ফ্রাঞ্জ জোসেফ বেনেডেকের পরাজয়ের সংবাদে বিচলিত বোধ করলেন। ইতালির ক্যাম্পেইনে সাফল্য এলেও মূল যুদ্ধ তো জার্মানিতে। সেখানে অস্ট্রিয়া যে পুচকে প্রুশিয়ার কাছে বারবার ধরা খাচ্ছে! ফ্রান্সে বসে তৃতীয় নেপোলিয়ন নিজেও উদ্বিগ্ন। তার আশা ছিল এই সংঘাত দীর্ঘায়িত হবে, তবে অস্ট্রিয়ার জয় নিয়ে তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহ। কোত্থেকে কী হয়ে এখন মনে হচ্ছে অস্ট্রিয়া জুলাই মাসটাও টেকে কিনা সন্দেহ।
৫ জুলাই অস্ট্রিয়ান সম্রাট নেপোলিয়নের মধ্যস্থতা কামনা করেন। বিসমার্ক উৎকণ্ঠা বোধ করলেন এই ভেবে যে প্রুশিয়া বেশি বাড়াবাড়ি করলে ফরাসীরা ময়দানে নামতে পারে। তিনি নেপোলিয়নকে লোভ দেখালেন প্রুশিয়ার পক্ষে থাকলে রাইনের দক্ষিন তীরের জমি ফ্রান্সের হবে। একইসাথে ভয়ও দেখালেন নেপোলিয়ন যদি অস্ট্রিয়ার স্বপক্ষে অতিরিক্ত দাবিদাওয়া করে বসেন তাহলে পুরো জার্মানিকে তিনি খেপিয়ে তুলবেন ফরাসিদের প্রতি। এমনিতেই নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কারণে জার্মানরা ফরাসিদের দেখতে পারত না। কাজেই বিসমার্কের কথায় সন্দেহ করার কারণ ফরাসি সম্রাট দেখতে পেলেন না। তবে কনিগ্রেটজের যুদ্ধ জয়ের খবর বার্লিনে এসে পৌঁছলে বিসমার্ক নিশ্চিত হয়ে যান অস্ট্রিয়ার ভাগ্যের ব্যাপারে। তিনি নেপোলিয়নের কথায় পাত্তা দেবার আর প্রয়োজন মনে করলেন না।
ভিয়েনার পথে
ফ্রাঞ্জ জোসেফ ইতালি থেকে অস্ট্রিয়ান সেনাদের ফিরিয়ে আনা আরম্ভ করেছেন। মল্টকে চাইলেন তারা আসবার আগেই ভিয়েনাতে ঢুকে পড়তে। আর্মি অফ এল্বা আর ফার্স্ট আর্মি সেদিকে রওনা হয়। সেকেন্ড আর্মির গন্তব্য অল্মুটজ। বেনেডেক আর অবশিষ্ট অস্ট্রিয়ান এবং স্যাক্সোনরা সেখানেই আস্তানা গেড়েছে। সেখান থেকে বেনেডেক একদল সৈন্য ইতোমধ্যে ভিয়েনাতেও পাঠিয়ে দিয়েছেন। অল্মুটজে বসে তিনি দিশেহারা বোধ করলেন। ফার্স্ট আর্মির পার্শ্বভাগে তিনি হামলা করতে গেলে এল্বার আর্মি তাকে ধাওয়া করবে। সরাসরি ভিয়েনার দিকে দৌড় লাগালে সেকেন্ড আর্মি তার পিছু নেবে। আবার সেনাদের তথৈবচ অবস্থায় ক্রাউন প্রিন্সের মুখোমুখি হওয়াও ঠিক হবে না। কোনভাবে জয়ী হলেও লাভ নেই, সেকেন্ড আর্মি পিছিয়ে সিলিসিয়াতে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে আবার ফিরে আসবে।
এই ভাবাভাবির মধ্যেই ৭ জুলাই ক্রাউন প্রিন্সের অশ্বারোহীরা একদল অস্ট্রিয়ানের সাথে দেখা পায়। ছোটখাট সংঘর্ষ শেষে দুই দল নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে মনোযোগী হলো। ৮ জুলাই অস্ট্রিয়ান সম্রাট অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব দিলেন। শর্ত ছিল কনিগ্রেটজ আর আশেপাশের কিছু দুর্গ প্রুশিয়ানদের পরিত্যাগ করতে হবে। প্রুশিয়ানরা হেসেই তার দাবি উড়িয়ে দেয়।
