ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা শুনলেই দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লজ্জাজনক পরাজয়ের ইতিহাস মনে পড়ে যায় সবার। এই যুদ্ধে ৫৮ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা নিহত হয়। তবে এই যুদ্ধে বেশ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন এমন মার্কিন সেনার সংখ্যা কিন্তু কম নয়। ইউএস মেরিনের স্নাইপার কার্লোস নোরম্যান হ্যাথকক ছিলেন তেমনই একজন। তাকে বলা হতো ভিয়েতকং গেরিলাদের আতঙ্ক। মাথায় সাদা পালক গুঁজে রাখতেন বিধায় তাকে ‘হোয়াইট ফেদার’ নামে ডাকা হতো। বিভ্রান্তি নিরসনে আগেই জানিয়ে রাখা ভাল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বোচ্চ কনফার্ম কিল রেকর্ড (৫০৫ টি) এর মালিক সর্বকালের সেরা স্নাইপার ‘সিমো হাইয়া’কে ‘হোয়াইট ডেথ’ নামে ডাকা হতো। এ সংক্রান্ত আর্টিকেলটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
কার্লোস হ্যাথকক ২০ মে, ১৯৪২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাসের লিটল রক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১২ বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদের পর তিনি আরকানসাসের ওয়েনে গিয়ে দাদার কাছে থাকতে শুরু করেন। মিসিসিপিতে এক আত্মীয়র বাড়িতে গিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো শিকারে গিয়ে রাইফেলের প্রেমে পড়েন।
কার্লোস ছিলেন খুবই গরীব পরিবারের সন্তান। দাদার সাথে শিকারে হাতেখড়ি হওয়ার পর তিনি পাশের জঙ্গলে নিয়মিত শিকারে যেতেন। নিজের পোষা কুকুরকে নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধফেরত বাবা কার্লোস নোরম্যান সিনিয়রের এনে দেয়া পুরনো .২২ ক্যালিবার মাউজার রাইফেল দিয়ে তিনি যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার পাশাপাশি পরিবারের খাবার যোগাতেন। এভাবে খুব অল্প বয়সে তিনি রাইফেলের উপর নিজের দক্ষতা অর্জন করেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি মেরিন সৈনিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। অবশেষে ২০ মে, ১৯৫৯ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ইউএস মেরিনে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। কার্লোস এই বাহিনীর এতটাই ভক্ত ছিলেন যে ১৯৬২ সালে নিজের বিয়ের দিনকে স্মরণীয় রাখতে ১০ নভেম্বর মেরিন কর্পসের জন্মদিনকে বেছে নেন। তিনি জো উইনস্টেডকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির ঘরে এক ছেলেসন্তান হয় যার নাম রাখা হয় কার্লোস নোরম্যান হ্যাথকক জুনিয়র। জানেন নিশ্চয়ই, পশ্চিমাদের দাদা-বাবা-ছেলের একই নাম হওয়াটা এক পুরনো সংস্কৃতি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ
১৯৬৫ সালে কার্লোস হ্যাথকক ইউএস মিলিটারির আন্তঃবাহিনী লংরেঞ্জ শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ হিসেবে খ্যাত ক্যাম্প পেরি উইম্বলেডন কাপের শিরোপা জেতেন। ১৯৬৬ সালে তাকে ভিয়েতনামে মিলিটারি পুলিশ হিসেবে পাঠানো হয়। প্রথমে তার কাজ ছিল মার্কিন গ্যারিসনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পরবর্তীতে পেট্রোল টিমের উপর ভিয়েতকং গেরিলাদের চোরাগোপ্তা হামলা বেড়ে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড জেমস ল্যান্ড নামক একজন মেরিন অফিসার প্রত্যেক প্লাটুনে একজন করে স্নাইপার থাকা বাধ্যতামূলক করে নির্দেশ জারি করেন।
