সিংহাসনের লড়াই যেন ইতিহাসের এক অমোঘ বিধান। যে লড়াইয়ে বাদ যায়নি কোনো সম্পর্ক, কোনো ভালোবাসা। আবার ঠিক এমনও হয়েছে যে, ভালোবাসার টানে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ছেড়েছেন অনেকেই। বর্তমান ব্রিটিশ রানীর চাচা স্বয়ং ব্রিটিশ রাজপুত্র অষ্টম এডওয়ার্ড প্রিয়তমার জন্য ছেড়েছেন সিংহাসন। এরকম ঘটনা ইতিহাসের পাতা উল্টালে অহরহই চোখে পড়ে। কিন্তু ভাবুন তো, যদি শোনেন একজন ভিস্তিওয়ালাকে সিংহাসনে বসাতে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ছেড়েছেন একজন সম্রাট, তাহলে কি অবাক হবেন?
জ্বি, ঠিকই শুনেছেন, এরকমই এক রোমাঞ্চকর ঘটনার নায়ক ভিস্তিওয়ালা নিজাম। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের কাছ থেকে পেয়েছিলেন পুরো সাম্রাজ্যের রাজত্ব, হয়েছিলেন সম্রাট নিজাম ভিস্তিওয়ালা!
১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ; শের খান বিহারসহ মুঘল অঞ্চলগুলো জয় করে কনৌজের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। এদিকে বাংলা জয় করে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন চলেছেন রাজধানী আগ্রা অভিমুখে। এরইমধ্যে যাত্রাপথে চৌসা নামক স্থানে শের খানের বিশাল বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন হুমায়ুন। চলছে পরস্পর যুদ্ধের মহড়া।
২৬ জুন ১৫৩৯; নীরব, নিস্তব্ধ তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছে সম্রাটের বাহিনী। আচমকা কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই তাঁবুতে হানা দেয় শের খানের বাহিনী। তার দূরদর্শিতার কাছে হার মানে মুঘল বাহিনী। দিগ্বিদিক না ভেবেই মুঘল সম্রাট ঝাঁপ দিলেন গঙ্গায়। সম্রাট নদীতে প্রায় ডুবু ডুবু, ঠিক এই সময় ত্রাণকর্তারূপে হাজির ভিস্তিওয়ালা নিজাম। সম্রাটের দিকে তিনি ছুড়ে দিলেন তার বাতাস ভর্তি মশক। নিজামের এই মশকে ভর করেই হুমায়ুন পাড়ি দিলেন গঙ্গা। বেঁচে গেলেন হতভাগ্য সম্রাট। সেদিন হুমায়ুন ভিস্তিওয়ালাকে কৃতজ্ঞচিত্তে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারলে একদিনের জন্য হলেও মসনদে বসাবেন তাকে।
হুমায়ুন রাজ্য পুনরুদ্ধার করলেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, সম্রাট স্বীয় প্রতিশ্রুতি রাখলেন। নিজাম ভিস্তিওয়ালাকে বসালেন আগ্রার মসনদে। শুরু হয় নিজামের একদিনের শাসন। নিজাম তার মশককে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে সেগুলোতে সিল্ক ও স্ট্যাম্প লাগালেন। সেসব স্ট্যাম্পে তার নাম এবং রাজ্য অভিষেকের তারিখ লিপিবদ্ধ করে মুদ্রা জারি করেন। এভাবেই একজন ভিস্তিওয়ালা তার একদিনের সাম্রাজ্য শাসন স্মরণীয় করে রাখেন।
সেই সময় থেকে মুঘল সম্রাটের জীবন বাঁচানোর জন্য ভিস্তিওয়ালারা ইতিহাসে সুপরিচিত। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ভিস্তিওয়ালারা ছিল ঢাকার রাস্তায়।
কারা এই ভিস্তিওয়ালা?
