোল্ডার খুব সম্ভবত বিশ্বাস করেন না। আর যদি করতেনও, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারির পরে তা একদমই করেন না।
নিজের প্রথম পাঁচ ওভারে দিয়েছিলেন মোটে ৯ রান। তুলে নিয়েছিলেন ওপেনিং ব্যাটসম্যান কুইন্টন ডি ককের উইকেট। সেখান থেকে ইনিংস শেষে বোলিং ফিগার যদি ১০-২-১০৪-১ হয়, তা দেখলে জীবনের উপর থেকেই ভরসা উঠে যায়, প্রবাদ তো বহু দূরের কথা।
অথচ, ইনিংসের ৩০তম ওভার পর্যন্ত তো সব স্বাভাবিকভাবেই চলছিলো। ৩০তম ওভারের চতুর্থ বলে হাশিম আমলা আউট হয়ে যখন প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন, তখন রান কেবল ১৪৬। সেখান থেকে পঞ্চাশ ওভার শেষে স্কোর পৌঁছেছিলো ৪০৮ রানে। কারণ? সুপারম্যান নেমেছিলেন।
২১৮ বলে ২০০ রান থেকে দলকে ২৩৯ বলে ২৫০ রানে পৌঁছে দেয়া, ব্যাটিং পাওয়ার প্লের পাঁচ ওভারে ৭২ রান তোলা, এ সবই ছিলো ট্রেলার। সিনেমা তো দেখেছিলেন জেসন হোল্ডার।
প্রথম পাঁচ ওভারে নয় রান খরচা করার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। প্রথম আট ওভার শেষেও তো ফিগারটা মোটামুটি ভদ্রস্থ দেখাচ্ছিলো, সেই তিন ওভারে ৩১ রান দেয়ার কথা গোপন থাকলেই হলো।
গোপন আর থাকলো কই! শেষ বারো বলে ৬৪ রান বিলিয়ে রেকর্ড বই-ই যখন উল্টেপাল্টে দিয়েছেন, তখন তা নিয়ে চর্চা তো হবেই।
বলা বাহুল্য, এই ৬৪ রানই এসেছিলো ডি ভিলিয়ার্সের ব্যাট থেকে।
এবি ডি গড়েছিলেন দ্রুততম দেড়শত রানের রেকর্ড। আর নিজের নবম ওভারে ৩৪ রান দিয়ে জেসন হোল্ডার গড়েছিলেন এক ওভারে সবচেয়ে বেশি রান দেয়ার বিশ্বকাপ রেকর্ড।
১. মার্টিন স্নেডেন (১২-১-১০৫-২)
জেসন হোল্ডার এক রানের জন্যে যার রেকর্ড ছুঁতে পারেননি, তিনি নিউ জিল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার মার্টিন স্নেডেন। ক্যারিয়ার ইকোনমি রেট ৪.২৯ হলেও ১৯৮৩ বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে রান বিলানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন উদার হস্তে। সেই আমলে একশ রানের বেশি ব্যয় করে হয়ে গিয়েছেন বিশ্বকাপ ম্যাচে সবচেয়ে বাজে বোলিং ফিগারের মালিক।
স্নেডেন অবশ্য ‘শুভংকরের ফাঁকি’ বাগধারার আশ্রয় নিয়ে নিজেকে এই অপবাদ থেকে মুক্ত করতে পারেন। একদিবসী ক্রিকেটের ইনিংসপ্রতি ওভারসংখ্যা যখন ছিলো ৬০, স্নেডেন রেকর্ড গড়েছিলেন তখন। পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন পরিসংখ্যানের ফাঁকটা, ১০৫ রান খরচ করতে স্নেডেন বল করেছিলেন ১২ ওভার।
লন্ডনের সেই ম্যাচে ঝড়টা কেবল গিয়েছিলো নিউ জিল্যান্ডের দুই মার্টিনের ওপর দিয়েই। বাকি বোলারদের মাঝে সর্বোচ্চ ইকোনমি রেট যখন ৪.৭৫, মার্টিন স্নেডেন ওভারপ্রতি রান দিয়েছিলেন ৮.৭৫ করে। তুলনামূলক বিখ্যাত অন্য মার্টিন, মার্টিন ক্রো, ছয় ওভারেই দিয়েছিলেন ৫১ রান।
লেখার বাকি অংশ বলে, দলে কোনো একজনের এমন বাজে বোলিং মানেই, ঐ দলের ভাগ্যে জুটেছে নিশ্চিত পরাজয়। পরাজয়ের ব্যবধানটিও শত রানের কম নয়। এই ম্যাচেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। নিউ জিল্যান্ড হেরেছিলো ১০৬ রানের বিশাল ব্যবধানে।
পাদটীকা: চারদিকের গুঞ্জন সত্য হলে, ৩০ মে থেকে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপের উইকেট হতে যাচ্ছে পুরোপুরিই ব্যাটিংবান্ধব, যে উইকেটে রানসংখ্যা ৩০০ পেরোবে প্রায় সব ম্যাচেই। এমন উইকেটে খেলা হবার ফলাফল কী হতে পারে?
কী আর হবে! এই লেখার লেখককে পুনরায় কি-বোর্ড হাতে ঝাঁপাতে হবে!