প্রাচীনকাল থেকেই মধু খাবার এবং ওষুধ উভয় হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শুধু আয়ুর্বেদ নয়, বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানও মধুর উপকারের সাথে একমত। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, এশিয়া, এমনকি পুরো বিশ্বেই মধুর ব্যাপক চাহিদা। অনেকেই দু’বেলা নিয়ম করে খায় মধু। কিন্তু কী আছে এই মধুতে? কেন খেতে হবে নিয়মিত? আজ চলুন জানা যাক মধুর সাতকাহন।
মধুর ইতিহাস
বলা হয়ে থাকে, প্রায় ৮,০০০ বছর আগে মধু মানুষ প্রথমে ব্যবহার করত। যদিও খ্রিস্টপূর্ব ২,৪০০ অব্দ অবধি মৌমাছির কলোনী রাখা কিংবা চাষের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বহু শতাব্দী ধরে বহু চিকিৎসার মূল ভিত্তি ছিল মধু। ৪,০০০ বছর পূর্বে নানা আয়ুর্বেদিক ওষুধে মধু ব্যবহার করা হতো, যেখানে এটি দেহের বদহজম এবং ভারসাম্যহীনতা নিরাময়ে কার্যকর বলে মনে করা হতো। তখন ক্ষতস্থানের চিকিৎসার জন্যও ত্বকে ঘষে ব্যবহার করতো তারা।
যা আছে মধুতে
মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান রয়েছে। এটি গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ এবং খনিজের মতো উপাদান, যেমন- আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফেট, সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম দিয়ে তৈরি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) জাতীয় পুষ্টি ডাটাবেস অনুসারে, এক টেবিল চামচ মধুতে ৬৪ গ্রাম ক্যালরি, ১৭ গ্রাম সুগার, ১৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবার, ফ্যাট এবং প্রোটিনের পরিমাণ ০ গ্রাম। আরো রয়েছে:
- ফ্রুক্টোজ: ৩৮.২ শতাংশ
- গ্লুকোজ: ৩১.৩ শতাংশ
- মাল্টোজ: ৭.১ শতাংশ
- সুক্রোজ: ১.৩ শতাংশ
- পানি: ১৭.২ শতাংশ
- উচ্চতর শর্করা: ১.৫ শতাংশ
- অন্যান্য: ৩.২ শতাংশ
তবে মধুতে থাকা উপাদানগুলো উৎপাদনে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট উদ্ভিদের পাশাপাশি এর পানির পরিমাণের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।
কেন খাবেন মধু?
ত্বক ও মুখের যত্নে মধু
ময়েশ্চারাইজিং এবং পুষ্টিকর বৈশিষ্ট্যের কারণে ত্বকে মধুর ব্যবহার খুবই উপকারী। বিশেষ করে আপনার শুষ্ক ত্বকের জন্য মধু হতে পারে সেরা প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার। এটি প্রয়োগ করাও খুব সহজ। এটি পার্চযুক্ত ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করতে সহায়তা করে। পাশাপাশি মধু শীতের সময় ফাটা ঠোঁট নিরাময়েও দারুণ। এটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক হওয়ায় ক্ষত, ঘা, কাটা, পোড়া ও অন্যান্য সংক্রমণের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়।
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে
আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে এমন খাবার গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধু স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। মধু সেবন বিপাকীয় চাপকে বাধা দেয় এবং মস্তিষ্ককে শান্ত করতে সহায়তা করে যা দীর্ঘকালীন স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে।
কাশির জন্য ঘরোয়া প্রতিকার
শিশুদের জন্য কাশি একটি সাধারণ সমস্যা। তবে কাশির জন্য মূলধারার ওষুধ সবসময় কার্যকর হয় না এবং এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও হতে পারে।
