১৯৯৫ সালের দিকের কথা। “Drink Pepsi, Get stuff” স্লোগানে পেপসি তাদের বিভিন্ন পণ্যের জন্যে প্রমোশনাল ক্যাম্পেইন চালাচ্ছিল। মানুষ পেপসি কেনার সাথে সাথে ‘পেপসি পয়েন্ট’ সংগ্রহ করতে পারতো। এরপর সেসব পয়েন্টের বিনিময়ে নেওয়া যেত অন্যান্য পণ্য। ৭৫ পয়েন্টের বিনিময়ে একটি টি-শার্ট, ১৭৫ পয়েন্টে পাওয়া যেত সানগ্লাস ও ১৪৫০ পয়েন্টে ছিল একটি লেদার জ্যাকেট পাওয়ার সুযোগ। সেসময় এ তিনটিই একসাথে পড়ার মধ্যে বেশ চটকদার একটি ব্যাপার ছিল। অন্তত পেপসির বিজ্ঞাপনে বিষয়টিকে সেভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।
বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়, উন্মাদনা সৃষ্টির জন্যে কোনো বিষয়কে একেবারে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। যেমন- এনার্জি-ড্রিংকের বিজ্ঞাপনে আমরা দেখি কোনো ড্রিংকস পান করে কেউ ফুটবলকে আসমানে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিংবা কেউ চাটনি খেয়ে পৃথিবীকে রক্ষা করছে মহাজাগতিক দুর্যোগ থেকে। পেপসির এ ক্যাম্পেইনের জন্যে তৈরি করা বিজ্ঞাপনটিতেও তেমনটিই করা হয়েছিল।
এতে দেখা যায় গায়ে পেপসির টি-শার্ট, জ্যাকেট ও চোখে শেডস ছাপিয়ে এক কিশোর চড়ে বসছে একটি হ্যারিয়ার জেটে। তারপর আশেপাশের সবার চক্ষু চড়কগাছ করে যুদ্ধবিমানটিতে ছেপে সে পৌঁছাচ্ছে স্কুলে। পোঁছে তার বক্তব্য, “এটি নিশ্চিতভাবে বাসকে হার মানায়।” এদিকে স্ক্রিনে লেখা উঠছে ৭ মিলিয়ন পেপসি পয়েন্টের বিনিময়ে পাওয়া যেতে পারে একটি হ্যারিয়ার ফাইটার।
কৌতুকটি ধরতে তেমন গভীর সেন্স অব হিউমারের দরকার হয় না। পেপসি পয়েন্টের বিষয়টিকে তারা অতিরঞ্জন করে ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কৌতুকের দিক থেকে বেশ ভালো স্ক্রিপ্ট। কিন্তু গণিতের দিক থেকে দেখলে একটু কাঁচা কাজ হয়ে গিয়েছে। কারণ সাত মিলিয়ন সংখ্যাটা শুনতে যত বিশাল শোনায়, আসলে এটি তত বড় সংখ্যা না। বিজ্ঞাপন নির্মাতা দলটি হয়তো হিসাব-নিকাশ করে দেখেনি যে সংখ্যাটি আসলেই ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে কী না! কিন্তু জন লেনার্ড নামের একুশ বছর বয়সী একজন ছাত্র ঠিকই হিসাব করেছিলেন।
সেসময় একটি ‘এভি-এইট হ্যারিয়ার-টু জাম্প জেট’ কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর প্রায় তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার খরচ পড়তো। আর সৌভাগ্যবশত ডলারকে পেপসি পয়েন্টে রূপান্তর করারও একটি সহজ পদ্ধতি ছিল। প্রতি দশ সেন্টের বিনিময়ে এক পেপসি পয়েন্ট কেনার সুযোগ দিয়েছিল পেপসি। হিসেব কষে লেনার্ড দেখলেন- তেত্রিশ মিলিয়নের যুদ্ধবিমান পেপসির কাছ থেকে স্রেফ সাত লাখ ডলারের বিনিময়েই পাওয়া যাচ্ছে। এ অঙ্ক কষার পর তিনি বেশ আঁটঘাঁট বেঁধেই মাঠে নামলেন। পাঁচজন বিনিয়োগকারীকেও রাজি করে ফেললেন টাকার জন্য।
