১৯৭০ এর দশকে তাইওয়ানের সরকার দুটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়। সরকার বুঝতে পেরেছিল যে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী শক্তি হবে অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার প্রধান শক্তি। এজন্য ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’ ও ১৯৮০ সালে ‘সিঞ্চু সায়েন্স পার্ক’ স্থাপন করে। আসলে তাইওয়ানের ইলেক্ট্রনিক্স শিল্পের মূল কাজ ছিল বাইরের দেশগুলো থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করে সেগুলো সস্তা শ্রম কাজে লাগিয়ে পণ্যে পরিণত করা। কিন্তু এতে খুব বেশি লাভবান হওয়া যাচ্ছিল না, সাথে অভ্যন্তরীণ ইলেকট্রনিক্স পণ্যনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও উদ্ভাবনের অভাবে বৈশ্বিক বাজারে সুবিধা করতে পারছিল না। মূলত এই সমস্যাগুলো দূর করতেই তাইওয়ান সরকার দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী শক্তির পূর্ণ ফায়দা তোলার জন্য প্রতিষ্ঠান দুটো স্থাপন করে। এগুলোর প্রধান কাজ ছিল রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা পরিচালনা করা এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল রপ্তানিমুখী শিল্পের সাথে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে তুলে দেয়া।
১৯৮০-র দশকে তাইওয়ানের অর্থনীতিকে আরও বেশি উদানীতিকরণের আওতায় আনা হয়। কিন্তু এতে কিছু সমস্যার উদ্ভব হয়। যেমন বলা যায়, ইলেক্ট্রনিক্স ও অন্যান্য শিল্প পণ্যের দাম উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়েছিল। এই সমস্যা মোকাবিলা করতে তাইওয়ানের বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠান পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ও চীনে নিজেদের ব্যবস্থা স্থানান্তর করতে শুরু করে। যেহেতু সেসব অঞ্চলে শ্রমের দাম তূলনামূলক কম ছিল, জমি ছিল তাইওয়ানের চেয়ে সস্তা। বিশেষ ১৯৭০ সালের পর থেকে চীন নিজেদের অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগের ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করার পর তারাও তাদের অর্থনীতি উদারীকরণ নীতির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয়। তাইওয়ান থেকে চীনের দূরত্ব কম ও চীনের সস্তা শ্রম ও অবকাঠামোগত সুবিধার পূর্ণ সুবিধা আদায় করতে তাইওয়ানের বড় কোম্পানিগুলো চীনের দিকে যাত্রা শুরু করে।
তাইওয়ান সরকারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো, দেশটিতে ১৯৬৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত অর্থনীতিতে যে পালাবদলের প্রক্রিয়া চলছিল, সেসময়ে শিক্ষাখাতে বিশাল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা। ১৯৫০ এর দশকের সময় থেকেই তাইওয়ান সরকারের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভবিষ্যতে যদি ব্যবসায়িক কোম্পানিগুলোর চাহিদা অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ শ্রমশক্তিকে দক্ষ করে তোলা না যায়, তাহলো সমস্যায় পড়তে হবে। হয়তো দেখা যাবে, দেশে দক্ষতার অভাবে অসংখ্য শিক্ষিত মানুষ কাজের অভাবে বেকারত্ব বরণ করে নিচ্ছে। এছাড়া তাইওয়ানের নিজস্ব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় দক্ষ কর্মী না পেলে তাদেরকে বাইরের দেশের সুদক্ষ কর্মীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে, যেহেতু বিদেশি কর্মীদের মজুরি তুলনামূলক বেশি হবে। বিশ্বব্যাংক ১৯৯৩ সালের এক রিপোর্টে উল্লেখ করে, তাইওয়ানের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় তাদের শিক্ষাখাতের বিপুল বিনিয়োগের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। তাইওয়ানে ১৯৮০ সালের পর থেকে উচ্চশিক্ষায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকৌশল ও বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির পরিমাণ দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি দেশীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা সম্প্রসারণে উৎসাহিত করার জন্য কুয়োমিনতাং সরকার ১৯৭০ এর দশকে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নের বিশাল পরিকল্পনা হাতে নেয়। এরই অংশ হিসেবে দশটি বিশাল প্রকল্প পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যেগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশটির পণ্য স্থানান্তর ও যাতায়াত ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা। এই দশটি প্রকল্পের অধীনে সবার আগে তাইওয়ানের সমুদ্রবন্দরগুলোকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। এরপর দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য সুপার-হাইওয়ে নির্মাণ করা হয়। এছাড়া রাজধানী তাইপে থেকে পশ্চিমে অবস্থিত তাওইয়াউন নামক জায়গায় একটি আধুনিক বিমানবন্দরও স্থাপন করা হয়। যেহেতু তাইওয়ানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছিল, তাই প্রতিবছরই কলকারখানা বাড়ছিল। এতে করে বিদ্যুৎের চাহিদা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এই চাহিদা পূরণে আধুনিক পারমাণবিক শক্তিচালিত জেনারেটর তৈরি করা হয় সেই প্রকল্পগুলোর অধীনে।
১৯৭৩-৭৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে একধরনের সংকট শুরু হয়। এর দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাইওয়ানকেও। শুরুর দিকে তাইওয়ানে মুদ্রাস্ফীতি ছিল এক বড় সমস্যা। ১৯৭৩ সালে দিকে মুদ্রাস্ফীতি আরও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালে যেখানে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ছিল ৩ শতাংশ, সেখানে ১৯৭৩ সালে মুদ্রাস্ফীতি গিয়ে দাঁড়ায় ৮ শতাংশে। ১৯৭৪ সালে মুদ্রাস্ফীতি একপর্যায়ে ৪৭.৫০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। তাইওয়ান সরকার এই সমস্যা সমাধানের দ্রুত বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এসব পদক্ষেপের কারণে ১৯৭৫ সালেই মুদ্রাস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে চলে আসে। তাইওয়ানের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল বৈদেশিক বাণিজ্য। মুদ্রাস্ফীতির জন্য এই খাতটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৪ সালের তুলনায় ১৯৭৫ সালে রপ্তানি প্রায় ছয় শতাংশ কমে যায়।
যেকোনো প্রযুক্তিপণ্য নির্মাণ করতে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা আইসি চিপ অপরিহার্য উপাদান। ১৯৭৪ সালে তাইওয়ানের জাতীয় তিয়াও চুং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই ইলেক্ট্রনিক্স রিসার্চ এন্ড সার্ভিসেস অর্গানাইজেশন বা ইআরএসও প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমেরিকাতে তাইওয়ানের যেসব বিজ্ঞানী সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে কাজ করছিলেন, তাদেরকে এখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তাইওয়ানে তখন আমেরিকাভিত্তিক কোম্পানি আরসিএ কর্পোরেশন ‘কমপ্লিমেন্টারি মেটাল অক্সাইড সেমিকন্ডাক্টর’ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আইসি চিপ তৈরি করত। পরবর্তীতে তাইওয়ান সরকারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইআরএসও আমেরিকাভিত্তিক সেই কোম্পানির প্রযুক্তি নিজেদের কাছে নিয়ে আসে। তবে এর পেছনে আমেরিকাভিত্তিক সেই কোম্পানির অবদান ছিল বেশি। ১৯৭৬ সালের দিকে এই কোম্পানি ইলেক্ট্রনিক্স রিসার্চ এন্ড সার্ভিসেস অর্গানাইজেশনের বিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
