১
প্লাস্টিক দূষণ এখন এক ভয়ংকর সমস্যার নাম। পুরো পৃথিবীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ সমস্যা। প্রতিদিন পৃথিবীজুড়ে উৎপাদিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক। গত ছয় দশকে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮.৩ বিলিয়ন মেট্রিক টনে! কিন্তু প্লাস্টিক সহজে পঁচে না, মিশে যায় না মাটির সঙ্গে। পঁচতে এর লেগে যায় প্রায় ৪০০ বছর! তাই বেশিরভাগ প্লাস্টিকই এখনো রয়ে গেছে। পঁচে বিলীন হয়েছে এর বড়জোর ১১%। রয়ে গেছে ৯১ শতাংশই। এগুলো পড়ে থাকে ময়লা-নর্দমায়, রাস্তাঘাটে। সমুদ্রে গিয়ে পড়ে এর একটা বড় অংশ। প্রতি বছর ১৪ মিলিয়ন টনের মতো দূষিত প্লাস্টিক সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। বর্তমানে সমুদ্রে যে পরিমাণ ময়লা ও দূষিত বর্জ্য আছে, এর ৮০ শতাংশই প্লাস্টিক। এই প্লাস্টিক খেতে বাধ্য হয় সামুদ্রিক প্রাণীরা। কিন্তু হজম করতে না পেরে মারা যায়। আবার, অনেক প্রাণীর গলায় আটকে যায় প্লাস্টিক। এক কথায় বললে, পৃথিবীর জলবায়ু, সামুদ্রিক প্রাণ ও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চক্র (যেমন অক্সিজেন চক্র) ধ্বংসের পেছনে অন্যতম দায়ী উপাদান এই প্লাস্টিক দূষণ।
তাহলে, এর সমাধান কী? এ নিয়ে নানা ধরনের কাজ করছেন বিজ্ঞানী, গবেষক ও প্রযুক্তিবিদরা। এরকমই একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগের নাম মিনিউইজ। তাইওয়ানভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানের বিচিত্র সব উদ্যোগ ও প্লাস্টিক দূষণ নিরসনের প্রচেষ্টা সত্যিই বিষ্ময়কর। আর, এর পেছনে আছেন প্রতিষ্ঠাতা আর্থার হুয়াং।
২
আর্থার হুয়াং একজন স্থপতি ও পুরকৌশলী। তাইওয়ানে জন্ম। এগারো বছর বয়সে চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন স্থাপত্যবিদ্যা বা আর্কিটেকচার নিয়ে। সেখানে নিজের কাজের জন্য তিনি বেশ কিছু পুরস্কার পান। এর মধ্যে রয়েছে চার্লস গুডউইন স্যান্ডস মেডাল। স্থাপত্যকলা বা শিল্পে চমৎকার কাজের জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
এরপর আর্থার চলে যান হার্ভার্ডে। ২০০৪ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন স্থাপত্যবিদ্যায়। কিন্তু তার বিশেষ আগ্রহ ছিল গ্রিন বিজনেস বা সবুজ ব্যবসা নিয়ে। পড়াশোনার করার সময় তিনি দেখেছেন, পরিবেশ দূষণ সমস্যা সমাধানে নানা জন নানা ধরনের কথা বলেন। কিন্তু এর কোনোটাই তেমন বাস্তব সম্মত না। কেউ এ নিয়ে পরে সত্যিকার অর্থে কাজ করেছেন, এমনটাও দেখা যায় না খুব একটা। কী করা যায়, এ নিয়ে ভাবছিলেন আর্থার। এ সময় তিনি ফিরে আসেন জন্মস্থান তাইওয়ানে, শুরু করেন তুঙ্ঘাই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় শিক্ষকতা। পাশাপাশি অর্ধকালীন বা পার্টটাইম সহকারি অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন ন্যাশনাল চাও টুং বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এ সময় আর্থার হুয়াং আরো ভালোভাবে বুঝতে পারেন, পরিবেশ দূষণ সমস্যা নিয়ে সত্যিকার কাজ তেমন হচ্ছে না। তার মনযোগ যায় প্লাস্টিক দূষণের দিকে। তিনি চিন্তা করেন, কোনোভাবে যদি প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার করা যায়, তাহলে একটা বড় সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু কীসে ব্যবহৃত হবে এসব প্লাস্টিক? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আর্থার ফেরেন নিজের পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতার দিকে। স্থাপত্যবিদ্যা! এর মাধ্যমে গড়ে উঠে মিনিউইজ।
৩
মিনিউইজের লক্ষ্য ছিল খুবই অদ্ভুত। শুনলে অস্বাভাবিক লাগতে পারে এই ২০২১ সালেও, যখন মিনিউইজ পেরিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠার প্রায় ১৬ বছর।
২০০৫ সালে আর্থার হুয়াং যখন মিনিউইজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন, তার সঙ্গী হন তুঙ্ঘাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক গুণীন, জারভিস লিউ। দুজনে মিলে ঠিক করেন, বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য থেকে বাড়িঘর, ফার্নিচার বা আসবাব এবং বাড়িঘর নির্মাণে প্রয়োজন, এমন বিভিন্ন জিনিস বানাবেন তারা। শুধু ভেবে ক্ষান্ত হননি, সত্যি সত্যি এরকম একটি প্রক্রিয়া তারা গড়ে তুলেছেন। প্লাস্টিক ট্র্যাশ-টেক। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্লাস্টিকবর্জ্য থেকে ষড়্ভুজাকৃতির টাইল বানায় মিনিউইজ। পাঁচটি প্লাস্টিক বোতল দিয়ে একটি টাইল বানানো যায়। ৫০টি বোতলের ঢাকনা ও ঢাকনার সঙ্গে বোতলের মুখে যে রিং থাকে, তা থেকে বানানো যায় ১টি টাইল। এগুলো কোনো ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি নয়। এ রকম টাইল মিনিউইজ ইতিমধ্যেই অনেক বানিয়েছে এবং নিয়মিত বানাচ্ছে।
এছাড়াও প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে মিনিউইজ বিভিন্ন ধরনের ‘ইট’ বানাচ্ছে। ‘ইট’ শব্দটা এখানে ঠিক যুৎসই নয়। কারণ, ইট বানানো হয় মাটি পুড়িয়ে। সত্যি বলতে, মিনিউইজ যা বানাচ্ছে, বাংলায় এর যুৎসই কোনো নামই নেই। কারণ, এরকম কিছু এ দেশে প্রচলিত নয়। এরকম এক ধরনের ইটের নাম পলিব্রিক। স্বচ্ছ এই ইটগুলো একাধারে মজবুত এবং বেশ টেকসই। স্বচ্ছতার কারণে প্রাকৃতিক আলোর কোনো অভাব হবে না ভেতরে। প্লাস্টিকজাত বলে এটি আবার সাউন্ডপ্রুফ, যদিও বিষয়টা নির্ভর করে মূলত দেয়ালের পুরুত্বের ওপর। এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যাতে এর ভেতরে প্রয়োজনীয় এলইডি এবং সোলার প্যানেল বসিয়ে দেওয়া যায়।
এরকম আরেক ধরনের ‘ইট’ বানায় মিনিউইজ, নাম পলিবার। এটি স্বচ্ছ নয়। সাউন্ডপ্রুফ বৈশিষ্ট্যও আছে। তার ওপর পলিবার দিয়ে দেয়াল বানাতে দরকার পড়ে না আলাদা মর্টার (দেয়াল বানাতে সিমেন্টের যে পেস্ট দেয়া হয় দুই ইটের মাঝে)। পলিবারের রয়েছে নিজস্ব পিন এবং লক সিস্টেম। নির্দিষ্ট খাঁজের ভেতর বসে যাবে পিন, আটকে যাবে দুটো পলিবার। এর দ্বিতীয় আরেকটি ভার্সনও আছে, ব্রিক লাইট। এতে দরকার হলে সিমেন্ট বা কংক্রেট মেশানো যায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনের জন্য।
