২০১৯ সালের জুনে ইসরায়েলের তিনজন কম্পিউটার প্রকৌশলী আমেরিকার নিউ জার্সিতে এফবিআইয়ের এক ভবনে পৌঁছেন। তারা সাথে করে নিয়ে আসা কয়েক ডজন কম্পিউটার সার্ভার বের করেন। তারপর সেগুলো একটা বদ্ধ রুমে তাকের মধ্যে সাজিয়ে রাখেন। তাদের সরঞ্জামগুলো স্থাপন করা শেষ হলে তারা তেল আবিবের হার্জলিয়া অঞ্চলে এনএসও গ্রুপের সদর দফতরে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে ধারাবাহিকভাবে কয়েকটা ফোন কল করেন। এনএসও গ্রুপ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে কুখ্যাত স্পাইওয়্যার নির্মাণকারী কোম্পানি। যন্ত্রগুলো ঠিকঠাক জায়গায় বসানো হয়ে গেলে, তারা পরীক্ষা শুরু করেন।
এফবিআই এনএসওর স্পাইয়িং সফটওয়্যার পেগাসাসের একটা সংস্করণ ক্রয় করেছিল। প্রায় এক দশক ধরে এই ইসরায়েলি ফার্ম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাদের কাছে তাদের সার্ভেইল্যান্স সফটওয়্যার সাবস্ক্রিপশন মডেলে বিক্রি করে আসছিল। তারা প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা এমন কিছু করতে পারে যা অন্য কোনো কোম্পানি, এমনকি কোনো রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও করতে পারে না। তারা ধারাবাহিকভাবে ও অত্যন্ত নির্ভরযোগ্যতার সাথে যেকোনো আইফোন ও স্মার্টফোনের এনক্রিপ্টেড মেসেজগুলো উদঘাটন করতে পারে।
এনএসও বিশ্ব বাজারে পেগাসাস সফটওয়্যার নিয়ে আসে ২০১১ সালে। এই সফটওয়্যারের সাহায্যে মেক্সিকোর কর্তৃপক্ষ মাদক সম্রাট জোয়াকিন গুজম্যান লোয়েরাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে, যিনি ‘এল চ্যাপো’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ইউরোপীয় গোয়েন্দারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধে, সংগঠিত অপরাধমূলক কার্যক্রম দূর করতে, আন্তর্জাতিক শিশু পাচার চক্রকে ধরতে ৪০টিরও বেশি দেশে সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করতে নীরবেই পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটা ছিল অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের হাতে উন্নত এনক্রিপশন যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা, যা ডিক্রিপ্ট করার ক্ষমতা গোয়েন্দাদের ছিল না। বৃহৎ অর্থে দেখলে মনে হচ্ছিল এনএসওর পণ্যগুলো এই সমস্যার একটা সমাধান নিয়ে এসেছিল।
কিন্তু কোম্পানিটির প্রকৌশলীরা ২০১৯-এ যখন নিউ জার্সির অফিসের দরজা দিয়ে প্রবেশ করছিলেন, সে সময়েই পেগাসাসের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ নথিভুক্ত ছিল। মেক্সিকো এই সফটওয়্যার শুধু গ্যাংস্টারদের ধরার জন্যই ব্যবহার করেনি। বরং তারা সাংবাদিক আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধেও এটা ব্যবহার করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এই সফটওয়্যার দিয়ে এক নাগরিক অধিকারকর্মীর ফোন হ্যাক করে। আমিরাত সরকার তাকে কারাদণ্ড দেয়। সৌদি আরব এটা ব্যবহার করেছে নারী অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে। সৌদি সরকারের এক ভিন্নমত পোষক ব্যক্তির মামলার তথ্য অনুযায়ী তার সাথে ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জামাল খাশোগজির যোগাযোগে আড়ি পাতার জন্য সৌদি সরকার এই সফটওয়্যার ব্যবহার করেছিল। খাশোগজিকে ২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে হত্যা করা হয়।
