১৮৯৫ সালে চলচ্চিত্র ইতিহাসের পথচলা শুরু হয় লুমিয়ার ব্রাদার্সের হাত ধরে। তাদের নির্মিত ৫০ সেকেন্ডের প্রথম ছবি ওয়ার্কার্স লিভিং দ্য লুমিয়্যার ফ্যাক্টরি ছিল নির্বাক ও সাদা-কালো। অতঃপর সময়ের সাথে প্রযুক্তির উত্কর্ষে সাদা-কালো থেকে রঙিন সিনেমার যাত্রা শুরু হয়, এবং কালক্রমে দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হতে থাকে রঙিন সিনেমা। ফলে মানুষ ভুলতে শুরু করে সেলুলয়েডের সাদা-কালো ফ্রেমকে। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কালার ফিল্মের এই সময়ে এসেও টাইম ট্রাভেলে চড়ে কেউ কেউ সিনেমা বানিয়েছেন ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ফিল্ম। যেগুলো কালার ফিল্মের সাথে পাল্লা দিয়ে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে সমানভাবে। রঙিন যুগের এমনই কিছু ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট চলচ্চিত্রের গল্প নিয়ে এ আয়োজন।
র্যাগিং বুল (১৯৮০, যুক্তরাষ্ট্র)
হলিউডের নিরীক্ষাধর্মী নির্মাতা মার্টিন স্করসিসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে র্যাগিং বুল। এর প্লট এক খিটখিটে প্রকৃতির বক্সার জেক লামত্তার জীবনী নিয়ে, যাতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন কিংবদন্তী অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো। মূলত চল্লিশের দশকের সময়কে বাস্তবিক ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপনের জন্য বেছে নেওয়া হয় ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ফর্মকে। তাছাড়াও র্যাগিং বুল-এর সমসাময়িক বক্সিং নিয়ে নির্মিত অন্য সব মুভি ছিল রঙিন। স্করসিস এক্ষেত্রে দর্শকদের অভ্যস্ততা কাটিয়ে ভিন্নতা উপহার দিতে সাদা-কালো করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
ম্যানহাটন (১৯৭৯, যুক্তরাষ্ট্র)
ম্যানহাটন ১৯৭৯ সালে উডি এলেন নির্মিত রোমান্টিক কমেডি ফিল্ম। এটি পরিচালকের পূর্ববর্তী এনি হল ও ইনটেরিয়র্স চলচ্চিত্রদ্বয়ের বিশেষ সমন্বিত রুপ। এলেন তার বাল্যকালে দেখা ম্যানহাটন শহরকে যেভাবে অবলোকন করেছে, তার স্মৃতিকে সে সবসময় সেভাবে বিস্তৃত ও সাদা-কালো ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। মূলত সেই ভাবনা মাথায় নিয়ে ওয়াইডস্ক্রিনে সাদা-কালোতে চিত্রধারণ করা হয়। ছবিতে ৪২ বছরের এক রম্য লেখককে ১৭ বছরের কিশোরীর সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে দেখা গেলেও আসলে সে তার ঘনিষ্ট এক বন্ধুর কর্ত্রীর প্রেমে পড়ে। অস্কার মনোনয়নপ্রাপ্ত ম্যানহাটন মুক্তির পর পরই বক্স অফিসে হিট হয়। যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস ছবিটিকে বিশেষ সম্মাননা জানাতে তাদের ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রিতে সংগ্রহে রাখে।
দ্য আর্টিস্ট (২০১১, ফ্রান্স)
অস্কারে ১০ নমিনেশন ও ৫টি পদক, কান, গোল্ডেন গ্লোব, সিজারসহ ফ্রান্সের সবচেয়ে বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত আলোচিত সাদা-কালো চলচ্চিত্র দ্য আর্টিস্ট। সম্পূর্ণ সাদা-কালো এবং নির্বাক এই ছবিটির পরিচালক মাইকেল হাজানাভিসিয়াস। ১৯২৭-৩২ সালের হলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে নির্বাক থেকে সবাক সিনেমা নির্মাণের যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন, তারই প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে এ সিনেমা। নির্বাক যুগের বয়স্ক অভিনেতার সাথে সবাক ছবির উঠতি অভিনেত্রীর সাক্ষাৎ এবং সময়ের সাথে পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের যে বাস্তবতা তার নানা দার্শনিক দ্বন্দ্বের শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ ফরাসি ফিল্ম দ্য আর্টিস্ট। ৮৪তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, পরিচালক, অভিনেতা (জ্যাঁ দুর্জাদিন), কস্টিউম ডিজাইন এবং অরিজিনাল স্কোর (মিউজিক কম্পোজিশন) এই পাঁচটি বিভাগে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে দ্য আর্টিস্ট।
