ইউরোপের সাথে এশিয়ার যোগাযোগ সহজতর করেছে মধ্যপ্রাচ্যের জমিনে নির্মিত কৃত্রিম জলধারা ‘সুয়েজ খাল’। আরবিতে একে ‘কা’নাত-আল-সুয়াইস’ ডাকা হয়। একসময় ইউরোপ এবং এশিয়ার বণিকরা আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ইউরোপে পাড়ি দিত। এর ফলে সময়ের অপচয় এবং পরিবহণ ব্যয়ভার- দুটোই বৃদ্ধি পেত। অথচ ইউরোপীয়দের সবচেয়ে লাভজনক বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো এশিয়ায় অবস্থিত ছিল। বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর শত শত কলোনির অবস্থান ছিল পৃথিবীর এই অংশে। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা দ্রুততর না হওয়ায় মুনাফার পরিমাণ অনেকাংশে হ্রাস পেত। তাই সবদিক বিবেচনা করে ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরকে জুড়ে দিয়ে নির্মিত সুয়েজ খাল যেন দুই মহাদেশের জন্য আশির্বাদরূপে আবির্ভূত হলো।
বাণিজ্যিক সুবিধা পেতে নির্মিত এই সুয়েজ খাল নির্মাণের বহু আগে থেকেই বহুজাতির মধ্যকার কোন্দল, বিতর্ক এবং স্নায়ুযুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নির্মিত হওয়ার পর এটি হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাঠের অন্যতম উপাদান।
খালের অবস্থান
ভূমধ্যসাগর এবং সুয়েজ উপসাগরকে (লোহিত সাগরের অংশ) সংযুক্ত করা কৃত্রিম খাল সুয়েজের অবস্থান মিশরেরর সাইদ সমুদ্রবন্দরের সন্নিকটে। সমুদ্রপৃষ্ঠের সমউচ্চতায় নির্মিত এই খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৯৩.৩০ কিলোমিটার। ইউরোপ-এশিয়ার মধ্যকার সংক্ষিপ্ততম জলপথ হিসেবে পরিচিত এই খাল আফ্রিকা মহাদেশ থেকে এশিয়াকে আলাদা করেছে। এর ফলে দক্ষিণ আটলান্টিক হয়ে এশিয়া পৌঁছানোর ঝামেলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। বণিকরা অতিরিক্ত ৭ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার ধকল থেকে বেঁচে যায়। এই খালের মাধ্যমে মিশরের বন্দর সাইদ এবং তেউফিক বন্দরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। অন্যদিকে আলাদা হয়েছে মিশর এবং সিনাই উপদ্বীপ।
এই খালের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ (Suez Canal Authority)। পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের নৌপরিবহনের জন্য উন্মুক্ত থাকার নীতি নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে এই সংস্থার গোড়াপত্তন হয়েছে। এমনকি যুদ্ধের সময়েও যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হয় এই খাল। যদিও নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে এই নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
মিশরীয়দের খনন ইতিহাস
মনুষ্যনির্মিত খালগুলোর মধ্যে সুয়েজ এক বিস্ময়ের নাম। তবে এর ফলে ভেবে বসবেন না যে, মিশরের বুকে সুয়েজ খাল নতুন কিছু। বরং ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে জানা যায়, প্রাচীন ফারাওদের আমল থেকে মিশর সাম্রাজ্যের বুকে কৃত্রিম খাল এবং নালা নির্মিত হয়ে এসেছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫০ অব্দের দিকে তৎকালীন ফারাও ৩য় সেনুস্রেত লোহিত সাগরের সাথে নীলনদের যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন একটি কৃত্রিম খাল নির্মাণের মাধ্যমে। ফারাও ২য় নেকো এবং পারস্যের বীর দারিউসও স্বাধীনভাবে খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাবে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যায়নি। ফারাওদের নির্মিত খালটির খননকাজ খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের দিকে সম্পূর্ণ হয়েছিল। টলেমিয় শাসনামলে এটি মিশরের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়েছিল। ক্লিওপেট্রা স্বয়ং এই খালে বিহার করেছিলেন বলে জানা যায়। তবে ফারাওদের খাল নির্মিত হয়েছিল আমোদের উদ্দেশ্যে। ইউরোপ-এশিয়াকে যুক্ত করার কোনো উদ্দেশ্য সেখানে ছিল না।
সেসময় ভূমধ্যসাগরের সাথে লোহিত সাগরের সরাসরি সংযুক্ত করার যেকোনো প্রকল্প অসম্ভব হিসেবে ঠাহর করা হত। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল উচ্চতার ভিন্নতা। বিভিন্ন জরিপে দেখা গিয়েছিল, দুই সাগরের উচ্চতা ভিন্ন হওয়ায় খাল নির্মাণ করলে মিশর বন্যার পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। এর ফলে অশ্বযান, ট্রেনসহ বিভিন্ন স্থানীয় যানবাহনের সাহায্যে বণিকরা মালামাল আদান-প্রদান করত। বিশেষ করে, ব্রিটিশ বণিকরা তৎকালীন ভারতবর্ষের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এই রুট ব্যবহার করত।
