দিনটি ছিল ১৯৯০ সালের ২৬ জুলাই। নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের ইতিহাসে দিনটি আজও অমর হয়ে আছে এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক তৈরি করে। ৩ দশক আগে এ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ অ্যামেরিকান ডিজ্যাবিলিটি অ্যাক্টে স্বাক্ষর করেন। যুগান্তকারী এই আইন স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তিনি বলেন,
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সম-অধিকার বিবেচনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার মূলনীতির প্রতি সুবিচার করতে সক্ষম হয়নি সবসময়। পরিতাপের বিষয় এই যে বহু আমেরিকানের জন্যই সাম্যের আশীর্বাদকে আমরা সুদীর্ঘকাল যাবত সীমাবদ্ধ কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে অস্বীকারও করে এসেছি। আজ এই আইন পাসের ঘটনাটি আমাদের সেই দিনের কাছেই নিয়ে এসেছে যেদিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নাগরিককেই জীবনের নিরাপত্তা, মুক্তির স্বাদ এবং সুখের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হতে হবে না।
অ্যামেরিকান ডিজ্যাবিলিটি অ্যাক্ট শুধু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অধিকার সংরক্ষণেই সচেষ্ট হয়নি উপরন্তু তাদের সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি সকল নাগরিকের মনোভাবকে গোড়া থেকে ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে। বৈপ্লবিক এই আইন পাসের ৩০ বছর পূর্তিতে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়- ভোটাধিকার প্রয়োগ এবং অবাধ-সুষ্ঠু বিশ্ব ভ্রমণ।
বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ সালের আগে প্রচলিত আইনসমূহের মাঝে ছিল রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩, এডুকেশন অফ অল হ্যান্ডিক্যাপড চিলড্রেন অ্যাক্ট ১৯৭৪, ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্ট ১৯৬৮। এই আইনসমূহের আওতায় কারিগরি প্রশিক্ষণ, নিরাপদ আবাসন, সরকারি ভবনের সুবিধাদি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হতো।
১৯৮৬ সালে ন্যাশনাল কাউন্সিল অন ডিজ্যাবিলিটি ‘টুওয়ার্ড ইন্ডিপেন্ডেন্স’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এতে বেশ কিছু নতুন কার্যক্রমের কথা উল্লেখপূর্বক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের রূপরেখা প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাবনার প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষা থেকে কর্ম অর্থাৎ সমাজের প্রতিটি স্তরে এসব ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা ও মর্যাদাবোধ সমুন্নত রাখতে অবদান রাখা।
২ বছর পর অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে কর্তৃপক্ষ তাদের প্রস্তাবনার অগ্রগতি সম্পর্কে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে যাতে প্রস্তাবিত কার্যক্রমসমূহের শতকরা ৮০ ভাগের আংশিক থেকে সম্পূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। নাগরিক অধিকারের সর্বোচ্চ প্রয়োগের কথা বিবেচনা করলে তখনও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের বেশ কিছু বঞ্চনার জায়গা ছিল আর সেসব পূরণের উদ্দেশ্যেই অ্যামেরিকান ডিজ্যাবিলিটি অ্যাক্টের জন্ম। দৈনন্দিন জীবনে তারা হরহামেশাই যেসব অসমতার শিকার হতেন:
- হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী কোনো ব্যক্তির বাস বা ট্রেনে করে যাতায়াত করতে হলে তাকে হুইলচেয়ার ছাড়াই বাস বা ট্রেনে উঠতে হবে অর্থাৎ ব্যক্তি যানবাহন ব্যবহার করতে পারবেন তবে তার নিত্য প্রয়োজনীয় হুইলচেয়ার ব্যতীত।
- ট্রেনের শৌচাগার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য অভিগম্য ছিল না বিধায় তারা সতর্কতা হিসেবে ডায়াপার পরিধান করতেন।
- একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কর্মরত ব্যক্তিকে তার প্রতিষ্ঠান আইনানুগভাবে সুস্থ(!) সহকর্মীর তুলনায় কম পারিশ্রমিক দেওয়ার অধিকার রাখত এমনকি তিনি যদি অন্যান্যদের সমান বা বেশি কাজও করতেন।
- যেকোনো প্রতিষ্ঠান একজন ব্যক্তিকে কেবল তার শারীরিক সীমাবদ্ধতার দরুন নিয়োগ প্রদান করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের আইনি বৈধতা ভোগ করত।
- সমকামীদেরকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাথে এক কাতারে ফেলা হত। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সুনির্দিষ্ট কোনো সাংবিধানিক সংজ্ঞা ছিল না এবং ১৯৭৩ সালের আগ পর্যন্ত সমকামীতাকে একটি রোগ বলে বিবেচনা করা হতো।
- নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের কোনো দোকান একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে পণ্য ক্রয় করা থেকে রহিত করতে পারত।
- হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী কোনো ব্যক্তি শারীরিকভাবে গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতে পারলেও হুইলচেয়ারের অজুহাতে তাকে গ্রন্থাগারের কোনো বই ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হতো না। তার হুইলচেয়ার ব্যবহার অন্যদের গ্রন্থাগারের পরিবেশ বিনষ্ট করবে স্রেফ এই যুক্তিতে তিনি গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতে পারলেও তার ভেতরটা ঘুরে দেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন।
- রেস্তোরাঁগুলো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারত।
১৯৯০ সালের ২৬ জুলাই আমেরিকান ডিজ্যাবিলিটি অ্যাক্ট স্বাক্ষরিত হলে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার যাত্রায় এক দিগন্ত রচিত হয়। এই আইনটির মৌলিক ভিত্তি ছিল চারটি- কর্মসংস্থান, প্রাদেশিক ও কেন্দ্র সরকার, জনজীবনে নিরাপদ আবাসন এবং টেলিযোগাযোগ। নব্বই পরবর্তী বছরগুলোতে ধীরে ধীরে এ প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হতে থাকে।
এই আইনের বদৌলতে ধীরে ধীরে তাদের জীবনযাত্রার ধরন বদলে যেতে শুরু করে। কর্মসংস্থানে যেসব বৈষম্যের শিকার হচ্ছিলেন সেগুলো থেকে তারা রেহাই পেতে শুরু করলেন। সরকারি এবং বাণিজ্যিক সকল সুবিধাদি ভোগের ক্ষেত্রে তারা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই বিবেচিত হতে লাগলেন।
আবাসিক-অনাবাসিক সবধরনের হোটেলে বাক ও শ্রবণ সমস্যার অধিকারীরা যোগাযোগ করতে সক্ষম হলেন বিশেষায়িত জাতীয় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে। চলাচলে সীমাবদ্ধতার অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য গণপরিবহন, বিমানবন্দর, স্কুল-কলেজ, সরকারি ভবনসহ সকল স্থাপনায় লিফট, শাটল, র্যাম্প (হুইলচেয়ার চালনার জন্য নির্মিত ঢালু পথ), কার্ব কাট (ফুটপাত থেকে মূল সড়কে নেমে যাওয়া মসৃণ পথ) ইত্যাদি সুবিধার প্রচলন শুরু হয়। জনজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই অ্যাক্ট কাজ করে যেতে থাকে।
ন্যাশনাল কাউন্সিল অন ডিজ্যাবিলিটির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন জাস্টিন ডার্ট। অ্যামেরিকান ডিজ্যাবিলিটি অ্যাক্ট (ADA) পাসের পেছনে তার অবদানের জন্য তাকে অভিহিত করা হয়ে থাকে ‘ফাদার অভ অ্যাডা’ উপাধিতে। ডিজ্যাবিলিটি অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর তিনি লিখেন,
পৃথিবীর ইতিহাসে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য এটিই প্রথম সমতার বাণী ঘোষণা করছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় বরং সমগ্র বিশ্বের কাছে এ আইন এই বার্তাই পৌঁছে দিতে চায় যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা অবশ্যই পূর্ণ মানুষ; তাদের প্রতি সব রকমের বৈষম্যমূলক, পৃথকীকরণ নীতির আশু অবসান ঘটানো প্রয়োজন। সমাজের অন্যান্য সকলের মতোই সর্বপ্রকারের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা এবং যথাযোগ্য মর্যাদা প্রাপ্তি তাদের নাগরিক অধিকার। ডিজ্যাবিলিটি অ্যাক্ট কোনোভাবেই চূড়ান্ত কোনো সমাধান নয়। এটি কেবল সমতা আর ভারসাম্য আনয়নের পথে যাত্রার প্রারম্ভিকতা মাত্র। এই অর্জন ভবিষ্যতের অসংখ্য পরিবর্তন আর সমাধানের একটি শক্ত ভিত হিসেবে কাজ করবে বলে আমরা আশাবাদী।
ডিজ্যাবিলিটি অ্যাক্ট সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের ২০ টিরও বেশি রুল রয়েছে। এদের মাঝে ৪টি ডিজ্যাবিলিটির সংজ্ঞা নিরূপণে যথেষ্ট ঔদার্যের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যতম একটি রুল অনুসারে কর্মক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাকেও একধরনের বৈষম্য বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতাকে কেন্দ্র করে ২০০৮ ও ২০১৫ সালে এসেছে দুটি সংশোধনী। এসব অগ্রগতির কারণে ক্রমে ক্রমে ১৯৯০ সালের সেই যুগান্তকারী সূচনা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে করে তুলেছে আরো একটু মানবিক, ও ভারসাম্যপূর্ণ।