Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্যাটল অফ মিডওয়ে (পর্ব-২): জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রস্তুতি

একই সময়ে একাধিক অপারেশন শুরু করলেও জাপানিদের মূল টার্গেট ছিল মিডওয়ে আইল্যান্ড। কারণ প্রথমত, এটি হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মার্কিন এয়ারবেজের যুদ্ধবিমানের রেঞ্জের বাইরে। দ্বিতীয়ত, মিডওয়েতে ল্যান্ড বেজড হেভি বোম্বার থাকলেও তাকে হিসেবে আনেননি অ্যাডমিরাল ইয়ামামোতো। কেননা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের বিরুদ্ধে যে এ ধরনের বোমারু বিমান কার্যকর নয় তা গত মাসে হওয়া কোরাল সি যুদ্ধে দেখা গেছে। মার্কিনিরা তিনবার হামলা করে একটি বোমাও ফেলতে পারেনি জাপানি জাহাজে। তৃতীয়ত, আগের পর্বে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মিডওয়ে দখল করতে পারলে এই দ্বীপ ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের মূলভূমিতে বিমান হামলা করা সম্ভব। এজন্য জাপান মিডওয়ের জন্য একপ্রকার মরিয়া ছিল।

এই ছবিটি ভালো করে দেখলেই মিডওয়ে দ্বীপের কৌশলগত গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন; Image source : britannica.com

অপারেশন এম-আই

বরাবরের মতো জাপানি অপারেশন প্ল্যান বেশ জটিল। নেভাল ওয়ারফেয়ার বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাসবিদদের ভাষায় যাকে বলা যায় ‘Unnecessary Complex‘। এটি একাধিক ব্যাটল গ্রূপের সমন্বিত কাজের সমন্বয়ে গঠিত এবং খুবই জটিল অ্যাকশন প্ল্যান মেনে চলে। অর্থাৎ দুই বা ততোধিক গ্রূপ একসাথে একই শিডিউল মেনে চলবে। কিন্তু একজন মিলিটারি কমান্ডার হিসেবে আপনাকে মাথায় রাখতে হবে যে যতই প্ল্যান করে যুদ্ধে নামুন না কেন, যুদ্ধ কখনোই শতভাগ প্ল্যান মোতাবেক হয় না। কোরাল সি যুদ্ধে যেরকম প্ল্যান করেছিল তা কার্যকর না হওয়াতে প্রথমবারের মতো জাপানের কোনো ইনভেশন অপারেশন ব্যর্থ হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাদের দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। তবে কোরাল সি যুদ্ধে জাপানের একটাই প্রাপ্তি যে ইউএসএস লেক্সিংটন ডুবে গিয়েছিল এবং ইউএসএস ইয়র্কটাউন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

জাপানিরা ধরেই নিয়েছিল যে দুটো ক্যারিয়ারই ডুবে গেছে। কয়েক মাস আগেই ইউএসএস সারাটোগাকে জাপানি সাবমেরিন টর্পেডো মেরে ক্ষতিগ্রস্ত করায় যুক্তরাষ্ট্রে মেরামত করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। অ্যাডমিরাল ইয়ামামোতো তার নেভাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতি শতভাগ আস্থা রেখেছিলেন। তিনি ধরে নিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এই মুহূর্তে দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ও ইউএসএস হরনেট রয়েছে। তাদেরকে পার্ল হারবার থেকে বের করে এনে মিডওয়েতে ফাঁদে ফেলে ধ্বংস করতে তিনি ‘Operation MI‘ নামে বিশাল এক প্ল্যান তৈরি করেন। MI দিয়ে Midway Invasion বোঝানো হয়েছে। 

ইউএসএস হরনেটকে বিদায় দিচ্ছে নাবিকরা (বামে) ও পার্ল হারবার যাওয়ার পথে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ; Image source : maritimequest.com

