পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে স্বীকৃত মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতা। তবে এলিয়ট স্মিথ, পেরীর মতো ঐতিহাসিকেরা আবার মিশরীয় সভ্যতাকে সবচেয়ে প্রাচীন হিসেবে মানতে চান। সময়ের হিসাব করলে সুমেরীয় সভ্যতা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০-৪০০০ ও মিশরীয় সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০-৩০০০ অব্দের মধ্যে গড়ে ওঠে। এই দুই প্রাচীন সভ্যতার প্রায় সমসাময়িক সময়ে পৃথিবীর বুকে আরও একটি সভ্যতার সূচনা ঘটে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশেই, সিন্ধু সভ্যতা!
তবে অন্য প্রাচীন সভ্যতাগুলো, যেমন- মিশরীয় কিংবা সুমেরীয়দের তুলনায় সিন্ধু সভ্যতা যেন রূপকথার রাজ্যের মতোই সকলের অন্তরালে থেকে গেছে।
রূপকথার সন্ধান
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈনিক চার্লস ম্যাসন ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে পর্যটক হিসেবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়ানো শুরু করেন। তার আবার ছিল মুদ্রা সংগ্রহের নেশা। বিভিন্ন সূত্র ধরে নিজে নিজেই বিভিন্ন প্রাচীন এলাকা খনন করতে থাকেন। এসব এলাকার মধ্যেই একটি ছিল পাকিস্তানের হরপ্পা, যা তিনি খুঁজে পান ১৮২৯ সালে। তবে শহরটি কে বা কাদের তৈরি সেই সম্পর্কে ধারণা না থাকায় ম্যাসন একে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সময়ের বলে ধরে নেন।
পরবর্তীতে ভারতবর্ষ থেকে ফিরে ১৮৪২ সালে তার ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লেখেন তিনি, ‘Narrative of Various Journeys in Balochistan, Afghanistan, the Panjab, & Kalât’। এই বইটিই ভারতে থাকা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ, বিশেষত স্যার আলেক্সান্ডার কানিংহামের (ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা), দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
১৮৫৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির কর্মীরা করাচি থেকে লাহোরের দিকে রেললাইন নির্মাণের সময় ইটের অভাব হলে কাছেই হরপ্পার ‘এক ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর’ থেকে ইট সংগ্রহ করে আনে। তখন পর্যন্তও কেউ জানত না এর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব সম্পর্কে।
যা-ই হোক, ১৮৭৫ সালে স্যার কানিংহাম হরপ্পায় অপরিচিত লিপি সম্বলিত একটি সীল খুঁজে পান। তিনিই এর নাম দেন ‘সিন্ধু লিপি’। তবে পরিপূর্ণ জ্ঞানের অভাবে হরপ্পা আবার লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়।
১৯২০ সালের দিকে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের কর্মকর্তা বাঙালি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারোতে বৌদ্ধ স্তুপের ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগের নিদর্শন খুঁজে পান। একই সময়ে হরপ্পাতে পাওয়া নিদর্শন ও মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া নিদর্শনের মধ্যে মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯২১-২৪ সালে তৎকালীন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালক জন মার্শালের নেতৃত্বে আবিষ্কৃত হয় আরও অনেক নিদর্শন। সিন্ধু নদীর তীরে গড়ে ওঠা প্রায় ৫,০০০ বছরের পুরনো এ সভ্যতার নাম দেয়া হয় সিন্ধু সভ্যতা।
সময় নির্ধারণ ও বিস্তার
১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার ১,০৫৬টি শহর এবং এলাকা পাওয়া গেছে যার মধ্যে এখন পর্যন্ত ৯৬টি খনন করা সম্পন্ন হয়েছে। আরব সাগরের তীরবর্তী সুতকাজেনডোর, বেলুচিস্তানের কোটজিদি, গুজরাটের ক্যাম্বে উপত্যকার লোথাল, আহমেদাবাদের সুরকোতাদা থেকে উত্তর-পশ্চিমে শিমলার পাদদেশ, রাজস্থানের কালিবঙ্গান, দিল্লির উত্তরে যমুনার অববাহিকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সিন্ধু সভ্যতা। প্রায় ১৩ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের এ সভ্যতা স্বাভাবিকভাবেই সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতা থেকে আকারে ছিল সর্ববৃহৎ। শুধুমাত্র কালিবঙ্গানে ঘাগ্গর-হাকরা নদীর (ধারণা করা হয়, ঋগ্বেদে উল্ল্যেখিত সরস্বতী নদী) তীরে প্রায় ৫০০টি এলাকা চিহ্নিত করা গেছে, যেখানে সিন্ধুর তীরবর্তী এলাকা সংখ্যা ১০০টি। এ কারণে অনেকে ‘সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতা’ বলেও আখ্যায়িত করে সিন্ধু সভ্যতাকে। হরপ্পায় প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় বলে একে হরপ্পা সভ্যতাও বলা হয়।