বিশ্বাস করা হয়, ভিস্তিরা ছিল আরব থেকে আসা এক সুন্নি মুসলিম গোষ্ঠী, যারা মুঘলদের অনুসরণ করে ভারতবর্ষে এসেছিল। এটাও ধারণা করা হয় যে, ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলের ভিস্তিদের আদি নিবাস বিহারে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঢাকায় পানীয় জলের তীব্র সংকট ছিল। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ঢাকাতেও পানীয় জলের জন্য খাল, নদী বা কূপের ওপর নির্ভর করতে হতো। তখন পশুর চামড়ার ব্যাগই ছিল পানি সরবরাহের একমাত্র মাধ্যম। সেই ব্যাগকে বলা হত ‘মশক’। মিজানুর রহমানের ‘ঢাকা পুরাণ’ থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে সব বাড়িতে কলের পানি পৌঁছত না। যেখানে কলের পানি ছিল না, সেখানে ভিস্তিওয়ালাই ছিল একমাত্র সহায়।
ঢাকায় ভিস্তিওয়ালাদের ‘সাক্কা’ বলা হতো। ‘ঢাকা পুরাণ’ থেকে এটাও জানা যায় যে, সেই সময়ে ভিস্তিওয়ালাদের একটি সংগঠন ছিল। সংগঠনের প্রধানকে বলা হতো ‘নবাব ভিস্তি’। তাদের নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। পুরান ঢাকায় আজ যে সিক্কাটুলি দেখা যায়, তা ছিল একসময় ভিস্তিদের এলাকা। ১৮৩০ সালে ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস এক আদমশুমারিতে ১০টি ভিস্তিপল্লির কথা উল্লেখ করেন। একই সময়ে কলকাতায় প্রায় ৩,০০০ ভিস্তি ছিল।
মশক
মশক এমন এক ঐতিহাসিক পণ্য, যেটি সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে ভিস্তিরা দক্ষতার সাথে তৈরি করে আসছে। ভিস্তিদের হাতে থাকা এই মশকগুলো মূলত ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি। মুসলমানদের কোরবানির ঈদে অসংখ্য ছাগল জবাই হয়। সেখান থেকে সেরা চামড়াগুলো দিয়েই বানানো হতো মশক। সেসব চামড়া থেকে দুর্গন্ধ এবং জীবাণু দূর করে চামড়াজাত করত তারা। বিশ দিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে শুকানোর পর একে পানিরোধী করতে মহিষের চর্বি দিয়ে ঘষা হতো। অতঃপর মশক কারিগররা সাদা সুতার সাথে একধরনের বিশেষ মোম ব্যবহার করে প্রস্তুত করতেন মশক, যা নিশ্চিতভাবেই পানি-নিরোধক হত।
‘ভিস্তি’ নামের উৎস নিয়ে যত কথা
পানি সরবরাহকারী এই সম্প্রদায়টি কারো কাছে ‘ভিস্তি’, আবার কারো কাছে ‘ভিস্তিওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই ‘ভিস্তি’ নামটি কীভাবে এসেছে তা নিয়ে প্রচলিত আছে নানা মত। ধারণা করা হয়, ‘ভিস্তি’ শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ ‘বেহেশত’ থেকে, যার অর্থ ‘স্বর্গ’।
এক সূত্রমতে, পশ্চিম এশীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী স্বর্গে ব্যাপক পানি রয়েছে, নদী-নালা, খাল-বিলে স্বচ্ছ পানিতে পরিপূর্ণ। তাই ভিস্তিওয়ালাদের মনে করা হয় স্বর্গের দূত হিসেবে। এজন্য তাদের নাম ভিস্তি। এই ধারণাগুলো সত্য হোক বা মিথ্যে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ভিস্তিওয়ালারা তখনকার সমাজে আশীর্বাদস্বরূপ ছিল।
ভারতবর্ষে বেশিরভাগ ভিস্তিই ছিল দলিত সম্প্রদায়ের। তৎকালীন সমাজে দলিত সম্প্রদায় ‘অস্পৃশ্য’ বলে বিবেচিত হতো। অথচ সেই ‘অস্পৃশ্য’দের কাছ থেকে পানি নিয়েই উচ্চবর্ণের লোকজনের প্রয়োজন মেটাতে হতো। শহরাঞ্চলে সুপেয় পানির ছিল বেশ অভাব। তাই শহরাঞ্চলের মানুষদের ভিস্তিওয়ালাদের উপর নির্ভর করতে হতো। তাদের সরবরাহ করা পানি তখন রান্না এবং স্নানের জন্য ব্যবহৃত হতো।
