ক্রিকেট ভারী বৈচিত্র্যময় খেলা। নানা সময় নানা আয়োজন করা হয়ে থাকে খেলাটি আরো বৈচিত্র্যময়, আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে। এই নানামুখী আয়োজনের একটি হলো ফাইভ মিনিট বেল; খেলা শুরু করার আগে ঘন্টা বাজানো। ইংল্যান্ডের লর্ডস থেকে শুরু হয়ে আরও বেশ কয়েকটি ভেন্যুতে পালন করা হয়েছে এই রীতি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- বাংলাদেশের নামও এর সাথে জড়িয়ে আছে বিভিন্নভাবে।
ফাইভ মিনিট বেলের শুরুটা খুব বেশি আগে না। ২০০৭ সালে প্রথম এই ধারণার প্রচলন লর্ডসে। এই লর্ডসের বদৌলতে ক্রিকেট দেখেছে অনেক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ক্রিকেট এরকমই আরও এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয় ২০০৭ সালের ইংলিশ গ্রীষ্মে, যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চার টেস্ট, তিন ওয়ানডে ও দুই টি-টোয়েন্টির এক দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ডে আসে।
সিরিজ মাঠে গড়ায় টেস্ট দিয়ে এবং প্রথম টেস্টই ছিল লর্ডসে। প্রথমদিন খেলা শুরু হওয়ার আগে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব অবাক হয়ে এমন এক ব্যাপার খেয়াল করল যা আগে কখনো দেখা যায়নি- লর্ডস প্যাভিলিয়নের বোলার বারের বাইরে এক ঘন্টা রাখা। বল মাঠে গড়াবার ঠিক আগমুহূর্তে সেই ঘন্টা পাঁচ মিনিট ঢং ঢং করে বেজে চলল; বাজালেন সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তি স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস ও বিবিসি টেস্ট ম্যাচ স্পেশালের তৎকালীন প্রযোজক পিটার বাক্সটার। ঐ টেস্টের প্রতিদিনই এভাবে ঘন্টা বাজিয়ে খেলা শুরু হলো।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর একই গ্রীষ্মে ইংল্যান্ড সফরে আসে ভারত। সেই সিরিজেও একইভাবে লর্ডসের এই নতুন সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়। সেই থেকে বলতে গেলে অনেকটা নিয়মেই পরিণত হয় এটা। লর্ডসে তখন থেকে এখন পর্যন্ত হওয়া প্রতি ম্যাচেই এ রীতি পালন করা হয়েছে।
সাধারণত সাবেক ক্রিকেটার, সংগঠক বা ক্রীড়ানুরাগী কোনো ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় লর্ডসের এই ঘন্টা বাজাতে। সেই ধারা অনুযায়ী একে একে এই সুযোগ পেয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়, স্যার গ্যারি সোবার্স, কপিল দেব, সুনীল গাভাস্কার, ব্রায়ান লারা, সঞ্জয় মাঞ্জেরেকার, ব্রেট লি, কুমার সাঙ্গাকারা, পল কলিংউডদের মতো রথী-মহারথীরা। ক্রিকেটের বাইরেও লর্ডসের এই অভিজ্ঞতা নিয়েছেন দুজন- জ্যামাইকান দৌড়বিদ ইয়োহান ব্লেক এবং লেখক ও ব্রডকাস্টার স্টিফেন ফ্রাই।
একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে এই ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন খালেদ মাহমুদ সুজন। ২০১০ সালের লর্ডস টেস্ট হয়তো আমরা মনে রেখেছি তামিম ইকবালের সেই বুনো শতক ও উদযাপনের কারণে। তবে সেই টেস্টেই খালেদ মাহমুদ সুজনের এই ঘন্টা বাজাবার কীর্তিও কিন্তু কম স্মরণীয় না।
শুধু কি লর্ডসেই সীমাবদ্ধ ঘন্টা বাজানোর রীতি? না। এখানে শুরু হয়ে আরো বেশ কয়েকটা ভেন্যুতেও এ সংস্কৃতি পালন করা হয়।
২০১৬ সালের শেষের দিকে ভারতে তিন টেস্টের দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে আসে নিউজিল্যান্ড। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট আয়োজন করবে কলকাতার বিখ্যাত ইডেন গার্ডেন্স। তখন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গলের সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি। তার মাথা থেকেই বুদ্ধিটা আসলো। যে-ই ভাবা সে-ই কাজ। ইডেনে স্থাপিত হলো লর্ডসের অনুরুপ সুদৃশ্য এক ঘন্টা। ভারতের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব মহাসমারোহে সৌরভকে সাথে নিয়ে সেই ঘন্টার উদ্বোধন করেন দ্বিতীয় টেস্ট শুরুর আগে।