ফেজ ১: এলিউশন দ্বীপে ইনভেশন পরিচালনা করবেন ভাইস এডমিরাল শিরো তাকাসু।

সম্ভাব্য ফলাফল: তার উপর মার্কিন কাউন্টার অ্যাটাক আসবে পার্ল হারবার থেকে এবং মার্কিন বাহিনীকে অবশ্যই মিডওয়ে দ্বীপ অতিক্রম করতে হবে। তাই এখানে ফাঁদ পাতা হবে।

ফেজ ২: এখানে দুটো ব্যাটল গ্রূপ একসাথে কাজ করবে। মিডওয়ে দ্বীপ দখলের জন্য আসবে এডমিরাল নাবুটাকে কন্ডোর ইনভেশন ফোর্স। মার্কিনিদের ফাঁদে ফেলে ধ্বংসের জন্য অগ্রবর্তী দল হিসেবে আগে আসবে এডমিরাল চুইচি নাগুমোর ক্যারিয়ার স্ট্রাইক ফোর্স। মিডওয়ের জলসীমায় আগেই পজিশন নেয়া জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো মিডওয়ে দ্বীপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করবে যেন এডমিরাল কন্ডোর ইনভেশন ফোর্স বাধা না পায়। এরপর মার্কিন ক্যারিয়ারের উপর অতর্কিতভাবে হামলা করা হবে।

সম্ভাব্য ফলাফল: ফাঁদে পড়ে মার্কিন ক্যারিয়ার ফোর্স ধ্বংস হবে। এজন্য দুটো মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার মোকাবেলায় চারটি ক্যারিয়ার এনেছিল জাপানিরা। নিজেদের ক্যারিয়ারের উপর হামলার খবর শুনে রিএনফোর্সমেন্ট পাঠাতে বাধ্য হবেন প্যাসিফিক ফ্লিট কমান্ডার এডমিরাল নিমিটজ।

ফেজ ৩: সেক্ষেত্রে প্যাসিফিক অঞ্চলের আশেপাশের সমস্ত আমেরিকান নৌ-শক্তি মিডওয়েতে রওনা দিতে পারে। যদি তেমনটাই হয় তবে তাদেরকে মোকাবেলা করবে নাগুমো ও কন্ডোর পিছু পিছু আসা এডমিরাল ইয়ামামোতোর কম্বাইন্ড নেভাল ফোর্স। এতে ভারী ভারী ব্যাটলশিপ/ক্রুজার থাকায় ইম্পেরিয়াল জাপানি নেভির সেন্টার ফোর্স নামে পরিচিত। ফলে প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপর অল-আউট স্ট্রাইক করতে পারবে জাপান। দরকার হলে এডমিরাল তাকাসু এলিউশন দ্বীপ থেকে তার এসকর্ট ক্রুজার ফোর্স মিডওয়ের দিকে পাঠাবেন এডমিরাল কন্ডো, ইয়ামামোতো ও নাগুমোকে সাহায্য করতে। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন যে তিনটি মেজর ব্যাটল গ্রূপের কো-অর্ডিনেটেড স্ট্রাইক প্ল্যান হচ্ছে অপারেশন এম-আই।

কিন্তু গতমাসের কোরাল সি যুদ্ধের যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্লেষণে এডমিরাল ইয়ামামোতোর বোঝা উচিত ছিল যে দুদিন আগেও যে মার্কিন ক্যারিয়ার দুটো পার্ল হারবারে বসে রোদ পোহাচ্ছিল, সেই ক্যারিয়ারগুলো কেন কয়েক হাজার মাইল দূরের একদম নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট লোকেশনে হঠাৎ করে আবির্ভূত হলো? তার মানে কি মার্কিন নেভাল ইন্টেলিজেন্স আগেই সব টের পেয়ে যাচ্ছে?

