১৮৯৬ সালের অক্টোবর মাস। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের বোম্বে শহর।
রেলস্টেশনে আর নদীর ঘাটে অজস্র মানুষকে পালিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছিলো। বড় ধরনের কোনো আতঙ্কের জন্ম না হলে মানুষজন এভাবে এলাকা ছাড়ে না। আর আতঙ্ক সব সময় এক চেহারা নিয়েও আসে না। তার অজস্র মুখ ও অসংখ্য মুখোশ।
চারপাশে ছড়ানো বিবর্ণ মৃতদেহের স্তুপ দেখে বোঝা যায়, এই আতঙ্ক যুদ্ধ বা দাঙ্গার নয়- মহামারীর। মহামারীর ছোঁয়ায় প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন মানুষ বড় সংখ্যায় অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এই মহামারীর নাম বিউবোনিক প্লেগ। যে বিউবোনিক প্লেগ মধ্যযুগে ইউরোপে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষ অকালে মারা গিয়েছিলো।
কলকাতা থেকে ট্রেনে করে বোম্বে আসছিলেন এক বিদেশী। বয়স ৩৬ এর কাছাকাছি। চেহারা দেখে আন্দাজ করা যায় যে, তিনি হয়তো ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত হবেন।
ভদ্রলোক ফ্রান্সে পাস্তুর ল্যাবরেটরিতে সহকারী গবেষকের কাজ করতেন। তার ইচ্ছে লুই পাস্তুরের পথ ধরে অণুজীব জগতের রহস্য আবিষ্কার করে রোগ নিরাময়ের কোনো কার্যকরী উপায় বের করে আনা। সেজন্যই ইউরোপে রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড হয়ে শেষে ভারতবর্ষে পা রেখেছেন তিনি।
মানুষটির নাম ওয়াল্ডিমার হাভকিন। জন্মসূত্রে রাশান ইহুদী। কলেরা ও প্লেগের টিকা আবিষ্কারের জন্য পৃথিবী তার এই বিজ্ঞানসাধক সন্তানকে চিরদিনের জন্য মনে রেখেছে।
১৮৬০ সালে রাশিয়ার ওদেসায় জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন উৎসুক প্রকৃতির। অনুসন্ধানী মন ও দ্বিধামুক্তভাবে সত্য খোঁজার ধাঁচ তাকে বিজ্ঞানী ও বিপ্লবী- দুই গোষ্ঠীর মানুষের সাথেই সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছিলো। পাশের বাড়িতে বিশিষ্ট জীবাণুবিজ্ঞানী অধ্যাপক মেচনিকভের সাধনা তাকে ভীষণ টানতো। আবার নভোরাসিস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার নিজের আবাস কবলেভস্কায়া স্ট্রিট হয়ে উঠেছিলো রীতিমতো বিপ্লবীদের অবস্থান করার আড্ডাখানা। ফলে দুই উৎস থেকেই মানুষের দৈহিক ও আত্মিক নিরাময়ের কর্তব্যই নিজের মধ্যে বোধ করতেন।
অধ্যাপক মেচনিকভের সাথে তার পরিচয়ের পরই বিজ্ঞানের কাজে একরকম সহযোগী হয়ে উঠলেন। দুজনে একসাথে জীবাণুর নমুনা খুঁজতে কৃষ্ণসাগরের উপকূলে যেতেন। ১৮৮৪ সালে হাভকিন নভোরাসিস্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৃতিবিজ্ঞানে পিএইচডি লাভ করেন। এই সময়টাতে রাশিয়ার ওদেসা ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। জার সরকার ও তার প্রশাসন রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর এক হাত নেবার চেষ্টা করছিলো। হাভকিনও সরকারের রোষানলে পড়েন।
অনেক কষ্ট করে জুওলজি মিউজিয়ামে সামান্য একটি চাকরি জোগাড় করেন। তিনি থেমে থাকার মতো মানুষ ছিলেন না। কৃষ্ণসাগরে মেচনিকভের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখে ফেললেন ‘ইউগ্লিনা’ ও ‘কৃষ্ণসাগরের প্রোটোজোয়া’ নামের দুটি নিবন্ধ। অধ্যাপক মেচনিকভ হাভকিনের অন্তর্দৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হলেন। তার সহায়তায় নিবন্ধ দুটি ‘প্যারিস বিজ্ঞান সাময়িকী’তে প্রকাশিত হলো।