ভিস্তিরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুদ্ধেও মশাক কাঁধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। যুদ্ধের মাঝেই তারা যোদ্ধাদের তৃষ্ণা নিবারণ করত। মহররমের শোভাযাত্রার সময় তাদের পানি ছিটিয়ে রাস্তা পরিষ্কার রাখার দায়িত্বে থাকতে দেখা যেত। লালবাগ কেল্লায় ভিস্তিরা পানিভর্তি মশক নিয়ে আসত। যেকোনো ধর্মীয় উৎসব, অনুষ্ঠান বা সমাবেশে পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকত ভিস্তিওয়ালারা।
প্রাথমিকভাবে, তারা কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়াই পানি সরবরাহ করে দিত। কিন্তু পরিবর্তিত সময়ের সাথে তারা এটিকে আয়ের উৎস হিসেবে গ্রহণ করে। কঠোর পরিশ্রম সত্ত্বেও এটার জন্য তাদের বিনিময় মূল্য ছিল একেবারেই নগণ্য। চামড়ার ভারী মশকটি বহন করার জন্যও প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। কিন্তু আয় হতো সামান্যই। দিনে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা ঘুরে ঘুরে মাত্র ২০০-৩০০ টাকা উপার্জন করতে পারত। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পরও তারা কাজ চালিয়ে যায় এবং ব্রিটিশ শাসনামলেও তাদের আনুগত্য ও দক্ষতার দ্বারা পরিচিতি পায়।
যে কারণে হারিয়ে গেল ভিস্তি সম্প্রদায়
ভিস্তিওয়ালারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা শহরে তাদের শক্তিশালী অবস্থান বজায় রেখেছিল। ঢাকা ছিল ভারতের শেষ শহর যেখানে ভিস্তিওয়ালারা ষাটের দশক পর্যন্ত দাপটের সাথে তাদের কাজ চালিয়ে যান। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ঢাকায় কোনো স্থায়ী সুপেয় পানির ব্যবস্থা ছিল না। তৎকালীন ঢাকা জেলা কালেক্টরকে সুপেয় পানির জন্য ১৫০ রূপি বরাদ্দ দেওয়া হত, যেখানে কি না তখন মাত্র দুই রূপিতেই চাল পাওয়া যেত। পানীয় জলের জন্য এত অর্থ বরাদ্দের কারণ ছিল ঢাকায় স্বাস্থ্যসম্মত পানির অভাব। যার ফলে কলেরার প্রকোপ চলত সারা বছর।
পরবর্তীতে ১৮৭৯ সালে নবাব আবদুল গণি এবং নবাব আহসানউল্লাহর যৌথ প্রচেষ্টায় চাঁদনীঘাটে স্থাপন করা হয় পানি শোধনাগার ‘ঢাকা ওয়াটার-ওয়ার্কস’। এর নির্মাণব্যয় ছিল তখনকার মুদ্রায় প্রায় দুই লক্ষ টাকা। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে ঢাকায় ‘ওয়াসা’ নির্মাণের ফলে সুপেয় পানির আর অভাব রইল না। এতে নগরবাসীর উন্নয়নের চাকা ঘুরলেও ভিস্তিদের ভাগ্যের চাকা দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
এমনকি এক দশক আগেও কলকাতা পৌর কর্পোরেশন কর্তৃক রাস্তাঘাটে পানি সরবরাহের জন্য ভিস্তিরা নিযুক্ত ছিল। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রসরতায় ভিস্তিওয়ালাদের পেশায় ধস নামে। পানিবাহী ট্যাংকের আগমনে তারা চাকরি হারায়। এছাড়াও যেসব হ্যান্ডপাম্প থেকে তারা পানি পেত সেগুলোর অধিকাংশই শুকিয়ে গেছে। সময় ও উন্নয়নের সাথে সুপেয় পানি সহজলভ্য হওয়ায় ভিস্তিদের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায়। জীবিকার অভাবে কমতে থাকে ভিস্তিওয়ালা। এমনকি, ধীরে ধীরে এই পেশাটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
তবুও ভিস্তিরা প্রজন্ম পরম্পরায় তাদের পেশা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। যদিও সময়ের বাস্তবতায় তারা তাদের পেশা পরিবর্তন করছে। তাদের সন্তানরা সবুজ চারণভূমির দিকে অগ্রসর হচ্ছে, আগামী প্রজন্মকে শিক্ষার আলোতে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ‘ভিস্তিওয়ালা’ সম্প্রদায়টি।