কিন্তু এত বিতর্ক এনএসও’র কাছে নতুন ক্রেতা আসা থামাতে পারেনি। এর মাঝে যুক্তরাষ্ট্রও ছিল। এফবিআইয়ের পেগাসাস ক্রয় করা কিংবা সফটওয়্যার পরীক্ষা করা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। যে বছর খাশোগজি মারা যান, সে বছরই সিআইএ জিবুতি সরকারকে পেগাসাস সফটওয়্যার কিনতে সাহায্য করে আমেরিকার মিত্রদের সন্ত্রাসবাদ দমনে সাহায্য করার জন্য। মানবাধিকার লঙ্ঘন, সাংবাদিক ও সরকার বিরোধীদের দমন-নিপীড়নে পেগাসাসের ভূমিকা থাকার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ডিইএ, সিক্রেট সার্ভিস, আমেরিকার সেনাবাহিনীর আফ্রিকা কমান্ড এনএসও’র সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে। তাদেরই দেখানো পথে পরবর্তী পদক্ষেপ নিচ্ছিল এফবিআই।
প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে এফবিআই কর্মীরা স্থানীয় দোকান থেকে নতুন স্মার্টফোন কিনে এনে বিদেশি সিম কার্ড ব্যবহার করে এদের সাথে ডামি একাউন্ট সংযুক্ত করেন। পেগাসাসকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন আমেরিকান ফোন নাম্বারগুলো হ্যাক করতে না পারে। পেগাসাস প্রকৌশলীরা তখন ইন্টারফেস খুলে ফোন নাম্বারগুলো হ্যাক করা শুরু করেন।
পেগাসাসের এই সংস্করণকে বলা হয় ‘জিরো ক্লিক’, যা অন্যান্য হ্যাকিং সফটওয়্যারগুলো থেকে আলাদা। অন্যান্য সফটওয়্যারগুলোর মতো পেগাসাসকে কোনো প্রকার লিংক পাঠাতে হয় না, যাতে কেউ ক্লিক করলে ওই যন্ত্রের দখল নেওয়া যায়। তাই তখন ডেটা হ্যাক হতে থাকলেও ফোন পর্যবেক্ষণ করা আমেরিকান এফবিআই কর্মীরা কোনো প্রকার প্রমাণ দেখতে পাচ্ছিলেন না। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের সার্ভারের নেটওয়ার্কের সাথে সংযোগ থাকা পেগাসাস কম্পিউটারগুলো ফোনগুলোকে হ্যাক করে নিউ জার্সিতে থাকা যন্ত্রগুলোতে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু এফবিআই কর্মীরা এসব কিছুই সেখানে দেখতে পাচ্ছিলেন না। কয়েক মিনিট পর তারা যেটা দেখেন, তাদের ফোনে থাকা প্রতিটি ডেটা পেগাসাস কম্পিউটারের মনিটরে চলে এসেছে। এগুলোর মধ্যে ছিল ইমেইল, ছবি, টেক্সট মেসেজ, কন্টাক্টে থাকা সব ফোন নাম্বার। তারা আরো দেখতে পান ফোনের অবস্থান, এমনকি এর ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনও তাদের দখলে চলে এসেছে। তাত্ত্বিকভাবে এফবিআই এজেন্টরা আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের যেকোনো দেশের মোবাইল ফোনকে শক্তিশালী নজরদারি মাধ্যমে রূপান্তরিত করতে পারতেন।
২০১৩ সালে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির সাবেক কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেন আমেরিকান নাগরিকদের ওপর সরকারের নজরদারি নিয়ে তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার পর থেকে অভ্যন্তরীণ নজরদারি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। স্মার্টফোন ও স্পাইওয়্যারগুলোর যেভাবে উন্নত হচ্ছিল, তাতে ফোনগুলো থেকে প্রতিদিনের টেরাবাইট পরিমাণ তথ্য পাচার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছিল। তখন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা আর জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য আনা নিয়ে বিতর্ক হতে থাকে। ইসরায়েল তখন সতর্ক হয়ে এনএসও’র পেগাসাসকে আমেরিকান ফোন নাম্বারগুলো লক্ষ্যবস্তু বানাতে অক্ষম করতে বাধ্য হয়। এতে এনএসও’র বিদেশি ক্লায়েন্টরা আমেরিকান নাম্বারগুলোতে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পারে না। একইসাথে তাদের আমেরিকান ক্লায়েন্টরাও আমেরিকান নাগরিকদের ওপর নজরদারি করতে পারে না।