এডমিরাল ইয়ামামোতোর অপারেশন প্ল্যানিংয়ে ছিল তিনটি মেজর ব্যাটল গ্রূপের সম্মিলিত অ্যাকশন; Image source : history.com

ফেজ-১ : এলিউশন দ্বীপে ইনভেশন (অপারেশন এ-এল)

হিটলার যেভাবে ইউরোপ জয় করেছেন, তেমনি করে প্যাসিফিক অঞ্চল জয়ের চিন্তা ছিল জাপানের মাথায়। কিন্তু ইউরোপের ভূমি ও প্রশান্ত মহাসাগর তো আর এক জিনিস না। তারপরও জাপান একের পর এক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপগুলো শক্তিশালী নৌ ও সেনাবাহিনীর শক্তিতে দখল করে নিচ্ছিল। মিডওয়ের পাশাপাশি এলিউশন দ্বীপে নিজেদের বিমানঘাঁটি করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূমিতে হামলা করা জাপানের জন্য আরো সহজ হয়ে যাবে। এই দ্বীপ সামরিকভাবে যত গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিকভাবে। এই দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত ‘আট্টু’ এবং ‘কিসকা’ দ্বীপ অফিসিয়ালি যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ফলে ১৮১২ সালের যুদ্ধের পর এই প্রথম মার্কিন ভূমি অন্য কেউ দখল করে নিলো- এই প্রোপাগান্ডা চালাতে পারবে জাপান।

এডমিরাল ইয়ামামোতো পরিকল্পনানুযায়ী ‘অপারেশন এ-এল‘ লঞ্চ করা হবে মিডওয়ে দ্বীপের মার্কিন বিমানঘাঁটিতে আক্রমণের সময়। কিন্তু এডমিরাল নাগুমোর ক্যারিয়ার টাস্কফোর্স যাত্রাপথে একদিন দেরি করে ফেলে। ফলে মিডওয়েতে হামলার আগেই ৩ জুন এলিউশন দ্বীপে হামলা শুরু হয়। ইতিহাসবিদ ও যুদ্ধ বিশেষজ্ঞরা এই ঘটনার প্রেক্ষিতে এডমিরাল ইয়ামামোতোর যুদ্ধ কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি যদি এলিউশন দ্বীপে হামলাকে যুক্তরাষ্ট্র ধোঁকা দেয়ার কাজে ব্যবহার করতে চান তবে কেন তিনি একই দিন একই সময়ে মিডওয়ে দ্বীপেও হামলা করতে চাইবেন? তাহলে তো মিডওয়ের আশেপাশে জাপানিদের ক্যারিয়ারের উপস্থিতির কথা যুক্তরাষ্ট্র জেনেই গেল! বরং একদিন দেরি হওয়ায় মার্কিন নৌবহর ফেজ-১ এর জাপানের অনুমান মোতাবেক কাউন্টার অ্যাটাক ফোর্স প্রেরণ করে। অর্থাৎ অপারেশন ঠিকঠাক মতোই সামনে এগোচ্ছে। কিন্তু মার্কিনিরা এলিউশন দ্বীপ নয়, বরং মিডওয়ের জন্যই এই ফোর্স পাঠিয়েছে। সেটাও আবার জাপানি অনুমানের একদিন আগে!

এলিউশন দ্বীপে ইনভেশন ম্যাপ ও ট্রুপ্‌স ল্যান্ডিং; Image source : history.com

মার্কিন ও জাপানি পাইলটদের প্রস্তুতি

আগের পর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে মার্কিনিরা কীভাবে জাপানের অপারেশন পরিকল্পনা আগেই জেনে গিয়েছিল। মার্কিন কোডব্রেকাররা ছিল জাপানের বিরুদ্ধে তুরুপের তাস। তাদের দেয়া ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী ভাইস এডমিরাল হ্যালসির এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এন্টারপ্রাইজ ও হরনেট প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু হ্যালসি নিজেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নন! দীর্ঘদিন সমুদ্রে অপারেশন চালিয়ে যুদ্ধজাহাজের ছোট্ট রুমে থেকে খোসপাঁচড়ার মতো ভয়াবহ চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি হন।