ইতালির ক্যাম্পেইন কম্যান্ডার আর্চডিউক অ্যালব্রেখট সেখানে বেশ কয়েকটি জয় পেয়েছিলেন। ফ্রাঞ্জ জোসেফ বেনেডেককে সরিয়ে দিয়ে জার্মান থিয়েটারে অ্যালব্রেখটকে সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করলেন। তবে অ্যালব্রেখট ভেনেশিয়া থেকে তার বাহিনী নিয়ে আসা পর্যন্ত বেনেডেক কাজ চালিয়ে যাবেন। অস্ট্রিয়ানরা তাদের প্রায় পূর্ণ বাহিনী ভিয়েনাতে জড়ো করবার চেষ্টা করছিল। ফলে ১১ জুলাই বেনেডেককেও সেখানে যাবার আদেশ দেয়া হয়। কিছু সেনা রেলপথে আর বাকিরা পায়ে হেঁটে ভিয়েনার দিকে যাত্রা করে। তারা ভাগ ভাগ হয়ে দ্রুত মার্চ করছিল যাতে প্রুশিয়ানদের থেকে বাধা আসবার আগেই ভিয়েনা পৌঁছে যাওয়া যায়।
ফ্রেডেরিক চার্লসের বাহিনী ততক্ষণে ভিয়েনার নিকটবর্তী। এখানে টিশ্নোভিটজ শহরের সামনে জুলাইয়ের ১১ তারিখে তার লোকদের সাথে কিছু অস্ট্রিয়ান সেনার দেখা হলো। মার খেয়ে অস্ট্রিয়ানরা পিছিয়ে যায়। পরদিন ব্রুন শহর প্রুশিয়ানরা কোন বাধা ছাড়াই দখল করে। ১২ তারিখ স্নেইম নগরীও তাদের হাতে চলে যায়। দু’দিন পর মূল দুই বাহিনী দু’দিক থেকে ভিয়েনার দিকে যাত্রা করে। একই দিন ইতালি থেকে অস্ট্রিয়ান সেনারা ভিয়েনাতে পৌঁছে যায়।
ওদিকে অল্মুটজ থেকে পাখি যে উড়ে গেছে তা সেকেন্ড আর্মি টের পেয়ে গেল। পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত কিছু লড়াইয়ের পর তারা বেনেডেককে তাড়া করে। রাস্তায় থাকা অস্ট্রিয়ানদের একটি বাহিনী তাদের হাতে পরাস্ত হলেও বেনেডেক অন্যান্যদের নিয়ে ক্রাউন প্রিন্সের থেকে দূরে সরে যেতে সমর্থ হন। মল্টকে তাকে বাধা দিতে ফার্স্ট আর্মিকে লুন্ডেবার্গ শহরে চলে যেতে বার্তা পাঠালেন। অল্মুটজ থেকে ভিয়েনার রেলপথ সেখান দিয়েই গেছে। তাছাড়া বেনেডেকের মার্চরত সেনাদের যাত্রাপথও সেদিক দিয়েই। ১৫ তারিখ প্রুশিয়ানরা রেললাইন উপড়ে টেলিগ্রাফের তার কেটে দেয়। পরদিন ফ্রেডেরিক চার্লস লুন্ডেবার্গে শিবির ফেলেন।
কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বেনেডেক এবার কার্পাথিয়ান পর্বতমালার দুর্গম রাস্তা বেছে নিয়ে বাধ্য হন। প্রুশিয়ানরা সদলবলে সেদিকে গিয়ে নিজেদের দুর্ভোগ বাড়ানোর কারণ দেখল না। সেকেন্ড আর্মির কিছু সেনা অল্মুটজে রয়ে গেল, কিছু গেল বেনেডেককে পাশ থেকে অনুসরণ করতে। বাকিরা রওনা হলো ক্রাউন প্রিন্সের সাথে ভিয়েনার পথে। ১৯ জুলাই প্রুশিয়ানরা ভিয়েনা থেকে দু’দিনের দূরত্বে ছিল। অস্ট্রিয়ান স্যালজবার্গের রাশবাখ এলাকার পেছনে নিজেদের তারা তিন ভাগে ভাগ করে অবস্থান নেয়।
ভিয়েনাতে তখন মোটামুটি এক লাখের কিছু বেশি সেনা একত্রিত হয়েছে। তাদের থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে প্রেসবার্গ (বর্তমান হাঙ্গেরির ব্রাতিস্লাভা) শহর কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বেনেডেককে এখান দিয়ে ভিয়েনার রাস্তায় উঠতে হবে। তার আর অ্যালব্রেখটের সম্মিলন হবে না যদি প্রুশিয়ানরা প্রেসবার্গ অধিকার করে। কিন্তু সেখানে মাত্র দুই ব্রিগেড সেনা রাখা আছে। ফলে ২০ তারিখে অতিরিক্ত সেনা প্রেসবার্গের দিকে মার্চ করে। কিন্তু তাদের আগেই ২১ জুলাই প্রুশিয়ানদের বাহিনীর বড় অংশ শহরের কাছাকাছি চলে এলে প্রেসবার্গ, এবং এই পথ ধরে ভিয়েনার পতন সময়ের ব্যাপার হয়ে ওঠে।