মর্টিমার হুইলার মহেঞ্জোদারো শহরের ৭টি স্তর আবিষ্কার করেন এবং ধারণা করেন প্রত্যেক স্তরের সময় ছিল ৫০০ বছর এবং শেষ স্তরটি ছিল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের।
মিশর এবং মেসোপটেমিয়া দুটি সভ্যতাতেই একধরনের নীলরত্ন (ল্যাপিস লাজুলি) বেশ জনপ্রিয় ছিল। মূলত এর প্রাপ্তিস্থল ছিল ভারত। সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কার হওয়ার আগঅবধি পন্ডিতদের ধারণা ছিল না যে এই রত্ন কী করে মেসোপটেমিয়া বা মিশরে এলো। তাছাড়া, মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত সুমেরীয় সভ্যতার সীলমোহর দেখে এটা প্রতীয়মান হয় যে সুমেরীয়দের সাথে তাদের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। এই সূত্রে সিন্ধু সভ্যতার সূচনাকাল ধরা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ অব্দ।
পরবর্তীতে লোথাল ও কালিবঙ্গানে কার্বন ডেটিংয়ে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, সভ্যতার সময় খ্রিস্টপূর্ব ২২০০-১৭০০ বলে ধারণা করা হয়। তবে আত্মপ্রকাশের পূর্বে মাটির নিচের স্তরে পানির নিচে আরেকটি স্তর চিহ্নিত করা হয়, যা ৫০০ বছরের। সব মিলিয়ে এটা ধারণা করা হয় যে সিন্ধু সভ্যতার জন্ম ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দে এবং খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে এর পতন ঘটে।
সিন্ধু সভ্যতার সময়কে তিনটি পর্বে ভাগ করা যায়-
- আদি হরপ্পা (Early Harappan Phase): খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০০-২৬০০ অব্দ
- পূর্ণ-বর্ধিত হরপ্পা (Mature Harappan Phase): খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০-১৯০০ অব্দ
- পরবর্তী হরপ্পা (Late Harappan Phase): খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০-১৩০০ অব্দ
কেমন ছিল রূপকথার রাজ্য?
মনে করা হয়, প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুপরিকল্পিত নগরায়ন ঘটেছিল সিন্ধু সভ্যতায়। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো ছিল রাজধানী। যেখানে প্রাচীন শহরগুলোতে গড়ে ১০ হাজার লোক বসবাস করত, সেখানে শুধু এই দুই নগরীতেই ছিল প্রায় ৪০-৫০ হাজার লোকের বাস! সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখেরও বেশি জনসংখ্যা ছিল এ সভ্যতার। স্বাভাবিকভাবেই জনবসতি বেশি হলে সেখানকার পরিবেশ অরাজকতাপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং ধারণা করা হয় বসবাসরত জনগণ ছিল বেশ শান্তিপ্রিয়।
নগর নির্মিত হয়েছে গ্রিড প্যাটার্নে। সড়কের প্রান্তে বৃত্তাকারে নির্মিত বাড়িগুলো ছিল পোড়া ইট এবং মাটির তৈরি সমতল ছাদবিশিষ্ট। প্রত্যেক বাড়ি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। কোনো কোনো বাড়ি ছিল বহুতলবিশিষ্ট। দুই কক্ষ থেকে পঁচিশ কক্ষের বাড়িও পাওয়া গিয়েছে! শহরের পয়ঃপ্রণালী ছিল অতি উন্নতমানের। প্রত্যেক বাড়িতে বারান্দা, গোসলখানা এবং কুয়া ছিল। বাড়ি থেকে পানি নিষ্কাশনের জন্য ভূগর্ভস্থ ড্রেন ছিল। রাস্তার ড্রেনগুলোতে ছিল আধুনিককালের মতো ম্যানহোল সিস্টেম। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ছিল আলাদা ব্যবস্থা, ছিল জলাধার। আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা রোমানদের হাত ধরে শুরু হয় বলেই আমরা জানতাম। কিন্তু রোমানদেরও প্রায় হাজার বছর পূর্বে সিন্ধুর ইঞ্জিনিয়াররা পৃথিবীর প্রথম স্যানিটেশন সিস্টেমের উদ্ভাবন ঘটান!