এত কম সময়ে এত বেশি মানসম্পন্ন স্নাইপার নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয়। ক্যাপ্টেন জেমস ল্যান্ড এবার প্লাটুনে থাকা সবচেয়ে শার্পশুটারদের ভালো মানের স্নাইপার রাইফেল বরাদ্ধ দেন এবং তাদের বাড়তি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এই কাজ করতে গিয়ে ক্যাম্প পেরি উইম্বলেডন কাপের শিরোপাজয়ী কার্লোস হ্যাথককের খোঁজ পান। তার প্রতিভা দেখে তাকে মিলিটারি পুলিশ থেকে মেরিন স্কাউট স্নাইপার হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে নিয়োগ দেন।
কার্লোস তার দক্ষতার কল্যাণে বেশ দ্রুতই মার্কিন বাহিনীতে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তার কনফার্মড কিল রেকর্ড ৯৩টি। সাধারণত কিল শট নেয়ার পর সেটি স্নাইপারের সহকারী (সামরিক পরিভাষায় স্পটার) কর্তৃক নিশ্চিত হলেই তাকে ‘কনফার্ম কিল’ হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিয়ম ছিল যে শুটার ও স্পটার ছাড়াও থার্ড পার্টি কনফার্মেশন লাগতো। অর্থাৎ তৃতীয় আরেকজন ব্যক্তি উক্ত শটকে ‘কনফার্ম কিলশট’ বলে সাক্ষ্য দিতে হবে। এই তৃতীয় ব্যক্তি আবার অবশ্যই একজন অফিসার হতে হবে, সোলজারের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য না! এসব কারণে কার্লোসের কিল রেকর্ড ইতিহাসের বিখ্যাত অন্য সব স্নাইপারের তুলনায় অনেক কম।
মেশিনগান দিয়ে স্নাইপার শট!
১৯৩৩ থেকে আজ অবধি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীতে আস্থার সাথে ব্যবহার হওয়া একটি বিখ্যাত মেশিনগান হলো এম-২ ব্রাউনিং। .৫০ ক্যালিবারের এই হেভি মেশিনগানের কার্যকর রেঞ্জ ১৮০০ মিটার এবং সর্বোচ্চ রেঞ্জ ৭,৪০০ মিটার! কার্লোস লং রেঞ্জ স্নাইপার রাইফেলের ভক্ত ছিলেন। কিন্তু শত্রুকে অনেক দূর থেকে ঘায়েল করার মতো অস্ত্র সেই যুগে ছিল না।
হ্যাথককের মাথায় তখন এক উদ্ভট চিন্তা পেয়ে বসলো। তিনি ভাবলেন যে ব্রাউনিং মেশিনগান দিয়ে যদি এত দূরে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি করা যায় তবে চেষ্টা করলে স্নাইপার শটও নেয়া সম্ভব! এজন্য তিনি তার রাইফেলের 8x টেলিস্কোপিক সাইট খুলে মেশিনগানে লাগিয়ে অনুশীলন শুরু করেন। ঝাঁকুনি কমাতে মেশিনগানকে ট্রাইপডে বসান এবং একে বালুর বস্তাতে আটকে নেন। সেদিন সকালে হিল ৫৫ এলাকায় এক ভিয়েতকং গেরিলাকে অস্ত্রসহ সাইকেল চালিয়ে আসতে দেখেন। হ্যাথকক ২,২৫০ মিটার দূর থেকে প্রায় আন্দাজে গুলি ছুড়ে ঐ গেরিলাকে ঘায়েল করেন। তার কমান্ডিং অফিসার ঘটনাটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কেননা রিকয়েল (ঝাঁকুনি) এর কারণে এভাবে মেশিনগান সিঙ্গেল শটে লক্ষ ভেদ করাটা প্রায় অসম্ভব। এটি ছিল তৎকালীন সময়ের Longest Confirmed Kill রেকর্ড (বর্তমানে ৭ম) যা ২০০২ সাল পর্যন্ত অক্ষুণ্ন ছিল।
কার্লোস ছোটবেলা থেকেই শিকারি ছিলেন। তারপরও ভিয়েতনামে এসে এভাবে মানুষ হত্যা করা পছন্দ করতেন না। কিন্তু কাজটি করতে তিনি বাধ্য হয়েন। অনেক মার্কিন সেনা ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি তাদের একজন কিনা সে ব্যাপারে তার পরিস্কার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। স্নাইপিং প্রসঙ্গে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“It was the hunt, not the killing. I like shooting, and I love hunting. But I never did enjoy killing anybody. It’s my job. If I don’t get those bastards, then they’re gonna kill a lot of these kids dressed up like Marines. That’s the way I look at it.”
