বর্তমান স্পেনের সরিয়া অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে ডুরিয়াস (Durius) নদী। ডুরিয়াস ও এর শাখার মাঝখানে পাহাড়ের উপরাংশ জুড়ে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন নুম্যানশিয়া (Numantia)। কেল্টিবেরিয়ান জাতির একটি গোষ্ঠী, আরেভাকি (Arevaci) বাস করত এখানে। আরেভাকিরা ছিল কেল্টিবেরিয়ানদের মধ্যে অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং নুম্যানশিয়া ছিল তাদের প্রধান ঘাঁটি। পাহাড়ের উপর প্রাকৃতিকভাবেই নগরটি যথেষ্ট সুরক্ষিত ছিল, এছাড়া নগরপ্রাচীরও ছিল শক্তিশালী।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট
হিস্পানিয়াতে প্রাধান্য বিস্তারের তাগিদে বিভিন্ন স্প্যানিশ জাতির সাথে রোম লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছিল। লুসিটানিয়ান ও কেল্টিবেরিয়ানদের অন্যান্য গোত্রের সাথে বিবাদ চলাকালে নুম্যানশিয়াও রোমের দৃষ্টিসীমায় চলে আসে। আরেভাকি ও তাদের আঞ্চলিক মিত্ররা তখন আশেপাশের এলাকাতে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চাচ্ছিল। কাজেই রোমের সাথে সংঘাত ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে নুম্যান্টাইনরা সব সময়েই রোমের সাথে শান্তি বজায় রেখে থাকতে চেয়েছিল। তারা কোনো সময়েই রোমের উপর আক্রমণ চালায়নি, বরং বার বার রোমান হামলা প্রতিরোধ করেছে।
নুম্যানশিয়া অবরোধ ও রোমের সাথে সন্ধি
কন্সাল নোবিলিওর (Fulvius Nobilior) তার বাহিনী নিয়ে ১৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম নুম্যানশিয়া অবরোধ করলেন। তিনি মনে করেছিলেন সহজেই এদের পদানত করে লুণ্ঠন চালান যাবে। কিন্তু নুম্যান্টাইনরা অন্যান্য স্প্যানিশ গোত্রের মতোই দক্ষ যোদ্ধা ছিল। নগরবাসীর প্রচণ্ড বাধার মুখে রোমান সেনাদল অগ্রসর হতে পারল না। নোবিলিওরকে পিছিয়ে আসতে হয়।
নোবিলিওরের উত্তরসূরি হিসেবে আসলেন মার্সেলাস (Claudius Marcellus)। তিনি নতুন করে আক্রমণ না করে পরবর্তী বছর নুম্যান্টাইনদের সাথে শান্তিচুক্তি করেন। এরপর মোটামুটি দশ বছর এই এলাকা স্থিতিশীল ছিল।
নুম্যান্টাইনদের অস্ত্রধারণ
১৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিস্পানিয়াতে রোমান গভর্নর ছিলেন মেটেলাস (Caecilius Metellus)। এই সময় ভিরিথিয়াসের প্ররোচনায় আরেভাকিরা আবার রোমের বিপক্ষে অস্ত্র তুলে নেয়। মেটেলাস দ্রুত সেনাদল নিয়ে আরেভাকিদের এলাকায় প্রবেশ করলেন। তিনি পরের বছর পর্যন্ত অবস্থান করে এখানকার বেশ কিছু শহর রোমানদের অধীনে নিয়ে আসেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কন্ট্রেবিয়া (Contrebia) যা নুম্যানশিয়ার ৮০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। কেবলমাত্র নুম্যানশিয়া ও প্রতিবেশী টারমেনশিয়া (Termantia) রোমান আগ্রাসন প্রতিহত করে টিকে থাকতে সক্ষম হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, মেটেলাস এই দুই শহরে শক্ত বাধা আশঙ্কা করে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। তার নজর ছিল কেবলমাত্র যেসব শহর সহজেই কব্জা করা যাবে সেদিকে।
১৪১-১৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
১৪১-১৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিস্পানিয়ার গভর্নর ছিলেন পম্পিয়াস (Quintus Pompeius)। ৩০,০০০ সেনা নিয়ে তিনি ৮,০০০ নুম্যান্টাইনকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। নোবিলিওরের মতোই পরিণতি তাকে বরণ করতে হয়। এবার তিনি তার আক্রমণের দিক পরিবর্তন করে টারমেনশিয়ার দিকে অগ্রসর হলেন। কিন্তু এখানেও তিনি ব্যর্থ হন। এদিকে শীত চলে আসছিল। হতাশ পম্পিয়াস কোথাও না গিয়ে নুম্যানশিয়ার কাছেই শীতকালীন ক্যাম্প করে কাটালেন।