মার্কিন প্যাসিফিক ফ্লিট কমান্ডার চেস্টার ডব্লিউ নিমিটজ হ্যালসির দেয়া পরামর্শ অনুযায়ী রিয়ার এডমিরাল রেমন্ড স্প্ৰুয়েন্সকে টাস্কফোর্স ১৬-এর দুটো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি মূলত ক্রুজার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজের কমান্ডার, একসময় সাবমেরিনও চালিয়েছেন। তবে তিনি ক্যারিয়ার যুদ্ধের কৌশলও ভালো জানতেন বিধায় হ্যালসি নিজেই তাকে কমান্ডার বানাতে প্রস্তাব করেন। কিন্তু দুটো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এই যুদ্ধের জন্য যথেষ্ট নয়। নিমিটজের চাহিদামতো যুক্তরাষ্ট্রের ডকইয়ার্ডে ইউএসএস সারাটোগার মেরামত অসমাপ্ত রেখেই তাকে প্যাসিফিক অঞ্চলে পাঠানো হয়। কিন্তু তার এখানে এসে পৌঁছাতে চারদিন সময় লাগবে। ততদিনে মিডওয়ের যুদ্ধ শেষ! তাই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত ইয়র্কটাউনকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে ১,৪০০ শ্রমিক-ইঞ্জিনিয়ার মিলে মেরামত করে ৩ সপ্তাহ সাগরে চালানোর মতো উপযোগী করে তোলেন।

পার্ল হারবার ড্রাই ডকে ইয়র্কটাউনকে মেরামত করা হচ্ছে (বামে) ও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত ইয়র্কটাউন (ডানে); Image source : history.navy.mil 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোরাল সি যুদ্ধে ইউএসএস ইয়র্কটাউনে ফেলা ২৫০ কেজির জাপানি আর্মার পিয়ারসিং বোমাটি চারটি ডেক ভেদ করে বিস্ফোরিত হয়েছিল। এর ফলে ১৩ ফুট ব্যাসের বিশাল এক গর্তের সৃষ্টি হয়। ইয়র্কটাউন যে তিন মাসের আগে পানিতে ভাসবে তা সাধারণ নাবিকরা কল্পনাও করেনি। ফলে সামগ্রিকভাবে তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। কোরাল সি যুদ্ধে ইউএসএস লেক্সিংটন ও ইয়র্কটাউনের প্রচুর বিমান ধ্বংস ও পাইলট নিহত হয়। এডমিরাল নিমিটজ হাতের কাছে যত বিমান পেয়েছেন সবগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন।

ইয়র্কটাউন ও লেক্সিংটনের বেঁচে যাওয়া ক্রু ও সারাটোগার রেখে যাওয়া স্কাউট প্লেন, টর্পেডো ও ডাইভ বোম্বার স্কোয়াড্রন দিয়ে ইয়র্কটাউনকে সাজানো হয়। এভাবে বিভিন্ন ইউনিটের পাইলট ও এয়ার ক্রুদের জগাখিচুড়ি পাকানোর ফলাফল কিন্তু ভয়াবহ হতে পারে তা তিনি জানতেন। যদিও মার্কিন পাইলটরা ভিন্ন ক্যারিয়ারে অপারেশন চালিয়ে অভ্যস্ত ছিলেন, তারপরও একসাথে ট্রেনিং না করায় যুদ্ধের সময় তাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে বিকল্প নেই। যুদ্ধের সময় ইয়র্কটাউন স্কোয়াড্রনের এক্সিকিউটিভ অফিসার (XO) লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ডোনাল্ড লোভেল্যাস আকাশ যুদ্ধের অনুশীলন করার সময় একজন অনভিজ্ঞ তরুণ পাইলটের গুলিতে নিহত হন।

