আইফোন ভালো, নাকি অ্যান্ড্রয়েড?
অ্যাপল ম্যাপস না গুগল ম্যাপস?
কোন ব্রাউজার ভালো? সাফারি, নাকি ক্রোম?
আপনি যদি স্মার্টফোন ব্যবহারকারী হন, তাহলে কখনো না কখনো এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হয়েছেন কিংবা সামাজিক মাধ্যমে এ সম্পর্কিত বাকযুদ্ধ চোখে পড়েছে। এই প্রশ্নগুলো থেকে মনে হয়, অ্যাপল আর গুগল প্রযুক্তি দুনিয়ায় একটি চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। পর্দার পেছনের দৃশ্যটি কিন্তু অনেকটাই ভিন্ন। এই দুইটি প্রযুক্তি জায়ান্টের মধ্যে রয়েছে কয়েক বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি, যেখান থেকে তারা উভয়েই বিশাল অঙ্কের লাভ করছে।
বাজার বিশ্লেষকদের ধারণা অনুযায়ী, গুগল প্রতি বছরে অ্যাপলকে আট থেকে বারো বিলিয়ন ডলার প্রদান করে। এ অর্থ খরচের উদ্দেশ্য হচ্ছে, অ্যাপলের সবগুলো ডিভাইসে যেন ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে গুগলকে ব্যবহার করা হয়। বুঝতেই পারছেন, গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের প্রায় অর্ধেক মুনাফা আসে অ্যাপল ডিভাইস থেকে এবং ইন্টারনেট দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তারে এটা গুগলকে বিশাল পরিমাণ সুযোগ দেয়।
চুক্তিটি এতই শক্তিশালী যে গুগলের বিরুদ্ধে গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিগত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় অ্যান্টিট্রাস্ট মামলাটি করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে বড় দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে কীভাবে প্রযুক্তি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় একটি পার্টনারশিপ তৈরি হয়েছে?
গুগলের ইতিহাসের প্রথমদিকে, অ্যাপলের সাথে তাদের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজ ও সার্গি ব্রিন সে সময়ে স্টিভ জবসকে একজন মেন্টর হিসেবে দেখতেন। অনেকসময় তাদেরকে একসাথে দেখা যেত। গুগলের সে সময়কার সিইও অ্যাপলের বোর্ড অভ কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। ২০০৫ সালে গুগল একটি চুক্তি করেছিল, যেন ম্যাক কম্পিউটারে ব্যবহৃত ব্রাউজার সাফারিতে ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে গুগল ইনস্টল করা থাকে। এরপরে, ২০০৭ সালে যখন প্রথম আইফোন ঘোষণা করা হয়, গুগল সেখানেও ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে জায়গা পেল। এ জায়গা থেকে গুগল ধীরে ধীরে বড় কোম্পানি হওয়া শুরু করেছিল।
গুগল শুধুমাত্র সার্চ ইঞ্জিন কোম্পানিতে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইল না। তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করল। ফলে, অ্যাপলের সাথে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও শুরু হলো। ২০০৮ সালে, অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের ঘোষণা দিয়ে সরাসরি অ্যাপলের ব্যবসায় তারা আঘাত করে। পরের বছরই, গুগলের প্রধান নির্বাহী এরিক স্মিডট অ্যাপলের বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। এরপর থেকে ক্রমেই তারা একে অপরের ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে থাকল। যেমন: প্লে স্টোরের প্রতিযোগী হলো অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর, সিরির প্রতিদ্বন্দ্বী হলো গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট।
মোবাইল অ্যাসিস্ট্যান্ট সিরিতে প্রথমদিকে সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে মাইক্রোসফটের বিং ব্যবহৃত হতো। ২০১৭ সালে এসে, বিং থেকে গুগলে পরিবর্তন করা হয়েছিল। সে সময়ে অ্যাপল ও গুগলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক ও সুন্দর পিচাইকে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ভিয়েতনামী রেস্তোরাঁয় একসাথে ডিনার করতে দেখা গিয়েছিল। দু’টি কোম্পানির মধ্যে যখন নতুন করে একটি চুক্তি হচ্ছিল, সে সময়ে উভয়ের জন্যেই তা অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল। ফেসবুকের দ্রুতবেগে বৃদ্ধি পাওয়া বিজ্ঞাপনের ব্যবসার জন্য গুগল তুমুল প্রতিযোগিতার শিকার হয়। সে সময়ে, অ্যাপলের সাথে চুক্তিটি বিলিয়নেরও বেশি ডিভাইসে তাদের পণ্যটি রাতারাতি ছড়িয়ে দিয়েছিল। এখন গুগলের প্রায় অর্ধেক সার্চ আসে অ্যাপল ডিভাইস থেকে। আইফোনে কিছু সার্চ করলেই সরাসরি গুগলের সাইটে পৌঁছে দেওয়া হয়।
