ভারতীয় ইতিহাসের মধ্যযুগের মারাঠা শক্তির উত্থান বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মহারাষ্ট্রে এককালের রাজা শিবাজী ভোঁসলে প্রায় দেবতার মতোই সম্মান পেয়ে থাকেন। তিনি ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও সম্মানিত। প্রবল প্রতাপের সাথে রাজত্ব করা মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশাল মারাঠা সাম্রাজ্য। মুঘলদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবারের সফল যুদ্ধযাত্রা মারাঠা রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে দিয়েছিলো।
১৬৮১ সালে শিবাজী মহারাজের মৃত্যু হলে তার শুন্যস্থান পূরণ করেন জ্যেষ্ঠ পুত্র সাম্ভাজী ভোঁসলে। পর্তুগিজ শক্তি ও মহীশুরের ওয়াদিয়ের রাজাকে পরাজিত করে তিনি আগেই নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। এমনকি সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিদ্রোহী পুত্র আকবরের সাথেও রাজনৈতিক মিত্রতা কায়েম করেছিলেন। মুঘলদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ইচ্ছে থাকলেও প্রতিপক্ষ পিছিয়ে ছিলো না। আগে প্রচুর যুদ্ধজয়ের পতাকা উড়লেও সঙ্গমেশ্বরে মুঘলদের বিরুদ্ধে হামলা করে সাম্ভাজি ভোঁসলে পরাজিত হলেন। ১৬৮৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি ও তার সহযোগী কবি বিলাস মুঘল সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লেন। ২১ মার্চ তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার পুত্র সাহুজী ভোঁসলে মুঘলদের হাতে বন্দী ছিলেন। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তিনি মুক্তি পান।
সাহুজী ক্ষমতা নেবার পর বালাজী বিশ্বনাথকে ‘পেশোয়া’ বা প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। তার সময় মারাঠা সাম্রাজ্য দূর পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। মুঘল আমলের সুবে বাংলা অঞ্চলের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিলো।
মারাঠা সেনাপতিদের মধ্যে রঘুজী ভোঁসলে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ছিলেন। মারাঠা সাম্রাজ্যের বিস্তৃতিতে তার বিশেষ ভূমিকা ছিলো। বালাজী বাজীরাও এর অধীনে রাজপুত শক্তির বশ্যতা স্বীকারের কৃতিত্বও তার। ক্রমান্বয়ে দক্ষিণের কর্ণাটক ও ত্রিচিনোপল্লিতেও সফল অভিযান মারাঠা শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলো। কর্ণাটক থেকে ফিরে রঘুজী ভোঁসলে বাংলার দিকে নজর দিলেন। কৃষি, কারিগরি ও ব্যবসায় যে বাংলা সেসময় উপমহাদেশ সবচেয়ে সমৃদ্ধ ছিলো।
উল্লেখ্য, উপমহাদেশের অন্যান্য রাজশক্তির যুদ্ধকৌশলের সাথে মারাঠা কৌশলের পার্থক্য ছিলো। সরাসরি সম্মুখযুদ্ধের পাশাপাশি অতর্কিতে আক্রমণ ও পশ্চাদপসরণ এই কৌশলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এছাড়া শত্রুর শক্তি কমানোর জন্য কোল্যাটারাল ড্যামেজ বা যুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতি তাদের অন্যতম মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র হিসেবে কাজ করতো। যে যুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতি ও নিরীহ রক্তপাত বাংলার ইতিহাসে নিদারুণ ভয়ের স্মৃতি হিসেবে লোককথা-উপকথায় জায়গা করে নিয়েছিলো।
১৭৪২ সালে বাংলায় সর্বপ্রথম মারাঠা আক্রমণ হয়। রঘুজী ভোঁসলে তখন অনেকটা স্বায়ত্তশাসিত রাজার মতো। তার দুর্ধর্ষ ও নিষ্ঠুর সেনাপতি ভাস্কর রাম কোহ্লাটকর আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইতিহাসে এই সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত নামেও খ্যাত। নিরীহ কৃষকের ফসল জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হলো। নির্বিচারে লুটতরাজ চলতে থাকলো। চারিদিকে হতভাগ্যদের বোবা কান্না ও আহাজারিতে বাংলার বাতাস ভারী হয়ে উঠলো।
পুরো বাংলা জুড়ে মারাঠা আক্রমণের নির্মমতা ‘বর্গীর হামলা’ নামে ছড়িয়ে পড়লো।