জার্মানিতে অস্ট্রিয়ান মিত্রদের সাথে লড়াই
ভন ফ্যালকেনস্টেইনের সাথে ৪৫,০০০ সেনা আর্মি অফ মেইন নামে অস্ট্রিয়ার জার্মান মিত্রদের দমন করছিল। হ্যানোভারিয়ানদের পর তাদের সামনে ছিল বাভারিয়ান আর কনফেডারেট বাহিনীর মোটামুটি আশি হাজার সেনা। কনফেডারেটরা ঘাঁটি করেছে ফ্রাঙ্কফুর্টে, হেসের প্রিন্স অ্যালেক্সান্ডার তাদের অধিনায়ক। সেখান থেকে তারা বের হলো বাভারিয়ার প্রিন্স চার্লসের সাথে যোগ দিতে।
চার্লসের অধীনস্থ সৈনিকেরা বাভারিয়ারই শোয়াইনফুর্ট শহরে থেকে ২৬ জুন অগ্রসর হতে শুরু করেছিল। তাদের সাথে মিলিত হবার পথে থাকতেই কনফেডারেট বাহিনী হ্যানোভারিয়ানদের আত্মসমর্পণের সংবাদ পায়। এই পরিস্থিতিতে আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই বাহিনী সংযুক্ত করবার উপায় ছিল না, কারণ মাঝখানে ফ্যালকেনস্টেইন চলে এসেছেন। সবথেকে সহজ পথ ছিল পিছিয়ে গিয়ে মেইন নদী বরাবর বাভারিয়ানদের সাথে মিলিত হওয়া। কিন্তু এখন পশ্চাদপসরণ করলে সৈনিকদের মনোবলের ক্ষতি হবে ভেবে চার্লস কঠিন পথ বেছে নিলেন। তিনি সামনে এগিয়ে ফুল্ডা শহরে বাভারিয়ানদের সাথে একত্রিত হবেন বলে ঠিক করেন।
পয়লা জুলাই বাভারিয়ানরা ফুল্ডার কাছাকাছি চলে আসে। অ্যালেক্সান্ডারও নিকটে চলে এলেন। ফুল্ডা আর ওয়াইজেন্থাল শহরের পথে জার্মানরা অবস্থান নেয়। এই অঞ্চলে পরপর কয়েকদিন প্রুশিয়ানদের সাথে দুই বাহিনীর ছোট ছোট দলের বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ হয়। একদিন নিকটবর্তী হুনফেল্ড শহরের কাছে ভন বেয়ারের অগ্রগামি দল একটি বাভারিয়ান ডিটাচমেন্টের দেখা পায়। প্রুশিয়ান কামান মাত্র কয়েকবার গোলা ছোড়ার পরেই বাভারিয়ান অশ্বারোহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যেতে থাকলে তাদের পথে পড়ে যায় বাভারিয়ার মূল বাহিনী। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে বাভারিয়ানরা ফুল্ডা ছেড়ে পিছিয়ে যায়। ফলে ফুল্ডা আর ওয়াইজেন্থাল শহর অরক্ষিত হয়ে পড়ল। খবর পেয়ে ৬ জুলাই ফ্যালকেনস্টেইন ফুল্ডার দিকে এগিয়ে আসেন।
চার্লস অন্য পথে অ্যালেক্সান্ডারকে মিলিত হবার অনুরোধ পাঠালেন। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে কনফেডারেট সেনারা চলে যায় কিঞ্জিগ উপত্যকার দিকে। প্রাকৃতিকভাবেই দুর্গম এই উপত্যকা প্রতিরক্ষামূলক লড়াইয়ের জন্য আদর্শ। তারা সেখানেই ঘাঁটি করল। প্রুশিয়ানরা তাদের পরাস্ত করলেও ক্ষতি নেই, পেছন দিকে দিয়ে সোজা ফ্রাঙ্কফুর্টের পথ ধরা যাবে। অ্যালেক্সান্ডার ভাবলেন, চার্লস যদি চায় তাহলে নিজে এসে তাদের সাথে যোগ দিক, তাদের কী ঠেকা পড়েছে বিপদ মাথায় নিয়ে পথে পথে ঘুরে মরার। কিন্তু কনিগ্রাটজে অস্ট্রিয়ানদের পরাজয়ের সংবাদ এসে পৌঁছলে তার চিন্তাধারা পরিবর্তন হল। তিনি কিঞ্জিগ ছেড়ে ফ্রাঙ্কফুর্টে চলে গেলেন। সম্ভবত এখান থেকে জার্মানির দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলকে প্রুশিয়ান আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা তার পরিকল্পনা ছিল।