চারিদিকে শত্রু
হ্যাথকক এবার পাঁচদিনের একটি লংরেঞ্জ পেট্রোল মিশনে বের হন। ফেরার সময় একটি ধানক্ষেত অতিক্রম করার সময় একদল উত্তর ভিয়েতনামিজ সেনার সামনে পড়ে যান। এখানে শত্রু থাকার কথা ছিল না। কার্লোস People’s Army of Vietnam (PAVN) সেনাদের নতুন ইউনিফর্ম দেখে বুঝতে পারেন যে এরা রিক্রুট হওয়া কোনো নবীন সেনাদল। তাদের সাথে কোনো রেডিও ডিভাইসও ছিল না। এটি দেখে তিনি ও তার সঙ্গী ধারণা করেন যে এরা হয়তো দলছুট কোনো দল, দিকভ্রান্ত হয়ে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এসে পড়েছে। কিন্তু হ্যাথকক ও তার স্পটার তো দুদিক দিয়ে বিপদে পড়ে গেছেন! তিনি দ্রুততার সাথে ধানক্ষেতে শুয়ে পড়েন এবং সামনের দিকের দুজন অফিসারকে গুলি করেন। পিছনে তার সঙ্গীও একজনকে ফেলে দিয়েছে। তারা দুজনে পজিশন বদল করে আর্টিলারি হামলা চালাতে রেডিওতে অনুরোধ করেন। এতে উত্তর ভিয়েতনামীদের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে শত্রুপক্ষের অফিসারদের টার্গেট করে তাদের নেতৃত্বশূন্য করে দেয়ায় কার্লোস ও তার সঙ্গীর বুদ্ধিমত্তা পুরো বাহিনীতে সুনাম কুড়ায়।
এক অসম্ভব মিশন
হ্যাথকক বিখ্যাত হয়েছিলেন প্রায় অসম্ভব এক মিশন সম্পন্ন করে। ১৯৬৬ সালে উত্তর ভিয়েতনামের একজন শীর্ষস্থানীয় জেনারেলকে হত্যা করার অর্ডার দেয়া হয়। কিন্তু শত্রু এলাকার এত ভেতরে ঢুকে এ ধরনের মিশন সম্পন্ন করার সাহস কারও ছিল না। কার্লোস নিজে থেকে এই মিশনের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হন। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য তাকে একবারে শেষ মুহূর্তে মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্রিফিং দেয়া হয়।
কার্লোস রাতের আধারে একাকী বেরিয়ে পড়েন। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, একটানা চার দিন তিন রাত ধরে তাকে এই মিশনের জন্য শত্রু এলাকার ভেতরে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে হয়েছে। ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সাবধানে চলতে শুরু করেন কার্লোস। ঘুম-খাওয়া বাদ দিয়ে, পোকার কামড় খেয়ে লাল হয়ে, অল্পের জন্য ব্যামবো ভাইপার সাপের কামড় থেকে বেঁচে গিয়ে শত্রু ঘাঁটির একদম নিকটে হাজির হন। কিন্তু মাঝখানে রয়েছে বিশাল বিশাল লম্বা ঘাসের খোলা মাঠ।
কার্লোস আগে থেকেই ঘাস-লতাপাতা দিয়ে তৈরি বিশেষ পোশাক (গিলিস্যুট) পড়েছিলেন, যার ফলে তিনি খুব সহজেই পরিবেশের সাথে মিশে যেতে পারতেন। খুব ভালো করে না তাকালে মানুষ নাকি গাছপালা বোঝাই যেত না! এবার তিনি একদম খোলা ক্ষেতের ভিতর দিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ক্রলিং করে প্রায় দুই কিলোমিটার সামনে এগিয়ে যান। বেশ কয়েকবার তার আশেপাশে দিয়ে ভিয়েতনামি টহল দল গিয়েছে, কিন্তু টের পায়নি। নির্ধারিত পজিশনে গিয়ে জেনারেলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কার্লোস খুব ভোরে নয়তো একদম সন্ধ্যায় আক্রমণ করতে পছন্দ করতেন। তিনি বলেন,
“First light and last light are the best times. In the morning, they’re going out after a good night’s rest, smoking, laughing. When they come back in the evenings, they’re tired, lollygagging, not paying attention to detail.”