লর্ডসের মতো ইডেনেও তখন থেকে এই রীতি চালু হয়ে গেল এবং তারপর ইডেনে হওয়া প্রতি ম্যাচেই তা পালন করা হয়েছে। তবে দুটো প্রেক্ষাপটের কথা না উল্লেখ করলেই নয়। কারণ এতে বাংলাদেশের নাম জড়িয়ে আছে।
প্রথমটা ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ, আমাদের গর্ব সাকিব আল হাসানের জন্মদিনে। মজার ব্যাপার হলো, জন্মদিনের দিনেই আইপিএলে তার দল সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের খেলা পড়ল তারই সাবেক দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের সাথে। খেলাটাও আবার ইডেনে। সব মিলিয়ে এমনিতেই ব্যাপারটা জমে গিয়েছিল, তার উপর সাকিবের ইডেনের এই ঘন্টা বাজানোর মুহুর্তটা ব্যাপারটাকে করে তুলল আরো রঙিন।
দ্বিতীয়টাও ২০১৯ সালে, তবে মাসখানেক পর। নভেম্বরে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ হিসেবে ভারতের মাটিতে দুই টেস্ট খেলতে যায় টাইগাররা। হঠাতই সিদ্ধান্ত হয়, দ্বিতীয় টেস্টটা হবে গোলাপী বলে দিবা-রাত্রির। উভয় দলই তাদের ইতিহাসে প্রথম পিংক টেস্ট খেলতে যাচ্ছে, তাই আয়োজনের কমতি নেই। পুরো কলকাতা সাজল গোলাপী আভায়, সাথে থাকল আরো নানা চোখধাঁধাঁনো অনুষ্ঠান। পুরো আবহকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলল টেস্টের প্রথম দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির একসাথে ঘন্টা বাজিয়ে খেলার উদ্বোধন ঘোষণা করার ব্যাপারটি। একই টেস্টের দ্বিতীয় দিনে এই কাজটি করেন বিখ্যাত দুই দাবাড়ু বিশ্বনাথ আনন্দ এবং ম্যাগনাস কার্লসেন।
ঘন্টা বাজাবার রীতি অনুসরণ করা আরেক ভারতীয় ভেন্যু মুম্বাইয়ের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়াম। একটা সময় পর্যন্ত এই মাঠ নিয়মিতই আয়োজন করতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। কিন্তু মুম্বাইয়েরই আরেক স্টেডিয়াম ওয়াংখেড়ের উত্থানের পর স্তিমিত হয়ে যায় ব্রাবোর্ন। তবে অনেকটা হঠাৎ করেই ২০১৮ সালের ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের চতুর্থ ম্যাচ কিছু সমস্যার কারণে ওয়াংখেড়েতে আয়োজন করা সম্ভব না হলে সামনে চলে আসে ব্রাবোর্নের নাম। দীর্ঘদিন পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরাকে স্মরণীয় করে রাখতে লর্ডস ও ইডেনকে অনুসরণ করে ব্যবস্থা করা হয় ঘন্টার। লিটল মাস্টার শচীন রমেশ টেন্ডুলকার এবার এই অনন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ পান।
কথায় আছে, শেষ ভালো যার সব ভালো তার। শেষের একটা গুরুত্ব আছে বটে। তাই এই লেখার শেষটা বাংলাদেশকে দিয়েই হোক।
২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের সাথে টাইগারদের ২ ম্যাচ হোম সিরিজে বিসিবি সিদ্ধান্ত নেয় সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামকে টেস্ট ভেন্যু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। সেই ধারাবাহিকতায় দেশের ৮ম টেস্ট ভেন্যু হিসেবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে আত্মপ্রকাশ ঘটে সিলেটের। এই উপলক্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে অনেক অনেক আয়োজন করে বিসিবি। সেসবের মধ্য একটা ছিল এই ঘন্টা বাজিয়ে খেলা শুরু করবার রীতি অনুসরণ করা। বাংলাদেশের কোনো স্টেডিয়ামে এখন পর্যন্ত এই একবারই ঘন্টা বাজাবার সেই বিরল সুযোগটা পান সাবেক ক্রিকেটার আকরাম খান।