মানবসভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়েছে। শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রেরও একটি লক্ষ্য ছিল, মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা। একটি কার্যকর অর্থনৈতিক কাঠামোর মাধ্যমে নাগরিকেরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারেন, রাষ্ট্রও নাগরিকদের কাছ থেকে অধিক হারে রাজস্ব আদায় করতে পারে। ফলে, মানুষের জন্য কোনটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকর অর্থনৈতিক মতবাদ, তা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে, নিয়মিতভাবে হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক।
অর্থনৈতিক মডেল নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক পুরোদমে শুরু হয়েছে ইউরোপকে কেন্দ্র করে সংস্কার আন্দোলন ‘রেনেসাঁর’ সময় থেকেই, অর্থনৈতিক মডেলের পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে মোটাদাগে বিংশ শতাব্দীতে। একবিংশ শতাব্দীতেও এই বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক চলছে, চলছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক মডেলের উপর পরীক্ষানিরীক্ষা।
সমাজতন্ত্র কী?
পুঁজিবাদ, কমিউনিজমের পাশাপাশি একটি বহুল আলোচিত রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মতবাদ সমাজতন্ত্র। কমিউনিজমের সাথে এই অর্থনৈতিক মডেল ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হলেও, কমিউনিজমে একটি শাসনতান্ত্রিক মতবাদ, যেখানে অর্থনৈতিক দর্শনও অন্তর্ভূক্ত আছে। অন্যদিকে, সমাজতন্ত্র কেবল এবং কেবলমাত্র একটি অর্থনৈতিক মতবাদ, এই অর্থনৈতিক মডেল যেকোনো ঘরানার সরকারের অধীনে বাস্তবায়ন করা যায়। সমাজতন্ত্র গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে কাজ করতে পারে, রাজতন্ত্রের অধীনে সফলভাবে একে চালু রাখা যায়, চালু রাখা যায় অভিজাততন্ত্রেও। স্বৈরশাসকের অধীনেও এই অর্থনৈতিক মতবাদ কাজ করতে পারে, সামরিক শাসকের অধীনেও বাস্তবায়ন করা যায় সমাজতন্ত্র।
সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে সমাজতন্ত্রের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মাধ্যমেই একটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে সমাজতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে। এই আর্টিকেলে সমাজতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর পাশাপাশি এই সীমাবদ্ধতাগুলোও আলোচনা করা হবে।
প্রথমত, অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে সমাজতন্ত্র সম্পদের ব্যক্তিমালিকানাকে স্বীকার করে না। বরং, রাষ্ট্রের সকল জমি ও সম্পদের মালিকানা থাকে রাষ্ট্রের হাতে কিংবা সমাজের হাতে। যেসব জায়গায় জমি এবং সম্পদের মালিকানা সমাজের সকল সদস্যের নামে সামষ্টিকভাবে থাকে, সেসব জায়গাতেও রাষ্ট্র সামাজিক মালিকানার অধীনে থাকা জমি আর সম্পদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।
রাষ্ট্র প্রয়োজন এবং অর্থনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে জমি নাগরিকদের কাছে লিজ দেয়, উদ্বৃত সম্পদের বণ্টন করে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে। ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বপ্ন পূরণের সুযোগ এই অর্থনৈতিক মডেলের মধ্যে নেই। আবার, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামাজিকভাবে একই পণ্য উৎপাদন করতে হয় কৃষকদের, পরিশ্রমের পার্থক্যকে উহ্য রেখে আয়ের বণ্টন হয় সকল সদস্যের মধ্যে।
দ্বিতীয়ত, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মডেলে রাষ্ট্র সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করে, রাষ্ট্র নাগরিকদের ঠিক করে দেয়, কোন পণ্য ঠিক কতটুকু উৎপাদন করতে হবে। বাজারের ব্যাপারে সকল তথ্য থাকে রাষ্ট্রের কাছে। ফলে, রাষ্ট্র যেকোনো পণ্যের চাহিদা এবং যোগানের ব্যাপারে সঠিক পরিমাপ করে কৃষকদের পণ্য উৎপাদনে নির্দেশিকা দিতে পারে। যেসব পণ্যের উৎপাদন কম হয় কিংবা চাহিদা বেশি থাকলেও যোগান থাকে কম, রাষ্ট্র সেই পণ্যগুলো উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে পারে। ফলে, কোনো পণ্য অতিরিক্ত উৎপাদিত হয় না, আবার কোনো পণ্যের সংকটও তৈরি হয় না বাজারে।