‘বর্গী’ শব্দটি মারাঠী ‘বর্গির’ শব্দ থেকে আগত- যার মূল অংশ ফার্সী থেকে এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ ‘হালকা অস্ত্র বহনকারী দল’। আহমদনগর সালতানাতের প্রধানমন্ত্রী মালিক আম্বর দাক্ষিণাত্যে বিভিন্ন যুদ্ধে অতর্কিতে আক্রমণ ও পলায়নের এই কৌশলের সফল ব্যবহার করেছিলেন। যা পরে মারাঠী সাম্রাজ্য আয়ত্ত করে নিয়েছিলো।
তখন সুবে বাংলার নবাব ছিলেন আলীবর্দি খান। ১৭৪২ সালে তিনি উড়িষ্যা দখল করে কটক থেকে ফিরছিলেন। হুগলীর আরামবাগ এলাকায় মোবারক মঞ্জিলে পৌঁছতেই তার কাছে এই অকস্মাৎ আক্রমণ ও প্রাণক্ষয়ের সংবাদ পৌঁছলো। শত্রুকে প্রতিহত করতে তিনি রওনা হলেন। ১৭৪২ সালের ১৫ এপ্রিল বুরদোয়ান অঞ্চলে পৌঁছলেন। ভাস্কর পণ্ডিতের মারাঠা বাহিনী চারিদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেললো। মুর্শিদাবাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা আগে করায় প্রবল শত্রুর তুলনায় তার ৩০০০ ঘোড়সওয়ার নিতান্ত কম দেখা গেলো।
মারাঠা সৈন্যদের একটি দল ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে আলীবর্দীর বাহিনীর রসদ সরবরাহে প্রচণ্ড বাধা দিতে লাগলো। অন্য দল বল্গাহীন লুটতরাজ চালিয়ে যেতে লাগলো। বিনিময়ে আলীবর্দি খান তার গোলন্দাজ ও বন্দুক বাহিনী দিয়ে মারাঠাদের বিধ্বস্ত করতে লাগলেন।
আলীবর্দি তার বাহিনী নিয়ে শত্রুর আরো কাছে অগ্রসর হতে চাইলেন। ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে চতুর মারাঠা বাহিনী তার গোলন্দাজের সীমানার বাইরে থাকে লুটতরাজ আরো প্রসারিত করে চললো। নিরীহ মানুষের হত্যাযজ্ঞ আরো বাড়ানো হলো। আলীবর্দির বাহিনী কোনভাবে কাটওয়া পৌঁছলো। মারাঠা দস্যুরাও বসে ছিলো না। সুজাউদ্দীনের জামাতা মির হাবিব আলিবর্দির অন্যতম শত্রু ছিলেন। মারাঠা বাহিনীর আক্রমণের নতুন পরিকল্পনা তার কাছ থেকে এলো। তার পরামর্শে ভাস্কর পণ্ডিত ৭০০ ঘোড়সওয়ার নিয়ে মুর্শিদাবাদ হামলা চালালো। সমানে লুটতরাজ ও হত্যাযজ্ঞ চললো এখানেও।
মুর্শিদাবাদে ধনকুবের জগৎশেঠের কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা আদায় করে মারাঠা বাহিনী কাটওয়ার দিকে রওনা দিলো। আলীবর্দি ইতোমধ্যে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে কাটওয়া ছেড়েছেন। মারাঠা সৈন্যরা কাটওয়া এলাকায় তাদের ঘাঁটি গড়ে তুললো। মির হাবিব কার্যত এই সৈন্যদলের উপদেষ্টা হলেন। হুগলী ও এর বন্দর মারাঠাদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হলো। অন্যতম সেনাপতি শেষরাও নতুন এলাকায় সৈন্যদের দায়িত্ব নিলেন।
বুরদোয়ানের মহারাজের সভাকবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার তার কবিতায় এসে অঞ্চলে মারাঠা দস্যুদের নির্মমতার সাহিত্যিক সাক্ষ্য রেখে গেছেন।
সে বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভাস্কর পণ্ডিত বিজয়ের উৎসব হিসেবে বড় আকারে দুর্গাপুজা উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। লুটতরাজের অর্থ ও ধনরত্ন ব্যয় করে জমকালো আয়োজন করা হলো। মহানবমীর ভোর রাতে- অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে আলীবর্দি খান তার বাহিনী নিয়ে মারাঠাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অতর্কিত এ আক্রমণের কোন রকম উত্তর দেবার ক্ষমতা মারাঠা দস্যুদের ছিলো না। তাই প্রাণ নিয়ে পলায়নই ছিলো একমাত্র পথ।
ভাস্কর পণ্ডিত প্রাণ বাঁচানোর পর তার বাহিনী নিয়ে মেদিনীপুর জেলায় এলেন। এই অঞ্চলের রাধানগরের বিখ্যাত রেশম শিল্পের কেন্দ্র অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ধ্বংস করে লুটতরাজ ও হত্যা চালাতে লাগলেন। তার সৈন্যের অন্য একটি দল কটকে ঘাঁটি করলো। আলীবর্দি কটক দখল করে মারাঠা সৈন্যদের তাড়িয়ে দিলেন। ১৭৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নবাব রাজধানীতে বিজয়ীর বেশে ফিরলেন।
কিন্তু মারাঠা বাহিনীর মতো দুর্ধর্ষ ও চতুর শত্রু এত সহজে দমে যাবার পাত্র ছিলো না। আর শাসক হিসেবে আলীবর্দি খানও সম্ভবত সামান্য নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ যাপনের ভাগ্য নিয়ে জন্ম নেননি !