ফ্যালকেনস্টেইন ফুল্ডায় সেনা রেখে অগ্রসর হলেন। ১০ জুলাই দুই জায়গায় বাভারিয়ানদের দুইদল পরাজিত হয়। চার্লস আরো পেছাতে থাকেন। এদিকে শান্তি আলোচনার ইঙ্গিত পেয়ে বিসমার্ক ফ্যালকেনস্টেইনকে জানান মেইনের উত্তরে প্রুশিয়ান নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে, তাহলে আলোচনার টেবিলে এই ভূখণ্ড প্রুশিয়া নিজের বলে দাবি করতে পারবে।ফলে সেদিকে থাকা শত্রুসেনাদের বিপক্ষে প্রুশিয়ানরা অগ্রসর হল। এদিকে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অ্যালেক্সান্ডার এবার বাভারিয়ানদের সাথে যোগ দিতে মনস্থ করলেন। সেজন্য দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে তিনি রওনা হলেন মেইনের উত্তরে অ্যাশফেনবার্গ শহরের দিকে।
জুলাইয়ের ১৩ তারিখ জেনারেল ভন গোবেন হেসের সৈন্যদের হারিয়ে দেন। তারা চলে যায় অ্যাশফেনবার্গ। অ্যালেক্সান্ডার আগে আগে কিছু সেনা সেদিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরদিন অ্যাশফেনবার্গে হেসে আর অস্ট্রিয়ানদের মিলিত এক বাহিনী পরাস্ত হয়। ভুর্তেমবার্গ আর ব্যাডেনের সেনারা তাদের দিকে আসছিল, কিন্তু যথাসময়ে পৌঁছতে তারা ব্যর্থ হলো। ফলে অ্যাশফেনবার্গ চলে যায় প্রুশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। এখানে বাভারিয়ানদের সাথে একজোট হবার কোন উপায় রইল না।
অ্যালেক্সান্ডার এবার মেইনের নিম্নাঞ্চলে দিবর্গ শহরে শিবির করলেন। কিন্তু ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে তার বাহিনী বহু দূর সরে আসায় শহর অরক্ষিত হয়ে পড়ে, কনফেডারেট ডায়েটের সদস্যরা পালিয়ে যায় অগসবুর্গ শহরে। ১৬ জুলাই ফ্রাঙ্কফুর্টের পতন হলো। এর সাথে হানাউ আর অ্যাশফেনবার্গ মিলিয়ে মেইনের উত্তরাঞ্চল প্রায় পুরোটাই প্রুশিয়ার অধীনে চলে এলো। ফ্রাঙ্কফুর্টের সাথে প্রুশিয়ানদের শত্রুতা পুরনো। ফলে ফ্যালকেনস্টেইন শহরবাসিদের উপর প্রথমে ৩ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ ধার্য করেন। কয়েকদিন পর আরো ১০ মিলিয়ন তিনি দাবি করলেন। বিপন্ন নাগরিকেরা রাজা উইলিয়ামের কাছে আবেদন করলে তিনি দ্বিতীয় ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে নেন। ফ্যালকেনস্টেইনকে বোহেমিয়ার সামরিক গভর্নর করে ম্যান্টফেলকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়।
ইত্যবসরে ২২ জুলাই বাভারিয়ান আর অ্যালেক্সান্ডারের সেনাদের সম্মিলন সম্পন্ন হয়। তারা অবস্থান নিল টুবের নদী আর ভুর্জবোর্গ শহরের মাঝে। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ম্যান্টফেল তাদের মোকাবেলা করতে চললেন। ওদিকে চার্লস আর অ্যালেক্সান্ডারের ভেতর সমর পরিকল্পনা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিল। এই অবসরে ২৩ জুলাই ম্যান্টফেল তাদের উপর এসে পড়েন। তিনি যখন কনফেডারেট সেনাদের উপর হামলা করলেন, সেই সময় বাভারিয়ানরা মেইনের উত্তর তীর ধরে তার পার্শ্বভাগের দিকে যাবার উদ্যোগ নিলে তারা কনফেডারেটদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সম্মুখ থেকে প্রুশিয়ানদের তীব্র আক্রমনে নিরুপায় অ্যালেক্সান্ডার তখন টুবের অতিক্রম করে রুক্ষ দুর্গম এলাকায় প্রবেশ করলেন।
