এমন রাতগুলো বার্সেলোনা সমর্থকদের জীবনে আজকাল প্রায় হররোজই আসে!
রক্ষণভাগ এন্তার ভুল করে, মধ্যমাঠের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় ম্যাচের খানিকক্ষণ না পেরোতেই দলের মুখ্য স্ট্রাইকার ক্ষমার অযোগ্য সব গোলের সুযোগ মিস করেন, আর রেফারির শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে টানেলের পথ ধরাটা মেসির তো প্রায় অভ্যাসই হয়ে গেছে। এবং সব দেখেশুনে খেলাশেষে ফোনের স্ক্রিনটা বন্ধ করতে করতে ‘আর এই জঘন্য দলটার খেলাই দেখব না’ মর্মে প্রতিজ্ঞা করাটাও বেশ রোজকার গল্পই হয়ে গিয়েছে কাতালান দলটির অনুসারীদের।
ওই পণে যে খুব জোর থাকে, তা অবশ্য বলা যাচ্ছে না। কেননা এমন পণ আগেও অগুনতিবার করেছিলেন তারা, কোনোবারই বিশেষ লাভ-টাভ হয়নি। শক্তরকমে দেয়া কথার পিঠেও কোনোবার বাধার দেয়াল তুলেছিলেন মেসি, কখনো বা পেপ গার্দিওলার স্বর্ণালি যুগের স্মৃতি, আবার কখনো আবেগের ভেলায় ভাসাতে সামনে চলে এসেছিল ক্লাবটির ইতিহাস; ‘ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা’ নামের এই ক্লাবটার ক্ষেত্রে এসব পণটন, কথা দেয়ানেয়া খুব একটা কোনোদিনই খাটেনি।
যুগের পর যুগ এত সব ভালোবাসা-ইতিহাস-চেতনা-মাঠের পারফরম্যান্স মিলেমিশে একাকার হয়ে বার্সেলোনা হয়ে উঠেছে ক্লাবের চেয়েও বেশি কিছু।
যেভাবে হলো এফসি বার্সেলোনা
সুইস ব্যবসায়ী হ্যান্স ম্যাক্স গাম্পার মূলত রওনা দিয়েছিলেন আফ্রিকার উদ্দেশ্যে, সেখানটায় কিছু চিনিকল কোম্পানি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দেখভাল করতে। তখনকার যে যাতায়াত-ব্যবস্থা, তাতে সুইজারল্যান্ড থেকে আফ্রিকা অঞ্চলটায় যেতে হলে পেরোতে হতো বার্সেলোনা শহর, গাম্পারের এক চাচা তখন ওখানেই থাকেন। একই শহর দিয়ে যখন যেতে হবেই, তখন চাচার বাড়ি বেড়িয়ে গেলে মন্দ হয় না। এই ভেবে গাম্পার দিনকতকের জন্যে আস্তানা গেড়েছিলেন বার্সেলোনায়। তখন কি আর জানতেন, বার্সেলোনার সঙ্গে তাকে পাকাপাকিভাবে জুড়ে দেওয়ার চিত্রকল্পটা বিধাতা আঁকতে শুরু করেছিলেন এই মুহূর্ত দিয়েই!