১৭৪৩ সালের মার্চ মাসে নাগপুরের রাজা রঘুজী ভোঁসলে স্বয়ং ভাস্কর পণ্ডিতকে নিয়ে কাটোয়ায় উপস্থিত হলেন। ছত্রপতি সাহুজী ভোঁসলেকে স্বয়ং মুঘল সম্রাট বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা থেকে কর আদায়ের অনুমতিপত্র দিয়েছিলেন। সাহুজী সেজন্যই রঘুজীকে পাঠিয়েছেন। শক্তি প্রয়োগ করে সেই দাবি পূরণ করতেই রঘুজী ও ভাস্কর পণ্ডিতের আগমন। মুঘল সম্রাট সাহুজীকে বাংলায় লুটতরাজ বন্ধের আহ্বান জানালে তিনি সম্মত হলেন। সাহুজী নবাব আলীবর্দি খানের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। আলীবর্দি খান বাৎসরিক কর ছাড়াও পেশোয়া সাহুজীকে ২২ লাখ টাকা দিতে সম্মত হলেন। বিনিময়ে তিনি রঘুজী ও ভাস্কর পণ্ডিতের লাগাম টেনে ধরার আশ্বাস দিলেন।
কিন্তু বিধি বাম।
কয়েক মাস পরে ভাস্কর পণ্ডিত উড়িষ্যা ও মেদিনীপুরের পথে এসে আবার বাংলায় চড়াও হলেন। পেশোয়া সাহুজী ও আলীবর্দির সমঝোতার সংবাদ তাকে উন্মাদ করে তুলেছিলো। তার এত বছরের পরিশ্রম মাড়ি হলো, আর সাহুজী কিনা ২২ লাখ টাকা বিনা পরিশ্রমে পাবে!
আলীবর্দি ভাস্কর পণ্ডিতের আক্রমণে প্রমাদ গুণলেন। ক্রমাগত যুদ্ধ ও অন্যান্য খরচের কারণে রাজকোষ শূন্য হয়ে এসেছিলো। এছাড়া চলমান সংগ্রামে তার সেনাবাহিনীও রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। সুতরাং আবার বড় যুদ্ধের ঝুঁকি তিনি চাচ্ছিলেন না। তার সেনাবাহিনীর অন্যতম বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব গুলাম মুস্তফা খান এগিয়ে এলেন। তিনি নবাবকে কৌশলে কাজ করতে উৎসাহ দিলেন। তার পরামর্শ ছিলো- সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে ভাস্কর পণ্ডিতকে সমঝোতায় আহ্বান করা হোক। তারপর সুযোগ বুঝে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
১৭৪৪ সালের ৩১ মার্চ। বহরমপুরের কাছে এক তাঁবুতে সমঝোতার আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা হলো। ভাস্কর পণ্ডিত তার ২১ সহযোদ্ধা নিয়ে তাঁবুর সামনে এলেন। আড়ালের গুপ্তঘাতকরা অতি সাবধানে ২০ জনকে গোপনে হত্যা করলো। শুধু রঘুজী গাওয়োকার পালিয়ে বাঁচলো। ভাস্কর পণ্ডিত চতুর ও দুর্ধর্ষ হলেও এতটা তার ধারণার বাইরে ছিলো। গুপ্তঘাতকের হাতে এই তুখোড় সেনানায়কও শেষ পর্যন্ত প্রাণ বিসর্জন দিলেন।
মারাঠা বাহিনী দুর্ধর্ষ হবার পাশাপাশি নির্মমও ছিলো। আক্রমণের পথে চোখে পড়া মাত্রই শহর গ্রাম জ্বালিয়ে ধ্বংস করা, নির্বিচারে হত্যা ও লুটতরাজ তাদের মূলনীতি ছিলো। নবাবী আমলে বাংলাকে এই ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে বাঁচাতে আলীবর্দি খান যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। সাফল্য কিছুটা দেখা গেলেও উপদ্রব কখনও একেবারে শূন্য হয়ে যায়নি।