অ্যাপলের জন্যে চুক্তিটি দু’দিক থেকে উপকার করেছিল। প্রথমত, সাফারি, সিরি আর স্পটলাইটের সার্চ রেজাল্টে একটি সামঞ্জস্য এসেছিল। সে সময়ে, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট সিরিতে মাইক্রোসফট বিংয়ের পারফরম্যান্স নিয়ে টিম কুক সন্তুষ্ট ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, অ্যাপল একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, ২০২০ সালের মধ্যে তাদের বার্ষিক মুনাফা ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করবে। গুগল থেকে পাওয়া অর্থ দিয়েই সেদিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ ছিল। আর এখন, গুগল থেকে পাওয়া অর্থটি অ্যাপলের বাৎসরিক মুনাফার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। ফলে, অ্যাপলের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাগুলোর জন্যে তারা বিশাল পরিমাণ অর্থের যোগান পেয়ে গেছে।
অ্যাপল এখানে অনেকটা স্টোরের মতো কাজ করছে। কোনো স্টোরের সামনের তাকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পণ্যগুলো রাখা হয়। অ্যাপল তাদের এই জায়গাটি গুগলকে ভাড়া দিচ্ছে। আর গুগল সেখান থেকে বিশাল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করছে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ব্রুস স্যুয়েল অ্যাপলের সাধারণ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি বলেন,
We have this sort of strange term in Silicon Valley: co-opetition. You have brutal competition, but at the same time, you have necessary cooperation.
অর্থাৎ,
সিলিকন ভ্যালিতে আমাদের ‘কো-অপিটিশন’ নামে একটি অদ্ভুত শব্দ আছে। এতে ভীষণ প্রতিযোগিতা থাকার পরও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া যায়।
সত্যিকার অর্থেই, সাধারণ চোখে তাদের এ চুক্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না। বরং, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবেরই বেশি আভাস পাওয়া যায়। যেমন, অ্যাপলের টিম কুক একবার গুগলের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ইন্টারনেটে দেখানো বিজ্ঞাপন থেকেই গুগলের প্রধান মুনাফা আসে। ফলে, গুগল তার ব্যবহারকারীদের উপরে নজরদারি চালাতে বাধ্য। সত্যি বলতে, স্মার্টফোন, ডিজিটাল ম্যাপ, ল্যাপটপের মতো অনেককিছুতেই তারা মুখোমুখি প্রতিযোগিতা করলেও, নিজেদের স্বার্থপূরণের জায়গাটিতে তারা ঠিকই বন্ধুসুলভ হতে জানে।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ গুগলের বিরুদ্ধে অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা করেছে। এ মামলা সাধারণত করা হয়, যখন কোনো কোম্পানি তার নিজস্ব বাজারে একাধিপত্য চালায়। অর্থাৎ, অন্য কোম্পানিগুলোকে প্রতিযোগিতা করার যথেষ্ট সুযোগ দেয় না। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ সে অভিযোগেই গুগলকে অভিযুক্ত করেছে এবং দাবি করেছে, গুগলের এরকম আচরণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, বিজ্ঞাপনদাতা ও অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ চুক্তির ফলেই, গুগল ইন্টারনেট দুনিয়ার ৯২ শতাংশ সার্চের একাধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। মামলাটি আরো দাবি করে, অ্যাপল ডিভাইসগুলোতে ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিনের জায়গা হারানোকে গুগল তার কোম্পানির ভেতরে ‘কোড রেড’ বিপদ হিসেবে বর্ণনা করেছে। যদিও গুগল এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইয়েল্প, এক্সপেডিয়ার মতো অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো, এমনকি নুডলস শপ থেকে শুরু করে সংবাদ সংস্থাগুলো পর্যন্ত অনেকসময়ই অভিযোগ জানায়, গুগল সার্চের একচেটিয়া ব্যবসার কারণে মানুষ যদি তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে সার্চ দেয়, তখনো গুগলকে তাদের অর্থ পরিশোধ করতে হয়। মাইক্রোসফট জানায়, আইপ্যাড ও আইফোনের মতো ডিভাইসগুলোতে যদি তাদের সার্চ ইঞ্জিনকে ডিফল্ট জায়গাটি দেওয়া হতো, তাহলে তারা আরো বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারত। ফলে, গুগলও এমন আধিপত্য চালাতে পারত না।
এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে, গুগল প্রতি বছর চুক্তি অনুযায়ী যে অর্থ প্রদান করে, অ্যাপল তা থেকে সহজে সরে আসতে চাইবে না। ২০১৮ সালে টিম কুক এবং সুন্দর পিচাই আবারো একটি মিটিং করেছিলেন। সেখানে, সার্চ থেকে কীভাবে তারা আরো বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারেন, সে ব্যাপারে আলোচনা হয়। বিচার বিভাগের অভিযোগ অনুযায়ী, এ মিটিংয়ের পরে, অ্যাপলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মচারী লিখেছিলেন,
Our vision is that we work as if we are one company
গুগল বা অ্যাপলের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের চুক্তির মূল্য প্রকাশ করেনি। তবে, গুগলের প্রাক্তন সিইও এরিক স্মিডটকে এই চুক্তিটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান,
একটি চুক্তি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে তা নিয়ে দরাদরি করিনি। চুক্তিটি অ্যাপলের জন্যে অনেক লাভজনক ছিল। গুগলের সম্পর্কে বা অ্যাপল ফোনে গুগল সার্চ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন পরিবর্তন করা এখানে অনেক বেশি সহজ।
গুগল বেশ কয়েকবারই দাবি করেছে, ইন্টারনেট সার্চে তাদের আধিপত্য আসার কারণ হচ্ছে, ব্যবহারকারীরা তাদেরকে পছন্দ করে। তারা দাবি করছে, বিচার বিভাগ একটি অসম্পূর্ণ চিত্র এঁকেছে। সুপারমার্কেটে সামনের দিকের তাকের জায়গা নেওয়ার জন্যে কোকাকোলা যেমনভাবে অর্থ প্রদান করে, অ্যাপলের সাথে তাদের চুক্তিটিও ঠিক তেমনই সাধারণ। অ্যাপলের সাথে মাইক্রোসফটের বিংও মুনাফা ভাগাভাগির চুক্তি করেছিল। গুগল ঠিক এ ব্যাপারটিই নিজেদের পক্ষে তুলে ধরেছে, যে কেউ চাইলে তার ডিভাইসের ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিনের জায়গা থেকে গুগলকে সরিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু খুব কম লোকই তা করে থাকে।
গুগল জানিয়েছে, বিচার বিভাগের এই মামলাটিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। গুগলের চিফ লিগ্যাল অফিসার জানিয়েছেন, এ মামলা কোনোভাবেই ব্যবহারকারীদের উপকার করবে না। তাছাড়া, অ্যাপলের সাথে তাদের সম্পর্কটি খুবই সাধারণ। কিন্তু বিচার বিভাগ যদি সফল হয়, তাহলে কী ঘটবে?
মামলাটি সহজ নয়। ফলে, অনেক বছর ধরেই তা চলতে পারে। তবে গুগল এখানে হারলে অ্যাপলের সাথে তাদের চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাবে। এতে অ্যাপলের যেমন বিশাল অঙ্কের ক্ষতি হবে, গুগলের জন্যে তা আরো বড় আশঙ্কায় পরিণত হতে পারে। বিং, ডাকডাকগো, ইয়ানডেক্সের মতো সার্চ ইঞ্জিন থাকলেও তাদের কারোই আধিপত্য গুগলের মতো না। কিন্তু কিছু বিশ্লেষক দাবি করছেন, গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের আধিপত্যে আঘাত করার মতো সামর্থ্য একমাত্র অ্যাপলেরই রয়েছে।
গুগলের আভ্যন্তরীণ অনেকেও একই মত পোষণ করেন। এর কারণ হচ্ছে, অ্যাপল ডিভাইসের বিলিয়নেরও বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে। হয়তো এ মামলার ফলেই অ্যাপল তাদের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করার উদ্যোগ নেবে। তাছাড়া, চুক্তিটি বাতিল হলে অ্যাপল হয়তো তার ব্যবহারকারীদের জন্য গুগল সার্চ ব্যবহার কঠিন করে তুলবে।
অনেক বিশ্লেষক মতামত দিয়েছেন, অ্যাপল হয়তো কোনো সার্চ ইঞ্জিন কোম্পানি কিনে নেবে। অ্যাপল এখনো এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে, চুক্তিটি বাতিল হয়ে গেলে উভয় কোম্পানিই যে প্রাথমিকভাবে একটি আর্থিক ধাক্কা খাবে, সে ব্যাপারে খুব কমই সন্দেহ রয়েছে। ভবিষ্যতে ইন্টারনেট দুনিয়া কেমন আকৃতি নেবে, তা-ও এ মামলার রায় থেকে বোঝা যাবে।