বেলফোন্দের জরিপ
যুগে যুগে বিভিন্ন শাসক এবং প্রকৌশলীগণ এই রুটে খাল নির্মাণের প্রচেষ্টা করেছেন। তবে প্রথম আধুনিক প্রচেষ্টা করেন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। নেপোলিয়নের মিশর অভিযানের সময় এই পরিকল্পনা প্রস্তাবিত হয়। এর পেছনে সূক্ষ্ম রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। এই অঞ্চলে ফরাসি নিয়ন্ত্রিত খাল নির্মাণ করলে ব্রিটিশ বণিকদের খাল ব্যবহারের জন্য ফ্রান্স সরকারের কাছে কর দিতে হবে। নচেৎ ফের আফ্রিকা ঘুরে বাণিজ্য করার ঝামেলায় যেতে হবে। ব্রিটিশদের এভাবে কাবু করার জন্য খাল নির্মাণ জরুরি ছিল। ১৭৯৯ সালে নেপোলিয়নের নির্দেশে জরিপ শুরু হয়। প্রকৌশলীদের হিসাবে ফের লোহিত সাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে উচ্চতার তফাৎ ধরা পড়ল। তাই নেপোলিয়ন খাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। ফের ১৮৩০ সালের দিকে ফরাসি প্রকৌশলী লিনান্ত দি বেলফোন্দের আগ্রহে নতুনভাবে খাল খননের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। তিনি হিসাব করে প্রচলিত ধারণা ভুল প্রমাণ করতে সক্ষম হন। তার জরিপে দেখা গেলো দুই সাগরের মধ্যে থাকা উচ্চতার পার্থক্য খুব একটা বেশি নেই। যার ফলে খাল খননের ক্ষেত্রে কারিগরি বাধা নেই।
তবে খাল খননের সুযোগ তৈরি হতে আরও দুই দশক লেগে যায়। তখন মিশর এবং সুদান অঞ্চলে অটোম্যানদের খেদিভ (শাসক) ছিলেন সাইদ পাশা। তিনি এই খাল খননকে মিশর এবং অটোম্যান সাম্রাজ্য- উভয়ের জন্য লাভজনক একটি প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি ফরাসি কূটনীতিক ফার্দিনান্দ দি লেসেপ্সকে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে খাল খননের কাজ শুরু করার অনুমতি দেন। ফার্দিনান্দ খেদিভের অনুমতি নিয়ে ‘সুয়েজ খাল কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সম্রাটের বিশেষ ক্ষমতাবলে ৯৯ বছরের জন্য এই অঞ্চলের পানির উপর ইজারা লাভ করে এই তারা।
লেসেপ্স মোট ১৩ জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠন করেন ‘Commission Internationale pour le percement de l’isthme des Suez’। এই বিশেষজ্ঞদল খাল খননের প্রক্রিয়া এবং নকশা করার দায়িত্বে ছিলেন। ১৮৫৬ সালে এই দল নকশা এবং পরিকল্পনাসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেয় এবং এর দু’বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে সুয়েজ খাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়।
খাল খনন
১৮৫৯ সালে সাইদ বন্দর থেকে শুরু হয় খাল খননের কাজ। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে চলেছিল এই খাল খননের কাজ। নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, এই কাজের জন্য প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে মিশর সরকার বিতর্কিতভাবে দেশের দরিদ্র নাগরিকদের হুমকি দিয়ে নামেমাত্র বেতনে কাজ করতে বাধ্য করেছিল। শুরুর দিকে এসব শ্রমিকদের গাঁইতি ও বেলচার সাহায্যে খাল খনন করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়া এসব যন্ত্র দিয়ে খালি হাতে খাল খনন করা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। ফলে কাজের অগ্রগতি ছিল অত্যন্ত ধীর। ক্রীতদাস ব্যবহারের কারণে ব্রিটিশ, ফরাসি এবং মার্কিন বিনিয়োগকারীরা প্রতিবাদ জানায়। তাছাড়া হাজার হাজার শ্রমিক কলেরা এবং কাজের চাপে স্বাস্থ্যহানি হয়ে মৃত্যুবরণ করায় সমালোচিত হয় সুয়েজ খাল কোম্পানি।
১৮৬৩ সালে মিশরের তৎকালীন শাসক ইসমাইল পাশা খাল খননে বলপূর্বক শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া নিষিদ্ধ করে দেন। এই নির্দেশনার পর ফার্দিনান্দ লেসেপ্স তার পন্থা পাল্টে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। মোট ৭৫ মিলিয়ন ঘন মিটার অপসারিত বালির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্যে করা হয়েছিল। ১৮৬৪ সালের ফার্দিনান্দ এক বিবৃতিতে জানিয়ে দেন,