প্রায় ৭০০ গজ একটিমাত্র গুলি ছুড়ে সেই জেনারেলকে হত্যা করেন। তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও PAVN সেনারা খুঁজে পায়নি। মার্কিন স্নাইপারদের জন্য বাউন্টি ছিল গড়ে ৮ থেকে ২,০০০ ডলার। কিন্তু হোয়াইট ফেদারকে মারতে পারলে তৎকালে ৩০ হাজার ডলার পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা করেছিল PAVN যা আজকের যুগের ২.৪৫ লাখ ডলারের সমতুল্য। তাকে মারতে তাদের সেরা স্নাইপারদের পাঠানো হয়। এ সময় তার প্লাটুনের সহযোদ্ধারা শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে সবাই মাথার হেলমেটের স্ট্র্যাপে সাদা পালক গুঁজে রাখতে শুরু করেন। তারা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন এ জন্য যে কার্লোস হ্যাথকক ভিয়েতকং গেরিলা ও PAVN সেনাদের মাঝে যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছেন তা শেষ হয়ে যাবে।
টেলিস্কোপের ভেতর দিয়ে গুলি
কার্লোস এমন একটি কীর্তির জন্য বিখ্যাত যেটি ইতিহাসে এখন পর্যন্ত আর কেউই করে দেখাতে পারেনি। উত্তর ভিয়েতনামের একাধিক স্নাইপার তার হাতে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন শত্রু স্নাইপারকে তার ব্যবহৃত রাইফেলের টেলিস্কোপিক সাইটের ভেতর দিয়ে চোখে গুলি করেন!
সেদিন ডা নাং অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমে হিল ৫৫ একটি পাহাড়ি জঙ্গলে তার প্লাটুনের ঘাঁটি ছিল। কার্লোস খবর পান যে তাকে মারতে ‘কোবরা’ ডাকনামে বিখ্যাত এক উত্তর ভিয়েতনামী স্নাইপারকে পাঠানো হয়েছে। সে বেছে বেছে কেবল মাথায় সাদা পালকওয়ালা কয়েকজন মেরিন সেনাকে ইতিমধ্যেই মেরেছে। দেরি না করে কার্লোস তার স্পটার জন রোনাল্ডকে নিয়ে কাউন্টার স্নাইপিং মিশনে বেড়িয়ে পড়েন। তিনি সম্ভাব্য লোকেশনে কোবরাকে খুঁজতে যান। হঠাৎ করে একটি গুলি ছুটে আসে তাদের অবস্থান লক্ষ্য করে। সৌভাগ্যক্রমে গুলিটি জন রোনাল্ডের পানির ক্যান্টিনে লাগে।
হ্যাথকক পাল্টা গুলি ছুড়ে নিজের অবস্থান ফাঁস করতে চাইলেন না। তিনি জানতেন যে ‘হোয়াইট ফেদার’ এর মৃত্যু হয়েছে কিনা নিশ্চিত হতে কোবরা এবার লাশ দেখতে আসবে। কার্লোস ও তার সঙ্গী এবার ঘুরে কোবরার পজিশনে চলে যান। সৌভাগ্যক্রমে সূর্য ছিল তার মাথার পেছনে। হঠাৎ একটি ঝোপের ভেতর থেকে আলোর ঝিলিক দেখতে পান। এটি ছিল স্নাইপার রাইফেলের উপরে লাগানো টেলিস্কোপিক সাইটের লেন্সের উপর সূর্যের আলোর প্রতিফলন! তিনি বুঝতে পারেন যে শত্রুও তাকে খুঁজছে। দেরি না করে ঐ আলোর ঝিলিক বরাবর গুলি ছোড়েন। বুলেটটি কোবরার রাইফেলের টেলিস্কোপিক সাইটের ভিতর দিয়ে ঢুকে হেডশট হয়ে যায়! এই ঘটনার বর্ণনায় হ্যাথকক বলেন,
“If I hadn’t gotten him just then, he would have gotten me. He was very cagey, very smart. He was close to being as good as I was… But no way, ain’t no way ain’t nobody that good.”