তখন ইউরোপে জীববিজ্ঞান চর্চায় নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিলো। ফ্রান্সের প্যারিসে বিখ্যাত অণুজীববিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের সাধনায় উৎসাহিত হয়ে অনেক বিজ্ঞান সাধক এগিয়ে এসেছিলেন। সারা ইউরোপে জীবাণু ও রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারের উদ্যম দেখা গিয়েছিলো। গবেষণার পরিশ্রমসাধ্য পথ কঠিন বাধাকে সহজ করে দিচ্ছিলো। জীবাণু রহস্য পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝতে পারলে রোগব্যাধি চিরদিনের জন্য জয় করার কোনো না কোনো উপায় বের হবেই- এমন প্রত্যয় বিজ্ঞাননিষ্ঠাকে আরো বাড়িয়ে তুললো।
রাশিয়ায় হাভকিন স্বপ্ন দেখতেন প্যারিসে পাস্তুরের গবেষণাগারে কাজ করার। সে স্বপ্নের তাড়নাতেই একদিন রাশিয়া ত্যাগ করলেন। পাস্তুরের গবেষণাগারে অতি সামান্য কোনো কাজ পেলেই তিনি খুশী। ভাগ্য প্রসন্ন ছিলো, সামান্য কাজ তাকে করতে হয়নি। মেচনিকভের সহায়তায় গবেষণাগারের লাইব্রেরিতে একটি কাজ পেলেন।
লাইব্রেরির কাজ করতে করতে একদিন আকাঙ্ক্ষিত একটি সুযোগ মিললো। পাস্তুর গবেষণাগারের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এমিল রু্য এর সহকারী অধ্যাপক পূর্ব এশিয়ায় গেলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হলেন ওয়াল্ডিমার হাভকিন। এতদিনে অদেখা স্বপ্ন বাস্তব হয়ে দেখা দিলো।
তখন ১৮৯০ সাল চলছে। সারা পৃথিবীতে কলেরার প্রকোপ। তার নিজের জন্মভূমিই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ধুঁকছে। অথচ তখন অবধি এর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কারই হয়নি। একরকম দানবীয় পরিস্থিতির মুখোমুখী হলেন হাভকিন। সুতরাং পেছানোর কোনো পথ আসনে নেই।
সুতরাং কঠিন শপথ নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। বিজ্ঞানের বজ্রকঠিন পথে পরম যুক্তিনিষ্ঠা নিয়ে এগোলেন। জীবাণু পরীক্ষার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন খরগোশ। কলেরার ব্যাকটেরিয়ার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া সূক্ষ্মভাবে দেখতে খরগোশের দেহে সংক্রমিত করলেন। এক দেহ থেকে অন্য দেহে সংক্রমিত করার প্রক্রিয়া চালিয়েই গেলেন। এসময় কিছু কৌতূহলজনক বিষয় দেখতে পান। চল্লিশতম সংক্রমণ সম্পূর্ণ হলে কলেরার জীবাণু অত্যন্ত ভয়ানক হয়ে ওঠে। এরপর সংক্রমিত করলে খরগোশ প্রায় সাথে সাথেই মারা যায়। কিন্তু পেশির গভীরে সংক্রমিত না করে চামড়ার নিচে করলে জীবাণুর কার্যকারিতা কমে যায়।
হাভকিন যেন অন্ধকারে হঠাৎ আলোর দেখা পেলেন। ‘বিষে বিষক্ষয়’ বলে এক পুরনো প্রবাদ আছে, সে প্রবাদই যেন এক্ষেত্রে বাস্তব হয়ে দেখা দিলো। কলেরা জীবাণু দিয়েই এর টিকা তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু হলো। পরীক্ষায় দেখা গেলো যে, প্রায় ঊনচল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কলেরা জীবাণু বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই জীবাণু খরগোশ ও গিনিপিগের দেহে সংক্রমিত করে অভাবনীয় ফল দেখা গেলো। এরা শুধু সুস্থই রইলো না, শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতাও জন্মালো।
তবে কার্যকরী টিকা প্রস্তুত করার আগে শুধু খরগোশ আর গিনিপিগের উপরই পরীক্ষা করলে চলে না। মানুষের দেহে তার প্রতিক্রিয়াও দেখতে হয়। তবে অন্যকে স্বেচ্ছাসেবক করার ঝুঁকিতে গেলেন না হাভকিন। নিজের উপরই পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। দুর্বল জীবাণুর টিকা নিজের দেহে সংক্রমিত করলেন। সামান্য অসুস্থতার পর সুস্থ হলে এবার সবল জীবাণু সংক্রমিত করলেন। ফলাফল বিস্ময়কর। রোগ দেখা গেলো না। অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের ক্ষেত্রেও একই ফল হলো।
