২০২০ সালে অকস্মাৎ বিশ্ব জুড়ে আঘাত হানল এক অদৃশ্য শত্রু। করোনা সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেতে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব নানা পদক্ষেপ নেয়া হলো। নিউ ইয়র্কের টাইম স্কয়ার, লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ কিংবা আমাদের ঢাকার সদরঘাটের মতো জনাকীর্ণ এলাকাগুলো মানুষের অভাবে খাঁ খাঁ করতে থাকল। এ ব্যবস্থা ছাড়া উপায়ও ছিল না, মার্চ মাস নাগাদই ইউরোপে শুরু হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর মিছিল। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য থেকে শুরু গোটা ইউরোপবাসীর তখন দিশেহারা অবস্থা। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের হারের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল আর রাশিয়া উপরের দিকে থাকলে প্রথমদিকে মূল ঝড়টা গেছে ইউরোপের ওপর দিয়ে।
তবে সেসময়ে ইউরোপের একটা দেশ হাঁটতে লাগল উল্টোপথে। সাম্প্রতিক খবরাখবর সম্পর্কে ধারণা রাখেন যারা, এমন অনেকেই জানেন সুইডেনের কথা।
এই একটি দেশেই এখন পর্যন্ত একদিনও করোনার কারণে লকডাউন দেয়া হয়নি। অন্যান্য দেশে যেখানে জুমে অনলাইন ক্লাস কিংবা অফিস চালানো হচ্ছে, সেখানে সুইডিশ জনগণ কোনো ছুটিই পাননি। স্কুল, রেস্তোরাঁ, মার্কেট, খেলার মাঠ কোনো জায়গাই জনশূন্য হয়ে পড়েনি। সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ জনের জনসমাগম করার অনুমতি পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। দেশের সীমানা কিংবা নৌবন্দরও বন্ধ করা হয়নি। ‘কোয়ারেন্টিন’, ‘লকডাউন’, এই বিষয়গুলো দূর থেকেই দেখে গেছেন সুইডেনবাসী, কিন্তু কখনো প্রয়োগ করেননি। দেশটির এই হার্ড ইমিউনিটি স্ট্র্যাটেজি সেসময়ে আলোচনার ঝড় তোলে।
হার্ড ইমিউনিটি আসলে কী? যেকোনো ছোঁয়াচে রোগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষের মাঝে ঐ রোগ ছড়িয়ে পড়লে আস্তে আস্তে তা ছড়ানোর মাত্রা কমে আসে। এর দুটি কারণ। প্রথমত, যারা আক্রান্ত হয়, তাদেরকে ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে সুস্থ করা হয়। আর দ্বিতীয়ত, যারা কোনো ভ্যাক্সিন ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠে, তাদের শরীরে এই জীবাণু প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়। ফলে, তাদের দ্বারা এই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে না। সুতরাং সংক্রমণের হার বাধাগ্রস্ত হতে হতে আস্তে আস্তে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।
যুক্তরাজ্যের গবেষকদের মতে, একটি জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৬০ শতাংশ মানুষ যদি নির্দিষ্ট কোনো রোগ বা সংক্রামকের প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, তাহলে তাদের মাধ্যমে বাকি ৪০ শতাংশ সংবেদনশীল মানুষের মাঝে আর সে রোগ ছড়াতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বলছে, এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকতে হবে কমপক্ষে ৭০ শতাংশ মানুষের মাঝে। তাহলেই কেবল বাকিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ১৯৮০ সালে প্রথমবারের মতো এই হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের মাধ্যমে বিশ্ব থেকে গুটি বসন্ত সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়েছিল। একে পপুলেশন ইম্যুনিটি নামেও ডাকা হয়।
শুধু করোনা প্রতিরোধ নয়, দেশের অর্থনীতির স্বার্থেও ব্যাপারটি কাজে লাগিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল সুইডেন। কিন্তু জীবাণুর সাথে এই যুদ্ধে কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হিসেবে বহু মানুষের মৃত্যুর শঙ্কা থেকে যায়। সুইডিশ নাগরিকদের বড় একটি অংশ তাই এ নীতির কঠোর সমালোচনা করে কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখলেও সরকার পিছিয়ে আসেনি।
সরকারপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নিয়মানুবর্তী সুইডিশ জাতি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মেনে চললে খুব বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বে না। সেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ২৫ জন মানুষ বসবাস করে। তাছাড়া সামনেই আসছে গ্রীষ্মকাল, সুতরাং খুব বেশি সমস্যা হবে না।
অবশ্য দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্টেফান লোভফ্যান এপ্রিল মাসের দিকে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুঝুঁকিতে থাকার কথা স্বীকার করে সবাইকে সতর্ক করেছিলেন। দেশের বিরোধী দলীয় নেতা জিমি অ্যাকিসন একে ম্যাসাকারের সাথে তুলনা করেন। কিন্তু এ মাশুল দিয়েও কিন্তু সুইডেন হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে পারেনি।
সেসময়ে দেশটির প্রধান এপিডেমিওলজিস্ট অ্যান্ডার্স টেগনেল সবাইকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, মে মাসের শেষ নাগাদ স্টকহোমের ৪০ শতাংশ মানুষ করোনা থেকে ইমিউন হয়ে যাবে। কিন্তু মে মাসের শেষে এসে জরিপ করে দেখা গেল, মাত্র ৬.১ শতাংশ মানুষের শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়েছে।
তো এই জুলাই মাসে এসে সুইডেনের করোনা পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছাল? এ দেশে এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৭৪,৮৯৮ জন, মৃতের সংখ্যা ৫,৫২৬ জন। এটি তাদের নর্ডিক প্রতিবেশী নরওয়ের মৃতের সংখ্যার ১২ গুণ।
সুইডেনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা অবশ্য বারবার বলে যাচ্ছেন, হার্ড ইমিউনিটি অর্জনই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। দ্বিতীয় দফা করোনা সংক্রমণ হলে অধিক রোগীর চাপে যাতে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে না পড়ে, তার জন্যই মূলত এই ভিন্নধর্মী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এদিকে করোনা মহামারির সবচেয়ে ভয়াবহ শিকার হওয়া একটি দেশ হলো স্পেন। গড়ে প্রতি মিলিয়নে ৬০৭ জন মানুষ মারা গেছে এখন পর্যন্ত। মেডিকেল সাময়িকী ল্যানসেটের সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, স্পেনের জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ অ্যান্টিবডি এখনও হার্ড ইমিউনিটির পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। জরিপে স্পেনের ৬০ হাজারের বেশি মানুষ অংশ নেয়। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এটি ইউরোপে চালানো সবচেয়ে বড় জরিপ। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, করোনা থেকে সুস্থ মানুষদের মাঝে মাত্র পাঁচ শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।
বোঝাই যাচ্ছে, ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হোক বা না হোক, করোনা ঠেকানোর ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি প্রক্রিয়া খুব একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে না। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে চিন্তা করতে গেলে এর পরিণতি হবে আরো ভয়ানক। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ৭০ ভাগ মানুষ অসুস্থ হলে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। দেশের এই চিকিৎসা অবকাঠামো নিয়ে কোনোভাবেই তাদের জীবন বাঁচানো যাবে না। আপাতত যেকোনো উপায়ে সংক্রমণ এড়িয়ে চলা এবং আংশিক লকডাউন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়াই তাই নিরাপদ।