লেনার্ড তার পরিকল্পনায় কোনো ফাঁক রাখতে চাননি। পেপসি স্টাফের পুরষ্কারের একটি প্রাইজ ক্যাটালগ যোগাড় করলেন তিনি। হ্যারিয়ার জেটের নামটি ক্যাটালগে ছিল না অবশ্য। তবে লেখা ছিল কারো পনের পেপসি পয়েন্ট থাকলে, এরপর প্রতি দশ সেন্টের বিনিময়ে অপরিমিত পেপসি পয়েন্ট কেনা যাবে। আর বাড়তি দশ ডলার লাগবে শিপিং খরচের জন্যে। লেনার্ড সব ঠিক-ঠাকমতো সম্পন্ন করলেন। একটি ফরম তুলে পনের পেপসি পয়েন্ট ও একটি ৭০০,০০৮.৫০ ডলারের চেক সহযোগে পাঠিয়ে দিলেন কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। অর্ডার করলেন একটি হ্যারিয়ার জেটের।
তিনি অর্ডারটি পাঠিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের ২৭শে মার্চ। অর্ডারটি পেয়ে ৭ মে পেপসি চেকটি ফেরত পাঠায়। সঙ্গে একটি চিঠিতে ব্যাখ্যা করে যে যুদ্ধবিমানটি তাদের অফারের মধ্যে ছিল না। প্রাইজ ক্যাটালগেও ছিল না এর নাম। তারা শুধু বিজ্ঞাপনটি আরো চটকদার করে তুলতে জেটটি ব্যবহার করেছে। সঙ্গে তারা বেশ কয়েকটি কুপনও পাঠিয়েছিল। ক্ষমা চেয়েছিল যেকোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝির জন্যে। কিন্তু লেনার্ড তো আর এত অল্পতে সন্তুষ্ট হওয়ার জন্যে এত আয়োজন করেননি। নিজের দাবির পক্ষে লড়তে উকিলেরও ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন তিনি। চিঠিটি পাওয়ার সপ্তাহখানেক পর তার উকিল প্রতিউত্তরে লিখলেন,
৭-ই মে তে পাঠানো আপনাদের চিঠিটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। আমরা পেপসি স্টাফের বিজ্ঞাপনের ভিডিওটি পুনরায় দেখেছি। সেখানে স্পষ্টভাবে সাত মিলিয়ন পেপসি পয়েন্টের বিনিময়ে একটি নতুন হ্যারিয়ার জেটের অফার দেওয়া হয়েছে। আমাদের মক্কেল আপনাদের সকল নিয়ম-কানুন অনুসরণ করেছেন। তাই আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানাচ্ছি যে, আপনারা আপনাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন এবং শীঘ্রই একটি নতুন হ্যারিয়ার জেট আমাদের মক্কেলের কাছে হস্তান্তর করুন। এ চিঠি পাওয়ার পরবর্তী দশ কার্যদিবসের মধ্যে যদি আপনারা হস্তান্তরের উদ্যোগ না নেন, তবে পেপসির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা থাকবে না আমাদের সামনে।
মজার বিষয় হচ্ছে, এবার পেপসি নিজে উত্তর না দিয়ে এ চিঠিটি পাঠিয়ে দেয় বিজ্ঞাপনটি তৈরি করা কোম্পানির কাছে। তারা লেনার্ডকে জানায়, “এটি স্পষ্টতই একটি কৌতুক ছিল। তারা ভাবতেই পারছে না যে কেউ আদৌ এটি বিশ্বাস করে বসবে।” আর বিষয়টি নিয়ে কিছুটা বিচলিত হয়েই হয়তো পেপসি এরপর বিজ্ঞাপনে হ্যারিয়ার জেটের জন্যে প্রয়োজনীয় পেপসি পয়েন্টের সংখ্যা সাতশো মিলিয়ন করে দেয়। সে যা-ই হোক, তাদের তখনো লেনার্ডের সাথে নিষ্পত্তি করা বাকি। বিষয়টি ততদিনে আদালতের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
পেপসির আইনজীবীরা আদালতে ব্যাখ্যা করেন যে এটি সম্পূর্ণরূপে কৌতুক ছিল, এটি কেন কৌতুক সেটিও ব্যাখ্যা করতে হয় তাদের। একটি কৌতুক কেন কৌতুক তা ব্যাখ্যা করা বেশ মুশকিল ব্যাপারই বটে। তবে তারা চেষ্টা চালান-
প্রথমত, বিজ্ঞাপনে কিশোরটির বক্তব্য ছিল যুদ্ধবিমানে করে স্কুলে যাওয়া “নিশ্চিতভাবে বাসকে হার মানায়”। বিষয়টি অস্বাভাবিক। কারণ বাসে করে স্কুলে আসার তুলনায় একটি আবাসিক এলাকা দিয়ে যুদ্ধ বিমান চালানো অত্যন্ত দুরূহ ও বিপদসংকুল।