এবার সত্যিকারের রোগীদের সেবা করার পালা। ১৮৯৩ সালের প্রথমদিকে কলকাতা এলেন। শহরের বিভিন্ন জায়গায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও মানবেতর অবস্থা কলেরা রোগের উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছিলো। আর দরিদ্র অঞ্চলে জনমানুষের অসচেতনতা তো ছিলোই। সেসবের বিরুদ্ধে একত্রে কাজে নেমে পড়লেন হাভকিন।
শীঘ্রই শহরতলীতে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেলো। চারজন ভারতীয় সহকর্মীকে নিয়ে হাভকিন রোগী দেখতে গেলেন। তবে প্রথমে কেউই ইনজেকশন নিতে রাজি ছিলো না। ফলে ডাক্তাররা নিজেদের উপর প্রথমে পরীক্ষা করে সবাইকে নিশ্চিত করলেন। রোগীদের বিশ্বাস জন্মালো। ইনজেকশন নিয়ে অনেক মানুষ রোগমুক্তির দেখা পেয়েছিলো। এই খবর ছড়িয়ে পড়লো ভারতের বিভিন্ন স্থানে। দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসার আমন্ত্রণ এলো। তার অদম্য পরিশ্রমে কলেরার মরণ আঘাতের তীব্রতা ধীরে ধীরে অনেক কমে এলো।
১৮৯৬ সালে বোম্বেতে বিউবোনিক প্লেগের উপদ্রব দেখা গেলো। ওয়াল্ডিমার হাভকিন ৭ অক্টোবর এখানে পৌঁছলেন। কঠিন শপথে আবার কাজে নামতে হবে।
কিন্তু এক্ষেত্রে কাজ আগের মতো সহজ ছিলো না। প্লেগের জীবাণু মানুষের জন্য মারাত্মক হলেও মানবদেহের বাইরে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে। সুতরাং উপযুক্ত পরীক্ষার জন্য ভালো পোষক লাগবে। গরুর মাংসে নারকেল তেল মিশিয়ে পোষক তৈরি করা হলো। তবে এতে জীবাণু ভালোভাবে বংশবৃদ্ধি করলেও আগের পদ্ধতিতে দুর্বল করা জীবাণু ইঁদুরের দেহে কার্যকর হলো না।
কিন্তু হাভকিন অজেয় মানসিকতার মানুষ ছিলেন। হাল ছাড়লেন না। প্রতিষেধক ইঁদুরের দেহে কাজ না করলেও মানুষের দেহে করতে পারে। তবে তার জন্য সতর্ক পরীক্ষার প্রয়োজন। আবারও নিজেই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেন। ১৮৯৭ সালের ১০ জানুয়ারী নিজের দেহে ১০ সিসি প্লেগ জীবাণুর ভেকসিন নিলেন। ফলে প্রবল জ্বর ও ব্যথায় কুঁকড়ে গেলেন। কিন্তু পরীক্ষার খবর গোপন রাখা হলো।
ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। ফলে টিকা তৈরির বৈধতা মিললো। বোম্বের জেলে প্লেগ দেখে দিলে সেখানে এই টিকায় সাফল্য পাওয়া গিয়েছিলো। ফলে মহামারী আকারে প্লেগের প্রতিকার করার পথ পাওয়া গেলো। এই ভেকসিনের সাহায্যে সীমান্ত প্রদেশ, পুনা, পালামপুর, হায়েদ্রাবাদ, সিন্ধু ও হায়েদ্রাবাদের রোগাক্রান্ত এলাকায় অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া গেলো।
পুরো বিশ্বে প্লেগের মহৌষধের আবিষ্কারক হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়লেও ভারতের ব্রিটিশ সরকারের চোখে সেটা ভালো ঠেকলো না। ইংরেজদের রুশ বিদ্বেষের শিকার হলেন এই কালজয়ী সাধক। ১৯০২ সালে টিকা দানে অনিচ্ছাকৃত একটি ভুলের জন্য তাকে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হলো। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা ক্ষুব্ধ হলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কারক রোনাল্ড রস। তীব্র প্রতিবাদের মুখে ওয়াল্ডামেয়ার হাভকিন আবার নিজের পদে ফিরে আসতে পেরেছিলেন।
১৯৩০ সালের ২৬ অক্টোবর এই কালজয়ী বিজ্ঞানী সুইজারল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। মানুষের রোগ নিরাময়ের ইতিহাসে চির অমর হয়ে রইলেন বিজ্ঞানী ওয়াল্ডিমার হাভকিন।