একদম প্রথম দর্শনেই বার্সেলোনাকে ভালো লেগে গিয়েছিল বলে গাম্পার দাঁড়ি বসিয়েছিলেন আফ্রিকা গমনের পরিকল্পনায়, সঙ্গে সঙ্গে নিজের সুইস নাম বদলে বেছে নিয়েছিলেন এক কাতালান নাম, হুয়ান গাম্পার। বার্সেলোনাতেই কিছু একটা করবেন ঠিক করে প্রথমে হয়েছিলেন ক্রেদি লিওনেঁর অ্যাকাউন্ট্যান্ট। চাকরি করেছিলেন সারিয়া রেলওয়ে কোম্পানি আর দু’টো সুইস পত্রিকার ক্রীড়া প্রতিবেদক হিসেবেও। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘লস দেপোর্তেস’ নামের এক ম্যাগাজিন।
কিন্তু এই ব্যবসায়ী গাম্পারের আড়ালে অন্য এক গাম্পারও তো লুকিয়ে ছিলেন, যিনি হতে চাইতেন ক্রীড়াবিদ, ভালোবাসতেন খেলতে। ছোটবেলা থেকে রাগবি-টেনিস-গালফ কিংবা এই জাতীয় খেলা খেলে বড় হওয়া এই মানুষটির মূল ঝোঁকটা ছিল ফুটবলে। সুইজারল্যান্ডে থাকাকালীন তো তাকে ফুটবল দলে ভেড়াতে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়তো দলগুলোর ভেতরে। বার্সেলোনায় এসে থিতু হবার আগেই খেলেছিলেন এফসি বাসেল, এফসি উইন্টারথারের মতো সব ক্লাবে, বয়স ২২ পেরোবার আগেই গড়ে তুলেছিলেন এফসি জুরিখ ক্লাব। বার্সেলোনায় এসেও ব্যবসার ফাঁকেতালে কী করে ফুটবল খেলা যায়, গাম্পার ভাবছিলেন তা-ই। কিন্তু কেবল নিজে ভাবলেই তো হবে না, বরং ফুটবল খেলতে চাই গোটা একটা দল। এই দল গড়ে তুলবার জন্যে ‘লস দেপোর্তেস’ ম্যাগাজিনে ১৮৯৯ সনের ২২ অক্টোবর তারিখে হুয়ান গাম্পার ছাপালেন ৮ লাইনের এক বিজ্ঞাপন। তাতে বললেন,
‘একটি ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আগ্রহীরা আগামী ২৯ অক্টোবর তারিখে, রাত ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে চলে আসবেন জিমনাসিয়া সোলেতে।’
গাম্পারের ডাকে সাড়া দিয়ে ২৯ অক্টোবর, ১৮৯৯ তারিখে জিম সোলের অফিসে জড়ো হয়েছিলেন গুয়ালতেরি ওয়াইল্ড, লুইস ডি’অসো, বার্তোমেউ তেরাদোস, ওতো কুঞ্জলে, ওতো মায়ের, এনরিক দুকাল, পিরে ক্যাবট, কার্লেস পুজেল, জোসেপ লোবেট এবং জন আর উইলিয়াম পারসন। নাম-তারিখগুলো ভুলবেন না যেন! আজ যাকে আমরা ‘ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা’ বলে চিনি, তার জন্ম তো ১২ জনের ওই সভাতেই।
একদল ইংরেজ প্রবাসীর সঙ্গে বোনানোভা সাইকেল ট্র্যাকে গাম্পাররা খেলেছিলেন বার্সেলোনার ইতিহাসের প্রথম ম্যাচ। ম্যাচটা অবশ্য বার্সেলোনা হেরেছিল ১-০ ব্যবধানে। শুরুটা হার দিয়ে হলেও স্পেনের শীর্ষ দল হিসেবে বার্সা নাম কামিয়ে নিয়েছিল আবির্ভাবের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ১৯০২ সালে ‘কোপা মাকায়া’ জিতে ট্রফি ক্যাবিনেটে এসেছিল প্রথম শিরোপা। স্পেনের ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থা (রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন) কর্তৃক প্রবর্তিত কোপা দেল রের শুরুর আসরেও ফাইনাল খেলেছিল দলটি। যদিও বাস্ক অঞ্চলের ক্লাব ভিজকায়ার কাছে হেরে গিয়েছিল ২-১ ব্যবধানে, তবে ১৯২৫ সালের মধ্যে ৬ বার আসরটির শিরোপা তারা জিতেছিল ঠিকই। এছাড়া একই সময়কালে ১২ বার কাতালান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ এবং তৎকালীন ইউরোপীয় ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর বলে বিবেচিত, পাইরেনিস কাপের শিরোপা পরপর চার মৌসুমে জিতে গোটা ইউরোপেই ফুটবল ক্লাব হিসেবে সমীহ জাগাবার কাজটিও বার্সেলোনা করে ফেলে এরই মধ্যে।
তবে যে কারণে বার্সাকে বলা হচ্ছে ‘More than a club’, তার গল্পটি শুরু হচ্ছে এরপর থেকেই।
ক্লাবের চেয়েও বেশি কিছু?
জাত্যাভিমান-আঞ্চলিক বিদ্বেষ তো সবখানেই থাকে, তবে স্পেনের ওদিকটায় এসব একটু বেশি মাত্রাতেই ছিল। কেননা রাজা ফার্ডিনান্ড আর রানি ইসাবেলা, মিলিত শক্তিবলে মুরদের কাছ থেকে ‘আইবেরিয়ান পেনিনসুলা’ জাতীয় রাজ্য করায়ত্ত করে তাদের সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করলেও একীভূত স্পেনে মানুষে-মানুষে মনের মিলটা কখনোই হয়নি। বরং রা জা-রানী নিজেদের রাজ্য বৃদ্ধির বিনিময়ে ওসব অঞ্চলকে দিয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসন। ফলতঃ ওসব এলাকার মানুষেরা নিজেদের কখনো ‘স্প্যানিশ’ বলেই মনে করেনি। উল্টো গ্যালিসিয়া, কাতালুনিয়া, ভ্যালেন্সিয়া রাজ্যের মানুষগুলো সবসময়ই সচেষ্ট ছিল নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, এবং স্বকীয়তা রক্ষায়; এমনকি স্পেনের অংশ হবার পরেও বাস্করা আর কাতালানরা মেনে চলতো তাদের পূর্বপুরুষদের নিয়মকানুনই।
উত্তরকালে নানা শাসক অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন স্পেনের এই পৃথকীকরণ নীতির ইতি টানতে। যেমন: রাজা চতুর্থ ফিলিপের পরামর্শক কাউন্ট ডিউক ডি অলিভারেস চেষ্টা করেছিলেন, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক আর বিধানিক দিক থেকে স্প্যানিশদের একত্রিত করতে। লাভের লাভ অবশ্য কিছুই হয়নি সেবার। বরং নিজেরা কার্লিস্ট যুদ্ধ হারার পর এবং স্পেন ইউরোপের বাইরে তাদের সমস্ত উপনিবেশকে স্বাধীনতা প্রদানে বাধ্য হলে স্পেনের সীমানাপাড়ের (কাতালুনিয়া, গ্যালিসিয়া, বাস্ক অঞ্চল) জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবাদ জেগে উঠতে শুরু করে আরও তীব্রভাবে। ঊনবিংশ শতকে কয়েকজন বামপন্থীর হাত ধরে শুরু হয় কাতালান রেনেসাঁ, বহির্বিশ্বে কাতালান দর্শন ছড়িয়ে দেয়াই ছিল যার উদ্দেশ্য। কাতালানদের সঙ্গে সঙ্গেই বাস্ক এবং গ্যালিসিয়া অঞ্চলেও শুরু হয় ‘Rexurdimento’ আর ‘Eusko Pizkundea’ আন্দোলন; অনুবাদ করলে যার মানেটা দাঁড়ায় একই, পুনর্জাগরণ।
এই পুনর্জাগরণটা ওই কাতালুনিয়া আর বাস্ক অঞ্চলকে স্পেনের বাদবাকি অংশের চাইতে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, কৃষিজ, তথা সবদিক থেকেই এগিয়ে দেয় অনেকখানি। শিল্প-সংস্কৃতির দিক থেকেও কাতালানরা যে তখন স্বর্ণযুগ পার করছিল, তা বুঝতে পারা যায় সে যুগের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের দিকে তাকালে। স্থপতি আন্তোনিও গদি, পরাবাস্তববাদী চিত্রকর সালভাদর দালি, সংগীতজ্ঞ ফেলিপে পেদ্রেল, তারা সকলেই ছিলেন কাতালান। এমন কি মালাগায় জন্ম নিলেও পাবলো পিকাসো কাতালুনিয়ায় চলে আসেন মাত্র ১৪ বছর বয়সে, এবং সেখানেই আয়োজিত হয়েছিল তার প্রথম প্রদর্শনী।
জাগরণের গান শোনা থেকে ফুটবলই বা বাদ থাকে কী করে! পুনর্জাগরণের ওই সময়টাতেই ব্রিটিশ নাবিক আর লৌহশ্রমিকদেরদের হাত ধরে ফুটবলটা এসেছিল স্পেনে, বাদবাকি অঞ্চলগুলোর মতো কাতালানরাও নেমেছিল সে ফুটবল-বিপ্লবে। বিপ্লবী কাতালানরা তাদের প্রাণের দল হিসেবে বেছে নিয়েছিল বার্সেলোনাকে এবং একে জাতীয়তাবাদী রূপ দিতে শুরু থেকেই ছিল সচেষ্ট। বার্সার লোগোর বাঁয়ে তাই স্থান দেয়া হয় কাতালান পতাকার লাল-হলুদ ডোরাকে, ১৯২১ সালে ক্লাবটির প্রাতিষ্ঠানিক ভাষাতে পরিণত হয় কাতালান।
তবে এ তো আর রূপকথা নয়, বার্সেলোনার দিনকালও তাই সরলরেখায় চলেনি সুখ-শান্তিকে ধ্রুব রেখে। বরং কাতালানদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে গিয়ে বার্সাকেও আঘাত সইতে হয়েছে বিস্তর।
ইতিহাসটা আঘাতেরও
ফুটবলে টাকার ঝনঝনানিটা আজকাল অতিমাত্রায় বেশি। তবে টাকার প্রভাব খেলাটার ওই হাঁটি-হাঁটি পা-পা দিনগুলোতেও ছিল। মাঝে টানা চার বছর শিরোপাহীন থাকায় বার্সেলোনা দেউলিয়া হয়ে যেতে বসেছিল একদম গোড়াতেই। কিন্তু ভালোবাসার ক্লাবকে এভাবে নিশ্চিহ্ন হতে দেখে হাল ধরেছিলেন গাম্পার, ক্লাবের অর্থনৈতিক ঘাটতি পূরণ করেছিলেন নিজের কোষাগার থেকে। তারই হাত ধরে বার্সা পেয়েছিল পেশাদারিত্বের ছোঁয়া, খেলোয়াড়েরা এসেছিলেন চুক্তির আওতায়, নতুন স্টেডিয়ামও মিলেছিল তার সভাপতিত্বেই। সব যখন চলছিল ঠিকঠাক, তখন ১৯২৫ সালে ইংল্যান্ড থেকে একটি ফুটবল দল বার্সেলোনার বিপক্ষে খেলতে এলেই বাঁধে বিপত্তি। ম্যাচ শুরুর পূর্বে স্পেনের জাতীয় সংগীত বাজানো হলে দুয়োধ্বনিতে ব্যঙ্গোক্তি করেন মাঠে উপস্থিত স্বাধীনতাকামী কাতালানরা। এ খবর মাদ্রিদের স্বৈরশাসকের কানে গেলে বার্সেলোনার তৎকালীন ভেন্যু লেস কোর্টসে খেলা গড়ানো বন্ধ থাকে ছয় মাস, সঙ্গে সঙ্গে সভাপতির পদ থেকে হুয়ান গাম্পার হন পদচ্যুত। এই দুই আঘাত গাম্পারের জীবনে যেন এসেছিল বজ্রপাতের মতো, সঙ্গে ওয়াল স্ট্রিটে শেয়ারবাজার ধ্বসের দরুন অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়েছিলেন নিদারুণভাবে। চতুর্দিকে এত বিপর্যয় মানতে না পেরে গাম্পার সুখ খুঁজে নেন আত্মহত্যায়, বার্সেলোনার ওপর নেমে আসে প্রথম বড় আঘাত।
গাম্পারের মৃত্যুর পর বার্সেলোনা কোণঠাসা হতে শুরু করে একটু একটু করে। একই সঙ্গে গোটা স্পেনজুড়েই বাড়ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, যা ১৯৩৬ সালে গিয়ে রূপ নেয় গৃহযুদ্ধের। তিন বছর আর পাঁচ লাখ মানুষের রক্তে রঞ্জিত পথ বেয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ফ্র্যাংকো। গদিতে বসেই এক শাসনতন্ত্রে স্পেন চালাবার নীতি বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন ফ্র্যাংকো, ফলে স্পেনের প্রান্তসীমার অঞ্চলগুলোর ওপর আঘাত আসতে শুরু করেছিল শুরু থেকেই। গণতন্ত্রের অনুসারী, একইসঙ্গে যুদ্ধে রিপাবলিকানদের পক্ষ নিয়েছিল বলে কাতালানরা যে আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল সবচেয়ে বেশি।
কেমন ছিল ফ্র্যাংকোর বার্সেলোনা?
১৯৩৮-এর মার্চে কাতালুনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনায় গণহত্যা চালায় ফ্র্যাংকোর আর্মিরা, যেখানে মাত্র তিনদিনে হত্যা করা হয় হাজারের বেশি মানুষকে। রিপাবলিকান শাসনামলে পাওয়া স্বায়ত্তশাসনের অধিকার তুলে নেয়া হয় কাতালানদের কাছ থেকে, স্প্যানিশ রীতিনীতি, সংস্কৃতি, ভাষা চাপিয়ে দেয়া শুরু হয় তাদের ওপরে। কর বাড়িয়ে দেয়া হয় আগের চাইতে বহুগুণ, কেননা ফ্র্যাংকোর আদালত কাতালুনিয়াকে দেখেছিল বাকি অঞ্চলের চাইতে ধনী হিসেবে।
আঘাত এসেছিল ক্লাব বার্সেলোনার ওপরও। ১৯৩৮ সালে এফসি বার্সেলোনার ক্লাবহাউজ বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া হয় ফ্র্যাংকোর নির্দেশে, মূলত এর পরপরই বার্সেলোনা শহরটা পুরোপুরিভাবে চলে আসে ফ্র্যাংকোর নিয়ন্ত্রণে। গৃহযুদ্ধ শুরু হবার ঠিক আগে আগে নির্বাচিত ক্লাব সভাপতি জোসেফ সুনিওল ছিলেন কট্টর বামপন্থী এবং রিপাবলিকানদের অনুসারী। গৃহযুদ্ধ শুরু হবার প্রথম মাসেই ফ্র্যাংকো-বাহিনী প্রথমে আটক এবং পরবর্তীতে নির্মমভাবে হত্যা করে তাকে। হয়তো বা একই ভাগ্য বরণ করতে হতো বার্সেলোনার বাদবাকি সদস্য এবং খেলোয়াড়দেরকেও। তবে যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই পালিয়ে মেক্সিকো, ফ্রান্সসহ অন্য দেশগুলোতে চলে গিয়েছিলেন বলে বেঁচে গিয়েছিলেন তারা। ক্লাবের সদস্যরা এভাবে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়াতে যুদ্ধ শেষে বার্সার সদস্যসংখ্যা কমতে কমতে নেমে আসে মাত্র ৩৫০০ জনে।
ফ্র্যাংকোর স্বৈরশাসনের শুরুর দিকে স্পেনের সমস্ত ক্লাবের প্রশাসনকেই নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয় কেন্দ্র থেকে। ১৯৪৬ পর্যন্ত বার্সেলোনার পরিচালনা পর্ষদ ঠিক করে দেয়া হয় ‘ন্যাশনাল স্পোর্টস ডেলিগেশন অব দ্য ফ্যালাঞ্জে’ থেকে। জানিয়ে দেয়া হয়, এই বার্সেলোনা আর আগের বার্সেলোনার প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না। ক্লাবের আমূল সংস্কারের অংশ হিসেবে স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ বদল আনে বার্সার লোগোতে। আগের লোগোর বাঁয়ে থাকা কাতালান পতাকার চার ডোরার জায়গা নেয় স্পেনের পতাকার দুই ডোরা। বদল আসে নামেও, ‘ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা’ থেকে হয়ে যায় ‘ক্লাব ডি ফুটবল বার্সেলোনা’। সূক্ষ্ম এই বদলে হয়তো বা বোঝা যায় না, প্রথম নামটি লেখা হয়েছে কাতালান ভাষায়, পরেরটি স্প্যানিশে।
বার্সেলোনার ওপর আঘাত এসেছিল খেলোয়াড়দের দলবদলেও। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য, যে আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকে নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ রচনা করেছিল তাদের ইতিহাসের স্বর্ণালিতম অধ্যায়, সেই তিনি কি না স্পেনে পাড়ি জমিয়েছিলেন বার্সায় খেলবার উদ্দেশ্যে!
ডি স্টেফানো কার?
আলফ্রেডো ডি স্টেফানো তখন ২৫ বছরের তরুণ, খেলতেন বোগোটা মিলনারিওসে। তাদের হয়েই স্পেনে একটি আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট খেলতে এসে বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ দু’য়েরই নজর কাড়েন ডি স্টেফানো। তবে তাকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টাটা বার্সেলোনার তরফ থেকেই বেশি ছিল বোধহয়, বোগোটার সঙ্গে যোগাযোগ করবার সাথে সাথে তারা যোগাযোগ করেছিল আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভারপ্লেটের সঙ্গেও।
রিভারপ্লেটের সঙ্গে যোগাযোগের কারণ, বোগোটার হয়ে খেললেও এই আর্জেন্টাইনের রেজিস্ট্রেশন করা ছিল রিভারপ্লেটের নামে। ‘যে ক্লাবের হয়ে রেজিস্ট্রেশন, স্টেফানোকে বুঝে নিতে হবে তাদের কাছ থেকেই’, এমন বুঝ পেয়ে বার্সেলোনা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় বোগোটার সঙ্গে, বরং স্টেফানোর চুক্তির অংশ হিসেবে রিভারপ্লেটকে পাঠিয়ে দেয় সাড়ে চার মিলিয়ন পেস্তা। ডি স্টেফানো এবং তার পরিবার এসে নামেন বার্সেলোনাতে, ব্লগরানা জার্সিতে অংশ নেন কিছু প্রীতি ম্যাচেও।
সবকিছুই যখন চলছিল ঠিকঠাক, তখনই এসে বাদ সাধেন স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের হর্তাকর্তারা। তাদের মতে, বোগোটা মিলনারিওস ক্লাব এই চুক্তিতে রাজি হয়নি, সুতরাং খেলোয়াড়ের এই দলবদল প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য নয় তাদের কাছে। বার্সেলোনা অবশ্য তাদের দাবি আঁকড়ে বসেই ছিল যে, এই দলবদল প্রক্রিয়ায় বোগোটার কোনো অংশ থাকতেই পারে না। বার্সেলোনার তৎকালীন বোর্ড ভুল করেছিল, এমন কিছুও বলা যাচ্ছে না, কেননা ফিফাও একমত পোষণ করেছিল বার্সেলোনার দাবির সঙ্গে।
কিন্তু তখন ফিফা-বার্সা মানতে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের বয়েই গেছে! স্টেফানোকে বার্সার জার্সি গায়ে মাঠে নামতে দিতে রাজিই হয়নি তারা। তাদের এই কালক্ষেপণের সুযোগ নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ ডি স্টেফানোর ব্যাপারে চুক্তিতে পৌঁছায় বোগোটার সঙ্গে।
এমন অচলাবস্থায় বেশ কয়েক মাস কাটবার পর আরএফইএফ সিদ্ধান্ত দেয়, চার বছরের পরিক্রমায় ডি স্টেফানো এক মৌসুম খেলবেন রিয়ালের জার্সিতে, পরের মৌসুমে গায়ে চাপাবেন বার্সার জার্সি, যার শুরুটা হবে রিয়াল দিয়ে। এমন সিদ্ধান্তকে বার্সা বোর্ডের কর্তারা দেখেছিলেন আঁতে ঘা লাগবার মতোন। স্টেফানোকে দলে ভেড়াতে না পারায় বার্সা সভাপতি মার্টি কারেতো বাধ্য হয়েছিলেন পদত্যাগে, একইসঙ্গে স্টেফানোর সঙ্গে চুক্তি ভেঙে দিয়েছিল বার্সার অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের কর্তারা। রিয়ালের জার্সি গায়ে চাপিয়ে এরপর স্টেফানো গড়েছিলেন ইতিহাস।
তবে প্রশ্নটা তো রয়েই যাচ্ছে। কোনো কারণে বার্সেলোনার সঙ্গে রিভারপ্লেটের চুক্তির বৈধতা ফিফা মানলেও স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ মানেনি? প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তরটা মেলেনি এখনো। তবে বরাবরই ইঙ্গিতটা গিয়েছিল জেনারেল ফ্র্যাংকোর দিকে।
পঞ্চাশের দশকটায় রিয়াল মাদ্রিদ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে পরিচিত ছিল ফ্র্যাংকোর দল হিসেবে। হয়তো বা কিছুটা অতিরঞ্জন ছিল এই বক্তব্যে, তবে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিষ্কার সমর্থন বরাবরই ছিল রিয়াল মাদ্রিদের দিকে। রিয়ালের তৎকালীন সভাপতি সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সঙ্গেও ফ্র্যাংকোর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। আর স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের ওপর তার প্রভাব যে ছিল, তা তো বলাই বাহুল্য। বার্সেলোনার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে তাই চাঁছাছোলা ভাষাতেই স্টেফানোর দলবদলের ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে ‘A strange federative maneuver with Francoist backing’ বলে।
কেন বলছি ‘মোর দ্যান আ ক্লাব’?
প্রথমে গৃহযুদ্ধ, তারপরে বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে স্পেন সবদিক থেকেই পড়ে গিয়েছিল গভীর সংকটে, আর জেনারেল ফ্র্যাংকোর ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতায় আসবার দরুণ অনেক দেশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল স্পেন থেকে। এরকম বিপর্যস্ত অবস্থায় মানুষের মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখার মাধ্যম হিসেবে ফ্র্যাংকো সরকার বেছে নিয়েছিল ফুটবলকে; আর জাতিতে-জাতিতে রেষারেষি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করে দিয়েছিলেন ফুটবল ক্লাবগুলোর মাঝে, যেহেতু ক্লাবগুলো তখন ছিল অঞ্চলেরই প্রতিশব্দ।
বার্সা সমর্থকেরা এই সুযোগটা নিয়েছিলেন কড়ায়-গণ্ডায়। তারা এই অস্থির সময়টায় ফুটবল ক্লাবেই ঢেলে দিয়েছিলেন নিজেদের স্বজাত্যবোধের পুরোটা, ফুটবলের মাধ্যমেই তারা দাবি করতে থাকে স্বাধীনতার। ভিক ডিউক এবং লিজ ক্রলি তাদের লেখা ‘ফুটবল, ন্যাশনালিটি, অ্যান্ড স্টেট’ বইতে যেমন বলছেন,
“যেহেতু কাতালানদের অধিকার রক্ষায় তখন কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, কোনো আঞ্চলিক সরকার ছিল না, স্বীয় ভাষায় কথা বলবার জন্যে কোনো অধিকার ছিল না, তারা তাদের সমস্ত অহংবোধ ঢেলে দিয়েছিল বার্সার ওপরে। বার্সার ম্যাচে তারা কাতালান ভাষায় কথা বলতে পারতো, নিজেদের ঐতিহ্যবাহী গান গাইতে পারতো, যে সুযোগ তারা অন্য কোথাও পেতো না।”
বার্সেলোনাকেই যে কাতালানরা কাতালুনিয়ার অধিকার আদায়ের মঞ্চ ভাবতেন, তার একপ্রস্থ প্রমাণ পাওয়া যায় ফ্র্যাংকো শাসনামলের শেষদিকে। ১৯৭৪-এর ১৮ ফেব্রুয়ারিতে হওয়া এল ক্লাসিকোতে রিয়াল মাদ্রিদকে ৫-০ ব্যবধানে হারাবার পর কাতালুনিয়ার বাসিন্দারা বার্সেলোনার নীল-মেরুন পতাকার বদলে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন লাল-হলুদ কাতালান পতাকা নিয়ে। স্পেনের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে কাতালানরা যে বার্সেলোনাকেই বেছে নিয়েছিল, তা পরিষ্কার বোঝা যায় এ ঘটনাতেই।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বার্সেলোনা আরও গভীরভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছে কাতালান জাতিসত্তার সঙ্গে। ফ্র্যাংকোর শাসনামলে স্বায়ত্তশাসন হারানো কাতালানরা স্পেন থেকে মুক্তি চায় এখনো। এখনো তাই ন্যু ক্যাম্পের খেলাগুলোতে স্পেনের জাতীয় সংগীতে দুয়োধ্বনির আওয়াজ ওঠে, খেলা চলাকালীন এখনো তাই দর্শকসারিতে ব্যানার আসে, ‘আমরা কাতালানরা স্বাধীনতা চাই।’
বার্সেলোনা কাতালুনিয়ার সঙ্গে এমন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে বলে ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর নারসিস ডি কারিয়াস তাই বলেছিলেন,
‘Barca is something more than a football club.’
কারিয়াসের কথাকে আপ্ত মেনে পরবর্তীকালে ক্লাবের স্লোগানই হয়ে গিয়েছে ‘mes que un club’, যার বাংলা দাঁড়াচ্ছে, ক্লাবের চেয়েও বেশি।
অবশ্য ক্লাবের মোটো হিসেবে লাইনটি লিখবার দরকারই বা কী ছিল? একটা গোটা জনগোষ্ঠীর বুকের ভেতরে স্বাধীনতার বারুদ জ্বালানো, ১১১ বছর ধরে অর্থের বিনিময়ে জার্সিসত্ত্ব বিক্রি না করা, কেবলমাত্র ক্লাবের নামে আঁচড় লাগবে বলে যৌক্তিক দাবি নিয়েও লিওনেল মেসির বোর্ডকে আদালতের কাঠগড়ায় না তোলা, জাতীয় দলের কোচ থাকাকালীন রোনাল্ড ক্যোমানের চুক্তিপত্রে লেখা থাকা, ‘কেবলমাত্র বার্সা থেকেই ডাক এলে চাকরি ছাড়তে পারবেন তিনি’, ক্যান্সারফেরত সতীর্থের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ এরিক আবিদালের হাতে কার্লোস পুয়োলের কাপ্তানের আর্মব্যান্ড তুলে দেয়া, আর সব ভুলে মাঠে দলের ভয়ংকর দুর্দশাতেও দলটার সমর্থকদের টিভিতে বুঁদ হয়ে থাকা – বার্সাকে ‘ক্লাবের চেয়েও বড়’ প্রমাণে এমন সব গল্পই কি যথেষ্ট হতো না?