দ্বিতীয়ত, কোনো স্কুলই তার ছাত্রের যুদ্ধবিমানের জন্যে ল্যান্ডিং স্পেস দেবে না কিংবা একটি জেট ব্যবহারের জন্যে যেসব সমস্যা হবে তা মেনে নেবে না।
তৃতীয়ত, একটি যুদ্ধ বিমানের মূল কাজ বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা। এমন একটি যানকে স্কুলে যাওয়ার জন্যে ব্যবহার করার বিষয়টি কোনোভাবেই ঐকান্তিক হতে পারে না।
তাই সব মিলিয়ে এটিকে কৌতুক ভিন্ন অন্য কোনোভাবে নেওয়ার কোনো মানেই হয় না।
অন্যদিকে লেনার্ডের আইনজীবীরা বলেন,
ফেডারেল জাজের পক্ষে এটি সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব না যে, বিজ্ঞাপনটি আসলে তাদের টার্গেট দর্শক ‘পেপসি জেনারেশনের’ কাছে অফার হিসেবে নাকি কৌতুক হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। বরং এ সিদ্ধান্ত জুরীদের কাছ থেকে আসা উচিৎ। সে জুরীদল গঠিত হওয়া উচিৎ পেপসি জেনারেশনের তরুণদের নিয়ে।
এভাবে তর্কে-বিতর্কে তিন বছর আদালতের গণ্ডিতে ঘুরতে থাকে মামলাটি। তবে শেষতক বিচারকরা পেপসির পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। তারা উপসংহারে বলেন,
কোনো বোধবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিই যুক্তিসংগতভাবে এ সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না যে বিজ্ঞাপনটি আসলেই গ্রাহকদের একটি হ্যারিয়ার জেটের অফার দিয়েছিল।
এর পাশাপাশি ভবিষ্যতেও কোনো বিজ্ঞাপনকে ‘অফার’ হিসেবে ধরা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় আদালত। এজন্যই হয়তো এত অবাস্তব সব বিজ্ঞাপন এখনো দেখানোর সুযোগ পায় প্রতিষ্ঠানগুলো। যা-ই হোক, এখন প্রশ্ন হলো জন লেনার্ডের আসল উদ্দেশ্য কী ছিল? আসলেই কি তিনি পেপসির কাছ থেকে একটি যুদ্ধবিমান আশা করে বসেছিলেন? সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, বাস্তবিকই একটি জেট বিমানের মালিক হওয়ার ধারণাটি তার কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় ঠেকছিল। সেজন্যেই তার এত আয়োজন।
কিন্তু বিষয় হলো, আদালত লেনার্ডের পক্ষে রায় দিলেও কি তিনি যুদ্ধবিমানের মালিক হতে পারতেন? যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর বরাতে জানা যায়, সম্ভব হতো না বিষয়টি। লেনার্ড অবশ্য বলেছিলেন, বিমানটির সকল সামরিক কার্যক্ষমতা দূর করে তাকে দিলেও তিনি সন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু হ্যারিয়ার জেটের সামরিক বৈশিষ্ট্য দূর করতে গেলে সেটি ওড়ার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলবে। এছাড়া কোনোভাবে এ ধরনের একটি যুদ্ধবিমান তাকে দিলেও, সেটির ব্যবস্থাপনার যে বিপুল ব্যয় তা বহন করা অসম্ভবই হতো তার জন্য।
এসব মিলিয়ে বোঝা যায় লেনার্ড ও তার বিনিয়োগকারীরা আসলে যুদ্ধবিমানের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। বরং আদালতের বাইরেই বিষয়টি নিষ্পত্তি করে পেপসির কাছ থেকে বড়সড় পরিমাণ অর্থকড়ি হাতিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। শেষতক আর পেরে ওঠেননি। তবে এ কান্ড করে আইনের ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছেন ঠিকই।