 
যুক্তরাষ্ট্রের SBD Dauntless ডাইভ বোম্বার; Image source : wikipedia.org

এই ভয়েই কোরাল সি যুদ্ধে জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুইকাকু অক্ষত থাকলেও তার এয়ার গ্রূপের সাথে ক্ষতিগ্রস্ত অপর ক্যারিয়ার শকাকু এর এয়ারগ্রুপ (এয়ার ক্রু+পাইলট)-কে একীভূত করে তাকে মিডওয়ে যুদ্ধে নামাননি এডমিরাল ইয়ামামোতো। জনাথন পার্শাল ও এন্থনি টুলির মত ইতিহাসবিদেরা বলেছেন, জাপান চাইলে যুইকাকুকে এই যুদ্ধে নামাতে পারত। তাহলে এই যুদ্ধের ফলাফল ভিন্ন হতে পারত। তবে ইম্পেরিয়াল জাপানিজ নেভির পাইলট ট্রেইনিং প্রোগ্রামের দুর্বলতা জাপানকে নতুন করে দ্রুততম সময়ে একটি এয়ার গ্রুপ গঠন করার মতো সক্ষমতা দেয়নি।

এর বাইরেও আরেকটি কারণ আছে। জাপানিরা সবসময় Kidō Butai (機動部隊) বা ‘মোবাইল ফোর্স’ নামক ক্যারিয়ার যুদ্ধের ট্যাক্টিসের আলোকে দুটো একই শ্রেণীর বিমানবাহী রণতরী একসাথে মোতায়েন করে। শকাকু না থাকায় ক্যারিয়ার ডিভিশন ৫ এর অপর ক্যারিয়ার যুইকাকুকে যুদ্ধে নামানোর চেষ্টাও করেনি তারা। যার ফলে এডমিরাল নাগুমোর হাতে ক্যারিয়ার ডিভিশন ১ এর আকাগি ও কাগা এবং ক্যারিয়ার ডিভিশন ২ এর হিরয়ু এবং সরয়ু নামক চারটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হাতে ছিল। সব মিলিয়ে তার ক্যারিয়ার স্ট্রাইক ফোর্সে ২৪৮টি বিমান ছিল। এর মধ্যে আকাগিতে ৬০টি, কাগা তে ৭৪টি, হিরয়ু এবং সরয়ু এর প্রত্যেকটিতে ৫৭টি। তবে এই সংখ্যাটি Kidō Butai ট্যাক্টিসের জন্য যথেষ্ট ছিল না।

আইচি D3A1 Val ডাইভ বোম্বার, B5N2 Kate টর্পেডো বোম্বার, A6M Zero ফাইটার বিমানগুলো সেই নভেম্বর, ১৯৪১ সাল থেকে একটানা ওড়ানো হচ্ছে। স্পেয়ার পার্টসের সংকট থাকায় এসব বিমান মিডওয়ের মতো হেভি এয়ার স্ট্রাইক অপারেশনের জন্য তৈরি ছিল না। আবার নির্ভরযোগ্য Kate টর্পেডো বোম্বারগুলোর উৎপাদন বন্ধ ও Val ডাইভ বোম্বারগুলোর উৎপাদন কমিয়ে দেয়ায় উক্ত চারটি ক্যারিয়ারে তাদের ধারণক্ষমতার সর্বোচ্চ সংখ্যক বিমান ছিল না। এসব কারণে জাপানের শক্তি শুরুতেই কিছুটা কম ছিল।

মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলোর প্রয়োজনের চেয়ে কম সংখ্যক এন্টি এয়ারক্রাফট গান ও কমব্যাট এয়ার পেট্রোল (যুদ্ধের সময় আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহৃত ফাইটার) বিমান সংখ্যায় কম ছিল। তাছাড়া মার্কিন ক্যারিয়ারে প্রথম যুগের দুর্বল রাডার সিস্টেম থাকলেও জাপানিদের সেটাও ছিল না। এডমিরাল ইয়ামামোতো তার বহরের সাবমেরিন কাজে লাগাতে দেরি করেন। মার্কিন ক্যারিয়ারগুলো সাবমেরিনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মিডওয়ের উত্তর-পূর্বে পৌঁছে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে আগে আগে পৌঁছে যাওয়ার স্ট্র্যাটেজিক সুবিধা তারা ভোগ করে।

