১.
সাল ১৯২২। এক ইহুদি ব্যাংকারের ধনাঢ্য নাতনি, এবং তৎকালীন সময়ে ‘ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দরী নারী’ হিসেবে বিবেচিত, এডুইনা অ্যাশলেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন লুইস ‘ডিকি’ মাউন্টব্যাটেন নামের এক নেভাল অফিসার। অবশ্য আরেকটি পরিচয়ও তার ছিল। তিনি যে স্বয়ং রানী ভিক্টোরিয়ার বংশধর!
বিয়ের প্রস্তাবনা ও সম্মতির ঘটনাগুলো ঘটেছিল দিল্লি, অর্থাৎ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীতে। এডুইনা ও ডিকি, দুজনেরই বয়স তখন বিশের সামান্য বেশি। ভরা যৌবনের ভীষণ উদ্দামতায় মাত্র মাস কয়েকের পরিচয়েই পারস্পরিক জীবনের ভবিষ্যতকে তারা এক সুতোয় গাঁথার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন।
পরিচয়-পরবর্তী এবং প্রাক-প্রস্তাবনার সেই মাসখানেক সময়কাল দুজনের জন্যই ছিল স্বপ্নময় ও আবেগতাড়িত। রাত তিনটার সময় একবার মোটরগাড়িতে চেপে বাদশা হুমায়ূনের অসামান্য সমাধিসৌধ দেখতে চলে গিয়েছিলেন তারা। সেই দর্শনে বিমোহিত হয়েছিলেন এডুইনা। বোধ করি সেই রাতেই ডিকির কাঁধে মাথা রেখে মনে মনে ভেবে ফেলেছিলেন, এই মানুষটির সাথে সারাজীবন কাটানো যায়। তৎপরবর্তী সকল ঘটনাক্রম তো স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
কিন্তু মানুষের মন যে কী সাংঘাতিক রহস্যময়, সে ব্যাপারেও সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ডিকি পেয়ে গিয়েছিলেন এর কিছুকালের মধ্যেই। মজার ব্যাপার, এডুইনার সাথে তখনো গাঁটছড়া বাধা হয়নি তার। হবু দম্পতি আরেকবার রাতের আঁধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন হুমায়ূনের স্মৃতিচিহ্নের সামনে। কিন্তু সেবার কেন যেন আগেরবার প্রকাণ্ড বোধ হওয়া সমাধিসৌধটিকেই এডুইনার মনে হয়েছিল নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। প্রিয়তমার মনের এই আকস্মিক পরিবর্তন ডিকির হৃদয়ে তীক্ষ্ণ শূল বিঁধে দিয়েছিল বটে, কিন্তু তবু তিনি নিজের মতো করে একটি যুক্তি খাড়া করেছিলেন, হয়তো নিজের মনকেই প্রবোধ দেয়ার উদ্দেশে।
কয়েকদিন আগেই এডুইনা তাজমহল দেখেছে তো, তাই হুমায়ূনের সমাধিসৌধ দেখে আগের মতো আর তার চোখের তারা আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে না।
কিন্তু, আরেকটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলে বোধহয় ডিকি এডুইনার মনের তলেরও হদিস পেতেন। উপলব্ধি করতে পারতেন সেই মনের উথাল-পাতাল অস্থিরতা। বিয়ের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় তাকে শুনতে হতো না যে, একাধিক পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন তার বিবাহিতা স্ত্রী এডুইনা তথা লেডি মাউন্টব্যাটেন।
২.