তৃতীয়ত, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মডেলে নাগরিকদের সক্ষমতার চেয়ে নাগরিকদের প্রয়োজনের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ, একজন নাগরিকের প্রয়োজন অনুযায়ী মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের দায়িত্ব রাষ্ট্র নেয়, রাষ্ট্র সকল নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের পরই বিলাসদ্রব্যের ব্যবস্থাপনার দিকে মনোযোগ দেয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করা হয়।
চতুর্থত, সমাজতন্ত্রে শিশুদের ভরণপোষণের দায়িত্ব রাষ্ট্র নেয়, রাষ্ট্রই শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থার পুরোটাই থাকে সরকারের অধীনে, শিক্ষাব্যবস্থার সকল অবকাঠামোও পরিচালিত হয় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী। অধিকাংশ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই স্বাস্থ্যসেবাও থাকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, সকল নাগরিক সাধারণত একই অবকাঠামো থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে।
সমাজতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা
অর্থনৈতিক মডেল হিসেবে সমাজতন্ত্র কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার কাছাকাছি তাত্ত্বিক ভিত্তি উপস্থাপন করলেও, এর বেশ কিছু বাস্তবিক এবং তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এই সীমাবদ্ধতাগুলোর জন্য অধিকাংশ দেশেই সমাজতন্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে, নাগরিকেরা বিপ্লব আর বিদ্রোহ করে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে সমাজতন্ত্রী শাসকদের।
প্রথমত, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মডেলে রাষ্ট্রের কাছে অর্থনীতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে, বাজার সংক্রান্ত সকল তথ্যও থাকে রাষ্ট্রের কাছে। এই বিপুল তথ্যের প্রবাহ রাষ্ট্রকে কর্তৃত্ববাদী করে তোলে। একটি রাষ্ট্র তখনই গণতান্ত্রিক হয়, যখন রাজস্ব আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে প্রতিনিধিত্ব তুলে আনতে হয় নাগরিকদের মধ্যে থেকে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মডেলে সেই সুযোগ না থাকায় শাসকেরা স্বাভাবিকভাবেই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন।
দ্বিতীয়ত, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সকল অর্থের উপর সরকারের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থাকে। এই কর্তৃত্বকে ব্যবহার করে শাসকেরা শক্তিশালী সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র গড়ে তোলে। এই আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে শাসকেরা সংঘাত তৈরির ক্ষমতার উপর মনোপলি তৈরি করে করেন, নাগরিকদের মধ্যে যেকোনো ধরনের ভিন্নমতকে কঠোরভাবে দমন করেন।
তৃতীয়ত, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে সামাজিক সাম্য নিশ্চিত হলো, অর্থনৈতিক সাম্য এই অর্থনৈতিক মডেল নিশ্চিত করতে পারে না। বরং, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য সামর্থ্যবান আর কম সামর্থ্যের লোকজন একই মূল্যায়ন করায় মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রতি আগ্রহ কমে যায়, কমে যায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ।
চতুর্থত, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কাঠামো সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও, খুব কম দেশেই সেই স্বাস্থ্যসেবা নাগরিকদের চাহিদামতো যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সেবা দিতে পেরেছে। অধিকাংশ দেশের স্বাস্থ্যসেবাই ব্যর্থ হয়েছে দূর্নীতির কারণে, শিক্ষাখাত পরিণত হয়েছে সবচেয়ে অদক্ষ খাতগুলোর একটিতে।
সমাজতন্ত্রের পরীক্ষানিরীক্ষা