ঘটনাটি নিজ চোখে দেখার পরও তার স্পটার জন রোনাল্ড বিশ্বাস করেননি। তাই বাধ্য দেখে ঝুঁকি নিয়ে কার্লোস নিজে গিয়ে কোবরার ভাঙা স্কোপসহ স্নাইপার রাইফেলটি খুঁজে আনেন। এটি দেখার পর প্লাটুনের সবাই তার কথা বিশ্বাস করতে শুরু করে। হ্যাথককের ইচ্ছা ছিল কোবরার রাইফেলটি ট্রফি হিসেবে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পরবর্তীতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি অস্ত্রাগার থেকে চুরি হয়ে যায়।
দ্য এপাচি ওম্যান
কার্লোস হ্যাথককের আরেকটি বিখ্যাত লড়াই ছিল একজন নারীর বিরুদ্ধে। ভিয়েতকং গেরিলাদের স্নাইপার একজন প্লাটুন লিডারের ডাকনাম ছিল ‘The Apache woman’। তিনি ধৃত মার্কিন সেনাদের উপর ভয়ংকর অত্যাচার করতেন যেন তাদের চিৎকার মার্কিন ঘাঁটি থেকেও শোনা যায়। একবার কার্লোসের ইউনিটের এক তরুণ সেনার চোখ উপড়ে ফেলা, গায়ের চামড়া ছিলে নেয়ার মতো ভয়াবহ নির্যাতন করেছিলেন।
ক্ষিপ্ত হ্যাথকক এবার হিল ৫৫-তে তাদের ঘাঁটির অনেক নিকটে গিয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করেন। একজন নারীকে মারবার ইচ্ছা তার ছিল না। কিন্তু তার নির্যাতনের ভয়াবহতার জন্য তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। হঠাৎ জঙ্গল ছেড়ে পাহাড়ি ঢালে নেমে আসে পাঁচ স্নাইপারের একটি দল। কার্লোস জানতেন না যে এদের মধ্যে একজন নারী। কিন্তু একবার গুলি চালালেই বাকিরা তাকে শিকার করতে আসবে। তাই তিনি ঐ পজিশনে আর্টিলারি হামলার জন্য রেডিওতে অনুরোধ করেন। এতে তিনজন নিহত হয়, কিন্তু একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে একটু দূরে সরে যাওয়ায় বেঁচে যান একজন।
কার্লোস এবার বুঝতে পারেন ঐ ব্যক্তি একজন নারী, দেরি না করে প্রায় ৭০০ গজ দূর থেকে এপাচি ওম্যানের বুকে গুলি করেন। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই দ্বিতীয়বার গুলি করেন মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য। এতে তার পজিশন ফাঁস হয়ে যায়, উত্তর ভিয়েতনামীরা পাল্টা গুলি শুরু করে। কিন্তু তাদের ফাঁকি দিয়ে তিনি নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। এই ঘটনা তরুণ মার্কিন সেনাদের এপাচি ওম্যানের হাতে নির্যাতিত হওয়ার ভয় থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
১৯৬৭ সালে কার্লোস হ্যাথকক দেশে ফিরে যান এবং ১৯৬৯ সালে আবার ভিয়েতনামে ফিরে মেরিন স্নাইপার প্লাটুনের কমান্ডার নিযুক্ত হন। সেই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বরে উত্তর ভিয়েতনামীর পুঁতে রাখা ল্যান্ডমাইনে তাকে বহনকারী আর্মার্ড ভেহিকেলটি আক্রান্ত হয়। হ্যাথকক ছিটকে ভেহিকেল থেকে পড়ে যান। তিনি সাতজন মেরিনকে জ্বলন্ত ভেহিকেল থেকে বের করেন। এ সময় তার হাত-পা, মুখমন্ডল, বাহু ইত্যাদিসহ দেহের ৪০ শতাংশ পুড়ে যায়। ঘোরের মধ্যে থাকা কার্লোস নিজে কতটা বাজেভাবে আহত হয়েছেন তা বুঝতে পারছিলেন না। তাকে অন্য মেরিন সেনারা ধরাধরি করে অগভীর পানিতে নামিয়ে শুইয়ে রাখে। এই ঘটনায় সাহসিকতার জন্য প্রথমে পার্পল হার্ট পদক ও ত্রিশ বছর পরে সিলভার স্টার পদক লাভ করেন।
যুদ্ধ-পরবর্তী জীবন
