১৯৯১ সালে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে, এবং তদস্থলে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের নানাবিধ কারণ ছিল, এবং এই কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বহুজাতিক সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসাধারণের মধ্যে নৃগোষ্ঠীগত জাতীয়তাবাদের (ethnic nationalism) বিস্তার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গঠিত একটি ফেডারেল রাষ্ট্র। ১৯৯০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার ৫০.৭৮% ছিল জাতিগত রুশ, আর বাকি ৪৯.২২% ছিল অন্যান্য জাতিভুক্ত। এদের মধ্যে ইউক্রেনীয়, উজবেক, আজারবাইজানি, কাজাখ, জর্জীয়, আর্মেনীয় ও আরো বিভিন্ন জাতির মানুষ ছিল। ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে কমিউনিজম এই জাতিগুলোর ঐক্যের বন্ধন হিসেবে কাজ করছিল। কিন্তু যখন সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে কমিউনিজমকে অপসারণ করলেন, তখনই এই বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল এবং ইউনিয়ন ভেঙে গেল।
মধ্যপ্রাচ্যের বৃহৎ রাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ইরানও একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। ইরানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৩% জাতিগতভাবে পারসিক (Persian), এবং স্বাভাবিকভাবে তারাই ইরানের মূল ক্ষমতার অধিকারী। উল্লেখ্য, পারসিকরা ফার্সি ভাষায় কথা বলে, এবং ফার্সি হচ্ছে ইরানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু ইরানের জনসংখ্যার বাকি ৪৭% পারসিক নয়, বরং অন্যান্য বিভিন্ন জাতির অন্তর্ভুক্ত। ২০১৮ সালের এক হিসেব অনুযায়ী, জাতিগতভাবে ইরানের জনসংখ্যার প্রায় ১৬% আজারবাইজানি, ১০% কুর্দি, ৭% মাজান্দারানি ও গিলাকি, ৬% লুর, ২% বালুচ, ২% আরব, ২% তুর্কমেন ও অন্যান্য তুর্কি গোত্রভুক্ত এবং ১% আর্মেনীয়, তালিশ, জর্জীয়, সার্কাশীয় ও আসিরীয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই হিসেবকে চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায় না, কারণ জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে যেন জাতীয়তাবাদের বিস্তার না ঘটে, সেই উদ্দেশ্যে ইরানি সরকার এই পরিসংখ্যানকে নিজেদের সুবিধামাফিক পরিবর্তন করে থাকে।
বৃহৎ রাষ্ট্র ইরানের আয়তন ১৬,৪৮,১৯৫ বর্গ কি.মি., এবং এই রাষ্ট্রটি বর্তমানে ৩১টি প্রদেশে বিভক্ত। এই ৩১টি প্রদেশের মধ্যে মাত্র ১৩টি প্রদেশে জাতিগত পারসিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই প্রদেশগুলো হচ্ছে আলবুর্জ, ইস্ফাহান, ইয়াজদ, কিরমান, কুম, তেহরান, দক্ষিণ খোরাসান, ফার্স, বুশেহর, মারকাজি, রাজাভি খোরাসান, সিমনান এবং হরমুজগান। এই ১৩টি প্রদেশের মধ্যে আবার সবগুলোতে পারসিকরা এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, অর্থাৎ এই প্রদেশগুলোর প্রতিটিতে পারসিকদের জনসংখ্যার হার ৫০% এর উপরে নয়। এগুলোর মধ্যে ১১টি প্রদেশে পারসিকদের সংখ্যা ৫০%–এর উপরে, আর বাকি ২টি প্রদেশে (আলবুর্জ ও তেহরান) পারসিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু তাদের সংখ্যা ৫০%–এর নিচে। এর বাইরে ইরানের ১৮টি প্রদেশে পারসিকরা সংখ্যালঘু, এবং অন্যান্য বিভিন্ন জাতি সংখ্যাগরিষ্ঠ।
১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইরান ছিল একটি রাজতন্ত্র, এবং ১৯৭৯ সালের ‘ইসলামি বিপ্লবে’র পর এটি একটি ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রে’ পরিণত হয়। তখন থেকে ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রবাদ’ (Islamic republicanism) এবং শিয়া ইসলাম ধর্ম ইরানের রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ইরানের বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঐক্যের বন্ধন হিসেবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ইরানের সাদৃশ্য লক্ষণীয়। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত রাশিয়া ছিল একটি রাজতন্ত্র, এবং ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর এটি ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে’ পরিণত হয়। তখন থেকে কমিউনিজম দেশটির রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঐক্যের বন্ধন হিসেবে কাজ করছিল। কিন্তু কমিউনিজমের পতনের পর সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতন ঘটেছে। তাহলে ইরানের বর্তমান সরকার ও রাষ্ট্রীয় আদর্শের যদি পতন ঘটে, তাহলে কি ইরানও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যাবে?
ইতোমধ্যে ইরানের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অসন্তোষ ও উত্তেজনা লক্ষ্য করা গিয়েছে। ইরানের বেশ কিছু সংখ্যালঘু জাতি দীর্ঘদিন ধরে ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। তাদের কারো কারো লক্ষ্য ইরানি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন, আবার কারো কারো লক্ষ্য ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ইরানের বৈদেশিক শত্রুরা বিভিন্ন সময়ে নিজস্ব স্বার্থে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোকে সমর্থন প্রদান করেছে, যদিও এখন পর্যন্ত এগুলোর মধ্যে কোনোটি সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। কিন্তু ভবিষ্যতে ইরানি জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বিস্তার ইরানের ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে হুমকির সম্মুখীন করতে পারে।
আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদ
আজারবাইজানিরা পারসিকদের পর ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি। আজারবাইজানিরা বৃহত্তর তুর্কি জাতির অন্তর্ভুক্ত একটি জাতি, এবং পারসিকদের চেয়ে জাতিগতভাবে পৃথক। প্রচলিত হিসেব অনুযায়ী, ইরানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬% জাতিগত আজারবাইজানি। কিন্তু ধারণা করা হয়, ইরানের জনসংখ্যায় তাদের হার আরো বেশি (২১% থেকে ৩০% এর মাঝামাঝি)। ইরানে প্রায় দেড় কোটি থেকে ১ কোটি ৮৫ লক্ষ আজারবাইজানি বসবাস করে। বস্তুত স্বাধীন আজারবাইজানের তুলনায় ইরানে বেশি সংখ্যক আজারবাইজানি বসবাস করে। ইরানের ৬টি প্রদেশে (আরদাবিল, কাজভিন, জাঞ্জান, পূর্ব আজারবাইজান, পশ্চিম আজারবাইজান ও হামাদান) জাতিগত আজারবাইজানিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং আরো ৪টি প্রদেশে (আলবুর্জ, কুম, তেহরান ও মারকাজি) উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আজারবাইজানি বসবাস করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে আজারবাইজানি–অধ্যুষিত বাকু ও শিরভান অঞ্চল দখল করে নেয়, এবং এর মধ্য দিয়ে আজারবাইজানিরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে– রুশ আজারবাইজান ও ইরানি আজারবাইজান। রুশ আজারবাইজান বর্তমানে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, কিন্তু ইরানি আজারবাইজান এখনো ইরানের অংশ। কার্যত সাধারণভাবে ইরানি আজারবাইজানিরা ইরানি সমাজের সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই মিশে গেছে, তারা ব্যাপকভাবে নিজেদের ভাষা ব্যবহার করে থাকে, পারসিকদের মতো তারাও প্রধানত শিয়া ইসলামের অনুসারী, এবং বেশ কিছু আজারবাইজানি ব্যক্তিত্ব ‘ইরানি জাতীয়তাবাদে’র ও ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্রবাদে’র একনিষ্ঠ সমর্থক। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের সময় ইরানি আজারবাইজানি নেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, এবং ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই নিজেই একজন জাতিগত আজারবাইজানি।
কিন্তু ইরানি আজারবাইজানিদের একটি অংশের মধ্যে আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে ইরানি আজারবাইজানিদের মধ্যে ‘বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদে’র বিস্তার ঘটেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তর ইরান দখল করে নেয় এবং ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত সহায়তায় ইরানি আজারবাইজানে ‘আজারবাইজান জনগণের সরকার’ নামক একটি কমিউনিস্ট প্রোটো–রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, যেটি আজারবাইজান সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে’র সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের চাপে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৬ সালে ইরান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়, এবং ইরানি সৈন্যরা ইরানি আজারবাইজান পুনর্দখল করে নেয়। কিন্তু ইরানি আজারবাইজানিদের একাংশের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা বজায় থাকে, এবং ইসলামি বিপ্লবের পরেও এই পরিস্থিতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। উল্লেখ্য, আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদীদের নিকট ইরানি আজারবাইজান ‘দক্ষিণ আজারবাইজান’ হিসেবে পরিচিত।
১৯৮০–এর দশকে ইরানি আজারবাইজানি নেতা পিরুজ দিলানচির নেতৃত্বে ‘দক্ষিণ আজারবাইজান জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’ নামক একটি সংগঠনের সৃষ্টি হয়। এই দলটি ইরানি আজারবাইজানকে ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন করে আজারবাইজানের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি জানায়। ইরানি সরকার এই দলের ওপর খড়গহস্ত হলে দলটির নেতারা ১৯৯০ সালে আজারবাইজান সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে পালিয়ে যায়। এদিকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আজারবাইজান সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়, এবং দেশটির বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রপতি আবুলফাজ এলচিবে খোলাখুলিভাবে ইরানি আজারবাইজানকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করে ‘বৃহত্তর আজারবাইজান’ গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি রাশিয়ার দেরবেন্ত থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত একটি আজারবাইজানি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষপাতী।
অবশ্য এলচিবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আজারবাইজানের নতুন নেতৃবৃন্দ ইরানের বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবে সম্প্রসারণবাদী দাবি উত্থাপন থেকে বিরত থাকে। কিন্তু আরাস নদীর উভয় পাশেই আজারবাইজানি ও বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে ইরানি আজারবাইজানকে ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন করার স্বপ্ন অটুট রয়েছে। ২০০২ সালে মাহমুদালি চেহরেগানির নেতৃত্বে ইরানি আজারবাইজানে ‘দক্ষিণ আজারবাইজান জাতীয় জাগরণ আন্দোলন’ নামক আরেকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সৃষ্টি হয়েছে, এবং ইরানি সরকারের রোষানলে পড়ে এই দলটির নেতাদেরকেও আজারবাইজানে পালিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু তাতে ইরানি আজারবাইজানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যক্রম বন্ধ হয়নি।
২০২০ সালে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধ শুরুর পর ইরানি আজারবাইজানিরা সোৎসাহে আজারবাইজানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে, এবং ইরানি সরকার আর্মেনিয়াকে সহায়তা করছে, এই অভিযোগ তুলে ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। স্বভাবতই আজারবাইজানিদের প্রতি ইরানি আজারবাইজানিদের এই প্রকাশ্য সহানুভূতি ইরানি সরকারকে আতঙ্কিত করেছে, এবং যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ইরানি সরকার এই যুদ্ধে আজারবাইজানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতে বাধ্য হয়েছে। তদুপরি, যুদ্ধ শেষে আজারবাইজানি বিজয় উপলক্ষে বাকুতে আয়োজিত বিজয়সূচক প্যারেডে তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান এমন একটি কবিতা আবৃত্তি করেছেন, যেটিতে বলা হয়েছে যে, আজারবাইজান ও ইরানি আজারবাইজানের মধ্যবর্তী সীমানা ‘কৃত্রিম’। স্বভাবতই ইরানি সরকার এটিকে নিজস্ব ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, ইরানি আজারবাইজানে বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়িয়ে দিতে তুরস্ক ও আজারবাইজান আগ্রহী। এমতাবস্থায় আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদের বিস্তার ইরানের ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য মারাত্মক একটি হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
কুর্দি জাতীয়তাবাদ
কুর্দিরা ইরানের তৃতীয় বৃহত্তম জাতি। ইরানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% কুর্দি, এবং বর্তমানে ইরানে প্রায় ৮২ লক্ষ থেকে ১ কোটি ২০ লক্ষ জাতিগত কুর্দি বসবাস করে। ইরানের ৪টি প্রদেশে (ইলাম, উত্তর খোরাসান, কিরমানশাহ ও কুর্দিস্তান) কুর্দিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কুর্দি বসবাস করে। কুর্দিরাও পারসিকদের মতো ইন্দো–ইরানীয় জাতির অন্তর্ভুক্ত, এবং এই দিক থেকে পার্শ্ববর্তী/নিকটবর্তী তুরস্ক, ইরাক বা সিরিয়ার তুলনায় ইরানের কুর্দিরা তুলনামূলকভাবে বেশি মূল সমাজের সঙ্গে অঙ্গীভূত। বর্তমান ইরানি সরকার কুর্দিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, এরকম অভিযোগ থাকলেও তুর্কি ও ইরাকি সরকার নিজেদের কুর্দি জনগোষ্ঠীর প্রতি যেরকম নিষ্পেষণমূলক আচরণ করেছে, ইরানে সেরকম কিছু ঘটে নি। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ইরানি সরকার বিভিন্ন সময়ে নিজস্ব স্বার্থে তুরস্ক ও ইরাকের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তাও করেছে।
কিন্তু কুর্দিদের সঙ্গে পারসিকদের দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। ইরানের সাফাভি শাসকরা ইরানি কুর্দিস্তানের আধা–স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যগুলোর ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল এবং এর ফলে কুর্দিরা সাফাভিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করা হয়, এবং সাফাভি শাসকরা কুর্দি শহরগুলোকে ধ্বংস করার পাশাপাশি কুর্দিদেরকে ইরানের বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাসিত করে। পরবর্তীতে আফশারিদ ও কাজার বংশের শাসনামলেও কুর্দিরা বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করে, কিন্তু সেগুলোও সাফল্য অর্জন করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কুর্দি গোত্রগুলো আবার বিদ্রোহ করে, এবং তুরস্ক তাদেরকে সমর্থন প্রদান করে, কিন্তু ইরানি সরকার এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়।
১৯৪৫ সালে ‘ইরানি কুর্দিস্তান গণতান্ত্রিক দল’ প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং তখন থেকে দলটি ইরানি কুর্দিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। উল্লেখ্য, এটি ইরানি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রধান দল হলেও একমাত্র দল নয়। ইরানি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আরো বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় উত্তর ইরানে ‘মাহাবাদ প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি ক্ষুদ্র কুর্দি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, কিন্তু ইরান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পর ইরানি সৈন্যরা রাষ্ট্রটি দখল করে নেয়। পরবর্তীতে ইরানি সরকার কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে ওঠে এবং এজন্য ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবকে ইরানি কুর্দিরা স্বাগত জানায়। কিন্তু ইরানের নতুন সরকার কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নিতে ইচ্ছুক ছিল না, ফলে তারা ইরানি সরকারের পুনরায় বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত স্থায়ী এই বিদ্রোহে ইরানি কুর্দিরা ইরাকের সহায়তা লাভ করে, কিন্তু পরাজিত হয় এবং এই যুদ্ধে প্রায় ১০,০০০ মানুষ নিহত হয়।
১৯৮৯-৯৬ সালের মধ্যে ইরানি কুর্দিরা ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে আরেকটি বিদ্রোহ করে, এবং এসময় তুরস্ক তাদেরকে সহায়তা করে। কিন্তু এই বিদ্রোহটিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরপর থেকে ইরানি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে নিম্ন তীব্রতার সংঘাতে লিপ্ত। ইরাকি কুর্দিস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে তারা ইরানের অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনা অব্যাহত রেখেছে, কিন্তু সেগুলো খুব বেশি কার্যকর নয়। ২০০০–এর দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও ইসরায়েল ইরানি সরকারকে চাপে রাখার উদ্দেশ্যে ইরানি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা প্রদান করতে শুরু করেছে। সর্বশেষ ২০২০ সালে ইরান ইরাকি কুর্দিস্তানে ইরানি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে, এবং এক্ষেত্রে তারা তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে।
বর্তমানে ইরানি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রভাব খুব বেশি নয়। কিন্তু পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাফল্য ইরানের জন্য হুমকির সৃষ্টি করতে পারে। ইরাকি কুর্দিরা কার্যত ইরাকের অভ্যন্তরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছে। অনুরূপভাবে, সিরীয় কুর্দিরা সিরিয়ার অভ্যন্তরে একটি প্রায় স্বাধীন প্রোটো–রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছে। তুরস্ক তাদের সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তুর্কি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করতে সক্ষম হয়নি। এমতাবস্থায় কুর্দি জাতীয়তাবাদ যে ভবিষ্যতে ইরানের ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য বৃহৎ একটি হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না এবং ‘পূর্ব কুর্দিস্তান’ (কুর্দি জাতীয়তাবাদীরা ইরানি কুর্দিস্তানকে এই নামে অভিহিত করে থাকে) যে ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কার্যত ইরানি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি মার্কিন, সৌদি ও ইসরায়েলি সমর্থন এবং কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে তুর্কি–ইরানি সহযোগিতা ইরানি কুর্দি সমস্যার জটিল প্রকৃতিকেই তুলে ধরেছে।
বস্তুত আজারবাইজানি ও কুর্দি জাতীয়তাবাদের বিস্তার এবং এর ফলে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদ ইরানি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। আজারবাইজানি ও কুর্দিরা যথাক্রমে ইরানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম জাতি, এবং ইরানের মোট ১০টি প্রদেশে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্বভাবতই এই দুইটি জাতির মধ্যে যদি ব্যাপকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা বিস্তার ঘটে, সেক্ষেত্রে ইরানি রাষ্ট্রের পক্ষে তাদের ‘ক্ষুদ্র পারসিক সাম্রাজ্য’ সংরক্ষণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু ইরানের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জাতিগুলোর মধ্যেও কমবেশি জাতীয়তাবাদ/বিচ্ছিন্নতাবাদের বিস্তার ঘটেছে, এবং এগুলোও ইরানি রাষ্ট্রের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। পরবর্তী পর্বে এই ক্ষুদ্র জাতিগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।