প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে বানানো মানে, প্লাস্টিক দিয়ে বানানো। হয়তো ভাবছেন, আসলেই কি প্লাস্টিক দিয়ে মজবুত, বসবাসযোগ্য বাড়ি বানানো সম্ভব? এটা কতটা বাস্তব? এরকম ভেবে থাকলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় চমক। ইকোআর্ক। ৯ তলা এই গণজাদুঘরটি (public museum) একটি ইকোবিল্ডিং বা পরিবেশবান্ধব বাড়ি। পুরোটা বানানো হয়েছে ১.৫ মিলিয়ন পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকৃত প্লাস্টিক বোতল দিয়ে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে মিনিউইজের নিজস্ব উদ্ভাবন পলিব্রিক। ২০১০ সালে নির্মিত এ জাদুঘর সবার জন্য উন্মুক্ত।
দিনের বেলা প্রাকৃতিক আলো দিয়ে চলে পুরো বাড়িটি। সঙ্গে আছে সোলার প্যানেল। সারা দিন সৌরশক্তি জমিয়ে রাখে ইকোআর্ক। সেই শক্তি দিয়েই রাতের বেলায় চলে এর ভেতরের সব এলইডি বাতি। সাধারণ বিল্ডিংয়ের চেয়ে এটির ওজন ৫০ শতাংশ কম। অথচ প্রাকৃতিক যেকোনো দুর্যোগ সামাল দেয়ার সামর্থ্য রাখে। ইকোআর্ক সে জন্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকস মেগাস্ট্রাকচার হিসেবে ফিচারও হয়েছে।
শুধু তাই নয়, জুতো ও স্নিকার বানানোর জন্য পৃথিবীখ্যাত প্রতিষ্ঠান নাইকির জন্য তাইওয়ানে মিনিউইজ বানিয়ে দিয়েছে নাইকি কিকস লাউঞ্জ। ২০১৯ সালে বানানো এ ইকোবিল্ডিংয়ের ৭০% সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব। এজন্য মিনিউইজ ২৫০ জোড়া পুরনো স্নিকার সংগ্রহ করেছে তাইওয়ানের স্নিকারপ্রেমীদের কাছ থেকে। জুতোর ওপরের অংশ, সোল ও ইনসোল পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে নেওয়া হয়েছে প্রয়োজনমতো। পাশাপাশি, ১২ হাজার বোতল পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে বানানো হয়েছে ২,৭০০ এয়ারব্রিক। এটি মিনিউইজের উদ্ভাদিত আরেকটি নির্মাণ উপাদান, ইটের মতো।
এরকম বেশ কিছু বড় প্রজেক্টে কাজ করেছে করে মিনিউইজ। সম্প্রতি কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস দুর্যোগের সময় যখন থমকে গেছে পুরো পৃথিবী, আর্থার হুয়াং তখন পরিকল্পনা হাতে নেন প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে হাসপাতাল ওয়ার্ড বানানোর। শুধু পরিকল্পনা করেই থেমে থাকেননি, এই ওয়ার্ড তিনি সত্যি সত্যি বানিয়েছেন। ওয়ার্ডটিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী, যন্ত্রপাতি, বিছানা থেকে শুরু করে পুরো অবকাঠামো- সবকিছুই বানানো হয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে।
আর্থার হুয়াংয়ের ভাষ্যমতে, প্লাস্টিক বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে এভাবে কাজে লাগানোর অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছেন প্রাচীন রোমের স্থাপনাগুলো থেকে। প্রাচীন রোমে তেল, ওয়াইন ও শস্যদানা পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হতো টেরাকোটা অ্যাম্ফোরা নামে এক ধরনের পাত্র। মূলত সিরামিক দিয়ে বানানো এ পাত্রগুলো দেখতে ফুলদানির মতো। তবে এতে বিভিন্ন খনিজ ও কাঁচও থাকত কখনো কখনো। ব্যবহার শেষে, তেল বা ওয়াইন ফুরিয়ে গেলে ফেলে দেওয়া হতো এসব পাত্র। পরে এগুলো ভেঙ্গে, প্রক্রিয়াজাত করে বাড়িঘরের অবকাঠামো বানানোর কাজে লাগানো হতো। এই বিষয়টাই আর্থার হুয়াংয়ের মাথায় গেঁড়ে বসে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি এ নিয়েই কাজ করছেন।