শিন্ডলার’স লিস্ট (১৯৯৩, যুক্তরাষ্ট্র)
স্টিভেন স্পিলবার্গের মাস্টারপিস হিসেবে গণ্য করা হয় শিন্ডলার’স লিস্ট’কে। থমাস কেনেলির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাস শিন্ডলার’স আর্ক অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল সাদা-কালো এ চলচ্চিত্র। ছবিটির মূল কাহিনী জার্মান ব্যবসায়ী অস্কার শিন্ডলারকে নিয়ে, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১,১০০ ইহুদীর প্রাণ বাঁচান। তবে পরিকল্পনার শুরুতে নির্মাতা সাদা-কালোয় একটি কালোত্তীর্ণ ডকুমেন্টারি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে মত পরিবর্তন করা হয়। এজন্য ছবিতে ডকুমেন্টারি ধারার জার্মান এক্সপ্রেশনিজম এবং ইতালিয়ান নিউরিয়ালিজমের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। শিন্ডলার’স লিস্ট শ্রেষ্ঠ ছবি ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ সর্বমোট সাতটি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কার জিতে নেয়। এছাড়াও ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, নিউ ইয়র্ক ফিল্ম ক্রিটিক, প্রযোজক গিল্ডস, লস অ্যাঞ্জেলস ফিল্ম ক্রিটিকস এবং ডালাস ফিল্ম ক্রিটিকস থেকেও শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার অর্জন করে সাদা-কালো সিনেমাটি।
প্যারাডাইস (২০১৬, রাশিয়া)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ান, জার্মান এবং ফরাসি এই তিনটি ভাষায় নির্মিত সাদা-কালো চলচ্চিত্র প্যারাডাইস। গল্প বলার ধরন ও আঙ্গিক বিবেচনায় ছবিটির নিজস্বতা রয়েছে। গেস্টাপো এবং নাৎসি বাহিনীর অমানবিক নৃশংসতা এবং বন্দিশিবিরের কয়েদিদের সাথে ঘটে যাওয়া নানারূপ পাশবিকতা এ সিনেমার প্রতিপাদ্য, যা প্রকাশ পেয়েছে তিনজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতা বর্ণনার মাধ্যমে। এদের একজন ওলগা, যিনি জাতিতে রাশিয়ার একজন অভিজাত প্রবাসী এবং ‘French Resistance’ এর সদস্য। বাকিদের মধ্যে আছেন ফরাসি পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন অফিসার জুল। আর জার্মান আর্মির উচ্চপদস্থ SS র্যাঙ্কের অফিসার হেলমুট। রাশিয়ান এই ফিল্মের সমগ্র শুটিং হয়েছে জার্মানিতে।
চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রত্রয় ক্যামেরার দিকে সোজাদৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতার আদ্যোপান্ত তুলে ধরে। শৈল্পিক বিচারে যা অবশ্যই অভিনব। এবং প্রত্যেকের বিবরণীও অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী। তাদের ভাষাবৈচিত্র্য যুদ্ধের বৈশ্বিকতা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। তথাপি, সাক্ষাৎকারের দৃশ্য কাহিনীর গতিকে কিছুটা হ্রাস করে অনেকটা একঘেয়েমি তৈরি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বন্দীশিবিরের বীভৎসতার চিত্রায়ণ ঘটেছে দৃশ্যায়নের ভাঁজে ভাঁজে। প্রথমদিকে ওলগাকে দোষী সাব্যস্ত করার হেতু হিসেবে দেখতে পাই দুজন ইহুদী বালককে লুকাতে সাহায্য করার অভিযোগে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না, তাদের ঠিকই যেতে হয় নিষ্ঠুর বন্দিশিবিরে। প্যারাডাইস ৮৯ তম অস্কারে বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে শীর্ষ ৯টি শর্টলিস্টেড ফিল্মে জায়গা করে নিয়েছিল। তাছাড়া, ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ফিল্মটি অর্জন করেছিল সেরা নির্মাতার পুরস্কার, যা ‘সিলভার লায়ন’ বলে সমাদৃত।
দ্য লাস্ট পিকচার শো (১৯৭১, যুক্তরাষ্ট্র)
