ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে হিমালয়ের পাদদেশের এক অঞ্চলের মানুষের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল এক মানুষখেকো বাঘিনী। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই মানুষখেকোর পিছু নিয়েছিল সেখানকার পুলিশ, গুপ্ত শিকারি, এবং এমনকি একটি নেপালি গোর্খা রেজিমেন্ট। বলা হয়ে থাকে, প্রায় ৪৩৬টি নথিভুক্ত মৃত্যুর জন্য এ বাঘিনীটি দায়ী ছিল। গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুসারে, বাঘের আক্রমণে প্রাণহানির সংখ্যা বিবেচনায় এটিই ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
ক্রমেই এটি ইতিহাসের পাতায় চম্পাবতের মানুষখেকো নামে পরিচিতি লাভ করে। ইতিহাসবিদরা এর সম্পর্কে বলেছিলেন, “This tiger ceased to behave like a tiger at all. It transformed into a new kind of creature all but unknown in the hills of northern India’s Kumaon district.”
১৯০৭ সালে এক শিকারির বন্দুকের গুলিতে এই মানুষখেকোর মৃত্যু হয়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মানুষের মনে ত্রাস সঞ্চার করা চম্পাবতের এই কিংবদন্তির যবনিকাপাতের মধ্য দিয়েই জন্ম হয় ইতিহাসের আরেক বিখ্যাত কিংবদন্তির। সেই কিংবদন্তির নাম ছিল এডওয়ার্ড জেমস করবেট, সংক্ষেপে জিম করবেট। আর কুমায়ুন-গাড়োয়ালের মানুষের কাছে তার পরিচয় ছিল ‘কার্পেট সাহেব’। চম্পাবতের বিখ্যাত মানুষখেকো বাঘিনী ছিল তার প্রথম শিকার।
জিম করবেট (Jim Corbett) জন্মেছিলেন ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুলাই, ভারতের কুমায়ুনে অবস্থিত নৈনিতাল শহরে। স্থানটি বর্তমানে উত্তরাখণ্ড রাজ্যে। শীতে নৈনিতালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে করবেটের বাবা তখনকার বহুল প্রচলিত নিয়মানুযায়ী, নৈনিতাল থেকে ১৫ মাইল দূরে তেহরি রাজ্যের অন্তর্গত কালাধুঙ্গি নামক গ্রামে জমিজমা নিয়ে দ্বিতীয় আরেকটি আবাস গড়ে তোলেন শীতকালীন সময়ের জন্য। দুই আবাসস্থল পরবর্তীতে জিম করবেটের শিকারি হয়ে উঠার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে।
তার কাছে জঙ্গল ছিল হাতের তালুর মতো চেনা। অজস্র পশু-পাখির ডাক নকল করতে পারতেন তিনি। বাঘের মতোই নিঃশব্দ আর ক্ষিপ্র ছিল তার গতি। কুমায়ুন ও গাড়ওয়ালের বনে-পাহাড়ে এমন আরও হাজারো কাহিনী ছড়িয়ে আছে তার নামকে ঘিরে।
১৯০৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে করবেট মোট ৩৩টির মতো মানুষখেকো বাঘকে অনুসরণ এবং গুলিবিদ্ধ করেছিলেন। যদিও এদের মধ্যে মাত্র ডজনখানেক ভালোভাবে নথিভুক্ত হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে যে, এসব বড় বেড়ালেরা ১২০০ এর উপর পুরুষ, নারী এবং শিশুকে হত্যা করেছিল।
তার শিকারি জীবনে দুটি মানুষখেকো চিতাবাঘও শিকার করেছিলেন। ১৯১০ সালে পানারে প্রথম যে চিতাবাঘটিকে হত্যা করেছিলেন, সেটি প্রায় ৪০০ মানুষকে হত্যা করেছিল। আর দ্বিতীয়টি ছিল রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতাবাঘ। প্রায় আট বছর ধরে যেটি দৌরাত্ম্য বিরাজ করেছিল এবং হত্যা করেছিল ১২৬ এর অধিক তীর্থযাত্রী মানুষকে। রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো লেপার্ড শিকারের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে করবেট বলেছিলেন, “There are events in one’s life which, no matter how remote, never fades away from memory”
ভয়ঙ্কর কোনো শিকার ধরার সময় তিনি একাকি থাকতে পছন্দ করতেন এবং পায়ে হেঁটেই মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করতেন। অনেকসময় তিনি তার পোষা কুকুর রবিনকে সঙ্গে নিতেন শিকারের সময়। শিকারের সময় অন্যদের জীবন রক্ষার্থে তার নিজের জীবনের উপর বড় ঝুঁকি নিতেও পিছপা হতেন না।
কথায় আছে, বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা। কিন্তু কেন? কারণ বাঘের থাবায় আছে প্রচণ্ড জোর। বাঘ তার থাবা দিয়ে একবার আঁচড় দিলেই গ্যাংগ্রিন হয়ে মানুষ মৃত্যুর কোলে পর্যন্ত ঢলে পড়তে পারে। এসব জানা সত্ত্বেও তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে তাল্লা-দেসের মানুষ খেকো, মোহনের মানুষ খেকো, থাক-এর মানুষ খেকো এবং মুক্তেশরের মানুষ খেকোর মতো ভয়ংকর সব মানুষ খেকো শিকার করেছিলেন।
জিম করবেটের শিকার ও ভারতের বন্যপ্রাণী সম্পর্কে যে বিপুল অভিজ্ঞতা, সে তুলনায় তার লিখিত রচনার পরিমাণ বেশ কমই বলা যায়। নৈনিতালে তার বন্ধুর ছোট্ট প্রেসে ছাপা প্রথম বই ‘জাঙ্গল স্টোরিজ’-এর কথা বাদ দিলে (ছাপা হয়েছিল মাত্র ১০০ কপি, তাও বিক্রি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না) জিমের গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র ছয়টি।