সম্প্রতি এনএসও এফবিআইয়ের কাছে একটা সমাধান নিয়ে আসে। ওয়াশিংটনে তারা এক প্রেজেন্টেশনে এফবিআই কর্মকর্তাদের কাছে ‘ফ্যান্টম’ নামে নতুন এক সিস্টেমের পরিচয় করিয়ে দেয়। এর মাধ্যমে এফবিআই আমেরিকার অভ্যন্তরে থাকা যেকোনো ফোন নাম্বার হ্যাক করতে পারবে। ইসরায়েল এনএসওর ফ্যান্টম সিস্টেমকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যার মাধ্যমে তারা আমেরিকান নাম্বারগুলো লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারবে। এই লাইসেন্সের মাধ্যমে এনএসও ফ্যান্টম সিস্টেমকে শুধু আমেরিকান সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রি করতে পারে।
ভাইস নিউজে প্রকাশিত এনএসও’র এক প্রচারপত্র থেকে জানা যায় সম্ভাব্য ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে তারা বলছে, ফ্যান্টম সিস্টেম আমেরিকান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তথ্য সরবরাহ করবে ‘মোবাইল ডিভাইসগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডেটা সংগ্রহ করার মাধ্যমে’। এটা একটা ‘স্বতন্ত্র সমাধা’। এর জন্য এটিঅ্যান্ডটি, ভেরাইজন, অ্যাপল বা গুগলের সহায়তার কোনো প্রয়োজন নেই। এই সিস্টেম স্মার্টফোনকে পরিণত করবে তথ্যের খনিতে।
ফ্যান্টম নিয়ে বিচার বিভাগের সরকারি আইনজীবী আর এফবিআইয়ের দুই বছর ধরে আলোচনা চলতে থাকে, যার মাঝে দুই প্রেসিডেন্টের প্রশাসনও চলে আসে। আলোচনার মূল প্রসঙ্গ ছিল ফ্যান্টমের ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা টেলিফোনে আড়ি পাতা আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হবে কিনা সেটা নিয়ে। আইনজীবীদের মধ্যে বিতর্ক চলমান অবস্থাতেই এফবিআই পেগাসাস সিস্টেমের চুক্তি নবায়ন করে এবং এনএসওর সাথে প্রায় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়। এই সময়টায় এনএসও’র প্রকৌশলীরা এফবিআই কর্মীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন এবং প্রযুক্তিগত ও আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন।
বিচার বিভাগ আর এফবিআইয়ের এ আলোচনা গত গ্রীষ্ম পর্যন্ত চলতে থাকে। এফবিআই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় এনএসওর ‘অস্ত্র’ তারা ব্যবহার করবে না। এই সময় সংবাদ সংস্থাগুলোর এক কনসোর্টিয়াম ফরবিডেন স্টোরিজ এনএসও সাইবার অস্ত্রগুলো সম্পর্কে নতুন তথ্য উন্মোচন করা শুরু করে। এগুলো যেভাবে সাংবাদিক ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিপক্ষে ব্যবহার করা হয় তাও উন্মোচিত হয়। পেগাসাস সিস্টেম বর্তমানে নিউ জার্সিতে সুপ্ত অবস্থায় আছে।
এফবিআইয়ের এক মুখপাত্র জানান,
ব্যুরোতে নতুন নতুন প্রযুক্তির পরীক্ষা করে দেখা হয়। এতে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবহারের দিকগুলো দেখার পাশাপাশি সন্ত্রাস দমন এবং আমেরিকান জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়া ও তাদের নাগরিক স্বাধীনতার বিষয়ও বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ, আমরা নিয়মিতভাবে প্রযুক্তিগত বিভিন্ন সমাধান শনাক্ত করে সেগুলোকে বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা করে থাকি। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, এসব প্রযুক্তি ভুল মানুষের হাতে পড়লে নিরাপত্তার ব্যবস্থা কীভাবে নেওয়া হবে, সেটা ঠিক করা।
সিআইএ, ডিইএ, সিক্রেট সার্ভিস ও আফ্রিকা কমান্ড কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। জিবুতির এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, দেশটির পক্ষ থেকে কখনো পেগাসাসের কোনো সফটওয়্যার ক্রয় করা হয়নি কিংবা ব্যবহার করাও হয়নি।
(পরবর্তী অংশ পর্ব ২ -এ)