মহেঞ্জোদারোর রাস্তায় ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট ইটনির্মিত ব্যবস্থা ছিল। এ থেকে ধারণা করা হয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অধিবাসীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।
হরপ্পা ও কালিবঙ্গানের রাস্তাগুলো ছিল সোজা, উত্তর-দক্ষিণ বা পূর্ব-পশ্চিমমুখী। মহেঞ্জোদারোতে ছিল বৃহৎ স্নানাগার। এর জলাধার ছিল ৩৯ ফুট লম্বা, ২৩ ফুট চওড়া ও ৮ ফুট গভীর, যেখানে পানি প্রবেশ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। পাশে বসার জন্য মঞ্চ ও ছোট ছোট কক্ষ ছিল। ধারণা করা হয়, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে এটি নির্মাণ করা হয়। তবে কারও কারও মতে, শুধুমাত্র বিনোদনের উদ্দেশ্যেই এটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা দুই শহরেই ছিল শস্যাগার। মহেঞ্জোদারোর শস্যাগারটি ছিল সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে বড় স্থাপনা। এ ছাড়া মহেঞ্জোদারোতে ৮০ ফুট আয়তনের একটি বিশাল হল পাওয়া যায় যাতে সারি সারি বসার ব্যবস্থা এবং সামনে প্ল্যাটফর্ম ছিল! মহেঞ্জোদারোর চারদিকে দেয়াল ও দুর্গ ছিল। উঁচু এলাকায় নির্মিত এসব দুর্গ শহরকে বন্যা এবং বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করত। নগরীর নীচু অংশে ছিল উপনগরী। তবে পুরো সভ্যতা জুড়ে কোথাও কোনো উপাসনালয়, বৃহৎ স্তম্ভ বা প্রাসাদ জাতীয় কিছু পাওয়া যায়নি।
যেখানে অন্যান্য বেশিরভাগ সভ্যতা ছোট বা পল্লী জনপদ থেকে বিকশিত হয়েছিল, সেখানে সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা দেখে মনে করা হয় নির্দিষ্ট জায়গা বেছে নিয়ে পরিকল্পনা করে তবেই তা নির্মাণ করা হয়। এ থেকে এটাও ধারণা করা হয় যে, এ ধরনের নগর পরিকল্পনা, অর্থায়ন এবং বাস্তবায়নে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার হয়, যা হয়তো তাদের ছিল!