অন্যান্য দিকে ভন গোবেনের হাতে ২৪ তারিখ ভুর্তেমবার্গ আর ব্যাডেনের সেনারা পরাজিত হয়। গোবেনের তরফ থেকে হামলার আশঙ্কায় অ্যালেক্সান্ডার আর চার্লস দুজনেই পেছাতে থাকেন। ২৫ জুলাই গোবেন, বেয়ার আর ফ্লাইস ম্যান্টফেলের সাথে একত্রিত হলেন। বেয়ার বাভারিয়ানদের বিরুদ্ধে আর গোবেন অ্যালেক্সান্ডারের অগ্রসর হন। তাদের হাতে কয়েকবারই শত্রুরা পরাস্ত হলো। রাসব্রুন অঞ্চলে সরে গিয়ে চার্লস এবার ভন ফ্লাইসের বাহিনীর উপর আক্রমণের চিন্তা করলেন। অ্যালেক্সান্ডারকে বলা হলো ভুর্জবোর্গের দিকে অবস্থান নিতে, যাতে পরাজিত হলেও সেদিক দিয়ে নিরাপদে পালানো যায়।
২৬ জুলাই ভন ফ্লাইসের সাথে বাভারিয়ানদের সংঘাত শুরু হয়। বেয়ার কাছেপিঠেই ছিলেন, তিনি সুযোগমতো বাভারিয়ানদের পার্শ্বভাগে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বাভারিয়ান ব্যুহ তছনছ হয়ে যায়। সকাল ১০টার মধ্যেই তারা পালানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠে। চার্লস সবাইকে নিয়ে ভাইডবুটেব্রুন এলাকাতে এসে হাঁফ ছাড়লেন। এদিকে কনফেডারেটরাও প্রুশিয়ানদের ধাক্কায় একবারে মেইন পার হয়ে ভেগেছে। ফলে নদীর এই পারে বাভারিয়ানরা এখন একা। তবে যেকোনো কারণেই হোক প্রুশিয়ানরা নতুন করে চার্লসের উপর হামলা করল না। ফলে তিনি মেইন অতিক্রম করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
২৮ জুলাই, ১৮৬৬। অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়ার আলোচনার খবর এসে পৌঁছলে বাভারিয়ার সাথে অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষরিত হয়। আগস্টের ১৩ তারিখ ভুর্তেমবার্গ, ১৭ তারিখ ব্যাডেন আর ২২ তারিখ বাভারিয়ার সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হলো।
অস্ত্রবিরতি এবং শান্তিচুক্তি
প্রুশিয়ান বাহিনী যখন ভিয়েনার দোরগোড়ায় নেপোলিয়ন তখন শান্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। উইলিয়াম আর তার জেনারেলরা চাচ্ছিলেন ভিয়েনাতে ঢুকে অস্ট্রিয়ানদের পিষে ফেলতে। কিন্তু প্রুশিয়ান বাহিনীতে কলেরার প্রাদুর্ভাব, ইতালি থেকে অব্যাহত সেনার আগমন এবং ফরাসীদের হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত বিসমার্ককে ভাবিয়ে তোলে। তিনি জানতেন ক্রাউন প্রিন্স শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসায় আগ্রহী। তাকে নিয়ে তিনি উইলিয়ামকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অস্ত্রবিরতিতে রাজি করালেন। ২২ জুলাই দুপুর থেকে তা কার্যকর হয়। এদিকে সেদিন সকালেই একদল প্রুশিয়ান প্রেসবার্গে হামলা করেছে। জয় যখন নিকটে তখন দুপুর হয়ে গেল। ফলে অস্ত্রবিরতির শর্ত মোতাবেক দুই পক্ষই নিজ নিজ শিবিরে ফিরে যায়।