জাপানের Val ডাইভ বোম্বার, Kate টর্পেডো বোম্বার; Image source : history.com

শত্রুর খোঁজে আকাশের চোখ

৪ জুন, ১৯৪২ সালে মিডওয়ে বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ৩১টি PBY লংরেঞ্জ রিকনসিস বিমান ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বিমানগুলো ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প কার্ড। একেকটি বিমান সাগরের কয়েক হাজার মাইল এলাকায় নজরদারি করতে পারতো। উভচর বিমান হওয়ায় এরা সাগরের পানিতে নেমে বিশ্রাম বা যেকোনো জাহাজ থেকে রিফুয়েলিং করার সুবিধা পেত। ফলে এসব বিমান দিয়ে ভূপাতিত হওয়া পাইলট, জাহাজডুবির শিকার নাবিক উদ্ধার ছাড়াও সাবমেরিনের উপর হামলা করা যেত।

১৯৪২ সালের জুন মাসের শুরু থেকেই এসব বিমান প্রতিদিন মিডওয়ে দ্বীপের আশেপাশের কয়েক হাজার মাইল নজরদারি করতে আকাশে উড়তে শুরু করে। এছাড়া মিডওয়ের বিমানঘাঁটিতে সদ্য সার্ভিসে আসা ৬টি TBF Avengers ফাইটার-বোম্বারসহ ১৯টি SBD Dauntless ডাইভ বোম্বার, ৭টি F4F-3 Wildcats ফাইটারসহ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের বাইরে গ্রাউন্ড বেজ ভিত্তিক অতিরিক্ত মোট ১২৬টি বিমান এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তিনটি হলেও তারা প্রায় চারটির সমান সুবিধা পেয়েছিল। কিন্তু এই সুবিধাকে তারা তেমন কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারেনি।

PBY বিমানগুলো জলে-স্থলে ল্যান্ড করতে সক্ষম; Image source : airspacemag.com

জুনের শুরুতেই আমেরিকানরা পার্ল হারবার থেকে মিডওয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। জাপানিরা যুদ্ধজাহাজের সংখ্যায় এগিয়ে থাকলে চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যাওয়ায় তারা একজন আরেকজনকে সাপোর্ট দিতে পারেনি। আসলে চারটি না বলে পাঁচটি বলা উত্তম। জাপানের Kidō Butai (機動部隊) ট্যাক্টিসের অন্যতম ঘুঁটি ছিল ব্যাটলশিপ। এডমিরাল ইয়ামামোতোর তিনটি ব্যাটলশিপ সেই অনুযায়ী নাগুমোর ক্যারিয়ার স্ট্রাইক ফোর্সকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কারণ তারা যখন আক্রমণ করবে তখন এডমিরাল ইয়ামামোতোর কম্বাইন্ড ফোর্স এবং এডমিরাল কন্ডো মিডওয়ে থেকে অনেক দূরে থাকবেন। তাই নাগুমোর ব্যাটলশিপ সাপোর্টের জন্য ইয়ামামোতো তিনটি কঙ্গো ক্লাস ফাস্ট ব্যাটলশিপ তার বহরে যুক্ত হওয়ায় আদেশ দেন।

কিন্তু তারা সময়মতো নাগুমোর সাথে যোগ দিতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে তিনটি অপারেশন ফেজের চারটি ব্যাটল গ্রুপ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি পাঁচটি হয়ে যায়। ফলে যুদ্ধজাহাজের সংখ্যায় মার্কিনিদের চেয়ে কয়েকগুণ এগিয়ে থেকেও জাপান শুরুতেই পিছিয়ে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে পরদিন শুরু হওয়া ব্যাটল অফ মিডওয়ের প্রথম দিনের যুদ্ধেই।

(চলবে)

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ

১) ব্যাটল অফ মিডওয়ে (পর্ব-১): যে কারণে মার্কিন বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করেছিল জাপান

Related Articles