পিটার বোগদানোভিচ নির্মিত সাদা-কালো চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট পিকচার শো। ছবির গল্পে ১৯৫১ সালে একদল গবেষক ধীরে ধীরে বর্ণহীন, বিচ্ছিন্ন এবং জনশূন্য হয়ে যাওয়া পশ্চিম টেক্সাসের এক শহরে আসে, যা ততদিনে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উভয় দিক থেকেই বিলুপ্তপ্রায়। পরিচালক শৈল্পিক মান অক্ষুন্ন রাখতে একসময়ের ব্যস্ত শহরের গ্ল্যামার হারিয়ে যাওয়া কাহিনি বর্ণনায় তাই সাদা-কালোতে চিত্রায়নের সিদ্ধান্ত নেন। এটি মুক্তির পর বিশ্বব্যাপী রেকর্ডসংখ্যক সাড়া পড়ে। সেসময়ের রঙিন চলচ্চিত্রে অভ্যস্ত দর্শকরাও দ্য লাস্ট পিকচার শো‘কে গ্রহণ করে নেয় সানন্দে। এমনকি, চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ আসর অস্কারে ৮টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়নও পেয়ে যায় এটি। এর চেয়েও বড় খবর- ১৯৯৮ সালে সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং শিল্পমূল্য বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস চলচ্চিত্রটি তাদের ন্যাশনাল ফিল্ম রেজিস্ট্রিতে সংরক্ষণের ঘোষণা দেয়।
দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান (১৯৮০, যুক্তরাষ্ট্র)
নির্মাতা ডেভিড লিঞ্চের হিস্ট্রিকাল ড্রামা ফিল্ম দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান অস্বাভাবিক এবং ভয়ানক শারীরিক গঠনের ‘জোসেফ মেরিক’ নামে এক ব্যাক্তির বায়োপিক। এলিফ্যান্টিয়াসিসে (প্রোটিয়াস সিনড্রোম) আক্রান্ত মেরিকের অস্বাভাবিকতাকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর মানুষ ব্যবসায় নামে, নিজেদের আঁখের গোছায়। পক্ষান্তরে, আরেকটি দল মেরিককে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা এবং মারধর করে। আবার, সমাজের আরেক শ্রেণীর মানুষ তাদের নিঃস্বার্থ ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় মেরিকের প্রতি। মনের গহীনে জোরালো করে তোলে তার আসল পরিচয়- সে ‘মানুষ’। অস্কারে ৮টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায় ছবিটি। সাদা-কালো হওয়া সত্ত্বেও দ্য এলিফ্যান্ট ম্যান-এর মেকআপ বিশ্বব্যাপী বহুল প্রশংসিত হওয়ায় অস্কার প্রদান কমিটি (একাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্ট এন্ড সায়েন্সেস) মুভিটির সম্মানার্থে তার পরবর্তী বছর থেকে শ্রেষ্ঠ রুপসজ্জা (বেস্ট মেকআপ এন্ড হেয়ারস্টাইল) ক্যাটাগরি অন্তর্ভুক্ত করে।
লেখার শেষটা হোক সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাদেশী একটি সাদাকালো চলচ্চিত্র দিয়ে।
অনিল বাগচির একদিন (২০১৫, বাংলাদেশ)
জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অনিল বাগচির একদিন অবলম্বনে দেশবরেণ্য চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন সাদামাটা অথচ শ্বাসরুদ্ধকর এক সিনেমা। চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধকালীন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রাণ হারাবার যে আতংক, তারই প্রতিচ্ছবি কেন্দ্রীয় চরিত্র অনিল বাগচির যাপিত জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাবার মৃত্যুসংবাদ শুনে অনিলের শহর ছেড়ে সামরিক বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তার গন্তব্যপথে যে যাত্রাপ্রচেষ্টা- সেটিই এর বিষয়বস্তু। ছবিতে অনিলের ফ্ল্যাশব্যাকের (সামান্য কিছু দৃশ্যে) তার অতীতকে চিত্রায়িত করা হয়েছে জীবনের রঙিন অধ্যায় হিসেবে, এবং যুদ্ধকালীন শংকিত অনিলের অতিবাহিত বর্তমান রূপে উপস্থাপিত হয়েছে সাদা-কালোতে। রঙের এই বিভাজন অত্যন্ত সরল, সাবলীল এবং ধারাবাহিক। সেট, শিল্পনির্দেশনা, চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা, তথা সর্বোপরি নির্মাণকৌশলের কারণে এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ একটি চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচ্য।