১৯৮০ সালের দিকে তাইওয়ান সরকারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইলেক্ট্রনিক্স রিসার্চ এন্ড সার্ভিসেস অর্গানাইজেশন প্রথমবারের মতো ‘ইউনাইটেড মাইক্রোইলেকট্রনিক্স কোম্পানি’ নামে নিজেদের আইসি চিপ নির্মাণের কোম্পানি তৈরি করে। এতে বেসরকারিভাবে বিনিয়োগ করা হয় ৬০ শতাংশ, অপরদিকে তাইওয়ান সরকার বিনিয়োগ করে ৪০ শতাংশ। তাইওয়ানে আইসি চিপ শিল্পের উত্থানের পেছনে এই কোম্পানির অবদান সবচেয়ে বেশি। পরবর্তীতে এই কোম্পানি থেকে সাহায্য নেয়ার মাধ্যমে বেশ কিছু ডিজাইন হাউজ গড়ে ওঠে। ডিজাইন হাউজগুলোর মূল কাজ হচ্ছে মূলত আইসি চিপের ডিজাইন ও মানোন্নয়ন ঘটানো, সেই সাথে বিভিন্ন ডিজাইনের আইসি চিপের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান খুঁজে বের করা। তাইওয়ানের প্রথম আইসি চিপনির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিনটেক, যেটি ইলেকট্রনিক্স রিসার্চ এন্ড সার্ভিসেস অর্গানাইজেশনের একজন সাবেক প্রকৌশলী ও তার সহকর্মীদের হাত ধরে গড়ে ওঠে।
তবে তাইওয়ানে আইসি চিপ নির্মাণশিল্পে স্থানীয় বিনিয়োগকারীর অভাব দেখা যাচ্ছিল। তাইওয়ানে আইসি চিপ নির্মাণশিল্পে কাজ করার মতো অসংখ্য প্রকৌশলী পাওয়া যাচ্ছিল, যারা ইলেক্ট্রনিক্স রিসার্চ এন্ড সার্ভিসেস অর্গানাইজেশন কিংবা ইউনাইটেড মাইক্রোইলেকট্রনিক্স কোম্পানির দ্বারা প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। তাদের কাজে লাগিয়ে বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকই মুনাফা অর্জন করে নিচ্ছিল। ইউনাইটেড মাইক্রোইলেকট্রনিক্স কোম্পানি ছিল তাইওয়ানের একমাত্র আইসি চিপ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, কিন্তু তারা ডিজাইন হাউজগুলোকে সহায়তা দিতে খুব বেশি উৎসাহী ছিল না। এই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য তাইওয়ান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করে। এরপর দেশটির সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণশিল্পকে আর কখনও পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রাথমিকভাবে তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশন স্থানীয় ডিজাইন হাউজ ও বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির জন্য আইসি চিপ তৈরি করেই প্রচুর মুনাফা লাভ করে।
১৯৯০ সালের পর থেকেই পৃথিবীব্যপী ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের চাহিদা বেড়ে যেতে শুরু করে। তাইওয়ানের প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এই সুযোগে বিশ্ববাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে নেয়। জাপানি কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি তারাও ভাল মানের পণ্য সরবরাহ করায় তাদের পণ্যে চাহিদা দিন দিন বাড়তেই থাকে। প্রথমে তাইওয়ানের অল্প কিছু কোম্পানি যাত্রা শুরু করলেও ক্রমেই অন্যান্য কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে আসুস (Asus), এইসার (Acer) এর মতো অনেকগুলো তাইওয়ানভিত্তিক কোম্পানি পৃথিবীতে দোর্দণ্ড প্রতাপে ব্যবসা করে যাচ্ছে। তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণশিল্প এখনও আগের মতোই জমজমাট।
এই শতকে অর্থাৎ ২০০০ সালের পর থেকে অন্যান্য এশিয়ান টাইগারের তুলনায় তাইওয়ানের উন্নতি কিছুটা ধীরগতিতে হয়েছে বলেই প্রতীয়মান। তারপরও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি অনুন্নত দেশ থেকে তাইওয়ান যেভাবে বিশ্বঅর্থনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সঠিক পরিকল্পনা ও নিজ দেশের জনগণকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য না থাকার পরও যে অর্থনৈতিকভাবে সফল হওয়া যায়– সেটা তাইওয়ানই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। দেশটির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সময়ের পরিবর্তনে যে নতুন পরিকল্পনা হাতে নিতে হয় সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করেছিলেন খুব ভালোভাবে। তাইওয়ানের দীর্ঘ পথচলায় অনেকবারই প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে। প্রতিবার তাদের নীতিনির্ধারকেরা দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এভাবেই দেশটি পৃথিবীর অনেক দেশেরই রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।