গুরুতর আহত হ্যাথকক ও অন্যান্যদের প্রথমে জাপান, পরে যুক্তরাষ্ট্র পাঠানো হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি আবার বাহিনীতে ফিরে আসেন এবং কোয়ান্টিকো, ভার্জিনিয়াতে মেরিন স্কাউট স্নাইপার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে তিনি মেরিন স্নাইপার প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন। তিনি ইউএস নেভি সিল কমান্ডো স্নাইপার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষক ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ স্নাইপার ইউনিট তার কাছে পরামর্শ নিতে আসতো।
যুদ্ধের ইনজুরির কারণে তার স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। স্নাইপিংয়ের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছাড়াও ২০ বছর চাকরির মেয়াদ পূর্ণ করার আশায় তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েও কাজ চালিয়ে যান। তৎকালে ইউএস মেরিনে কমপক্ষে ২০ বছর চাকরি করলে অবসরোত্তর ভাতা পাওয়া যেত। কিন্তু ৫৫ দিন বাকি থাকতেই তাকে স্বাস্থ্যগত কারণে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। এর ফলে তিনি যুদ্ধাহত সৈনিকের ভাতা পান, কিন্তু শর্ত পূরণ না হওয়ায় অবসরোত্তর ভাতার মাত্র ৫০% পেয়েছিলেন। এসব কারণে তিনি মনে করতে থাকেন যে বাহিনী থেকে তাকে অপমানের সাথে জোরপূর্বক বিতাড়িত করা হয়েছে। তার মানসিক অবসাদের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেলে স্ত্রী জো উইনস্টেড বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে কার্লোস হাঙর শিকারের মতো ভয়ংকর অ্যাডভেঞ্চারে অবসাদ কাটানোর মাধ্যম হিসেবে খুঁজে পান।
১৯৯৯ সলের ২২ ফেব্রুয়ারি মারা যান কার্লোস। তাকে ভার্জিনিয়ার নরফোকে উডলাউন মেমোরিয়াল গার্ডেনে সমাহিত করা হয়। তার ছেলে কার্লোস হ্যাথকক জুনিয়র পরবর্তীতে ইউএস মেরিনে যোগদান করেন এবং বাবার দেখানো পথ ধরে একজন দক্ষ স্নাইপার হয়ে ওঠেন। তিনি বোর্ড অব গভর্নরস অফ ডিস্টিংগুইশড শ্যুটার অ্যাসোসিয়েশনের একজন সদস্য ছিলেন।
কার্লোস হ্যাথককের জীবনী নিয়ে Sniper (1993) নামে মুভি নির্মিত হয়েছে। এই মুভিতে কোবরার স্কোপের ভেতর দিয়ে গুলি করার দৃশ্যটি চিত্রায়িত করা হয়েছে। এছাড়া RoboCop 2, Eraser, Saving Private Ryan, Shooter মুভিতে শত্রু স্নাইপারের স্কোপের ভেতর দিয়ে গুলি করার যেসব দৃশ্য দেখানো হয়েছে তা মূলত হ্যাথককের কীর্তিকে স্মরণ করে দৃশ্যধারণ করা হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে সর্বোচ্চ কনফার্ম কিল রেকর্ড (১০৩টি) মালিক ছিলেন চার্লস বেঞ্জামিন চাক নামের একজন স্নাইপার। তবে হ্যাথককের মতো আর কেউই এককভাবে যুদ্ধে শত্রুপক্ষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি।
কার্লোসকে উৎসর্গ করে স্প্রিংফিল্ড আর্মোরি কোম্পানি এম-২৫ রাইফেলকে ‘হোয়াইট ফেদার’ নামকরণ করে। প্রতিবছর মেরিনদের সেরা স্নাইপারদের কার্লোস হ্যাথকক পদক দেয়া হয়। তার নামে একটি স্নাইপার ট্রেইনিং স্কুল স্থাপন করেছে মার্কিন সরকার। সব মিলিয়ে ইউএস মেরিনে তিনি ছিলেন একজন জীবন্ত কিংবদন্তি, উত্তর ভিয়েতনামীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক।