আধুনিকতার সাথে সাথে পৃথিবীর প্রাচীন বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক, ঐতিহাসিক নিদর্শন মানুষের সামনে তুলে ধরার অন্যতম মাধ্যম ‘জাদুঘর’। পূর্বপুরুষদের বীরত্বগাঁথা নিদর্শনের সামনে গেলে আজও মানুষের শরীরে কাঁটা দেয়। আমাদের ঐতিহ্য তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া, আজকের সমাজের সামনে সেটা স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের রেখে যাওয়া অংশবিশেষ। ১৯৭১ সাল আমাদের যেমন স্মরণ করিয়ে দেয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা, তেমনি বাঙ্গালীর বিজয়ে গর্বে ভরিয়ে দেয় বুক। তাই স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও বাঙালীর সেই সংগ্রামের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর‘। দীর্ঘ ৯ মাস সংগ্রামের ছবি, শহীদদের দেহাবশেষ, ব্যবহৃত সামগ্রী, অস্ত্রশস্ত্র, দলিলপত্রে সজ্জিত কক্ষে ঢুকলেই যুদ্ধের একটি আবহ তৈরি হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সচেতনার উদ্দেশ্যে আমাদের স্বাধীনতার ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রথম ব্যক্তিগতভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বর্বরতায় বাঙ্গালীর উপর যে অত্যাচার শুরু হয়েছিল, তা দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম শেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্ম দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র রক্ষায় এদেশের মানুষের নির্ভীক সশস্ত্র সংগ্রামের দৃষ্টান্ত চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’, যা ঢাকার সেগুনবাগিচায় একটি দোতলা ভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।
জাদুঘরের প্রতিটি কোনায় খুঁজে পাওয়া যায় বিদ্রোহ, বিজয়, সংগ্রাম, সাহসিকতা এবং লাখো মানুষের আত্মত্যাগের মর্মস্পর্শী না বলা কথা। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সাধারণ মানুষের সহায়তায় একটি ‘বোর্ড অফ ট্রাস্টি’ জাদুঘরটি পরিচালনা করে। বাংলাদেশের ইতিহাস সংরক্ষণে জাদুঘরটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে।
এই জাদুঘরে প্রায় ১৪,০০০ সংগ্রহ রয়েছে, যার ভিতর রয়েছে দুর্লভ ছবি, কাগজপত্র, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ, শহীদদের ব্যবহারকৃত সামগ্রী ও যুদ্ধাস্ত্র। জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় ১৯৯৯ সালে ঢাকার অদূরে মিরপুরে মুসলিম বাজার ও জল্লাদখানা নামক দুটি বধ্যভূমি খনন করে। সেখানে শহীদদের দেহাবশেষ এবং অস্ত্র সামগ্রী আবিষ্কৃত হয়, যা জনসাধারণের সম্মুখে মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত রূপ দান করে। তবে ভবনটিতে জায়গার স্বল্পতায় মাত্র ১,৩০০ সংগ্রহ প্রদর্শন সম্ভব হত। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা, প্রদর্শনী, তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করানো সহ বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে নিদর্শন সংগ্রহের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দীর্ঘ পরিসরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রয়োজনীয়তা থেকে প্রতিষ্ঠার ২১ বছর পর ২০১৭ সালে প্রথম তৈরি হয় জাদুঘরের নিজস্ব ভবন।
জাদুঘরের নতুন স্থায়ী ভবন ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত। ২০১১ সালের ৪ মে ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। জনসাধারণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সরকারের দেয়া তহবিলে গড়ে ওঠা ৯ তলা ভবনের এই জাদুঘরটির উদ্বোধন হয় ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল।
ব্যতিক্রমী স্থাপত্যশৈলীর এই জাদুঘর ভবনটি প্রায় দুই বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত। ভবনের ব্যবহারযোগ্য আয়তনের পরিমাণ ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গ ফুট। ছাদের উপর দেওয়ালের সামনে কামান ও বন্দুকের নলের মতো নানা মাপের কংক্রিটের নলের অংশ সামনে বের হয়ে এসেছে। এমনকি দেওয়ালের কাছে গেলে বিভিন্ন রকম ক্ষতচিহ্নের দেখা মিলবে। স্থাপত্যের এই ভিন্নরকম নিদর্শন সম্পর্কে স্থপতি তানজিম হাসান বলেন, ভবনটির কাছে গেলেই যাতে যুদ্ধের ক্ষতের একটি আবহ তৈরি হয় দর্শনার্থীর মনে; সেই উদ্দেশ্যে এই নির্মাণ কৌশল করা হয়েছে।
ভবনের প্রথমতলায় রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং চার নেতার ব্রোঞ্জের তৈরি ভাস্কর্য, মুক্তমঞ্চ, স্মারক বিক্রয়কেন্দ্র ও টিকিট কাউন্টার। সেখানেই যুদ্ধে ব্যবহৃত একটি বিমান ও হেলিকপ্টার রয়েছে ছাদ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায়। দ্বিতীয় তলা জুড়ে রয়েছে গবেষণাকেন্দ্র ও পাঠাগার। তৃতীয় ও চতুর্থ তলা জুড়ে রয়েছে চারটি গ্যালারি। এছাড়া পঞ্চম তলায় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত কক্ষটি এখনো নির্মাণাধীন রয়েছে।
এই গ্যালারিগুলোর নিদর্শন উপস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে জাদুঘর বিষয়ে অভিজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম গ্যালারিতে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রত্ননিদর্শন। কক্ষটির নাম ‘আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম‘। দ্বিতীয় প্রদর্শন কক্ষের নাম ‘আমাদের অধিকার আমাদের ত্যাগ’। এখানে রয়েছে ১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ঘটনা থেকে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় প্রবাসী সরকার গঠনপর্ব পর্যন্ত নিদর্শনাবলী। স্বাধীনতার দাবিতে রেসকোর্স ময়দানে অগণিত মানুষের বিশাল সমাবেশের চিত্রগ্রাহক শুক্কুর মিয়া যে ক্যামেরার সাহায্যে চিত্রটি ধারণ করেছিলেন, সেই ক্যামেরাটিও রাখা আছে ছবিটির নিচে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙালী মুক্তিবাহিনী যেসব রাইফেল ও বন্দুক নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল সেগুলো সহ রয়েছে মুক্তিবাহিনীর ব্যবহৃত বিভিন্ন পোশাক ও সামগ্রী। এই গ্যালারির সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো এখানকার শব্দ ও আলোকসজ্জা, যার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ২৫ মার্চের কালরাত্রির গণহত্যার ঘটনা। গ্যালারির এই অংশটি বেশ অন্ধকার। সেখানে আলোকসজ্জার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে সামরিক যানের আক্রমণ কিংবা মেঝেতে পড়ে থাকা মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের লাশ।
চতুর্থতলায় একটি কক্ষের নাম ‘আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র’, যেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালী শরণার্থীদের জীবনযাত্রা, বিভিন্ন বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, মুক্তিবাহিনীর গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ, রাজাকারদের কার্যক্রম ও মুক্তিবাহিনীর আশ্রয়স্থল। এছাড়া তুলে ধরা হয়েছে দেশে-বিদেশে যারা আমাদের সাহায্য করেছেন তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
সর্বশেষ কক্ষটিতে তুলে ধরা রয়েছে নৌ-যুদ্ধের নানা দিক, অসহায় নির্যাতিত বাঙালী, তাদের দগ্ধ বাড়িঘর এবং সবশেষে রয়েছে বিজয়োল্লাস। তাই এই কক্ষটির নাম রাখা হয়েছে ‘আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ’।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগরণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করেছে। ২০০৯ সালে সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধের কথ্য ইতিহাস সংরক্ষণে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই কর্মসূচিতে স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাদের অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা লিখিত আকারে সংগ্রহ করে জাদুঘরে পাঠায়। এই কর্মসূচিতে ৬৪ জেলার ১ লাখের বেশি শিক্ষার্থী ৪০ হাজারের মতো প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতা লিখে পাঠিয়েছে, যা ‘ছাত্রছাত্রীর সংগৃহীত মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য’ নামে বই আকারে ছয়টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ১৯৯৭ সাল থেকে ‘আউটরিচ‘ নামক কর্মসূচি শুরু হয়, যেখানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জাদুঘর ভ্রমণ করে। সেখানে তাদের মুক্তিযুদ্ধের ধারণা দেওয়া হয়। সেসব তথ্যের উপর কুইজ অনুষ্ঠিত হয়ে সেরাদের পুরস্কৃত করা হয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই কর্মসূচিতে ৭৮৯টি স্কুলের ১,৯২,৭৬১ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও সেসব শিক্ষার্থীদের নিয়ে আয়োজিত হয় মুক্তির উৎসব। সেখানে প্রতিবছর প্রায় ১৫,০০০ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র পরিসরে বাসের অভ্যন্তরে প্রদর্শনী সাজিয়ে শুরু করা হয় ভ্রাম্যমান জাদুঘর। ২০০১ সাল থেকে বাসটি বিভিন্ন জেলা-উপজেলা সহ প্রত্যন্ত এলাকাতেও প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। অন্যদিকে প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত বজলুর রহমান ফাউণ্ডেশনের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বজলুর রহমান স্মৃতিপদক প্রদান চালু করেছে ২০০৮ সাল থেকে। প্রতিবছর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত একজন সাংবাদিককে এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের একজনকে এই পুরষ্কার দেওয়া হয়, যার অর্থমূল্য ১ লক্ষ টাকা।
১০২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই জাদুঘর নতুন উদ্দ্যমে জনসাধারণের সাথে যোগসূত্র তৈরি করে চলেছে। সম্মুখের খোলা প্রাঙ্গণে তৈরি করা হয়েছে সাত বীরশ্রেষ্ঠর প্রতীকে প্রাচীন স্থাপত্যরীতির সাতটি স্তম্ভ, যা ইতিহাস-ঐতিহ্য আর গৌরবগাঁথার পরিচয় বহন করে, যাতে আগত দর্শনার্থীরা অনুধাবন করতে পারেন কতটা আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে এ দেশের গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অধিকার। এই জাদুঘর আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক স্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী সংগ্রামকে আগামী প্রজন্মের কাছে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, যার অবদান দেশের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিতে অপরিসীম।
ফিচার ইমেজ- merepix.com, newsbangladesh logo