সমাজতন্ত্রীদের একটি যুক্তি হচ্ছে, সমাজতন্ত্র পৃথিবীর কোথাও ব্যর্থ হয়নি, কারণ প্রকৃত সমাজতন্ত্র পৃথিবীর কোথাও প্রয়োগ করা হয়নি, হয়নি পরীক্ষা করা। তবে, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসীদের এই যুক্তি আসলে সঠিক নয়। বরং, পৃথিবীর যেসব জায়গায় সমাজতন্ত্র প্রয়োগ করা হয়েছে, সব জায়গাতেই ব্যর্থ হয়েছে সমাজতন্ত্র।
সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার উদাহরণ শুরু হবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দিয়ে। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব যখন মিখাইল গর্ভাচেভ নেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের তখন নিজের নাগরিকদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, মস্কোসহ অন্যান্য নগরীতে নিত্যপ্রয়োজনীয় রেশনের জন্য লম্বা লাইন ধরতে হতো। রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল, কৃষিখাত ধ্বংসের কাছাকাছি পৌঁছেছিল, শিল্পখাতও প্রতিযোগিতাতে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। সোভিয়েত শিল্পগুলোকে বলা হতো ‘প্রথম শিল্পবিপ্লবের জাদুঘর’।
সোভিয়েত ইউনিয়নের এই ব্যর্থতা হঠাৎ করে সবার সামনে আসেনি। শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন স্নায়ুযুদ্ধে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছিল। কিন্তু, সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ব্যর্থতা বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের দেশগুলোকে সমাজতন্ত্র প্রয়োগ করা আটকাতে পারেনি, আটকাতে পারেনি এই রাজনৈতিক প্রচারও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই লেবার সরকারের অধীনে সমাজতন্ত্রের প্রয়োগ শুরু হয় যুক্তরাজ্যে, বড় বড় শিল্পগুলোর সরকারিকরণ শুরু হয়। স্বল্প সময়ের জন্য এই পলিসি কাজও করে, দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করে। কিন্তু, দশকের মধ্যে যুক্তরাজ্যে সমাজতন্ত্রের এই টেস্ট কেইস ব্যর্থ হয়, যুক্তরাজ্যে আবার ফিরে আসে পুঁজিবাদে।
সমাজতন্ত্রের এরপরের প্রয়োগ দেখা যায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারতেও। প্রধান ধারার শিল্পগুলোর সরকারিকরণ শুরু হয়, রাষ্ট্র সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মানদণ্ড ঠিক করে দিতে থাকে। এখানেও ব্যর্থ হয় সমাজতন্ত্র, ভারতে এগিয়ে যেতে হয় সোশ্যাল ডেমোক্রেসির দিকে। সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কাঠামোতে ভারতে শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম আছে, শিক্ষাখাতে সরকার বিপুল বিনিয়োগ করে, স্বাস্থ্যখাতেও বাজেটের এক বড় অংশ খরচ করে সরকার। কিন্তু, শিল্পখাতকে প্রায় পুরোপুরি ব্যক্তি মালিকানার অধীনে করে দেওয়া হয়েছে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমও নির্ধারিত হয় চাহিদা আর যোগানের মাধ্যমে। সবমিলিয়ে, এখানেও ব্যর্থ হয়েছে সমাজতন্ত্র।
প্রথাগতভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ইসরায়েল, দুই দেশের মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা আর স্বার্থের সম্পর্ক। ইসরায়েলেও পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে প্রয়োগ করা হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মডেল। প্রথম দুই দশক দারুণভাবে সেই মডেল কাজ করে ইসরায়েলে, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছাড়িয়ে যেতে থাকে ১০ শতাংশকে। কিন্তু, দুই দশক পরেই এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে যায়, আরো এক দশকের মন্থর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরে ইসরায়েল ফিরে আসে পুঁজিবাদে।
এই দেশগুলোর বাইরে, লাতিন আমেরিকার থেকে শুরু করে আফ্রিকা বা এশিয়া, যে প্রান্তেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মডেল প্রয়োগ করা হয়েছে বা প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়েছে, অধিকাংশ দেশেই সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক মডেল ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি উত্থান ঘটেছে কঠোর কর্তৃত্ববাদের, উত্থান ঘটেছে স্বৈরশাসনের।