ডিকি তখন নিজের ক্যারিয়ার গড়ার অভিলাষে অথৈ সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছেন। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের সহজাত দক্ষতায় মন জয় করে নিচ্ছেন সকলের। এদিকে যে স্ত্রীর সাথে তার দাম্পত্যজীবনের ভেলা মাঝ সমুদ্রে ডুবে গেছে, তার ওপর থেকে তার স্ত্রীর মন পুরোপুরি উঠে গেছে, এসব বাস্তবতা তার নিকট প্রচ্ছন্নই হয়ে ছিল ১৯২৫ সালের এক কাল রাতের আগ পর্যন্ত, যে রাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তার হৃদয়।
গূঢ় সত্য জনসম্মুক্ষে প্রকাশিত হবার পর্বটিও সম্পন্ন হয়েছিল আশাতীত নোংরামি ও কদর্যতার মাধ্যমে, যখন আরেক বিবাহিতা নারী আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তার স্বামীর সাথে এডুইনার অবৈধ প্রণয়ের ব্যাপারে নালিশ জানাতে। এছাড়া এডুইনা ভালোবাসার খেলায় মেতেছিলেন লেসলি হাচিনসন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পীর সাথেও, যে বিষয়টি জনসম্মুখে এলে চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল।
তবে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো, স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশিদিন দুঃখবিলাস করেননি ডিকি। সম্ভবত তার আবেগমথিত হৃদয় শুকিয়ে রসকষহীন হয়ে পড়েছিল। কিংবা অনেকের মতে, তিনি হয়ে পড়েছিলেন অধিক শোকে পাথর। তাই ১৯২৯ সাল নাগাদ, পূর্বেকার সকল মানসিক টানাপোড়েনকে পেছনে ফেলে, তিনি এডুইনার সাথে এক অবাক করা সন্ধিচুক্তি করে বসেন। স্ত্রীকে জানান, তার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে তিনি কখনোই মাথা ঘামাবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা গুপ্ত থাকছে, আর পাঁচজনের রসালো আলাপের বিষয়বস্তুতে পরিণত না হচ্ছে।
১৯৩২ সালে দেখা যায়, ডিকি নিজেও একজন উপপত্নী গ্রহণ করেছেন। বিবাহিতা স্ত্রী ও উপপত্নীকে নিয়ে এক অপরাহ্নে খেতেও গিয়েছিলেন ডিকি। সেদিনের পর তাকে পাঠানো পরের চিঠিটিতে এডুইনা লিখেছিলেন,
“তোমার ‘মেয়েটি’ তো বেশ! আমার ওকে পছন্দ হয়েছে।”
এভাবেই মাউন্টব্যাটেন দম্পতি পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তাদের মধ্যকার অনানুগত্যকে। কিন্তু এ তো কেবল শুরু। কে জানত, এই আপাত প্রেমহীনতার আখ্যানই পরবর্তীতে জন্ম দেবে আরেক ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনীর!
৩.
দেখতে দেখতে চলে এসেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই বিশ্বযুদ্ধ শুধু পৃথিবীর মানচিত্রকেই চিরতরে বদলে দেয়নি, অনেক নতুন ক্ষত এবং অনেক নতুন সেলাই দিয়েছিল ডিকি ও এডুইনার ব্যক্তি ও কর্মজীবনেও।
নৌবাহিনীতে উপর্যুপরি সাফল্য, সেই সাথে রাজকীয় রক্তের কল্যাণে, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের অবস্থান গড়ে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন ডিকি। এদিকে সারাটা জীবন অর্থ-প্রতিপত্তির ঝনঝনানির মাঝে দিন গুজরান করা এডুইনাও বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে স্বেচ্ছাসেবা ও সমাজকল্যাণের মাধ্যমে জীবনের প্রকৃত অর্থ ও যথার্থতা খুঁজে পেতে শুরু করেছিলেন।
জীবনের নবার্থ খুঁজে পাওয়া এডুইনার মনোজগতে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, দিল্লিতে ডিকির সাথে ভাইসরয়ের প্রাসাদোপম ভবনে বাস করতে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে এসেছিল তার। অগনিত মার্বেল মাথর দিয়ে তৈরি সেই ভবনের একেকটি করিডোর, এবং দৈত্যাকার ঘরগুলো যেন গিলে খাচ্ছিল তাকে। এত বিলাসিতা আর সহ্য হচ্ছিল না। প্রাচুর্যের দেয়াল চারদিক থেকে তাকে গ্রাস করতে চাইছিল, বুঝিয়ে দিচ্ছিল আদতে তিনি কতটা একাকী ও নিঃসঙ্গ। তাই তিনি সেই ভবন থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন।
তবে বছর দুই বাদে, ১৯৪৭ সালে ডিকি নিজেই ভারতের ভাইসরয় নিযুক্ত হবার পর আবারো একই ভবনে ফিরে আসতে বাধ্য হন এডুইনা। ততদিনে তার জীবনে শূন্যতা ও বান্ধবহীনতা সুদে-আসলে আরো বেড়েছে। একে তো ব্রিটিশ ভারতের সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে ভাইসরয়ের দায়িত্ব পেয়ে কাজের সমুদ্রে ডুবে গিয়েছেন ডিকি, এদিকে এডুইনা নিজেও উপনীত হয়েছেন নারীজীবনের এক কঠিন কালে, রজোবন্ধতায়।
আর ঠিক এমন সময়েই, এডুইনার সাক্ষাৎ হয় তার স্বপ্নপুরুষের সাথে, যার দেখা পাবার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করে গিয়েছেন তিনি, কাটিয়েছেন শত-সহস্র বিনীদ্র রজনী, পাননি একাধিক পুরুষের সান্নিধ্যেও চির-আকাঙ্ক্ষিত স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তি।
সেই মানুষটি জওহরলাল নেহেরু।
৪.
ভারতে তখন চলছে সত্যিই বড় কঠিন সময়। ডিকি, যিনি সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন নামে, তিনি তখন প্রচণ্ড ব্যস্ত কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের মধ্যে সালিশিতে। ভারত কীভাবে স্বাধীন হবে, খণ্ড-বিখণ্ডিত হবে নাকি প্রবেশগুলো স্বরাজ-স্বায়ত্তশাসন পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করবে, এসব চিন্তায় তার রাতের ঘুম হারাম। আর ওদিকে এডুইনা তথা লেডি মাউন্টব্যাটেনের ঘুম হারাম জওহরের চিন্তায়।
জওহরের সাথে এডুইনার প্রেমের শুরুটা হয়েছিল ম্যাশোবরা নামক পাহাড়ি স্টেশনে। সবাই মিলে ফ্যামিলি পার্টিতে গিয়েছিলেন তারা। সেখানেই, অনাত্মীয় জওহরের সাথে আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল এডুইনার।
হ্যাঁ, আত্মারই সম্পর্ক। আত্মার সাথে আত্মার, এবং মেধার সাথে মেধার। কিংবা এডুইনার শব্দচয়নে যে সম্পর্ক অভিহিত হয়েছিল এক ‘দুর্লভ বন্ধন’ হিসেবে। সেই বন্ধনের এক ধারে ছিলেন এক বিপত্নীক পুরুষ, আরেক ধারে স্বামীর সাথে বিচিত্র সন্ধিতে আবদ্ধ এক নারী।
সম্পর্কের প্রাথমিক পর্যায়ে জওহরকে লেখা এক পত্রে মনের অর্গল খানিকটা খুলে দিয়েছিলেন এডুইনা। তিনি লিখেছিলেন,
আজ সকালে যখন তুমি গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছিলে, তখন আমার খুব খারাপ লাগছিল। তবে তুমি চলে গেলেও, আমাকে রেখে গিয়েছ এক অদ্ভূত প্রশান্তিময় অনুভূতিতে… তোমার মনেও কি আমি একই অনুভূতি জাগাতে পেরেছি?
৫.
বিষণ্ণতা ও শূন্যতার প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ দুই নরনারী নিজেদের মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন গভীর থেকে গভীরতর লগ্নতা, আর কী এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি, যা তাদের দুজনকে চুম্বকের মতো পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট করে চলেছিল। সেই আকর্ষণে তারা অভিভূত হয়েছিলেন, হয়েছিলেন উল্লসিত। নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় তাদের অন্তরঙ্গতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করেছিল, এবং একপর্যায়ে সরে গিয়েছিল তাদের মধ্যস্থিত পর্দা। তারপর তারা শুরু করেছিলেন নিঃশঙ্কচিত্তে চোখে চোখ রাখা। একে অন্যের চোখে পরস্পরের জন্য আকুতিটা তারা খুব ভালোভাবেই পড়তে পারছিলেন, কেননা দুজনেরই আকুতি কিংবা কামনার ভাষাটা যে ছিল অভিন্ন।
কিন্তু সেই আটান্ন বছর বয়সী পুরুষ ও সাতচল্লিশ বছর বয়সী নারীর চোখের কামনা কি শুধুই ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক, নাকি শরীরী চাহিদাও সেখানে হানা দিয়েছিল? তাদের প্রেমটাকে খুব কাছ থেকে অবলোকন করেছিলেন এডুইনার কন্যা পামেলা, যার বয়স তখন সবে ১৭। তার দাবি, তার মায়ের সাথে ভারতের ভাবি প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কটা কোনোক্রমেই শারীরিক ছিল না। তার মা ছিলেন ধীশক্তিকামী, আত্মার আন্তরিকতার আশায় তৃষিত। আর সেই পিপাসী প্রাণে শান্তির বারি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন ‘পণ্ডিতজি’।