শীত শেষ হলে ১৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পম্পিয়াস নুম্যান্টাইনদের সাথে রোমের অনুকূলে চুক্তি করতে সমর্থ হন। শর্ত অনুযায়ী নুম্যান্টাইনরা রোমান যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দেয়, রোমানদের কাছে জিম্মি হিসেবে বেশ কিছু নুম্যান্টাইনকে সমর্পণ করে, এমনকি ৩০ ট্যালেন্ট ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি হয়। কিন্তু পম্পিয়াস কখনোই এই চুক্তিকে সম্মান করার ইচ্ছা পোষণ করেননি। তিনি সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন। তাই পরবর্তী রোমান গভর্নর লেইনাস (Popillius Laenas) এসে পৌঁছানোমাত্র পম্পিয়াস তার আসল চেহারা প্রকাশ করেন। তিনি নুম্যান্টাইনদের সাথে সন্ধি বাতিল ঘোষণা করে রোমান বাহিনীর আক্রমণের পথ প্রশস্ত করে দিলেন।
লেইনাস এক বছর সময় নিলেন নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার জন্য। অবশেষে ১৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি নুম্যানশিয়া আক্রমণ করেন। ফের রোমান সেনাদল পরাজিত হলো। তবে রোমানদের এই বছর একটা লাভ হলো যখন টারমেনশিয়া রোমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সুতরাং একমাত্র কেল্টিবেরিয়ান গোষ্ঠী হিসেবে রোমের বিরুদ্ধে নুম্যান্টাইনরাই অবশিষ্ট রইল। ফলে নুম্যানশিয়া দখল করে নিতে রোমের সংকল্প আরও দৃঢ় হয়।
ম্যানসিনাসের পরাজয়
লেইনাস উত্তরসূরি ম্যানসিনাসের (Hostilius Mancinus) হাতে একটি ভঙ্গুর সেনাদল তুলে দিয়ে রোমে ফিরে গেলেন। ম্যানসিনাস নিজেও কম্যান্ডার হিসেবে ছিলেন অযোগ্য। ২০,০০০ সৈন্য নিয়ে তিনি নুম্যান্টাইনদের মোকাবেলা করলেন। কিন্তু অদক্ষ সেনাদল আর অযোগ্য নেতৃত্বে রোমানরা পরাজিত হয়। তিনি যখন পিছিয়ে আসছিলেন তখন পশ্চিম দিক থেকে আরেক স্প্যানিশ গোত্র ভ্যাকেইদের (Vaccaei) বাহিনী নুম্যান্টাইনদের সহায়তায় এগিয়ে আসার সংবাদ পেলেন। নুম্যান্টাইনরাও নতুন উদ্যমে রোমান বাহিনীকে ধাওয়া করে এক পাহাড়ি উপত্যকাতে তাদের ঘিরে ফেলল।
নুম্যান্টাইনদের মূল উদ্দেশ্য ছিল রোমানদের ধ্বংস করা নয়, বরং তাদের সাথে সন্ধি করে শান্তিতে বসবাস করা। অনন্যোপায় ম্যানসিনাস নিজের এবং সেনাদের প্রাণ রক্ষার্থে নুম্যান্টাইনদের সাথে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হলেন। তিনি বেঁচে ফিরে এলেও সিনেট ক্রোধান্বিতভাবে এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করল এবং শৃঙ্খলিত ম্যানসিনাসকে নুম্যানশিয়াতে প্রেরণ করে। কিন্তু নুম্যান্টাইনরা কোন ক্ষতি না করেই তাকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
নুম্যানশিয়ার পতন
বার বার নুম্যান্টাইনদের হাতে পরাস্ত হতে থাকায় রোমান সিনেটের কাছে এই নগরী মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই তারা তৎকালীন শ্রেষ্ঠ রোমান জেনারেল সিপিও অ্যামেলিয়ানাসকে (scipio aemilianus) কন্সাল করে ১৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিস্পানিয়া পাঠাল। প্রায় ৬০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী তার কম্যান্ডের অধীন করা হলো। তার অফিসারদের অন্যতম মারিয়াস, যিনি নিজেই পড়ে হয়ে উঠেছিলেন রোমের প্রথিতযশা এক জেনারেল। এছাড়া নুমিডিয়ান যুবরাজ জুগুর্থা (Jugurtha) ১২টি হাতি আর কিছু সেনা নিয়ে এই অভিযানে শামিল হলেন।
অ্যামেলিয়ানাস ভ্যাকেইদের পরাস্ত করে নুম্যানশিয়া অবরুদ্ধ করলেন। শহরের চারিদিকে অস্থায়ী প্রাচীর নির্মাণ করে সম্পূর্ণভাবে বেষ্টন করা হলো। এছাড়াও আশেপাশের পাহাড়ে তিনি সাতটি রোমান শিবির স্থাপন করলেন। ডুরিয়াস নদী ধরে যাতে কোনো সাহায্য নুম্যান্টাইনদের কাছে আসতে না পারে সেজন্য নদীপথে পাহারা জোরদার করা হলো।
অনেকবার চেষ্টা করার পরেও নুম্যান্টাইনরা অবরোধ ভাঙতে ব্যর্থ হলো। পার্শ্ববর্তী স্প্যানিশ গোত্রের কাছে সহায়তার আবেদন জানিয়েও তারা সাড়া পেল না। সিপিওর কঠিন অবরোধে শহরে দেখা দিল তীব্র দুর্ভিক্ষ। নয় মাস, মতান্তরে পনের মাস অবরুদ্ধ থাকার পর অবশিষ্ট কয়েক হাজার ক্ষুৎপিপাসায় কঙ্কালসার নুম্যান্টাইন আত্মসমর্পণ করে। সিপিও পুরো শহর জ্বালিয়ে দেন।
স্প্যানিশ গোত্রগুলোর বশ্যতা স্বীকারের পর দশজন রোমান সিনেটর হিস্পানিয়া পুনর্গঠন করলেন। এরপর প্রায় চার দশক কোনো যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াই কেটে গেল।