আর এখন মৃত্যুর ষাট বছর পরেও তার শিকার-কাহিনীগুলো এখনো বেস্টসেলার। অথচ সে অর্থে পেশাদার লেখক হবার কোনো বাসনা ছিল না তার। অধিকাংশ রচনাই ঘটনার বিশ, তিরিশ কিংবা চল্লিশ বছর পর লেখা।
১৯০৭ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ তিন দশক ধরে রাতের পর রাত হিংস্র শ্বাপদের সন্ধানে কেটেছে জিম করবেটের। একাধিকবার প্রায় অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। তার মতে শিকার তখনই মান্যতা পায় যখন তা হয় সাধারণ নিরীহ মানুষের প্রাণ রক্ষার স্বার্থে।
সুস্থ বাঘেরা সবসময় মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। তাদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও মানুষের মাংসের প্রতি অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। বাঘেরা মূলত মানুষখেকো হয়ে উঠে বয়সের ভারে শিকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। চম্পাবতের বাঘিনীর মতো আরো অনেক বাঘ তাদের বাস্তুতন্ত্রের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপী চলমান ধ্বংসযজ্ঞের ফলেও মানুষ খেকো হয়ে উঠতে পারে।
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যেই ৮০ হাজারের অধিক বাঘকে কেবল বিনোদনের উদ্দেশ্যেই হত্যা করা হয়েছে। বিগত শতাব্দীর মধ্যেই ভারতবর্ষের ৬৭% এলাকা হতে বাঘ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাই বাঘকে ‘নিষ্ঠুর ও রক্তপিয়াসী’ বলতে ঘোরতর আপত্তি ছিল করবেটের। তার ভাষায়, ‘‘বাঘ উদারহৃদয় ভদ্রলোক। সীমাহীন তার সাহস। যে দিন বাঘকে বিলোপ করে দেওয়া হবে, যদি বাঘের সপক্ষে জনমত গড়ে না উঠে বাঘ লোপ পাবেই, তা হলে ভারতের শ্রেষ্ঠতম প্রাণীর বিলোপে ভারত দরিদ্রতরই হবে।”
জিম করবেট সারা জীবন কাজ করে গেছেন ভারতবর্ষে বাঘেদের জন্য অভয়াশ্রম তৈরির উদ্দেশ্যে। ১৯৩৮ সালের ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬ টায় থাক-এর মানুষখেকো বাঘিনী শিকারের মধ্য দিয়ে জিম করবেট তার শিকারি জীবনের ইতি টেনেছিলেন। আজ পর্যন্ত মানুষখেকো প্রাণীদেরকে নিয়ে লেখা গল্পগুলোর মধ্যে এক অন্যতম নাটকীয় গল্প হলো থাক-এর মানুষখেকোকে নিয়ে লেখা গল্পটি।
তার লেখা ‘Man-Eaters of Kumaon’ বইটি ১৯৪৫ সালে আমেরিকার বর্ষসেরা বই হিসেবে মনোনীত হয়। ১৯৪৮ সালে হলিউডে Man-Eater of Kumaon নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল। যদিও চলচ্চিত্রটিতে করবেটের গল্পগুলোর কিছুই অনুসরণ করা হয়নি, তবে চলচ্চিত্রটিতে বাঘ শিকারের কিছু দৃশ্য ছিল। বলা বাহুল্য যে, চলচ্চিত্রটি প্রেক্ষাগৃহে ভরাডুবির সম্মুখীন হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে করবেটের করা একমাত্র মন্তব্যটি ছিল, “The best actor was the tiger.”
১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসে তার বোন ম্যাগিকে সাথে নিয়ে লক্ষ্ণৌ হতে মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন করবেট। সেখান থেকে এস. এস. অ্যারোন্দা জাহাজে মোম্বাসা এবং সেখান থেকে নাইরোবি হয়ে নায়েরি শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি এবং তার বোন ম্যাগি। ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তার লেখা চিঠিগুলো হতে প্রকাশ পেয়েছিল যে, তার ভয় ছিল স্বাধীন ভারতে হয়তো তার উপরে অত্যাচার নেমে আসবে এবং ইংরেজ হওয়ায় তিনি হয়তো সুবিচার পাবেন না।
লক্ষ্ণৌতে যারা সেদিন করবেটকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন তারা কেউ চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। তার প্রিয় ভারতভূমি ছেড়ে যাবার আগে নৈনিতালের বাড়ি বিক্রি করে তার বহুদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী রাইফেল ও বন্দুকগুলো গভীর জঙ্গলে ‘সমাধিস্থ’ করে এসেছিলেন।
৭৯ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালের ১৯শে এপ্রিল কেনিয়ার নায়েরিতে হার্ট অ্যাটাকে জীবনাবসান ঘটে জিম করবেটের।
ভারতীয় উপমহাদেশের ঘন জঙ্গলগুলোর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি ও উপকথা। যার অধিকাংশই হয়তো মানব মনের কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু জিম করবেটের জীবন ছিল এমনই এক প্রকৃত কিংবদন্তি, যার কোনো অংশই কল্পনাপ্রসূত নয়। তার পদচারণার ধ্বনি আজও ভারতীয় উপমহাদেশের ঘন শ্বাপদসংকুল জঙ্গলগুলোতে প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যায়।