যুদ্ধ শুরুর সাত সপ্তাহের মধ্যে বিধ্বস্ত অস্ট্রিয়া ২৬ জুলাই, ১৮৬৬ সালে নিকলসবোর্গ চুক্তির মাধ্যমে পরাজয় স্বীকার করে। ২৩ আগস্ট প্রাগে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি অনুমোদিত হয় (Peace of Prague)। এর আগে ২৫ আগস্ট প্রুশিয়ানরা বিজিত অঞ্চল ছেড়ে জার্মানিতে ফিরে যাওয়া আরম্ভ করে। ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সমস্ত প্রুশিয়ান সেনা অস্ট্রিয়ান অঞ্চল ত্যাগ করল।
অস্ট্রিয়ান এলাকা দখল করবার কোনো ইচ্ছাই বিসমার্কের ছিল না। তার সমস্ত যুদ্ধের উদ্দেশ্য সবসময় একটাই, জার্মান একত্রীকরণ। অস্ট্রিয়া সেই পথে বাধা বলে তিনি তাদের সরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পরাজিত শত্রুর থেকে তিনি তাদের মূল ভূখণ্ডের কোন অংশই দাবি করলেননা। তার মাথায় ছিল ভবিষ্যতে ফ্রান্সের বিপক্ষে এরা গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হতে পারে, কাজেই অযথা অস্ট্রিয়াকে খেপিয়ে রাখার কোনো কারণ বিসমার্ক দেখলেন না।
তবে জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়ার বিদেয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনার কোনো অবকাশ ছিল না। ফ্রাঞ্জ জোসেফ আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ট্রিয়াকে জার্মান ভুখন্ড থেকে সরিয়ে নেন এবং জার্মান কনফেডারেশনের বিলুপ্তি মেনে নিতে বাধ্য হন। অস্ট্রিয়ানদের দোস্ত স্যাক্সোনি ছাড়া বাকি সবাই প্রুশিয়ার পেটে চলে গেল। স্লেশউইগ-হোলস্টেইন তো আগেই গেছে। এর সাথে যোগ হলো হ্যানোভার, হেসে-কেসেল, হেসে-ডার্মস্টাড, নাসাউ আর ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর। প্রুশিয়া এবার পরিণত হলো অবিচ্ছিন্ন এক রাষ্ট্রে, যা জার্মানির সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। উত্তর জার্মানিতে তার ক্ষমতা একচ্ছত্র। এছাড়া যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রচুর অর্থও অস্ট্রিয়া প্রুশিয়াকে দিতে সম্মত হয়।
ইতালির ব্যাপারেও ১৮৬৬ সালের তেসরা অক্টোবর ট্রিটি অফ ভিয়েনা স্বাক্ষরিত হয়। সেই মোতাবেক ভেনেশিয়া অঞ্চল অস্ট্রিয়া ফ্রান্সের হাওলা করে দিল। নেপোলিয়ন এরপর ভেনেশিয়া ইতালিকে বুঝিয়ে দেন। ফলে অস্ট্রিয়ানদের কাছে হেরে ভূত হলেও ইটালিয়ানরা তাদের পাওনা ঠিকই পেয়ে গেল। এতে ইতালির একত্রীকরণ শেষ পর্যায়ে চলে আসে।
দখলকৃত রাষ্ট্রগুলোর রাজপরিবার উৎখাত নিয়ে ইউরোপে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে জার অ্যালেক্সান্ডার হ্যানোভারিয়ান রাজার উৎপাটন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ইউরোপিয়ান সম্মেলন ডেকে আলোচনার দাবি উত্থাপন করেন। সুসম্পর্ক থাকলেও বিসমার্ক হুমকি দিলেন তিনি তাহলে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে পোলিশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করবেন। ফলে জারের প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি।