“পৃথিবীতে যা কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে সত্য।”- আল কিন্দি
যদি প্রশ্ন করা হয়, কী সেই অন্তর্নিহিত সত্য? আল কিন্দি উত্তর দেবেন, ‘সৃষ্টিকর্তা’। দর্শন মানেই হচ্ছে সত্যের সন্ধান। আর আল কিন্দির নিকট এই সত্যের মূলে হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা। তার শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কাজ ‘অন ফার্স্ট ফিলসফি’র অপর নাম অনেকে তাই বলে থাকেন ‘স্টাডি অব গড’। সৃষ্টিকর্তার অধ্যয়ন? হ্যাঁ, আল কিন্দি সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কেই অধ্যয়ন করবার চেষ্টা করেছেন। যেখানে অ্যারিস্টটলের দর্শন ছিল অস্তিত্ববান সকল সত্য নিয়ে কাজ করা, সেখানে কিন্দির দর্শন সৃষ্টিকর্তার খোঁজ করা। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তাই সকল পার্থিব অস্তিত্বের কারণ। আর তাই সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে ভাবনার মধ্যেই পার্থিব সকল দর্শন নিহিত। তাহলে কী দাঁড়ালো? অ্যারিস্টটলের দর্শন আর কিন্দির দর্শন এক সুতোয় গাঁথা।
আল কান্দির দর্শন আলোচনা করতে গেলে অনেকেই তাকে ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত মনে করেন। কিন্তু আল কিন্দি সর্বদা ধর্ম আর দর্শনের মাঝে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। মেটাফিজিক্স বা আধ্যাত্মবাদ নিয়ে তার সমৃদ্ধ দর্শনকে ধর্মতত্ত্বের সাথে মেলানোটা বোকামি। তিনি সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এবং এর পক্ষে প্রমাণ স্থাপন করেছেন। তিনি পুরো পৃথিবীজুড়ে পরিবেশ প্রকৃতির প্রতিটি অংশে খুঁজে পেয়েছেন অসংখ্য ঐক্যের উদাহরণ, যারা প্রত্যেকেই একাধিকের সমন্বয়ে গঠিত। উদাহরণস্বরূপ, লাখো প্রজাতির সংখ্যাধিক্যের ঐক্যে গঠিত এক প্রাণিজগৎ। আবার এতো প্রজাতির মাঝে মানবজাতি একটি বিশেষ প্রজাতি হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য। তবে সকল স্বাতন্ত্র্যের ঐক্যেই গঠিত হয়েছে মানবজাতি। আর এসবই রূপকার্থে এক ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথিবীর সকল ভিন্নতাই শেষতক একসূত্রে গাঁথা। সেই ঐক্যর মাঝেই রয়েছেন ঈশ্বর।
“আর এভাবেই আমরা খুঁজে পাই অনুপম সেই একজনকে, যার কোনো আকার নেই, ওজন নেই, মাত্রা নেই, নেই কোনো গোত্র, বর্ণ, প্রজাতি কিংবা স্বাতন্ন্ত্র্য। পার্থিব কোনোকিছুর সাথে তিনি অতুলনীয়, তথাপি সবকিছুর মধ্যে তিনি বিদ্যমান। সকল ঐক্যের মাঝে তিনি উপস্থিত। তিনি ধ্রুব সত্য।”- অন ফার্স্ট ফিলসফি, ৪র্থ অধ্যায়।
আল কিন্দি আরবের কিন্দা গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। এই গোত্রটি ছিল তৎকালীন আরবের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোত্র, যাদের ইসলামের স্বর্ণযুগের প্রাথমিক পথপ্রদর্শক মনে করা হয়। আল কিন্দির দর্শন বেশ শক্তিশালী হলেও সমসাময়িক আরো অনেকেই তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আরবরা আল কিন্দিকে ‘ফিলসফার অব আরব’ খেতাব দেয়। ইতিহাসবিদরা মনে করেন তার বংশগত প্রভাবের কারণেই তিনি সমসাময়িকদের তুলনায় অধিক খ্যাতি পেয়েছিলেন। তার দর্শন ও বিজ্ঞানচর্চা ছিল প্রবলভাবে গ্রীক অনুবাদ দ্বারা প্রভাবিত। ব্যক্তির ক্ষেত্রে আল কিন্দির সবচেয়ে বড় প্রভাবক তথা আদর্শ ছিলেন অ্যারিস্টটল। দর্শনকে কিছুটা আধ্যাত্মবাদ এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করাই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তাছাড়া তার দর্শনে অ্যারিস্টটলীয় এবং নিওপ্লেটোনিক চিন্তার সংমিশ্রণও দেখা যায়। সবমিলিয়ে আল কিন্দির দর্শন ও চিন্তার প্রভাবের উৎস খুঁজতে গেলে বারবার প্রাচীন গ্রীক দর্শনেই ফিরে যেতে হবে। এক্ষেত্রে তার পরিবার এবং জন্মকাল যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল।
আল কিন্দির জন্মের সঠিক তারিখ জানা যায় না। তবে তিনি যেহেতু খলিফা মামুন এবং মুতাসিম এর দরবারে কাজ করেছিলেন, সেহেতু ধারণা করা হয় যে তার জন্ম ৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। এ সময়ে আরবের মুসলিমদের মাঝে গ্রীক ও রোমান ক্লাসিক্যাল দর্শন পাঠের বৈপ্লবিক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। প্রচুর পরিমাণে গ্রীক দর্শন অনুদিত হতে থাকে। ফলে এই সময়কালে জন্ম নেয়া মনিষীগণ স্বাভাবিকভাবেই গ্রীক দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। অন্যদিকে বসরায় জন্মগ্রহণ করা আল কিন্দি ইরাকের বাগদাদে পড়ালেখা করেন। বাগদাদে তখন অনুবাদের যে ধারা শুরু হয়েছিল, তাকে বলা হতো ‘অনুবাদ বিপ্লব’। সম্ভবত কৈশোর পার করেই তিনি অনুবাদের কাজে লেগেছিলেন। সরাসরি অনুবাদ করতেন না তিনি। তবে অনুবাদকদের অন্যান্য কাজে সহায়তা করতে গিয়ে শিখেছিলেন অনেককিছু। এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদগণের মাঝে বিতর্ক রয়েছে যে তিনি আমৃত্যু অনুবাদের সাথে জড়িত ছিলেন কিনা। অন্যদিকে ৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে আমরা জানলেও এ ব্যাপারেও ইতিহাসবিদগণ নিশ্চিত নন।
দশম শতকের শ্রেষ্ঠ বই বিক্রেতা এবং প্রকাশক ইবনে আল নাদিম অসংখ্য মুসলিম বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকের বইয়ের তালিকা বা ‘ফিরিস্ত’ তৈরি করেছিলেন, যার কারণে আমরা আজ ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া অনেক বইয়ের কথাও জানতে পারছি। আল কিন্দির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। তার খুব কম বই আধুনিক যুগ পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছে। কিন্তু ইবনে আল নাদিমের ফিরিস্ত থেকে আমরা জানতে পারি, বিজ্ঞান এবং দর্শনের উপর শতাধিক বই লিখেছিলেন আল কিন্দি। তার কাজগুলো তাকে দার্শনিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও তার দর্শন সংক্রান্ত বইয়ের চেয়ে বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ের সংখ্যাই বেশি! বলা বাহুল্য, আল কিন্দির কাজের উপর ভিত্তি করে তার পরিচয় বিজ্ঞানী হতেই পারতো। কিন্তু সেগুলো হারিয়ে যাওয়ায় তাকে দার্শনিক হিসেবে পরিচিত করেছে তার একমাত্র গ্রন্থ হিসেবে সম্পূর্ণরূপে টিকে থাকা ‘অন ফার্স্ট ফিলসফি’। এই বইয়ের মূল কপি, কিন্দির নিজ হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি সংরক্ষিত আছে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে।
মনস্তত্ত্ব নিয়ে কিন্দির বিখ্যাত কাজগুলো হচ্ছে ‘অন স্লিপ অ্যান্ড ড্রিম’, ‘ডিসকোর্সেস অন সোল’, ‘দ্যাট দেয়ার আর ইনকরপোরিয়াল সাবস্ট্যান্স’, ‘অন ডিসপেলিং সরোস’ ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে কেবল শেষোক্তটিই টিকে আছে আজ অবধি। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়েও কাজ করেছেন এই গুণী পণ্ডিত। ‘অন দ্য এজেন্ট কজ অব জেনারেশন অ্যান্ড করাপশন’ এবং ‘ অন দ্য প্রোস্ট্রেশন অব দ্য আউটারমোস্ট স্ফিয়ার’ নামে সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন আল কিন্দি। আবহাওয়াবিদ্যা এবং পূর্বাভাস নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এই বইগুলোতে। অন্যদিকে গণিতশাস্ত্রেও যে তার দক্ষতা রয়েছে তার প্রমাণ হচ্ছে ‘অন পারস্পেক্টিভ’।
আল কিন্দির মনোবিজ্ঞান বিষয়ক চিন্তাভাবনা ছিল তৎকালীন সময়ের তুলনায় যথেষ্টই উন্নত। ‘দ্যাট দেয়ার আর ইনকরপোরিয়াল সাবস্ট্যান্স’ বইটির মূল আলোচনাই আত্মাকে ঘিরে। নানান যুক্তিতর্কের মাধ্যমে আল কিন্দি এ কথাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন বা করেছেন যে প্রতিটি প্রাণীর মধ্যেই একটি অশরীরী, অপার্থিব, নিরাবয়ব কিছু একটা রয়েছে, যা এর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে। এটি আত্মা। আত্মার ভিন্নতাই মানুষের চিন্তা-চেতনা, মননে আর ব্যক্তিত্বে ভিন্নতা আনে। আত্মা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার জ্যোতি। এই জ্যোতি মানুষকে আলোকিত করে। এখানে জ্যোতি দ্বারা আল কিন্দি একথাই বোঝাতে চেয়েছেন যে সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী মানবাত্মার মধ্যে মিশে আছে। তিনি এসব গুণের খোঁজ করার তাগিদ দিয়েছেন। অন্যদিকে ‘ডিসকোর্সেস অন সোলস’ বইটিতে আল কিন্দি মৌলিক ব্যাখ্যার চেয়ে বরং অ্যারিস্টটল আর প্লেটোর বিভিন্ন তত্ত্বের উদাহরণ টেনে ব্যাখ্যা করেছেন।
আল কিন্দির মতে, আমাদের আত্মার প্রকৃত রূপটি হচ্ছে বিচক্ষণ, যুক্তিসঙ্গত এবং নৈতিক। কিন্তু বাহ্যিক পৃথিবীর নানা চাকচিক্য একে কলুষিত করলে এর একটি বিকৃত রূপ সৃষ্টি হয়। দেহের মৃত্যুতে সেই বিকৃত আত্মার মৃত্যু হলেও বেঁচে থাকে শুদ্ধ আত্মা! বুঝতে পারছেন না? শুদ্ধ আত্মা মানেই তো ন্যায় নৈতিকতা আর বিচক্ষণতা, যা মৃত্যুর পরও পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে বেঁচে থাকে। ‘অন ডিসপেলিং স্যাডনেস’ বইটিতে আল কিন্দি মানবাত্মাকে জাগতিক দুঃখ দুর্দশা থেকে দর্শনের মাধ্যমে সান্ত্বনা খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, পৃথিবীতে যা কিছুর বাহ্যিক অস্তিত্ব রয়েছে, তারই অশুদ্ধ হবার সম্ভাবনা থাকে। কারণ এসব বাহ্যিক বস্তু (বাড়ি, জমিজমা, অলঙ্কার ও অন্যান্য বিলাস সামগ্রী ইত্যাদি) প্রজন্মের পর প্রজন্ম টিকে থাকবে এবং এদের দ্বারা বা এদের জন্য কত পাপ সংঘটিত হবে, তার কোনো হিসাব নেই। অথচ আত্মা পূতপবিত্র এবং অবিনশ্বর। তাই নশ্বর বস্তুজগতের মোহে অন্ধ না হয়ে আত্মার অনুসন্ধান করতে হবে। নিজের বসবাসের ঘরখানি জাঁকালোভাবে না সাজিয়ে আত্মাকে সজ্জিত করতে হবে জ্ঞান দিয়ে আর পুণ্য দিয়ে। এবং যে ব্যক্তি একবার বাহ্যিক চাকচিক্যের মোহ থেকে বেরিয়ে এসে স্ব-আত্মার সন্ধান করতে শুরু করে, তার জীবনে দুঃখের অস্তিত্ব থাকে না।
আল কিন্দির সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল এই যে, তিনি স্থানীয় মুসলিম দর্শনের সাথে পাশ্চাত্য এবং ক্লাসিক্যাল গ্রীক দর্শনের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। আধ্যাত্মিকতার সাথে তিনি আধুনিকতার সংমিশ্রণ করেছেন। আজ তার কথা খুব একটা স্মরণ করা না হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন দার্শনিক এবং জ্যোতির্বিদও। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, মধ্যযুগে পশ্চিমে জ্যোতিষশাস্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম নামটিই ছিল আল কিন্দি। কিন্তু তার জ্যোতিষশাস্ত্র বিষয়ক গবেষণার কোনো কিছুই যথার্থভাবে টিকে নেই, যা নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব। তথাপি নিজের প্রধান কাজগুলো হারিয়েও আল কিন্দি আজ আধ্যাত্মিক দার্শনিক হিসেবে ভাস্বর। তার পরবর্তীকালে আধ্যাত্মিকতার দার্শনিকগণ তার দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং এখনো সে ধারা অব্যাহত রয়েছে।
ফিচার ছবি- yenifelsefe.com