৪
মিনিউইজ বর্তমানে বাড়িঘর, আসবাবপত্র ও চিকিৎসা সামগ্রী বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় ১,২০০ উপাদান তৈরি করছে নিয়মিত। সবই তারা বানাচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে। এখানে উদ্দেশ্যটা অবশ্যই প্লাস্টিকের বাড়িঘর বানানো নয়। উদ্দেশ্য, প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো কাজে লাগানো এবং প্লাস্টিক দূষণ সমস্যা সমাধান করা।
মিনিউইজ একার প্রচেষ্টায় কতদূর যেতে পারবে, তা বলা মুশকিল। তবে প্লাস্টিক সমস্যার এত চমৎকার সমাধান হাতের কাছে থাকতেও আমরা যদি গ্রহণ না করি, তাহলে নিজেদের বিপদই ডেকে আনব। বাংলাদেশের নদী-নালা ইতিমধ্যেই ভরে গেছে এ ধরনের ক্ষতিকার প্লাস্টিক বর্জ্যে। মাসিক সাময়িকী বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকাশিত তানভীর রিভনাত-এর একটি নিবন্ধ থেকে খানিকটা অংশ তুলে দিই-
“প্রতিদিন ২০টি লঞ্চে কমপক্ষে ২ হাজার মানুষ সদরঘাট-চাঁদপুর-সদরঘাট আসা-যাওয়া করে। পুরো দক্ষিণবঙ্গে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ হাজার মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করে। যদি এদের মধ্যে ২০ শতাংশ মানুষও (২০০০ জন) আসা-যাওয়ার পথে একটি করে পানির বোতল বা চিপসের প্যাকেট বুড়িগঙ্গায় ফেলে, তাহলে ৫০ বছর পর কী পরিমাণ প্লাস্টিকের পানির বোতল বা চিপসের প্যাকেট বুড়িগঙ্গায় থাকবে? ২০০০ × ৩০ × ১২ × ৫০ = ৩,৬০,০০,০০০ অর্থাৎ ৩ কোটি ৬০ লাখ প্যাকেট। এ তো গেল কেবল নদীর হিসাব। পুরো বাংলাদেশের দিকে নজর দেওয়া যাক। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে অন্তত ১ কোটি মানুষ যদি প্রতিদিন প্লাস্টিকসামগ্রী বাইরে নিক্ষেপ করে, তাহলে আগামী ৫০ বছরে কত মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য হবে? আগের মতো করে গুণ করলে দেখা যাবে, ১৮ হাজার কোটি প্যাকেট প্লাস্টিক বর্জ্য।”
পুরো পৃথিবী এখন প্লাস্টিক দূষণ, বায়ু দূষণ, মোট কথা, পরিবেশ দূষণ সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। যদিও অনেক দেশই খুব উদ্যোগী নয়। তবে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নেই খুব বেশি দেশ। ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের গড় ২ ডিগ্রির নিচে রাখতে না পারলে ডুবে যেতে পারে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অনেকাংশ।
মিনিউইজের এ ধরনের উদ্যোগ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও দূষণ সমস্যা সমাধানে রাখতে পারে জরুরি ভূমিকা। শুধু নিজ উদ্যোগে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। ইচ্ছে থাকলে যে উপায় হয়, এর অন্যতম বড় প্রমাণ মিনিউইজ ও আর্থার হুয়াং।