মজার বিষয় হলো, মধু শুকনো কাশির পাশাপাশি ভেজা কাশি নিরাময়ের অন্যতম সেরা ঘরোয়া উপায় হিসাবে পরিচিত। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, এক চামচ মধু পান গলায় জ্বালা কমাতে দ্রুত কাজ করে। মধু বিশেষত বাচ্চাদের কাশির জন্য দারুণ প্রাকৃতিক প্রতিকারের উপায় হিসেবে বিবেচিত। তাছাড়া এটি ঘুমের সময় কাশির উপশমে সাহায্য করে। তবে বটুলিজমের ঝুঁকির কারণে এক বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের মধু দেওয়া উচিত নয়।
চুলের যত্নে মধু
আপনি কি জানেন চুলের জন্য মধু কতটা উপকারী হতে পারে? খুশকির জন্য অন্যতম সেরা প্রাকৃতিক ঘরোয়া প্রতিকার হচ্ছে মধু। এজন্য আপনাকে যা করতে হবে তা হলো: ২ টেবিল চামচ মধু ও সমপরিমাণে উদ্ভিজ্জ তেল মিশিয়ে চুলে লাগান। এই মিশ্রণটি চুলে লাগিয়ে ১৫ মিনিটের জন্য রেখে দিন এবং ১৫ মিনিট পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এটি কেবল শুষ্ক চুলকে পুষ্টি সরবরাহ করে না, পাশাপাশি চুলকে করে মসৃণ এবং নরম।
ক্ষত নিরাময়ে মধু
গবেষণায় দেখা গেছে যে, কাঁচা মধু অযাচিত ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাককে হত্যা করতে পারে। মধুতে অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল, অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে- এ কারণেই মধু ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
প্রাকৃতিক স্লিপিং এইড হিসেবে মধু
ঘুমে সমস্যা হচ্ছে? পর্যাপ্ত ঘুম হয় না? সমাধানে রয়েছে মধু। ঘুমানোর ঠিক আগে গরম দুধ ও মধুর মিশ্রণের পানীয়টি খেতে পারেন। কয়েক শতাব্দী ধরে মানুষের ঘুমের সহায়তায় এই পানীয়র ব্যবহার হয়ে আসছে। এই পানীয় তৈরি করাও খুবই সহজ।
আপনাকে যা করতে হবে: এক গ্লাস গরম দুধে এক চা চামচ মধু যোগ করে পান করুন। রাতে ভাল ঘুম হতে এটি দারুণ উপকারী।
সাইনোসাইটিসে মধুর ভূমিকা
ক্রমবর্ধমান দূষণ এবং ধূলিকণার ফলে আজকাল অনেক লোক সাইনাস সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছে। মধু একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়াম এবং অ্যান্টি-সেপটিক যা সংক্রমণ পরিষ্কার করতে এবং প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। মধু কাশি হ্রাস করে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে, যার ফলে সাইনাস সংক্রান্ত সমস্যা কমে আসে।
মাড়ির রোগ প্রতিরোধে সহায়ক
মধুর অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়া এবং সংক্রমণ নিরাময়ের বৈশিষ্ট্যগুলো ক্ষত নিরাময়ে সহায়তা করে। জিঞ্জাইটিস, রক্তপাত এবং ফলকের মতো দাঁত ও মাড়ির রোগগুলো মধুর নিয়মিত ব্যবহারের মাধ্যমে অনেকাংশে নিরাময় করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা কাঁচা মধু পানিতে মিশিয়ে মাউথওয়াশ হিসাবে ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এছাড়াও আক্রান্ত মাড়িতে সরাসরি মধু মাখানো ব্যথা, প্রদাহ এবং অন্যান্য রোগ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি দেয়।
অ্যাকজিমা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে
অ্যাকজিমা হচ্ছে ত্বকের একধরনের প্রদাহ, যাতে ত্বক লালচে হয়ে যায় ও ফুলে ওঠে। সেই সাথে থাকে প্রচণ্ড চুলকানি। সাধারণত অল্প বয়সী শিশু-কিশোররা এতে ভোগে। যারা এই সমস্যায় ভুগছেন তারা কাঁচা মধু এবং জলপাইয়ের তেল দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। ত্বকের ময়লা অপসারণ করে ত্বককে মসৃণ ও নরম করে প্রাকৃতিক ক্লিনজার হিসাবে কাজ করে। এটি মৃত কোষগুলো অপসারণের জন্য ওটের সাথে মিশ্রিত করে ত্বকের এক্সফোলিয়েশনের জন্যও ব্যবহার করা যেতে পারে। মধুর নিয়মিত ব্যবহার অ্যাকজিমা হতে বা আবার ফিরে আসতে বাধা দেয়।
ওজন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর
ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য মধু বেশ কার্যকর। মধু শরীরের ফ্যাট কমিয়ে করে ওজন হ্রাস করে। চিকিৎসকরা শোয়ার আগে এক চামচ মধু খাওয়ার পরামর্শ দেন। সকালে খালি পেটে হালকা গরম পানি দিয়ে খানিকটা মধু খেতে পারেন। এতে দারুণ ফল পাওয়া যায়। সকালে এটি খাওয়ার অভ্যাস বিপাক বাড়াতে সহায়তা করে যা ওজন দ্রুত হ্রাসে সহায়তা করে।
রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণ করে
রক্তচাপ হৃদরোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। দুই চামচ মধুর সঙ্গে এক চামচ রসুনের রস মেশান। সকাল-সন্ধ্যা দুবার এই মিশ্রণ খান। প্রতিদিন সকালে খাওয়ার এক ঘন্টা আগে এটি খেলে উচ্চ রক্তচাপ কমায়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
মধুতে থাকা ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, যা এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল শক্তিগুলোতে অবদান রাখে, আপনার প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে তুলতে পারে। অধিকন্তু, যেহেতু অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহ কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং ক্যান্সারের কারণ হতে পারে, তাই হৃদরোগ এবং ক্যান্সার প্রতিরোধেও মধু দারুণ সহায়ক। তাছাড়াও মধু হজমে সহায়তা করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, যৌনশক্তি বৃদ্ধি করে, দৃষ্টিশক্তি বাড়ায় ও তারুণ্য বজায় রাখে।
মধুর সম্ভাব্য ঝুঁকি
শিশুদের মধ্যে বটুলিজম
১২ মাসের কম বয়সী শিশুদের মধু দেওয়া উচিত নয়। মধুতে ধূলিকণা রয়েছে যা বটুলিজমের কারণ হিসেবে ব্যাক্টেরিয়ার স্পোর বহন করতে পারে। শিশুদের জীবাণু প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল থাকে, যার ফলে তারা খুব সহজেই অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।
এলার্জি
যাদের অ্যালার্জির ঝুঁকি রয়েছে তাদের মধু খাওয়ার বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। মধুতে পরাগায়নের ফলে মারাত্মক অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।
ওজন বৃদ্ধি
হালকা গরম জল বা লেবুর রসের সাথে মধু গ্রহণ ওজন হ্রাসকে উৎসাহ দেয়। অতিরিক্ত ক্যালরি হ্রাস করতে এবং আমাদের শরীরের অতিরিক্ত পাউন্ড ঝরাতে সহায়তা করে। তবে এটি লক্ষ্যণীয় যে, খুব বেশি মধু খাওয়া আমাদের শরীরের জন্য এতটা ভাল নয়, এবং ক্ষেত্রবিশেষে এটি আমাদের স্থূল করেও তুলতে পারে! কারণ মধুতে চিনির পরিমাণ প্রচুর, যা সহজেই আমাদের রক্ত প্রবাহে শোষিত হতে পারে এবং এতে ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালরি রয়েছে।
ডায়াবেটিসে ঝুঁকিপূর্ণ
ডায়াবেটিসে চিনির চেয়ে মধু বিকল্প হিসেবে ভাল। তবে এটি শুধুমাত্র উপস্থিত চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করার পরেই খাওয়া উচিত। অতএব পরিমিত পরিমাণে নিয়মিত মধু খাওয়ার অভ্যাস করুন, সুস্থ থাকুন।