এডুইনার প্রতি জওহরের ভালোবাসা এতটাই তীব্র ও সুগভীর ছিল যে, তিনি পৃথিবীর যেখানেই যেতেন সেখান থেকেই এক টুকরো ভালোবাসা কুড়িয়ে আনতেন প্রিয় মানুষটির জন্য। কখনো যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে আসতেন চিনি, মিশর থেকে সিগারেট, সিকিম থেকে ফার্ন। একবার উড়িষ্যা গিয়ে সূর্যদেবতার মন্দির থেকে কামোন্মত্ত ভাস্কর্যের ছবিও তুলে এনেছিলেন। সেই ছবিগুলো এডুইনাকে পাঠিয়ে লিখেছিলেন:
আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এগুলো দেখে আমি ক্ষণকালের জন্য শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। তবে এ কথা স্বীকারে কোনো লজ্জা নেই। প্রয়োজন নেই এ অনুভূতি আড়ালেরও।
চিঠির ভাষা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কামদ ভাস্কর্যের পানে চেয়ে এডুইনাকেই স্মরণ করেছিলেন জওহর। তবে তাদের সম্পর্কের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটন সম্ভব এডুইনার প্রত্যুত্তর থেকেই:
আমি আসলে নিছক যৌনতা হিসেবে যৌনতায় আগ্রহী নই। সেখানে অবশ্যই আরো বেশি কিছু থাকতে হবে, আত্মার সৌন্দর্য ও রূপ, এবং সেই বোধশক্তির ধারণ। কিন্তু আমি মনে করি তুমি আর আমি পড়ি সংখ্যালঘুর কাতারে! আমাদের মিলন দুর্লভ।
অবশ্য জওহর-এডুইনার এই পরকীয়া প্রেম কিংবা বন্ধুবিলাসেও ছিল যথেষ্ট লুকোছাপা, সত্যকে আড়ালের প্রচেষ্টা। এডুইনা স্বামীর অগোচরে গোপন অভিসারের আমন্ত্রণ জানাতেন জওহরকে, এবং সে আমন্ত্রণপত্রের ভাষাও এ জাতীয় অন্যান্য পত্রের তুলনায় খুব একটা ব্যতিক্রম কিছু ছিল না।
“ডিকি আজ রাতে বাইরে থাকবে – চলে এসো রাত দশটার পরে।”
“তুমি আজ তোমার রুমালটা ফেলে গিয়েছিলে। তবে ভয় নেই, ডিকির হাতে পড়ার আগেই আমি সেটি লুকিয়ে ফেলেছিলাম।”
“সিমলার স্মৃতিগুলো আমার খুবই প্রিয় – আরোহণ ও তোমার স্পর্শের।”
তবে এই লুকোছাপার নেপথ্যে কী কারণ থাকতে পারে, তা আজো রহস্যাবৃত। কেননা জওহরের সাথে এডুইনার সম্পর্কের ব্যাপারে যে গোড়া থেকেই সব জানতেন ডিকি। এমনকি এতে তার প্রচ্ছন্ন আস্কারাও ছিল। কাছের মানুষদের কাছে সেই প্রশ্রয়তা প্রকাশেও তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন,
এডুইনা ভালো আছে। নেহেরুর সাথে ওর বনে ভালো। ওরা যখন একসাথে থাকে, তখন বড় সুখে থাকে। ভালো থাকুক ওরা।
এডুইনার অনেক প্রাক্তন প্রেমিকের ব্যাপারেই মনে মনে ক্ষুণ্ণ ছিলেন ডিকি। কিন্তু জওহর সেই ব্যতিক্রমতম পুরুষ, যার সান্নিধ্যে স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে পরম নিশ্চিন্ত ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয়।
৬.