শিল্প-সংস্কৃতি ও জীবনযাপন
ধারণা করা হয়, সিন্ধুর অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। বৃহৎ শস্যাগার সমৃদ্ধ কৃষিরই প্রমাণ দেয়। এছাড়া কারিগর ও বণিক শ্রেণী ছিল। মহেঞ্জোদারো বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। লোথালে পাওয়া বন্দর তাদের সমৃদ্ধ বাণিজ্যের প্রমাণ দেয়! মিশর, মেসোপটেমিয়া, আফগানিস্তান, চীন, পারস্য ও ক্রীট সভ্যতার সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সাজিমাটির তৈরি অসংখ্য সীলমোহর বাণিজ্যিক কাজে ব্যক্তিগত পরিচয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলেই মনে করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, আবিষ্কৃত সীলের মধ্যে ৬০% সীলে ইউনিকর্ন সদৃশ প্রাণীর ছবি পাওয়া গেছে। যদিও ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর ছবিও পাওয়া যায়, কিন্তু হরপ্পায় আবিষ্কৃত ১,৭৫৫টি সীলের মধ্যে ১,১৫৬ টি সীলেই এই ইউনিকর্নকে দেখতে পাওয়া যায়। ঠিক তার ওপরে সিন্ধু লিপি লিপিবদ্ধ করা। ধারণা করা হয়, এই ইউনিকর্ন কোনো বংশ, গোত্র, শহর বা রাজনৈতিক কোনো চিহ্ন আর ওপরের লিপি ব্যক্তিগত পরিচয়।
অধিবাসীরা তুলা দিয়ে সুতা কাটা ও বস্ত্র তৈরি করতে জানত। মৃৎশিল্পীরা চীনা মাটির পাত্র নির্মাণেও দক্ষ ছিল। অলংকার তৈরিতে তারা পারদর্শী ছিল। আবিষ্কৃত মূর্তি থেকে ধারণা করা হয়, পুরুষেরা শরীরের নিম্নভাগে ধুতি ও উপরিভাগে চাদরের মতো পোশাক এবং নারীরা দুই প্রস্থ কাপড় পরিধান করত। নারীদের প্রসাধনী ব্যবহারের কথাও অনুমান করা হয়। তারা চাকার ব্যবহার জানত। পরিবহনের জন্য গবাদি পশুচালিত গাড়ি ব্যবহার করত। তারা সেচকৌশল সম্পর্কে অবগত ছিল।
প্রযুক্তিগত দিকেও তারা যথেষ্ট উন্নত ছিল। তারা নির্ভুলভাবে দৈর্ঘ্য ও ভর পরিমাপ করতে জানত। খননে প্রাপ্ত কিউব আকৃতির বিভিন্ন পাথর থেকে মনে করা হয়, এগুলো ভর পরিমাপে ব্যবহার করা হত। লোথালে পাওয়া একটি হাতির দাঁতের স্কেলের ক্ষুদ্রতম মাপ ১.৬ মিলিমিটার যা ব্রোঞ্জ যুগে পাওয়া স্কেলের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্র। বাড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত পোড়া ইট আর্দ্রতা প্রতিরোধী এবং আকৃতিতে একই মাপের ছিল যা তাদের পরিমাপের দক্ষতার প্রমাণ দেয়। কোনো কোনো বাড়ির ছাদে ‘উইন্ড ক্যাচার’ ছিল যা ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করত। ধলাভিরায় ১৭টি জলাধার পাওয়া যায় যেটি একইসাথে সারা বছর এবং বন্যা থেকে শহরকে রক্ষাও করত! এমনকি সিন্ধু সভ্যতায় দন্ত চিকিৎসার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
অধিবাসীরা ধাতুবিদ্যায় (Metallurgy) পারদর্শী ছিল। তাছাড়া হাতির দাঁত, বিভিন্ন রত্ন, যেমন- কার্নেলিয়ান, ল্যাপিস লাজুলি ব্যবহার করে বিভিন্ন হস্তশিল্প ও গহনা তৈরির কাজ করত। বিভিন্ন ভাস্কর্য, সীলমোহর, মৃৎপাত্র, টেরাকোটা, সোনার গহনা ইত্যাদি শিল্পে তাদের দক্ষতার প্রমাণ দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্ল্যেখযোগ্য হলো একটি ১০ সেন্টিমিটার লম্বা ব্রোঞ্জ মূর্তি- দ্য ড্যান্সিং গার্ল। অন্যটি সাজিমাটির ১৭ সেন্টিমিটারের মূর্তি- দ্য প্রিস্ট কিং। মজার ব্যাপার হচ্ছে, খননের সময় ছোটদের অসংখ্য খেলনা, ডাইস, মার্বেল ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছে।
উপাসনালয়ের অনুপস্থিতির জন্য অধিবাসীদের ধর্ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা যায় না। তবে পোড়া মাটির তৈরি বিভিন্ন মূর্তির মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণে নারী মূর্তি পাওয়া গিয়েছে যা থেকে মাতৃপূজার বিষয়টি ধারণা করা হয়। কিছু সীলমোহরে দেখা যায় ধ্যানমগ্ন যোগী, মাথায় শিং ও পশু দ্বারা পরিবেষ্টিত। মনে করা হয়, পশুপতি শিব পূজার প্রচলন ছিল। তাছাড়া লিঙ্গমূর্তি পূজার প্রমাণও পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, সিন্ধু সভ্যতা থেকেই পরবর্তীতে হিন্দু ধর্মে এ লিঙ্গমূর্তি পূজা গৃহীত হয়। তাছাড়া প্রাণী উপাসনা ও প্রকৃতি পূজার প্রচলন ছিল। অশ্বত্থ গাছ ও পাতার ছবি সীলমোহর ও মৃৎপাত্রে পাওয়া গেছে বলে এমন ধারণা করা হয়।
হরপ্পায় প্রায় ৫৭টি কবরের এক কবরস্থান পাওয়া যায়। মৃতদেহের সাথে তাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিস ও অলংকার পাওয়া গিয়েছে। যা থেকে বোঝা যায় যে তারা পরকালে বিশ্বাসী ছিল। কালিবঙ্গানে ইটের তৈরি সমাধিক্ষেত্র পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া আংশিক কবরের নিদর্শন পাওয়া গেছে। কোনো কোনো স্থানে মৃতদেহ দাহ করে ভস্ম কবর দেয়া হতো।
সুপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য যদিও ভাবা হয় যে প্রত্যেক নগরে গভর্নর এবং একজন কেন্দ্রীয় শাসকের হাতে ক্ষমতা ছিল (কারও মতে, একজন শাসক), কিন্তু কোনো প্রাসাদ, স্তম্ভ বা রাজচিহ্ন পাওয়া না যাওয়ার দরুণ কেউ কেউ এটাও ভাবে যে সিন্ধু সভ্যতার আদৌ কোনো শাসক ছিল না। প্রত্যেক অধিবাসীই সমান সুযোগ সুবিধা নিয়ে বসবাস করত।
সিন্ধুলিপি
মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক্স, মেসোপটেমিয়ান কিউনিফর্ম এবং খুব সম্প্রতি মায়ান গ্লিফসের মতো লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হলেও সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি! আর এ কারণেই এমন এক সমৃদ্ধ সভ্যতার অনেক অনেক তথ্য রয়ে গেছে অগোচরে!
সিন্ধুলিপি মূলত বিভিন্ন চিহ্ন সম্বলিত চিত্রলিপি। সীল, সীরামিকের পাত্রসহ বিভিন্ন উপকরণ থেকে প্রায় ৪০০-৭০০টির মতো আলাদা আলাদা প্রতীক বা লিপি পাওয়া গেছে। লেখাগুলো সাধারণত ছিল ৪-৫টি প্রতীক বিশিষ্ট। সিন্ধু লিপি ডান থেকে বাম দিকে এবং পরের লাইন বাম থেকে ডান দিকে লেখা হতো।
হরপ্পায় প্রাপ্ত একটি মাটির সীলে ত্রিশূল, গাছ সদৃশ প্রতীক ডান থেকে বামে লিপিবদ্ধ হয়েছে বলে মনে করা হয়। কার্বন ডেটিং অনুসারে ওই সীলটি ৩৩০০-৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। ধলাভিরায় দশটি লিপি সম্বলিত লেখা পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, সেটি খুব সম্ভবত কোনো সাইনবোর্ড ছিল!
প্রতীকগুলো বিশ্লেষণ করে এটি ধারণা করা হয় যে, এগুলো ছিল লোগোসিলেবিক। অর্থাৎ প্রত্যেকটি প্রতীক ছিল একেকটি শব্দ এবং এদের উচ্চারণ পদ্ধতিও ছিল ভিন্ন ভিন্ন, যেমনটা ছিল মেসোপটেমিয়ার কিউনিফর্ম এবং মায়ান গ্লিফসে! তবে যেখানে অন্যান্য সভ্যতায় পাওয়া লেখাগুলো প্রায় ১০০ লিপি সমৃদ্ধ, সেখানে সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে দীর্ঘ লেখায় ১৭টি লিপি বা প্রতীক পাওয়া গেছে। এ কারণে কোনো কোনো পন্ডিত এমন মতও দেন যে এগুলোর আসলে কোনো অর্থই হয়তো নেই।
ধ্বংস হলো যেভাবে
সিন্ধু সভ্যতা ঠিক কী কারণে হারিয়ে যায় সেই সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিকদের মধ্যে এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।
কারো কারো মতে, সভ্যতার শেষ দিকে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। সিন্ধু নদের দিক পরিবর্তিত হওয়ায় এ অঞ্চলের অনেকাংশই পরিণত হয় মরুভূমিতে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। মহেঞ্জোদারোর কাছে ভয়াবহ ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল এবং ভূমিকম্পেই এ সভ্যতা ধ্বংস হয় বলে অনেকে মনে করেন। আবার কারো মতে, ক্রমাগত বন্যাই সিন্ধু সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। ২৭৫০ খ্রিস্টপূর্বে হওয়া প্রলয়ংকারী বন্যা যে হরপ্পা আর মহেঞ্জোদারোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মহেঞ্জোদারোতে তিন স্তরের বন্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
কারো কারো মতে, শহরগুলো ক্রমেই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এবং অধিবাসীরা স্থান পরিবর্তন করে চলে যায়। কেউ মনে করেন, বাণিজ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে ক্রমান্বয়ে পতন ঘটে এ সভ্যতার।
তবে বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের মতে, বহিরাগতদের আক্রমণে ধ্বংস হয় সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু অধিবাসীদের একাধিক বৈদেশিক আক্রমণের মোকাবেলা করতে হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে বেশিরভাগের মতে, আদতে বহিরাগত ছিল আর্যরা। কারণ হিসেবে ড. হুইলার যুক্তি দেন, ঋগ্বেদে উল্ল্যেখ আছে আর্যরা সপ্তসিন্ধু ও দুর্গঘেরা নগর জয় করে বসতি স্থাপন করে। এখানে সপ্তসিন্ধু বলতে হয়তো সিন্ধু তীরের সভ্যতাকেই বোঝানো হয়েছে। তাছাড়া ‘হরিওপি’র অঞ্চলে আর্য ও অনার্যদের যুদ্ধের বর্ণনা রয়েছে। এই হরিওপি ‘হরপ্পা’কে নির্দেশ করে আর অনার্য বলতে সিন্ধু অধিবাসীদেরই বোঝানো হয়েছে!
তবে দ্বিমত থাকলেও আর্যরা যে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে ভারতে এসেছিল এ বিষয়ে সবাই একমত। কালানুক্রমের দিক থেকেও তাই এটিই অনুমান করা হয় যে আর্যদের হাতেই সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটেছিল। তবে এক্ষেত্রে, বিতর্ক হচ্ছে কোনো গণহত্যা বা যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রমাণ আসলে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া সিন্ধুর অধিবাসীদের কোনো সৈন্যসামন্তও ছিল না। থাকলে অস্ত্রশস্ত্র-সরঞ্জাম অবশ্যই পাওয়া যেত!
শেষকথা
মেসোপটেমিয়ার কিউনিফর্মে মেলুহা (Meluhha) নামের এক দূরবর্তী স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। মেলুহার সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগের প্রমাণও পাওয়া যায়। কোনো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিকের মতে, এই মেলুহাই আসলে আমাদের সিন্ধু সভ্যতা!
মেলুহাই সিন্ধু সভ্যতা কিনা সেই তর্ক না হয় আরেকদিন হবে। মনে করা হতো, ভারতবর্ষের প্রাক-আর্যরা ছিল বর্বর এবং সংস্কৃতিতে অনুন্নত। কোনো রকমের চিহ্ন না রেখে হারিয়ে যাওয়া সিন্ধু সভ্যতা যে এই ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য!