“সুয়েজ খালের উপর কোনো জাতির অধিকার থাকবে না। এই খালের উপর আন্তর্জাতিকভাবে সবার সমান অধিকার।”
মিশর বিভিন্ন অঞ্চল তখন ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের শাসনাধীন ছিল। শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্থানীয় বহু বিদ্রোহীদল তখন আন্দোলন করছিল। ফলে স্থানীয় রাজনীতির ময়দান ছিল সরগরম। রাজনৈতিক সংঘাত ও অপর্যাপ্ত প্রযুক্তির কারণে খাল খননের কাজে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে ১০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত চলে যায়।
উদ্বোধন
১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর মিশর এবং সুদানের তৎকালীন খেদিভ ইসমাইল পাশা আনুষ্ঠানিকভাবে সুয়েজ খাল উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। খালের জলে প্রথম ভেসে চলার জন্য ফরাসি সম্রাজ্ঞী ইউজিন-এর আমোদতরী ল’এগল কে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু সারিতে থাকার হিসাব গড়মিল হওয়ায় ব্রিটিশ নৌজাহাজ এইচএমএস নিউপোর্ট এই গৌরব অর্জন করে ইতিহাসের অংশীদার হয়ে যায়। তবে সুয়েজ খালের দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাওয়া প্রথম জাহাজ ছিল যুক্তরাজ্যের এস এস ডিডো। তবে হতাশাজনকভাবে খাল উদ্বোধনের প্রথম দুই বছরে খুব কম জাহাজ এই পথ ব্যবহার করে।
যদিও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের আফ্রিকান কলোনিতে কর্তৃত্ব খাটানো এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নত করায় এই খাল গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ। এর ফলে ১৮৭৫ সালে যুক্তরাজ্যের কাছে তাদের মালিকানা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন ইসমাইল পাশা এবং অন্যান্য অংশীদার।
সঙ্কটের শুরু এবং দৃশ্যপটে জামাল আবদেল নাসের
খাল উদ্বোধনের পর পরই তা ব্রিটিশদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুটে পরিণত হয়। ১৮৭৫ সালে যুক্তরাজ্য খালের মালিকানা কিনে নেওয়ার পর তারা মিশরের বহু অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া শুরু করে। মিশরের নাগরিকদের মাঝে এর ফলে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। ১৮৮২ সালে এই উৎকণ্ঠা থেকে অ্যাংলো-মিশরীয় যুদ্ধ শুরু হয়। এর মাধ্যমে মিশর দখল করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত করা হয়। তারপর ১৯৩৬ সালে অ্যাংলো-মিশরীয় চুক্তির কারণে মিশর স্বাধীনতা অর্জন করলেও সুয়েজ খালের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ব্রিটিশদের অধিকৃত ছিল। এমনকি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তখনও মিশরের বুকে অবস্থান করতো। দুই দেশের সরকারের মধ্যে বহু আলোচনার পর ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ সৈন্যরা মিশর ত্যাগ করে। এর ফলে সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ মিশর সরকারের হস্তান্তরিত হয়।
মিশরের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ছিলেন জামাল (গামাল) আবদেল নাসের। তিনি অতিসত্বর সুয়েজ খালের তত্ত্বাবধায়ক ‘সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ’ থেকে মালিকানা বদলি করেন এবং খালের জাতীয়করণ করে মিশরের সরাসরি অধীনস্থ ঘোষণা করেন। ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে খালের জাতীয়করণ ঘোষিত হয়। এই ঘটনায় যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র- দুই দেশের সরকারপ্রধানরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।
জামাল আবদেল নাসের এরপর তিরান প্রণালী বন্ধ ঘোষণা করেন। এই প্রণালী ইসরাইলের সাথে লোহিত সাগরের সরাসরি যোগাযোগের পথ ছিল। এই ঘোষণায় ইসরাইলের সকল জাহাজ প্রণালীতে প্রবেশের অনুমতি হারিয়ে ফেলে।
১৯৫৬-৫৭ সুয়েজ সঙ্কট
জামাল আবদেল নাসেরের সুয়েজ খাল জাতীয়করণের ফলে দেশের ভেতর জনপ্রিয়তা বহুগুণে বেড়ে যায়। তিনি দেশটির ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল তখন মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স-ইসরাইল একজোট হয়ে মিশর আক্রমণের হুমকি দেয়। এই হুমকির ফলে পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে জোট সামরিক বাহিনী মিশর আক্রমণ করে বসে। তারা সুয়েজ খাল মিশরের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করে। এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত নেতা নিকিতা খ্রুশ্চেভ ইউরোপীয় বাহিনীকে অতিসত্বর সেনা প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেন। নচেৎ পশ্চিম ইউরোপের উপর পারমাণবিক বোমা হামলার হুমকি দেন। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা না করে অভিযান করায় রাষ্ট্রপতি ডুইট আইজেনহাওয়ারও অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি সেনা প্রত্যাহার না করলে তিন দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির হুমকি দেন।
ঘটনা সামাল দিতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠিত হয় এবং ৪ নভেম্বর তাদের মিশরে প্রেরণ করা হয়। সুয়েজ খাল সুরক্ষা এবং সকলের জন্য উন্মুক্ত রাখা ছিল এই বাহিনীর মিশন। মার্কিন এবং সোভিয়েত চাপের মুখে শেষপর্যন্ত তিন দেশ সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এর ফলে খালের নিয়ন্ত্রণ পুনরায় মিশরের হাতে চলে যায়। তবে ইসরায়েলের জন্য তিরান প্রণালী খুলে দেওয়া হয়।
আরব-ইসরাইল যুদ্ধ
সুয়েজ খাল নিয়ে মিশর এবং ইসরাইলের বিরোধ থেকে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সবগুলো যুদ্ধের পটভূমি ও ফলাফল বিশ্লেষণ করার জন্য এক প্রবন্ধ যথেষ্ট নয়। তাই প্রবন্ধের এই অংশে সামগ্রিকভাবে যুদ্ধের ফলাফল সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করা হবে।
১৯৫৬ এর সঙ্কটের ঠিক দশ বছর পর ১৯৬৭ সালে ফের সুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংঘাতের সূচনা ঘটে। সেবছর জামাল আবদেল নাসের সিনাই উপদ্বীপ থেকে জাতিসঙ্ঘ শান্তিবাহিনী প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। এই ঘটনার পরপরই ইসরায়েল সুয়েজ খাল আক্রমণ করে বসে এবং এর পূর্ব তীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। খালের ভেতর ইসরায়েলি জাহাজ প্রবেশ রুখতে খাল বন্ধ ঘোষণা করেন নাসের। মিশরের সেনাবাহিনী খালের উপর সামরিক অবরোধ তৈরি করে। এসময়ে খালে প্রবেশ করা জাহাজগুলো পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য সেখানে আটকে থাকে। ৬ দিনব্যাপী আরব-ইসরাইলের মধ্যকার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ইসরাইল গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, গোলান মালভূমির মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর দখল পেয়ে যায়। যুদ্ধের পর মার্কিন এবং ব্রিটিশ উদ্যোগে সুয়েজ খাল পুনরায় নিরাপদ করা হয়।
১৯৭৫ সালে তৎকালীন মিশরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত সুয়েজ খাল পুনরায় খুলে দেন। তবে ইসরায়েলি বাহিনী ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সিনাই উপদ্বীপে অবস্থান করে। ১৯৭৯ সালে দুই দেশের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির অংশ হিসেবে সুয়েজ খাল অঞ্চলে বহুজাতিক বাহিনী এবং পর্যবেক্ষক অবস্থান করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত সেই বাহিনী সুয়েজ খালে অবস্থান করছে।
একবিংশ শতকে সুয়েজ খাল
রাজনৈতিক সংঘাতের পাশাপাশি প্রতিবছর সুয়েজ খালে জাহাজ চলাচল বাড়তে থাকে। প্রাথমিক ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে এখন প্রতিদিন গড়ে ৫০টি মালবাহী জাহাজ সুয়েজ অতিক্রম করে। প্রতিবছর এই রুটে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন টন মালামাল লেনদেন হয়। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে খালের সংস্কারের কাজও নেওয়া হয় নিয়মিত। ২০১৪ সালে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের মাধ্যমে খাল সম্প্রসারণের প্রকল্প হাতে নেয় মিশর সরকার। এর ফলে খাল দিয়ে একই সময়ে দুই দিকেই জাহাজ চলাচল করতে সক্ষম হচ্ছে।
তবে প্রতিবছর বর্ধমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে তাল মেলাতে আরও সংস্কারের পরিকল্পনা করছে কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের মধ্যে এই খালের সক্ষমতা প্রতিদিন ৯৭ জাহাজে উত্তীর্ণ করার পরিকল্পনা করছে তারা। এর ফলে খাল থেকে আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ প্রতিবছর ১৩.২২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উত্তীর্ণ হবে।