কথিত আছে, ভারতকে টুকরো টুকরো করে দিয়ে মাউন্টব্যাটেনরা যখন ব্রিটেনের উদ্দেশে রওনা হচ্ছিলেন, তার আগে এডুইনা চেয়েছিলেন জওহরকে একটি অত্যন্ত দামি হীরার আংটি উপহার দিয়ে যেতে। কিন্তু জওহর অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন সেই আংটি গ্রহণে। তাই এডুইনা আংটিটি তুলে দিয়েছিলেন জওহরের কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর হাতে। বলেছিলেন, কখনো আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন হলে সে যেন আংটিটিকে কাজে লাগায়।
ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও জওহরের সাথে চিঠি মারফত যোগাযোগ অব্যাহত ছিল এডুইনার। পরস্পরের সাথে অসংখ্য চিঠি আদান-প্রদান করেছিলেন তারা। ৫৯ বছর বয়সে যখন আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান এডুইনা, ঠিক তার শিয়রের পাশেই রাখা ছিল এক ট্রাঙ্কভর্তি চিঠি। নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, চিঠিগুলো কার!
এডুইনার ইচ্ছে ছিল, তার শেষ ঠিকানা যেন হয় সাগরের বুকে। তার সেই ইচ্ছা পূরণ করা হয়েছিল। এদিকে প্রিয়তমার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেখানে, যেখানে সমাহিত করা হয়েছিল এডুইনাকে। নৌবাহিনী জওহরের পক্ষ থেকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেছিল এডুইনার সলিল সমাধিতে।
পরবর্তীতে এডুইনার স্মরণসভায় হাজির হয়েছিলেন জওহর। সরাসরি এডুইনাকে সম্বোধন করে তিনি বলেছিলেন:
তুমি যেখানেই চলে গিয়ে থাকো না কেন, তুমি আমার মনে এনে দিয়েছিলেন স্বস্তি, এনে দিয়েছিলে আশা, এনে দিয়েছিলে অনুপ্রেরণা। তাই এটি কি খুব বেশি বিস্ময়কর যে আজ যখন তুমি চলে যাচ্ছ, ভারতের মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে, তোমাকে নিজেদের একজন মনে করবে, এবং তোমার শোকে অভিভূত হবে?
৭.
কিন্তু, বাস্তবিকই ভারতবাসী এডুইনার বিদায়ে শোকসন্তপ্ত হয়েছিল কি না, তা যেমন প্রশ্নসাপেক্ষ, তেমনই সন্দেহের অবকাশ রয়েছে জওহর-এডুইনার এই প্রেমকাহিনীর নির্মলতা প্রসঙ্গেও। কারণ অনেকেরই ধারণা, তাদের দুজনের প্রেম কেবল তাদের দুজনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং প্রভাবিত করেছিল গোটা ভারতবর্ষকেই।
মাওলানা আজাদের যেমন দৃঢ় বিশ্বাস, ভারত ভাগ করার ব্যাপারে জওহরকে রাজি করানোয় মুখ্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন এডুইনা। স্বামীর চিন্তা-ভাবনা তিনি ভাগ করে নিয়েছিলেন জওহরের সাথে, এবং জওহরের উপর স্বীয় প্রভাব খাটিয়ে তার সম্মতিও আদায় করে নিয়েছিলেন।
এ কারণেই ‘যারা ভোর এনেছিল’ উপন্যাসে আনিসুল হক ব্যাঙ্গমার মুখ দিয়ে বলান:
নেহরু এডুনা করে পিরিতি যখন।
মাউন্টব্যাটেন ভাঙে ভারত তখন।।
কলমের দাগ দিয়া খণ্ডিল ভারতে।
এডুনা নেহরু ওড়ে ভালোবাসা রথে।।
এক বাক্স চিঠি লিখবে প্রেমিক যুগলে।
এই কথা লেখা থাকে কর্তিত ভূগোলে।।
এডুনার মাথা নিল নেহরু কিইনা।
পোকা কাটা পাকিস্তান পাইল জিন্নাহ।।
তাহলে বুঝতেই পারছেন, দশ লক্ষাধিক ভারতবাসীর মৃত্যু কিংবা আরো প্রায় দেড় কোটি মানুষের দেশান্তরী কিংবা নির্বাসিত হওয়ার পেছনে জওহর-এডুইনার এই ঐতিহাসিক প্রেমের প্রভাবক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না!